অনন্তর সঙ্গে দেখা হলে আমি খুব আকুল-ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠেছিলাম, যেমন বলেছিলাম অবন্তিকাকেও, ‘আসিস না কেন? মাঝেমধ্যে দেখতে এলেও তো পারিস আমাদের! ওই পারে চলে গেছিস তো কী হয়েছে? দেখাসাক্ষাৎ তো হতেই পারে।’
উত্তরে অনন্ত ভীষণ হেসেছিল, যেমন খুব করে কেঁদেছিল অবন্তিকা। কেন যে একজন হেসেছিল আর কেঁদেছিল অন্যজনে, বলা মুশকিল। তবে হাসি থামিয়ে অনন্ত বলেছিল, ‘চল, নদীর ধার থেকে হেঁটে আসি একটু।’ আর হঠাৎ করেই, যেন-বা মাঝপথে, কান্নার জল মুছতে মুছতে অবন্তিকা বলেছিল, ‘একটু বসো না আবীর ভাই… এইখানে ঘাসের ওপর একটু বসো। চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকি আমরা।’
আমি অনন্তের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম নদীর দিকে। এই নদী, লোকে যাকে করতোয়া বলে, এখন বেশ শুকিয়ে গেছে। গ্রীষ্মকাল বলে নয়—বর্ষার সময়েও এখানে আর তেমন পানি আসে না। কোথায় যেন একটা বাঁধ দেওয়া হয়েছে, যার কথা ঠিক মনে থাকে না আমার, সেই বাঁধটার কারণে আরকি। কিন্তু অবন্তিকার সঙ্গে আমার আর সেদিন বসা হয়নি ঘাসের ওপর। আর তারপর বহুদিন কেটে গেছে, অনন্ত ও অবন্তিকার দেখা আর পাচ্ছি না আমি, কথাও হচ্ছে না। দেখা হলেও ওইভাবে ওর কথামতো মাঠের ধারে কিংবা মধ্যিখানে গিয়ে বসা হতো কি না, সেটাও তো বলা মুশকিল। এইখানে, আমাদের এই মফস্সল শহরে কোনো মাঠে গিয়ে ছেলে আর মেয়েদের একসঙ্গে বসে থাকার চল-টল নেই। তাছাড়া আমি তো আর হিন্দু নই, আমার সঙ্গে অবন্তিকা ওইভাবে বসলে সারা শহরে নিশ্চয়ই ঢ্যাঁড়া পড়ে যেত; প্রেম-টেমের কথা আর কতক্ষণ চলত, কিছু লোক কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে সাবাসি দিতে শুরু করত, একটা হিন্দু মেয়েকে হাতড়ে-পাতড়ে নিজের ধর্মে নিয়ে আসার সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে। আবার কিছু লোকজন স্বধর্মের একজনকে হারানোর ভয়ে ভারি উদ্বিগ্ন হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করত। এইসব অবন্তিকা তো নিজেও বোঝে। বোঝে এই বসাবসির আহ্বান নেহাতই কথার কথা; যেমন, অনন্তর সঙ্গে যে করতোয়ার দিকে হেঁটে হেঁটে গেলাম, সেটাও নিতান্তই যাওয়ার যাওয়া।
অনন্ত আর অবন্তিকার সঙ্গে একটু-আধটু যে দেখা হয়ে যায় আর দু-চারটে কথাবার্তাও হয়, এই তো অনেক! যদিও আমি ঠিক জানি না, এখনো আমাদের কথাবার্তা বলা উচিত কি না। আমি তো আর ওদের মতো লেখাপড়া করতে পারলাম না। ক্লাস নাইনে ওঠার পর ওইসব বাদ দিয়ে দিতে হলো।
এটা ঠিক, অনেকদিনই হয়ে গেল, আমাদের আর দেখাসাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু এমন তো নয় যে, ভবিষ্যতেও আর হবে না। হতে পারে, কালকেও আমাদের দেখা হতে পারে। এইভাবে বলা নেই, কওয়া নেই, অনন্ত আর অবন্তিকার সঙ্গে একটু-আধটু যে দেখা হয়ে যায় আর দু-চারটে কথাবার্তাও হয়, এই তো অনেক! যদিও আমি ঠিক জানি না, এখনো আমাদের কথাবার্তা বলা উচিত কি না। আমি তো আর ওদের মতো লেখাপড়া করতে পারলাম না। ক্লাস নাইনে ওঠার পর ওইসব বাদ দিয়ে দিতে হলো। অবশ্য ছাত্র আমি ভালোই ছিলাম। এতই ভালো যে, পরীক্ষায় প্রতিবারই আমার আর অনন্তর মধ্যে রশি টানাটানি হতো। আমি হয়তো ইংরেজিতে ৯৩ পেয়েছি, কিন্তু অনন্ত পেয়েছে ৯২; আবার অনন্ত হয়তো অঙ্কে ৯৯ পেয়েছে, কিন্তু আমি পেয়েছি ৯৮। এইভাবে টানাহেঁচড়া চললেও একটা সাবজেক্টে গিয়ে আমার প্রথম হওয়াটা নিশ্চিত হয়ে যেত। ধর্মশিক্ষা, ধর্মশিক্ষার পরীক্ষা সব কিছু ওলটপালট করে দিত। আমাদের স্কুলে কোনো হিন্দু শিক্ষক ছিল না, সনাতন ধর্মের কোনো ক্লাসও হতো না, তবে পরীক্ষা হতো, পরীক্ষার খাতাও নাকি দেখা-টেখা হতো; যদিও সেই পরীক্ষায় কেন যেন কেউই ৬০-এর বেশি নম্বর পেত না। সনাতন ধর্ম পরীক্ষায় এমন নাম্বার পাওয়ায় প্রতিবারই অনন্তের রোল নাম্বার ধাঁ করে ১০-১১ হয়ে যেত। সবাই, আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারতাম, ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক না; কিন্তু ওই আন্দাজ করা পর্যন্তই। কার এত দায় পড়েছে যে, পাঁচ-সাতজন হিন্দু ছাত্র ধর্ম পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছে আর কেইবা খাতা দেখেছে, তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে? এমনকি অনন্তও কেমন যেন বোকার মতো হাসতে হাসতে বলত, ‘নাহ্, এত পড়ি! তাও এই ধর্মশিক্ষাকে কিছুতেই কব্জা করতে পারি না। এত কঠিন!’
কঠিন, নাকি সহজ, তা বলা একটু কঠিনই অবশ্য—তবে এতে কোনো সন্দেহ নাই, ধর্মশিক্ষাটাকে অনন্ত, অবন্তিকা কেউই ঠিকমতো কব্জা করতে পারে নাই। আমারও কব্জায় আসে নাই। অথচ না এসেও ধর্মশিক্ষা পরীক্ষার ফল কেন যেন আমার কব্জার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। তবে স্কুলের পরীক্ষায় তা আমার কব্জার মধ্যে থাকলে কী হবে, ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল। অনন্ত বৃত্তি পেল, আমিও পেলাম, কিন্তু অনন্ত ধর্ম শিক্ষা পরীক্ষায় আমার চেয়ে বেশি নম্বর পেল। তো ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না! অনন্তর সঙ্গে আমি যে চোখে চোখ রেখে কথা বলব, সেটার আর উপায় থাকল না। যদিও দোষটা আমার না, আর মনে হয় মওলানা স্যারেরও না। আসলে দোষটা যে আসলে কার, সেটা বলাও বেশ মুশকিল। সনাতন ধর্ম শিক্ষা পরীক্ষার খাতা দেখতেন আলী কদম স্যার—কেবল লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছেন। কিন্তু তাকেই বা সন্দেহ করি কী করে। স্যার লেখাপড়া করেছেন ভার্সিটিতে, জুমাবার ছাড়া পাঞ্জাবি পরতেন না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেমন পড়তেন, তেমনই জিন্সের প্যান্টও পরতেন, অবশ্য পায়ের গিঁটটার ওপরে। কে জানে, হয়তো এখনো পরেন; কয়েকবছর হলো স্যারকে এই শহরেই দেখি না। জানি না স্যার এখন কোথায় আছেন, কিইবা করেন। তবে বৃত্তি পরীক্ষার ওই রেজাল্ট হওয়ার পর দেখা গেল, স্কুলের ছেলেমেয়েরা কেন যেন চুপেচাপে কী সব বলাবলি করে, হাসাহাসি করে, কিন্তু আমাকে দেখলে কথা থামিয়ে দেয়, হাসিটাও গোপন করে ফেলে। পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত লাগতে শুরু করল আমার কাছে।
তবে আমার লেখাপড়া ছাড়ার কারণ কিন্তু ওইসব না। আমাকে লেখাপড়া ছাড়তে হলো, কেননা আমার বাবার ঠ্যাংটা কেটে বাদ দিতে হলো। বাস থেকে হেলপারের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেল বাবা। ঠ্যাংটা চাপা পড়ল বাসের চাকার নিচে। বাবাও ড্রাইভিং করত; আমি জানি না, সে যখন ড্রাইভিং করেছে, তখন কতজন মানুষজনকে ওইভাবে বাসচাপা দিয়েছে। তাই বলে আমি কিন্তু এরকম ভাবি না, পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে বাবার পা এইভাবে বাসের চাকায় চাপা পড়েছে। যাকগে, ঘটনা হলো, বাবার ঠ্যাং কাটা পড়ার পর আমার আর লেখাপড়া করার উপায় থাকল না। আমিও তার রাস্তায় পা বাড়ালাম। অবশ্য আমার স্কুলের স্যাররা খুব ভালো ছিল। লেখাপড়া বাদ দিলেও বৃত্তির টাকা তুলতে আমার কোনো সমস্যা হয় নাই। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অনন্ত আমাকে বৃত্তির টাকা জমা হওয়ার খবর দিত। আমি পরদিনই সেই টাকা তুলে আনতাম।
দিন যত কাটল, আমাদের সম্পর্কও হালকা হতে লাগল। সত্যি কথা বলতে গেলে, বছরখানেক বাদে আমি নিজেই অনন্ত আর অবন্তিকাকে তুই-তুমি করে কিছু বলতে ইতস্তত করতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম ‘কেমন আছ?’ টাইপের দু-চারটে কথাবার্তা হতো বইকি; কিন্তু তা আর কয়দিন? কয়দিন আর আমি কথাবার্তা বলতে পারি! যে মোটরসাইকেল, সাইকেল কিংবা রিকশা থামিয়ে কথা বলি, সেটা যে এই শহরের কেউ না কেউ ইব্রাহিম মিয়ার গ্যারেজে সারতে দিয়েছে, সেটা যে আমার না, তা তো অনন্তরাও ভালো করেই জানে। অবশ্য অনন্তদের অবস্থা আমাদের চেয়ে তেমন ভালো ছিল, তা কিন্তু না। আমাদের মতোই একটুকরো থাকার মতো জায়গা ওদের এই শহরে, তাও আমাদেরই বাড়ির পাশে। তবে দুই পাশেই এত বড়ো দুইটা দালান উঠছিল যে, আমাদের বাড়িতে সূর্যের আলো আর ঢুকতই না। আমাদের ছাপরা টিনের চালে সারাদিন এটাসেটা এসে পড়ত। কখনো সফট ড্রিংকস কিংবা পানির খালি বোতল, কখনো বিস্কুট-টোস্ট-চানাচুরের খালি প্যাকেট, ময়লা পানি, চিবুনো হাড়হাড্ডি এমনকি ব্যবহৃত কনডম পর্যন্ত বর হিসেবে প্রায়ই এসে পৌঁছাত আমাদের টিনের চালে। আমরা কিছুক্ষণ চ্যাঁচামেচি করতাম, গালিগালাজও করতাম, কিন্তু তাতে কিছুই হতো না, কোনো উত্তরই আসত না। আমাদেরই একসময় চুপ হয়ে যেতে হতো। আর অনন্তরা তো কোনো কথাবার্তাই বলত না, যেন কিছুই হয়নি, কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তবে গোপনে গোপনে ওরা বোধহয় একেবারে গোঁ ধরে বসেছিল, যে করেই হোক লেখাপড়াটা শেষ করতে হবে, একটা ভালো সরকারি চাকরি পেতেই হবে—এমন একটা সরকারি চাকরি, যাতে কাউকে ‘স্যার’, ‘স্যার’ বলে ডাকার পরও নিজের খানিকটা ক্ষমতা থাকে।
আর আমার কথা আর কী বলব! দৈনিকই একবার না একবার মনে হতো, শালার বাপে অ্যাকসিডেন্ট করার আর সময় পেল না! আর দুই-তিন বছর বাদে করলে কী এমন ক্ষতি হতো? তাও তো এসএসসি’টা পাশ করতে পারতাম। অবশ্য এসএসসি পাশ করলেই বা কী এমন ঘোড়া-হাতি হতো! তারপরও ওরকমই ভাবতাম—আহ, এসএসসিটা যদি পাশ করতে পারতাম।
অবশ্য অনন্ত কিংবা অবন্তিকাকে কখনোই বলি নাই, এমনকি মাঝখানে যখন খুব ঘন ঘন দেখা হচ্ছিল তখনো বলি নাই, ‘তোরা যে এসএসসি পাশ করলি, কেমন লাগল রে? একটা মিষ্টিও তো খেতে দিলি না!’ আসলে লজ্জাই লাগত—যত গরিবই হোক না কেন, ওরা তো লেখাপড়া করছে। আর ওদের আশপাশেও এখন কত লেখাপড়া জানা মানুষ! ছোটোবেলার খুচরা খায়-খাতিরের জোরে কি আর মিষ্টি খেতে চাওয়া যায়!
খাতির না থাকলে কি ওইভাবে পরান খুলে কথা বলা যায়? দেখা হলে যেন শতসহস্র বছর ধরে জমে ওঠা কথাবার্তা বলি আমরা। আমার অন্তরে অবশ্য অপরাধবোধের গ্লানি তবু জমেই থাকে। যেমন অনন্ত আর অবন্তিকার হৃদয়জুড়ে থাকে অপমানবোধের স্বাদ ও অশ্রুপাত।
তারপরও কথাবার্তা তো একেবারে কম হয় না দেখা হলে। আর খাতির না থাকলে কি ওইভাবে পরান খুলে কথা বলা যায়? দেখা হলে যেন শতসহস্র বছর ধরে জমে ওঠা কথাবার্তা বলি আমরা। আমার অন্তরে অবশ্য অপরাধবোধের গ্লানি তবু জমেই থাকে। যেমন অনন্ত আর অবন্তিকার হৃদয়জুড়ে থাকে অপমানবোধের স্বাদ ও অশ্রুপাত। তাছাড়া মন খুলে কথা বললেও তাতে মিথ্যা কথার ঝুরি তো আমার একদম কম থাকে না। এই তো সেবার ওদের বলেছিলাম আমি, ‘আশ্চর্য, তোরা যে এইভাবে ওই পারে চলে যাবি, আমি কিন্তু বুঝতেই পারি নাই। অবশ্য বুঝলেও কি পারতাম ঠেকাতে? নিশ্চয়ই তোদের মন উঠে গিয়েছিল আমাদের ওপর থেকে।’
অনন্ত কেমন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘আশ্চর্য, মরা মানুষের সঙ্গেও তুই এইভাবে মিথ্যা বলিস?’
আমি খুব আহত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘মিথ্যা বললাম?’
‘মিথ্যাই তো! এতদিন আমি ভাবতাম, সরাসরি মরে যাওয়ার কথা বলতে তোর খারাপ লাগে বলে তুই ঘুরিয়ে বলিস। ওই পার মানে পরপার। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, তোর এই ওই পার মানে বর্ডারের ওই পার।’
‘হ্যাঁ, সেটাই তো… কেন, তোরা ওই পারে যাস নাই?… তাহলে কোথায় গেছিস?’
‘ঢং ধরিস না। তুই খুব ভালো করেই জানিস, আমরা মরে ভূত হয়ে গেছি। আর কীভাবে মরেছি, তাও খুব ভালো করেই জানিস।’
কী বলব! আমি আর কথা বাড়াই না। কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কেউই তো বলতে পারবে না, অনন্ত কিংবা অবন্তিকার লাশ দেখেছে। লাশ পাওয়া গেলে নাহয় নিশ্চিত করে বলা যেত, হ্যাঁ, ওরা মারাই গেছে। যেমন, এটা সবাই জানে, ওদের দাদু হরেণ একটা পালকির মধ্যে মরে পড়ে ছিল। ওদের মা-বাবা অবশ্য অনেক আগেই মারা গিয়েছিল—দাদু ছাড়া অন্য কেউই ছিল না। দু-তিনটা মামা নাকি আছে, কিন্তু তারা তো সীমান্তের ওই পারেই থাকে। নিশ্চয়ই অনন্তরাও সীমান্তের দিকেই রওনা হয়েছিল। কিন্তু যেমন বিশ্রী পরিস্থিতি তখন! টেনশনে রাস্তাতেই মরে গেছে হরেণ দাদু। আর লাশ ফেলেই ওরা পাড়ি জমিয়েছে পাশের দেশে। একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার বোঝা যায় পুরো ঘটনা।
তবু কেন যে এরকম তেরছা গলায় আমার সঙ্গেই এমন কথাবার্তা বলে অনন্ত, বুঝতে পারি না। আর অবন্তিকা তো আরও এক ডিগ্রি ওপরে, কেবলই কাঁদে, হু হু করে কাঁদে; ওই ভাবে কাঁদলে কোনো পুরুষ মানুষের কি কখনো ভালো লাগে? কিন্তু তারপরও অবন্তিকা কেঁদেই চলে… কাঁদে আর বলে, ‘তুমি এমন একটা কাজ করতে পারলে, বলো?’
অথচ আমি তেমন কিছুই করিনি। আর আমার মতো মানুষের কি তেমন কিছু করার মতো ক্ষমতা আছে? স্বপ্ন দেখার জন্যেও একটা বিছানা থাকতে হয়, একটা বালিশ থাকতে হয়, খানিকটা ঘুমও থাকতে হয়। মানুষের স্বপ্ন আসলে তার বিছানার মতো বড়ো, বালিশের মতো গভীর আর ঘুমটুকুর মতো নির্ঘুম শান্তির। কিন্তু আমার কি তা আদৌ আছে? জেগে থেকে স্বপ্ন দেখার কোনো মানে দাঁড়ায় না। কিন্তু জেগে জেগে দেখা স্বপ্ন ছাড়া আদৌ কি কোনো স্বপ্ন আছে আমার? আমি থাকি কখনো গ্যারেজের ময়লাজমা পাটিতে, কখনো কোনো গাড়ির সিটে, কখনো শুয়ে থাকি মেঝেঘেঁষা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে। আমার স্বপ্ন আর কত বড়ো হবে! তাছাড়া এখন তো আমি জেনেই গেছি, ভালো করেই জেনে গেছি, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়ো আর মানুষের স্বপ্ন আবার তার নষ্টামির সমান। কিন্তু নষ্টামি করার সামর্থ্য কতটুকু আছে আমার!
নেই—একটুও নেই। থাকলে কি আর এমন ঘটে? থাকলে কি আর আমার ঘুরে ফিরে এখন দেখা হয়ে যায় অনন্ত আর অবন্তিকাদের সঙ্গে?
ইব্রাহিম মিয়ার গ্যারেজে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে আমি ঘুরঘুর করি এমপি’র পিছে পিছে। খুব লাভ হয় না অবশ্য—তবে মানুষজন মনে করে, কী না কী হয়ে গেছি; তাদের ওই সমীহভরা চোখমুখ দেখতে দেখতে আমার বুকের ছাতিও ফুলে ওঠে বেশ খানিকটা।
দু-দিকের দালানকোঠা আমাদের পুরে রেখেছিল অন্ধকার এক রাজ্যে। তবু অনন্ত আর অবন্তিকাদের আমরা ঠিকই দেখতে পেতাম; আমি কথা বলার স্পৃহা হারিয়ে ফেলছিলাম, কিন্তু আমার মায়ের সঙ্গে হরেণ দাদু ও ওদের কথাবার্তা ঠিকই হতো। আর আমাদের বাড়িতে রান্না করা এ মাছ ও মাছ কিংবা ভাজি-ভর্তার বাটি যে মাঝেমধ্যে ওদের বাড়িতে যেত না, তাও তো না। অথচ আমিই কেবল দূরে ছিটকে পড়ছিলাম। তাছাড়া সময় কোথায়—টাকাপয়সা কামাতে হবে না! ইব্রাহিম মিয়ার গ্যারেজে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে আমি ঘুরঘুর করি এমপি’র পিছে পিছে। খুব লাভ হয় না অবশ্য—তবে মানুষজন মনে করে, কী না কী হয়ে গেছি; তাদের ওই সমীহভরা চোখমুখ দেখতে দেখতে আমার বুকের ছাতিও ফুলে ওঠে বেশ খানিকটা। তাছাড়া একদিন হয়তো ১০০ টাকা, আরেকদিন হয়তো ৫০০ টাকা—এইভাবে মাসে হাজার পাঁচেক টাকাও আসে আরকি। এমপি’র সঙ্গে সময় দেই, তাই তিনি একটু-আধটু ‘ইনটেনসিভ’ দেন আরকি। এর মানে জানার জন্যে একদিন আমি বাড়িতে পুরোনো ডিকশনারিটা নাড়াচাড়া করেছিলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত অর্থটা আর উদ্ধার করতে পারিনি। তা ‘ইনটেনসিভ’ই হোক আর যাই হোক—টাকা তো! আবার কত টাকাই বা সেটা! আমি এদিক-ওদিক করে কিনে ফেলা এই স্মার্ট ফোনটায় আঙুল ছুঁই আর চিন্তা করি, কী করে এই ‘ইনটেনসিভ’ আরও জোরাল করা যায়। ফেসবুক আমার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। কত মানুষজন কত কিছু করে-কম্মে খাচ্ছে, ড্রাগন ফলের চাষ করে অমুকে এখন সুখের বাগানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে পোস্ট করছে, অফিসে অফিসে দুপুরবেলা লাঞ্চ সাপ্লাই করে অমুকের বউয়ের মুখে কেমন ডিব্বার মতো হাসি ফুটেছে, অমুক ছেলে আবার ভ্যান চালিয়ে সংসার চালানোর পরও কী এক তেলেসমাতিতে এসএসসি পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশান পেয়েছে… মানুষের এত সব সাফল্য আমার চারপাশে নাচানাচি করে, ওড়াউড়ি করে আর উপহাস করে আমাকে।
এমপির পিছে ঘোরাঘুরি করি, ‘ইনটেনসিভ’ পাই—এই নিয়ে লোকে আগে খুব হাসাহাসি করত। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, হাসাহাসি করার লোকজন কমে আসছে। আর কমবে না কেন? এই এমপিকে হাতের নাগালে পাওয়া অত সহজ না। এই এমপি আগে ছিল এক পাকা আমলা, এখনো সে আমলাগিরিই ফলায় সবার ওপর, ধমকাধমকি না করলে তার ভালোই লাগে না। লোকজন বলাবলি করে, কারও ওপর একদিন ধমকাধমকি করতে না পারলে তার নাকি বদহজম হয়, সে নাকি তা দূর করতে বাথরুমে গিয়ে বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই গালিগালাজ করে। তা পেটে খেলে পিঠে তো সওয়াতেই হয়। আমি তাই কোনো কিছু বলি না। সব কিছু হজম করে ফেলি কখনো মাটি-মেঝের দিকে তাকিয়ে, কখনো আকাশ বা গাছপালার দিকে তাকিয়ে। অবশ্য মাঝেমধ্যে মন ভালো থাকলে নরম গলায় নানা কথাবার্তাও বলে। যদিও এতদিনে আমি জেনে গেছি যে, ওভাবে কথা বলার মানেই হলো, দুর্বোধ্য এক শয়তানি জাল পাতছে সে আমাদের ঘিরে। কিন্তু তারপরও কেন যেন ভালো লাগে ওইভাবে সে কথা বললে। আর বিশ্বাস করারও ইচ্ছে জাগে।
একদিন অনেক রাতে ফিরছিল এমপি রাজধানী থেকে। তা অত রাতে কে আর তার কাছে ভিড় জমাবে বাসস্ট্যান্ডে। এমনকি তার পিএ পর্যন্ত বিদায় নিয়েছে আমার ওপর এমপিকে বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়ে আসার দায়দায়িত্ব দিয়ে। বাস আসার কথা ছিল রাত দেড়টায়, কিন্তু এলো সাড়ে তিনটার দিকে। রিকশাওয়ালারাও ততক্ষণে যার যার গ্যারেজের দিকে রওনা হয়েছে কিংবা হওয়ার জন্যে জুতসই যাত্রী খুঁজছে। কোনোমতে ভ্যানওয়ালা আজিজুলকে আটকে রেখেছিলাম আমি। শুধু বাড়তি ভাড়া দেবো বলে নয়, ওর ছোটোবোনটার তখন বিয়ের কথাবার্তা চলছে; আর দেখা যাচ্ছে, পাত্র আবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাদের কেমন যেন আত্মীয় হয়; অতএব মশার কামড় খেতে খেতে আমার সঙ্গে সে-ও অপেক্ষা করেছিল সেইদিন। এমপির মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল ভ্যান ছাড়া অন্য কোনো যান নেই দেখে। জিজ্ঞেস করেছিল, তার গাড়ি কোনখানে। ছেলে গাড়ি নিয়ে কোথায় কোন রিসোর্টে গেছে শুনে ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে শেষ পর্যন্ত সুস্থির হয়েছিল সে। একই ভ্যানের এদিক-ওদিক বসেছিলাম আমরা দুজন। আর কী ভেবে একসময় খুব নরম গলায় বলেছিল আমাকে, ‘কী রে, দিনকাল কেমন যাচ্ছে তোর?’
এমন সুযোগ কি আমি আর হাতছাড়া করি? আমি আমার দুঃখের কেচ্ছা শোনাতে শুরু করেছিলাম তাকে। শুনতে শুনতে এমপি কিছুই বলছিল না, মাঝেমধ্যে ‘কী?’, ‘ও!’ ‘হ্যাঁ’ ‘হু-উ-উ’—এইসব ছাড়া। আধো আলো আধো অন্ধকারময় পথে তার হাতের সিগারেটের আলোটুকু জ্বলছিল একচক্ষু শয়তানের কখনো তীব্র আর কখনো-বা নিভু-নিভু ক্রোধ নিয়ে। একসময় সাহস বোধহয় আমার বেড়েই গিয়েছিল। বলেছিলাম তাকে, ‘আমাগারে বাড়ির কয়াক দাগ পড়ে তো আপনের খালুর একখান প্লট পইড়া আছে। হেরা তো মনে কয় আর ফিইরা আসব না।’
এমপি কোনো উত্তর না দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছিল। আমি আবারও বলেছিলাম, ‘আমেরিকা থেইকা কি কেউ আর ফিইরা আসে!’
‘হু-উ-উ’… এমপি যে কোন ঘোরে ছিল আর কেনই বা বারবার হু-উ-উ হু-উ-উ করছিল তা ঠিক ধরতে না পারলেও এটা বুঝতে পারছিলাম যে, এখন সে অন্তত রেগে উঠে গালিগালাজ করবে না। তাই আমি বহুদিন ধরে মনের মধ্যে পুষে রাখা কথাটা শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলেছিলাম, ‘প্লটটা তো পইড়াই আছে, আপনে ইট্টু ফেবার করলি ওইখানে একটা গ্যারেজ বানাই—’
এতক্ষণে এমপি স্পষ্ট করে আমাকে একটা কথা শুনিয়েছিল, ‘তোর বাড়ির পাশেই তো একটা প্লট পড়ে আছে—সেইখানেই কর না।’
আমার বাড়ির পাশে প্লট পড়ে আছে! বিস্ময়ে আমার দুই চোখ কপালে ঠেকেছিল। তারপর বলেছিলাম, ‘আমার বাড়ির পাশে তো অনন্তগারে বাড়ি ছার!’
‘ও-ও-ও, ওখানে মানুষজন থাকে! আমি তো ভাবছিলাম, আমার খালুর মতোই খালি প্লট, ছাপরা ঘরে পাহারাদার থাকে। —বলে এমপি যেন নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়েছিল।
তারপর আরও যেন কয়দিন কেটেছিল। একদিন ভোরে একটু আগে-আগেই যেতে হয়েছিল। আমাদের পাড়ার মুদি দোকানদার হেতেম তার ছেলে কাশেমকে পুলিশের চাকরিতে দেবে। কিন্তু ঘুস দিতে হবে নয় লাখ টাকা। পাড়াপ্রতিবেশী মানুষ, খুব করে ধরল, আমি গেলাম একটু তদবির করতে। নয় লাখ টাকাকে সাত লাখ টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। অবশ্য একেবারে খালি হাতে না—পাঁচ হাজার টাকা নিজের ট্যাঁকে গুঁজে, কাজ হাসিলের পর আরও পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে। ভোরের বেলা কেউ তখন বাইরের ড্রয়িং রুমে ছিল না ঠিকই, কিন্তু এমপি আবার ঘুমাচ্ছিল অঘোরে। তা যা হোক, একথা সেকথার পর এমপি দরাজ গলায় বলেছিল, ‘তোর গ্যারেজ বানানোর কাজকর্ম কতদূর?’
‘জি ভাই, ভালো কথা তুইলছেন। আপনি যদি ফেবার করেন, আপনের খালুর—’
‘আমার খালুর কথা বাদ দে। ভ্যাজাইলা মানুষ, খালি ঝামেলা পাকায়। তুই ওই অনন্তগারে বলে দেখ না—’
‘তাগরে কী কমু ছার? তারা তো ওইখানে বসবাস করে! জায়গা পইড়া থাকলি এক কথা আছিল।’
‘বসবাস করে? অ-অ-অ… তো খোঁজখবর রাখ। হিন্দু মানুষজনের নিয়তের ঠিক আছে নাহি। একদিন সকালে উইঠা দেখবি, কার না কার কাছে সব কিছু বিক্রি কইরা দিয়া রাতের আন্ধারে ভাইগা গেছে। তারচে খোঁজখবর রাখা ভালো না?’
তো ঘটনা কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। আর তার বেশি হবে কী করে! মানুষের স্বপ্ন তো তার নষ্টামির সমান বড়ো। নষ্টামি আর কতটুকু করতে পারি আমি। স্কুল ছাড়ার পর ঘনিষ্ঠতা কমে এলেও আমি তো জানতাম, অনন্তদের ও পারে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, পরিকল্পনাও নেই। তারপরও এমপি ওই কথা বলার পর মাকে দিয়ে একদিন একটু টোকা দিয়ে দেখেছিলাম। তা অনন্তরা নাকি বোকার মতো তাকিয়েছিল। আর বোকার মতোই অবাক হয়ে বলে উঠেছিল, ‘কী বলেন কাকিমা, এই জায়গা কেন বেঁচব? বেঁচলে আমরা কোনখানে গিয়ে থাকব?’ তবে অনন্তর দাদু নাকি ভয়ানক খেপে গিয়েছিল। তো ঘটনা তো এইটুকুই। অতএব অনন্ত আর অবন্তিকাদের সঙ্গে যে আমার আগের মতোই একটুআধটু দেখা হবে, হয়তো কথাবার্তাও হবে—সেটাই তো স্বাভাবিক। অবশ্য অনন্তরা আমার মায়ের কাছে যতই বলুক, জমিজমা বিক্রি করবে না, ওপারেও যাবে না, শেষ পর্যন্ত বাড়িঘর কিন্তু ঠিকই বিক্রি করেছে—একই দাগে ছয় কাঠা জায়গা ওদের, সবই তারা বিক্রি করেছে এমপির কাছে। এ জন্যে কাউকে কোনো কিছু করতে হয়নি, ওই যে কী বলে ‘ফেসবুক’—‘ফেসবুক’ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
আসলেই এইসব কাজে ‘ফেসবুকের’ তুলনা হয় না। তবে তারপরও অনন্ত আমার ছোটোকালের বন্ধু, দেখাসাক্ষাৎ হলে আমি তার মুখ থেকেই ঘটনাটা জানার চেষ্টা করি, ‘আচ্ছা, তুই ফেসবুকে কী লিখেছিলি রে? পাবলিক এত খেপে উঠল!’
‘তোরও মনে হয় আমি লিখেছি?!’
অনন্তর কোনো ফোন নাই, কম্পিউটারও নাই। আর এমনও না যে, ও আমার মোবাইল ফোন থেকে ওর নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেসবুকে ঘোরাফেরা করে। তারপরও আমার সন্দেহ ঘোচে না, ‘তাহলে যে সবাই বলে, তুই লিখেছিলি, মানুষ বানর থেকে আসছে, কিন্তু মাস্টাররা তা পড়াতে চায় না…’
‘ও, লিখিস নাই?’ আমার কণ্ঠটা কেমন সন্দিগ্ধ শোনায়। আর সেরকম শোনানোটাই খুব স্বাভাবিক—কেননা আজকাল কেন যেন যেকোনো ব্যাপারে আমার নিজেকেও সন্দেহ হয়। পাড়ার পোলাপান হাজী সাহেবের বাড়ির গেটের লাইট ভেঙে দিয়েছে, কিন্তু মনে হয় আমিই ভেঙেছি। কোচিং সেন্টার থেকে সন্ধ্যার পর ফেরার সময় মেসে থেকে কলেজে পড়াশোনা করা বুনো মেয়েটিকে কারা যেন তুলে নিয়ে গিয়েছে, মনে হয় আমিই তুলে নিয়ে এসেছি। আবার সাবান কারখানার দারোয়ানটাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না নয়দিন ধরে; লোকজন ভাবছে, মেরে-কেটে তাকে কেউ নিশ্চয়ই করতোয়ায় ডুবিয়ে দিয়েছে বস্তায় ভরে পাথর বেঁধে; অথবা এমনও হতে পারে কেমিক্যালের যে নতুন গোডাউন করেছে আসলাম শেখ, সেখানকার কোনো ড্রামে ডুবিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়েছে মৃতদেহকে—শুনতে শুনতে মনে হয়, ঘটনাটা আমিই ঘটিয়েছি। মনে হয় আর মাথাটা কেমন ঘুরতে থাকে, কোনো কিছুতেই মন বসে না। বসে বসে মোবাইল ফোনে ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করি, কেন ঘুরি, কোথায় ঘুরি, কিছুই ঠিক ঠাহরে আসে না।
অনন্ত আমার সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করে, ‘আমার তো ফোন নাই—কম্পিউটারও নাই। তাহলে আমি ফেসবুকে কিছু লিখলাম কেমন করে?’
তা ঠিক, অনন্তর কোনো ফোন নাই, কম্পিউটারও নাই। আর এমনও না যে, ও আমার মোবাইল ফোন থেকে ওর নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেসবুকে ঘোরাফেরা করে। তারপরও আমার সন্দেহ ঘোচে না, ‘তাহলে যে সবাই বলে, তুই লিখেছিলি, মানুষ বানর থেকে আসছে, কিন্তু মাস্টাররা তা পড়াতে চায় না…’
‘মানুষ অবশ্য বানর থেকে আসে নাই, কিন্তু বানরের মতো একটা কিছু থেকেই তো আসছে। ও তো দুনিয়ার সবাই জানে। এ আবার নতুন করে লেখার কী আছে! আমাদের পুরো জীববিজ্ঞানই এখন দাঁড়িয়ে আছে এই থিওরির ওপরে। তবে এইটা ঠিক, মাস্টাররা থিওরিটা পড়াতে চায় না। সিলেবাসে থাকার পরও পড়ায় না। আমি মোখলেস স্যারকে বলেছিলাম, স্যার, এইটা একটু ভালো করে পড়ান—আমার একটু ইচ্ছে আছে। কিন্তু স্যার তো খেপে উঠল…।’
আমি নির্বোধের মতো বলি, ‘তারপরও তোর এ নিয়ে কথাবার্তা তোলা ঠিক হয় নাই অনন্ত।’
‘আমি তো কিছুই বলি নাই। স্যার খেপে উঠল, আমি শুধু শুনলাম। তারপর বসে পড়লাম।’
আমার অনন্তকে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু আশ্চর্য, ওর মাথায় হাত রাখার পরও তা যেন স্পর্শ করতে পারি না। আবার কোনোমতে চুলটা ধরতেই মনে হয়, ড্রিলিং মেশিনটা ওর বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছি, ও যাতে চিৎকার করতে না পারে, সেজন্যে মুখের মধ্যে নোংরা ন্যাকড়া ঢুকিয়ে দিয়েছি। বাইরে কোথায় যেন অজস্র মানুষ চিৎকার করছে, স্লোগান দিচ্ছে, আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আমাদের এমপি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে আর বলছে, ‘শেষরাতে আসলাম আসবে। ওর কথামতো যা করার করবি, বুঝলি। নিজে যেন আগ বাড়ায়ে কিছু করতে যাস না। চিন্তা করিস না। আর কয়েকদিন যেতে দে। এসি ল্যান্ডের সাথে কথা বলে রেখেছি, তোর নামে দলিলপত্র সব রেডি করে দেবে। তারপর গ্যারেজের কাজ শুরু করবি।’
আসলাম শেখের নাম শুনে আমার কেমন তরাশ লাগে! এই ব্যাটা তো হিন্দুদের দু-চোখে দেখতে পারে না; এই এলাকার কোনো বুনো, সাঁওতালকেও না। পয়সা ছাড়াই এই লোকটাকে হিন্দু-বুনো-সাঁওতালদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া যায়। ধর্ম বদল করতে না চাইলে কাউকে মেরে ফেলাকে ভারি পুণ্যির কাজ মনে করে সে। তরাশ লাগে, আবার খুশিও লাগে আমার। শালার এমপির মাথায় বুদ্ধি আছে—এই না হলে আমলা মানুষ। লাশ গায়েবের জন্যে খুঁজে-মুঁজে ঠিকই লাগসই লোকটাকে বের করে ফেলেছে। এই লোকের মাথা কখনোই শান্ত হবে না, জল্লাদ ফাঁসির দড়ি হাতে এসে দাঁড়ালেও বলবে, ‘ঠিক কামই তো করছি…।’
অতএব খুব একটা ঝামেলা হয়নি আমাদের। কারণ আসলাম শেখের মতো মানুষই লুকিয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে আমাদের মধ্যে। সময়মতো তারা বেরিয়ে আসে, সময়মতো জেগে ওঠে। তখন হইচই হয় কয়েকদিন, এই আরকি। দোকানপাট, বাড়িঘর আর জমিজমা লুটপাট-দখলের পর সবাই আপনাআপনিই শান্ত হয়ে পড়ে। বড়ো শহর থেকে লোকজন আসে। এমপির রিসোর্টটায় বসে এখানকার উকিল, মাস্টার, নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ দেখা যায়। একদিন শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর মিছিল বের হলে তারা সে মিছিলটাকে ছত্রভঙ্গও করে দেয়। তখন কয়েকদিন খুব ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে। তবে এমপির কাছ থেকে ‘ইনটেনসিভ’টা বেশ ভালোই মেলে।
গ্যারেজের কাজ অবশ্য গেল দুই বছরেও শুরু করতে পারিনি আমি। কিছু বলতে গেলেই এমপি বলে, ‘আরে, দেখছিস না, কত ঝুটঝামেলা লেগে গেছে। কয়েকটা দিন যেতে দে।’ এইভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছরও যায়। আমি শুনতে পাই, অনন্ত আর অবন্তিকারা নাকি তাদের জায়গাজমি এমপির কাছে বেঁচে দিয়ে গেছে। তা দিতেও পারে। ওইদিন হরেণ দাদু, অনন্ত আর অবন্তিকার শেষ কথা তো তার সঙ্গেই হয়েছিল। আমি তো পেয়েছি তাদের অজ্ঞান অবস্থাতে। তারপরও আমার মুখটা কেন যে লাল টকটকে হয়ে ওঠে! কেন যে ভার-ভার হয়ে ওঠে। আর এমপিও তা বোধহয় খেয়াল করে। শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘তোর নামে দলিল করলে কত ঝামেলা হতো, চিন্তা করেছিস? সামলাতে পারতি এইসব? এমনিতেই পাঁচজনে সাতরকম কথা বলে বেড়াচ্ছে। তখন তো তোর নামে মামলাই হয়ে যেত। এখনো যে হবে না, তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? দেখ, ঝামেলা মনে করলে তোর বাড়ির জায়গাটাও আমার কাছে বেচে দিতে পারিস।… আরে, চিন্তা করিস না, ইয়ার্কি করছি তো। হবে—আগে হোক আর পরে হোক, গ্যারেজ তোর হয়ে যাবে, জায়গা না বেচলেও হবে। আর এত জায়গাজমি দিয়ে আমি কী করব? খালি কয়টা দিন যেতে দে।’
জানি না, কয়টা দিন আর যেতে দিতে পারব। মানুষের স্বপ্ন হলো তার নষ্টামির সমান বড়ো। কত আর নষ্টামি করতে পারি! খুব ভয়-ভয় লাগে। এমপির কাছে আর আসতে চাই না, ‘ইনসেনটিভ’ও আর চাই না, তারপরও হাজিরা দিতে হয় প্রতিদিন। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, মুখ আর দেখাতে চাই না। কিন্তু কেন যে এমপি এখন ঘুরেফিরে আমাকেই ডাকে। চটজলদি উত্তর না পেলে গালিগালাজ শুরু করে। আমি চুপচাপ গালিগালাজ শুনি, ফাঁক পেলেই চোখ বুজি আর মনে মনে অনন্ত ও অবন্তিকাকে ডেকে ফিরি। কিন্তু কী আশ্চর্য, কেন যেন ওরা কিছুতেই আসে না; এলেও অনেকদূরে দাঁড়িয়ে থাকে; অনন্ত আর আমার সঙ্গে একটু হাঁটতেও চায় না, অবন্তিকা আর আমার সঙ্গে একটু বসতেও চায় না নদীর ধারে। আমি চিৎকার করে ডাকি, বারবার ডাকি, ‘অনন্ত… অবন্তি… অনন্ত… অবন্তি… কবে আসবি?… ’
কিন্তু কোনো উত্তর মেলে না। সাড়া মেলে না। অবশ্য তা নিয়ে খুব একটা ভ্রুক্ষেপও করি না। আমি তো জানি, খুব বেশি দেরি নেই আর, তাড়াতাড়িই ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে আমার।
জন্ম ১৩৭১ বঙ্গাব্দ, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ; সিরাজগঞ্জের সলপ জনপদের রামগাঁতী গ্রামে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘ডানাকাটা হিমের ভেতর’ (উপন্যাস, ১৯৯৬)। অন্যান্য উপন্যাস : ‘আমরা হেঁটেছি যারা’, ‘চরসংবেগ, ‘অন্ধ মেয়েটি জ্যোৎস্না দেখার পর’, ‘মোল্লাপ্রজাতন্ত্রী পবনকুটির’, ‘তা হলে বৃষ্টিদিন তা হলে ১৪ জুলাই’, ‘আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক’, ‘মৃত্যুগন্ধী বিকেলে সুশীল সঙ্গীতানুষ্ঠান’, ‘নীল কৃষ্ণচূড়ার জন্মদিনে’, ‘শাদা আগুনের চিতা’, ‘অন্তর্গত কুয়াশায়’, ‘যারা স্বপ্ন দেখেছিল’। সাহিত্যকীর্তির জন্য পেয়েছেন : ‘মৃত্যুগন্ধী বিকেলে সুশীল সংগীতানুষ্ঠান’ গ্রন্থের জন্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার (২০১২), লোক সাহিত্য পুরস্কার (২০১৩), জীবনানন্দ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪), ‘শীতের জ্যোৎস্নাজাবলা বৃষ্টিরাতে’ গ্রন্থের জন্যে প্রথম আলো বর্ষসেরা সৃজনশীল গ্রন্থ পুরস্কার (১৪২১), কিশোর উপন্যাস ‘পাতার বাঁশি বাজে’র জন্যে শিশু একাডেমি পুরস্কার (১৪২১) এবং কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০২০)। উপন্যাস, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, শিশু-কিশোরসাহিত্য, অনুবাদ সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০টি।