ইঁদুরেরা কাগজ খায় আর গুলি হাগে—এই কথা জেনে আমি মরে গিয়েছিলাম। মরে যাবার পর, অথবা আমাকে মেরে ফেলা হয়েছিল, আমার একমাত্র ঘরটি মৃত্যুসদনে পরিণত হয়। ছোটোবেলা থেকেই আমি ভেতরগোঁজা। যাকে বলে ঘরকুনো। সাত অথবা আট বছর বয়সে এই কথা শুনে মনে হতো আমার মাথার ভেতর অনেকগুলো ঘর। কোণবিশিষ্ট। ঘরে থাকি আমি। আর থাকে ইঁদুর। ঘরের অজস্র কোণে নদীর শব্দের মিহি অন্ধকার। বিবিধ কোণ এবং অন্ধকার থেকে উদ্ধারের চিন্তা অনেক অনেকদিন আগে একবার আমাকে বিপন্ন করে তুলেছিল। কিন্তু ঘরের অজস্র কোণে ইঁদুরের বংশবিস্তার আর তাদের খেলাধুলা আমাকে এতটাই আনন্দিত করেছিল যে, ঘরের কোণগুলো ছেড়ে, মরে গিয়েও, কোথাও যাবার ভাবনা আমি ঝেড়ে ফেলে দিই। ইঁদুরদের বন্ধুকৃত্য, সঙ্গ এবং খেলাধুলার নতুন নতুন উদ্ভাবন আমাকে প্লাবিত করে।
সারারাত ইঁদুরগুলো সেসব কাগজের স্তূপ এমনভাবে কেটে টুকরো টুকরো গোলকধাঁধা তৈরি করে যে, প্রাচীন কাগজে মানবসভ্যতার নানান প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির রংবেরঙের ছবি আর কথার মোহে পড়ে যায় আমার গৃহকোণের সকল কীটপতঙ্গ। এমনকি শহরের বাড়িঘরের ফাঁকফোকর থেকে দৌড়ে আসে বাস্তুসন্ধানী বেজি ও বাচ্চা তক্ষক।
ইঁদুর পোষা সব থেকে সহজ। ওদের খাদ্যের জন্য আমাকে বিশেষ কোনো চিন্তাই করতে হয় না। আমার শরীরের ঘাম ধুলোবালি আর ঘুম চেটেপুছে খেয়ে ওদের স্বাস্থ্য দিব্বি রাক্ষুসে হয়ে উঠেছিল। ছিটেফোঁটা আমিষের লোভ পূরণের কোনো অভাব ওদের ছিল না। আমার ঘরের কোণগুলোতে নির্ঝঞ্ঝাটে বেড়ে ওঠা এবং বংশবিস্তারে ক্লান্তিহীনভাবে পারঙ্গম মাকড়সা, খেয়ালি কাঠপিঁপড়া, সুখী টিকটিকি অথবা অন্যান্য নিশাচর কীটপতঙ্গ অবলীলায় সাবাড় করে ফেলে ইঁদুরগোষ্ঠী। তাছাড়া পুরোনো বাতিল পত্রিকা বা ফাঙ্গাসে বিধ্বস্ত ছেঁড়া বইয়ের পৃষ্ঠা কোণগুলোতে ছড়িয়ে দিলেই চলে। সারারাত ইঁদুরগুলো সেসব কাগজের স্তূপ এমনভাবে কেটে টুকরো টুকরো গোলকধাঁধা তৈরি করে যে, প্রাচীন কাগজে মানবসভ্যতার নানান প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির রংবেরঙের ছবি আর কথার মোহে পড়ে যায় আমার গৃহকোণের সকল কীটপতঙ্গ। এমনকি শহরের বাড়িঘরের ফাঁকফোকর থেকে দৌড়ে আসে বাস্তুসন্ধানী বেজি ও বাচ্চা তক্ষক। রঙিন বা সাদাকালো ছবি এবং পিঁপড়ার সারির মতো অক্ষরশোভিত কাগজের গোলকধাঁধায় কিছুদিন ঘুরে হৃষ্টপুষ্ট হয় কীটপতঙ্গ ও সরীসৃপগুলো। ইঁদুরের দল প্রথমে তাদের হত্যা করে, তারপর ধীরে ধীরে সাবাড় করে। এমনকি রাক্ষুসে পেল্লায় ইঁদুরের দল নেংটি ইঁদুরদেরও রেহায় দেয় না। তাদের হাগুর গুলি খেয়ে নেংটিগুলোর বুক ছেঁদা হয়ে যায়। তারপর নেংটিগুলো লাশ। ইঁদুরবাহিনী এসব প্রাণী হত্যায় এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠে যে, একদিন শিকার করল আস্ত একটা ধাড়ি বিড়াল। ইঁদুরগোষ্ঠীর সাহস এবং নিপুণ হত্যাকৌশল দেখে আমার ভেতর ভয়ের নদী বয়ে যায়। ভয় ক্রমশ বৃশ্চিকের শুঁড় ছড়িয়ে আমার মৃত শরীরে সংক্রমিত হতে থাকে। তখন মাথার ঘুটঘুটে কোনাকাঞ্চিতে ইঁদুরের সঙ্গে খেলার ধরন বদলে যায়। দেখা গেল, ছোটো ছোটো কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ হত্যার পর একদিন ইঁদুরেরা কয়েকটা দলে-উপদলে ভাগ হয়ে একটা ধাড়ি বিড়ালকে আক্রমণ করেছে। একদল বিড়ালটার লেজে তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদল অত্যন্ত দ্রুত চোখ নাক মুখ কান গলা লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে—মুহূর্তে বিড়ালটা বোমা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন লাশে পরিণত হয়। অতঃপর ইঁদুরবাহিনী চিৎপটাং ঘুমায়।
মরে যাওয়ার প্রথম রাতেই আমি মাথার ভেতর আলো-অন্ধকার ঘরের কোণে ইঁদুরগুলোর কুট কুট কুট কুট শুনতে পাই। তখন থেকে পৃথিবীর অন্যান্য সব শব্দ আমার কাছে অর্থহীন হয়ে ওঠে। হয়তো প্রভাতি বিদ্যালয়ের ঘণ্টা বাজার শব্দ দৌড়ে আসছে; বৃক্ষের ছায়ায় পা ডুবিয়ে কবিতার নন্দনতত্ত্ব, জলের জন্মরহস্য অথবা একখণ্ড জানালা বিষয়ক বক্তিমার শব্দ আসছে; পাখা গজানো পিপীলিকার উড়ালের শব্দ আসছে; কেউ মাথার ভেতর ভালোবাসার মেঘ তৈরির শব্দ করছে। হয়তো এসব শব্দের ঘুম ঘুম মেঘ দূরে কোথাও বৃষ্টি ঝরায়। বজ্রপাতের গোপন আওয়াজ হয়। আমি বৃষ্টি, বজ্রপাত, বৃক্ষ ও পিপীলিকার শব্দমেঘ; বিড়াল হত্যার ভয় দূর করার গোপন শব্দরাশি শিখছি আন্ডারগ্রাউন্ডে নিখোঁজ মানুষের মতো। অথবা ভুলে যাচ্ছি কবিতার শব্দবন্ধ, উড়ালের শব্দবন্ধ। হয়তো সেসব শব্দমেঘ আমি শুনি অথবা শুনতে পাই না। অথবা সেসব শব্দমেঘ ইঁদুরের কুটকুটে নিখোঁজ হলে স্পর্শ, অনুভূতি, স্বাদ, গন্ধ, এমনকি দৃষ্টির নির্দয় শূন্যতার ভেতর আমি বধির হয়ে গিয়েছিলাম; কেবল পুরোনো কাগজের ফাঙ্গাসে ধ্বস্ত কালো অক্ষরগুলোর ফিসফিসানি শুনতে পাওয়ার ঘূর্ণনশীল নিয়তির ভেতর আমার শ্রুতি আটকে হলে মাথার ভেতর নিরাময়হীন ভয়ের ব্যাধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল।
ইঁদুরের দল আমার আওয়াজ পেলেই মনমেজাজ বুঝে গোলকধাঁধার ভেতর দৌড়ানি দেয়; একবার শঙ্খিল অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে উঁকি দিয়ে দাঁত খিঁচায়, কখনো গলা চিপে ধরে বিরতিময় শ্বাসরোধের খেলা করে। তখন কাশির দমক ছাড়া কোনো শব্দ উচ্চারণের ক্ষমতা সাময়িক লুপ্ত হয়। কখনো এই খেলায় শ্বাসরোধী অথবা ইঁদুরদের গুলির মতো তীক্ষ্ণ দাঁত ফুটে বুক-ছেঁদা মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। তবে ইঁদুরদের এসব খেলা দেখাও বিপুল বিনোদনের। মনে হয় মানুষের কণ্ঠ বন্ধ করে দেওয়া বাকশূন্যতার এমন খেলা পৃথিবীতে অনন্য। বাকরহিত মানুষ কথা বলতে না পেরে, তাদের কপালে নীল ময়ূরের অজস্র পালকের চোখ জেগে ওঠে না কি, বিপুল শব্দের সম্ভাবনা ও উত্তেজনায়? নির্বাক মানুষের টুকরো টুকরো বিষাদ ছুঁয়ে যায়। নির্বাক মানুষের সুখদুঃখ নিয়ে শহরে রাত জমতে থাকে। নির্বাক মানুষের চাঁদ সূর্য দিন মাস বছর ছোটো হতে হতে শূন্য হয়ে এলে দেখি খেলার সর্বত্র জেগে আছে ইঁদুরের চোখ। ধুলো, ঝড় অথবা গান গোপন করে ইঁদুরের চোখে কী কী খেলা লুকানো থাকে, কী কী খেলা অনুষ্ঠিত হয়, সেসব খেলায় জয়ের আনন্দ কীভাবে দৃষ্টিশীলতা তৈরি করে? এমন বিবিধ ভাবনার ভেতর দেখি ইঁদুরের দুদিকের দুই চোখে অজস্র মাংসের খেলাধুলা। ভাবলাম, ইঁদুরেরা কি মাংস খেতে ভালোবাসে? মৃত মানুষের গলিত মাংস কি সুস্বাদু? মানুষের মাংস খেলে তাদের পটি কি পিতলের হলুদাভ হয়? শরীরের কোন অংশ থেকে তারা আমার মাংস দাঁতে কাটতে শুরু করবে? পা থেকে? তাহলে আমার শরীর নিঃশেষ হওয়ার আগেই সকল চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব পা থেকে যেন ইঁদুরেরা আমাকে ভক্ষণ করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলাম। মাথা থেকেও না। কেননা আমার চিন্তা এবং কল্পনার সব রহস্য এই অংশেই জমা রয়েছে। যদি বাঘের মতো ঘাড় এবং কণ্ঠনালি ওদের লক্ষ্য হয় সেটি আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের হবে। আমি আমার মস্তিষ্কপ্রসূত সকল ভাবনা ও স্মৃতি কণ্ঠের সাহায্যে শব্দে পরিণত করি। অজস্র শব্দ ঘরের কোনাকাঞ্চিতে জমা রাখি। ঘর আমার মাথার ভেতর হলে সেখানে অসংখ্য কোণ। আমি কণ্ঠের সকল কারুকাজ নিয়ে আমার মাথার কোনাকাঞ্চিতে প্রাচীন বইয়ের পৃষ্ঠায় একটা নীল ময়ূর হয়ে শুয়ে থাকি।
২.
আমার মৃত্যুকে জানার জন্য যেতে হবে প্রাচীন বইয়ের হারানো পৃষ্ঠায়। একটি প্রাচীন বই, দুটি প্রাচীন বই, তিনটি প্রাচীন বই; এভাবে অসংখ্য প্রাচীন বই, অথবা পৃথিবীর প্রথম বই। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের অনেক অনেক বছর আগে হয়তো নিখোঁজ মানুষের কণ্ঠস্বরে লিখিত হয়েছিল যেসব বই। ছোটোবেলা থেকে সেইসব হারিয়ে যাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বরচিহ্নিত পুরোনো বইয়ের প্রতি আমি তীব্র এবং গোপন তৃষ্ণা অনুভব করি। বই পড়তে যে খুব ভালোবাসি এমন নয়। বরং বইগুলোকে আমার প্রাচীন গৃহ মনে হয়। একটা বই মানে একটা গৃহ, একটা মাথা, একটা নিখোঁজ কণ্ঠস্বর। আমার মাথার ভেতর সেসব গৃহকোণ। রংবেরঙের প্রচ্ছদ, ধূলিধূসর নামলিপি আর ভেতরের গাঢ় বাদামি পৃষ্ঠাগুলো আমার মাথার ভেতর অদ্ভুত সব কোণ তৈরি করে। কোণজুড়ে চলে ইঁদুরের খেলাধুলা অথবা নতুন নতুন খেলার অস্ত্রশস্ত্র তৈরির রিহার্সেল—পিতলের হলুদাভ হাগুর অস্ত্র। একটি গৃহকোণে কপাটভাঙা ঘুলঘুলি—সে আকাশ ডেকে আনে ঘরে। একটি গৃহকোণে টুকরো আয়না—সে ঝড় ডেকে আনে ঘরে। একটি গৃহকোণে বাতাসের অস্ফুট স্থাপত্য—নদী ডেকে আনে সে আমার ঘরে। একটি গৃহকোণে বিকেল জমে থাকলে বুনো ফুলের ঘুম ঘুম গন্ধ দৌড়ে যায়। একটি গৃহকোণে রাত জমে থাকলে শহরে শিশিরের তুমুল গন্ধের ভেতর কাগজ ফেরিওয়ালারা অনৈসর্গিক স্বপ্নের মতো এসে ভিড় করে। তাদের কাছ থেকে আমি কম দামে পুরোনো বই সংগ্রহ করি। কাগজ ফেরিওয়ালারা কত কিছু জানে। তারা বলে:
—এই বই কেজিতে বিকোয় না।
—তাহলে নিন সবটুকু স্মৃতি।
—এত কম দামে কীভাবে দিই?
—তাহলে এই নিন একটা খেলা।
—খেলার আর দাম কী? তাছাড়া পদ্ধতিও জানা নাই!
—তবে দিতে পারি একটি দিন, একটি বিকেল এবং এবং একটি রাত।
—এসব দিয়ে কী করব।
—তবে নিন পৃথিবীর সকল শব্দ।
—গুলির শব্দ হলো বন্দুকের কণ্ঠস্বর, যেখানে সকল বই লাশ হয়ে জেগে থাকে।
—ইঁদুরেরা সারারাত কাগজ খায় গুলি হাগে।
—তাহলে ইঁদুরের সুড়ঙ্গ দিন।
—ওরা থাকে গৃহকোণে, মাথার ভেতর।
—একটি বইয়ের জন্য দিতে হবে একটি গৃহকোণ।
—সেখানে আছে আকাশ, ঝড়, আয়না আর গোধূলিপ্রস্থানের পূর্বমুহূর্ত।
—এক ঝুড়ি বাতাস দিন, বইগুলো ভাসিয়ে দিই অনন্ত নক্ষত্রে।
—বাতাস তো স্থাপত্য হয়ে আছে। ভাসমান নয়।
—বাতাস কি বইয়ের চাইতেও ভারী?
—বই যত না ভারী, তার অধিক ভার।
—এত প্রাচীন বই কোথাও পাওয়া যায়?
—মৃত্যুসদনে।
আমার চোখ ভেসে যায় কালো রেখায়। চোখে কি জেগে আছে লুকানো খেলাধুলা? দেখি আমার চোখে বৃষ্টির শব্দ ও আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে। হয়তো দেখি নিখোঁজ মানুষের কণ্ঠস্বর বৃষ্টির শব্দে জেগে উঠছে আর আমি ভিজে যাচ্ছি নোনা জলে। রংবেরঙের টুকরো তালি দেওয়া ধূলিধূসর প্রচ্ছদে আমার শরীর ঢাকা। মাথার ভেতর গৃহকোণে অনুভব করি, আমার শরীরে লেখা আছে কয়েক হাজার বৃষ্টি, কয়েক হাজার নিখোঁজ কণ্ঠস্বর।
কাগজ ফেরিওয়ালারা বলে, ঘরের দরজা এবং টয়লেট না থাকলে আমার শরীর লেখা হয়েছে নলখাগড়া কলমের কালো রেখায়। আমার ঘর কোনো প্রাসাদ অথবা অভিজাতদের আবাসস্থল হলে আমার শরীর লেখা হতো নীল ময়ূরের পালকে। আমার শরীরে কি লেখা ছিল প্রাচীন কাল? অথবা আমার মিউ মিউয়ে কি লেখা আছে বর্তমান কাল? নিখোঁজ মানুষের দ্রবীভূত কণ্ঠস্বর কল্পনা করে মাথার কোনাকাঞ্চিতে খেলাধুলার গাছাগাছালি ডালপালা ছড়ায়। দেখি খেলাধুলার মানুষজন সকলেই বিষাদে ডুবে আছে, ভয় দৌড়ে চলেছে তাদের চোখের শিরায়, সকলেই বিপন্ন। মাথার ভেতর ঘরের কোনাকাঞ্চিতে উড়ে বেড়ানো টুকরো কাগজ, ধুলো আর ইঁদুরের কুট কুটের ভেতর অনেক অনেকদিন পর আমি মৃত শরীর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আমি যেন কোনো নিখোঁজ কণ্ঠস্বরচিহ্নিত প্রাচীন বই। আমার চোখ ভেসে যায় কালো রেখায়। চোখে কি জেগে আছে লুকানো খেলাধুলা? দেখি আমার চোখে বৃষ্টির শব্দ ও আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে। হয়তো দেখি নিখোঁজ মানুষের কণ্ঠস্বর বৃষ্টির শব্দে জেগে উঠছে আর আমি ভিজে যাচ্ছি নোনা জলে। রংবেরঙের টুকরো তালি দেওয়া ধূলিধূসর প্রচ্ছদে আমার শরীর ঢাকা। মাথার ভেতর গৃহকোণে অনুভব করি, আমার শরীরে লেখা আছে কয়েক হাজার বৃষ্টি, কয়েক হাজার নিখোঁজ কণ্ঠস্বর। আমি আমার অথবা তার কাছে যাই। আমি অথবা সে ময়ূরপালক থেকে একঝাঁক বৃষ্টি লেখে আমার শরীরে। আমার অথবা তার কাছে যাই। আমি অথবা সে মেঘ থেকে একটা নদী লেখে আমার শরীরে। আমার অথবা তার কাছে যাই। আমি অথবা সে বৃক্ষ থেকে একগুচ্ছ কবিতার নন্দনতত্ত্ব লেখে আমার শরীরে। আমার অথবা তার কাছে যাই। আমি অথবা সে বিড়ালের চতুষ্পদ থেকে একটা নিঃশব্দ লেখে আমার শরীরে। আমার অথবা তার কাছে যাই। আমি অথবা সে বলে, সকল বই ইঁদুর অথবা মানুষের পাকস্থলীতে সুষম খাদ্য হিসেবে জমা হয় শরীরের অনুভূতি দিয়ে, গান দিয়ে, স্পর্শ দিয়ে, স্বাদ দিয়ে, সুখ দিয়ে, দুঃখ দিয়ে, প্রেম দিয়ে, রক্তের গোপন ধ্বনি দিয়ে—অতঃপর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আমি অথবা সে দেখে, প্রতিটি বই সমাধিস্থ মানুষের কণ্ঠস্বরকে স্মৃতি এবং অন্ধকার থেকে বের করে এনে শব্দ ও কথার অস্থিতে পরিণত করে।
অনেক অনেকদিন পর আমার গৃহকোণে একটি ধাড়ি বিড়াল ঢুকে পড়ে। সে কালো। অথবা সে সাদা। হয়তো সে হলুদ। আমার ঘরের দরজা এবং টয়লেট না থাকলে কীভাবে প্রবেশ করে বিড়ালটা? তখন এই কথা ভেবে দেখি বিড়ালটা ধূসর অথবা বাদামি, হয়তো সে সাদা এবং কালোয় চক্রাবক্রা। অথবা ছাই বর্ণ—সবসময় ছায়ার সঙ্গে মিশে আছে। অথবা সে হলুদাভ—গাছ হয়ে বেড়ে উঠছে নদীবাহিত পলিতে, অথবা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো দেখি বিড়ালটার রং বর্ণনা করা যাচ্ছে না, তবু সে আমার গৃহকোণে ঢুকেছে। বিড়ালের পায়ের শব্দ কি নিখোঁজ মানুষের কণ্ঠস্বরের মতো নিরুদ্দেশ হয়েছে, অনেক অনেকদিন আগে? বিড়ালের পায়ের স্পর্শ, স্বাদ, গন্ধও কি সকল শ্রুতিকে হত্যা করেছে? বর্ণনাতীত রঙের বিড়ালটিকে আমার অচেনা মনে হয়। অথবা চেনা মনে হয়। আমি তার পায়ের ভেতর নিঃশব্দ ভ্রমণ শিখি। নিঃশব্দ ভ্রমণের শিক্ষা আমাকে একটা গোপন দরজা খুলে দেয়। আমার ঘরের দরজা। নিঃশব্দ ভ্রমণ দেয়ালের উপনিবেশ থেকে প্রস্থানের নদী ছুঁয়ে যায়। আমার ঘরের দেয়াল। তখন এই কথা ভেবে দেখি, আমার গৃহকোণে প্রবেশ করা যায়, কিন্তু প্রস্থানপথ ইঁদুরের সুড়ঙ্গে চলে গেছে। শঙ্খিল সুড়ঙ্গ পথে কে যায়? কারা যায়? দেখি বিড়াল যেতে পারে না। সে পথে ইঁদুরেরা ছায়ার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে। দেখি ইঁদুরের পা আরও নিঃশব্দ। শব্দরহিত মৃত মানুষের কণ্ঠের বধিরতা নিয়ে ইঁদুরেরা পৃথিবীর সকল নিঃশব্দ জয় করেছে। তাদের নিঃশব্দ জেনে দেখি তারা বিড়ালের ভ্রমণের চেয়ে নিঃশব্দ। ধাড়ি বিড়ালটি শরীরের রং হারিয়ে সুড়ঙ্গ পথে গেলে ইঁদুরবাহিনী কুট করে তার পশ্চাদ্দেশ থেকে লেজ কেটে নেয়। বিড়ালটি কপাটভাঙা ঘুলঘুলি দিয়ে লেজকাটার যন্ত্রণা নিয়ে প্রস্থান করতে চাইল:
বিড়ালটা একবার লাফ দেয়। কী দেখে? একদল কুকুরের ঘি মাখানো বাঁকা লেজ।
বিড়ালটা দুইবার লাফ দেয়। কী দেখে? দাঁতকপাটি লাগা সারি সারি লোক।
বিড়ালটা তিনবার লাফ দেয়। কী দেখে? ধুমসো মুষকো লোলঝোল চেয়ার।
বিড়ালটা চারবার লাফ দেয়। কী দেখে? বান্দরের লাল পুটকিমুখী থলথলে মহিলা।
বিড়ালটা পাঁচবার লাফ দেয়। কী দেখে? একদল পশ্চাদ্দেশ দিয়ে কথা বলা লোক। পায়ুকণ্ঠীদের মুখস্থ কণ্ঠস্বরের চিলচিৎকারে শিশুরা কান্না করে।
বিড়ালটা ছয়বার লাফ দেয়। কী দেখে? ধর্ষণের পর ছিন্ন লিঙ্গ। ভেসে যাচ্ছে ম্যানহোলের সুড়ঙ্গে। অতঃপর লিঙ্গ ফুটছে আতশবাজির চরকিনাচে। নাচের ভেতর স্ফুলিঙ্গ। সব স্ফুলিঙ্গের গমন দাহ্যমুখী হলে লিঙ্গধারীরা শহর পোড়ায়, নারীরা বৃক্ষ হলে ক্লান্তিহীন আত্মহত্যায় তাদের বৃক্ষশাখায় ঝুলিয়ে দেয়। লিঙ্গের স্ফুলিঙ্গ-দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে বিড়ালটা লাফায়; কপাটভাঙা ঘুলঘুলি তার লাফের বাইরে। বিড়ালটা আয়নার ভেতর ঢুকতে চাইল। সেখানে ইঁদুরগোষ্ঠী সিংহের হুংকার এঁকে রেখেছে। বিড়ালটা পরবর্তী গৃহকোণ দিয়ে প্রস্থান করতে চাইল এবং সে হয়তো দেখে বুনো ফুল তাদের শরীরে বিষ চাষ করেছে। বিড়ালটা আরেকটি গৃহকোণে গেলে সে দেখল সেখানে নদী উড়ে গেছে সূর্যে। আরেকটি গৃহকোণে ছায়ার রহস্যে বিলীয়মান রোদের গন্ধের ভেতর কাগজ ফেরিওয়ালারা ছায়ার বিস্তার নিয়ে আসে। বিড়ালটা তখন আমার মাথার ভেতর দিকচিহ্নহীন গৃহকোণে আশ্রয় নেয়। মিউ মিউ ডাকে। আমি কাগজ ফেরিওয়ালাদের নিখোঁজ কণ্ঠস্বরচিহ্নিত পুরোনো বইয়ের দাম জিজ্ঞেস করি। কাগজ ফেরিওয়ালারা কত কিছু জানে। তারা বলে:
—এই বই কেজিতে বিকোয় না।
—তাহলে এই নিন একটা খেলাধুলা।
—এত কম দামে কীভাবে দিই।
—বর্ষা নেই, ঝড়ে মেঘ উড়ে গেছে। দিতে পারি শরীরের বৃষ্টি।
—মেঘের আশ্রয় সকল গাছ মৃত, সেখানে পাখি বসে না।
—তাহলে বিনিময় করি কবিতার গাছগাছালি।
—এত কম দামে কীভাবে দিই।
—তাহলে রক্তের গোপন মিউ মিউ দিতে পারি।
—আমাদের শরীরে অজস্র ছেঁদা, আমরা থাকি মৃত্যুসদনে।
কাগজ ফেরিওয়ালাদের এই কথা শুনে ঝাঁঝাঁ রোদে বিলীয়মান শিশিরের পৃষ্ঠায় লিখিত সকল বই আমার ঘরের কোনাকাঞ্চিতে জমা করি। তখন শরীরের রং বর্ণনা করতে না পারা ধাড়ি বিড়ালটা কোথায় যাবে? এই ধন্দে পড়ে সে মিউ মিউ ডাকে। হয়তো তার মিউ মিউ নিঃশব্দ, অথবা তার মিউ মিউয়ে দূরবর্তী কোনো সলজ্জ অন্ধকার নদীজলস্রোতে নিখোঁজ মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে চলেছে। সেসব নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর চাক্ষুস করতে করতে নিঃশব্দ জয় করতে না পারা ধাড়ি বিড়ালটা কীভাবে বাঁচে? মৃদু ক্লান্তি নিয়ে সে আমার মাথার ভেতর অন্ধকার কোণে আশ্রয় নেয়। তার ভয় পাওয়া বুকের দুরুদুরু শুনতে পাই। তার বুকের দুরুদুরু কি অন্ধকার কোণ ছেড়ে আমার বধিরতা ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে কপাটভাঙা ঘলঘুলির দিকে? আমি নিশ্চিত হতে পারি না। রাশি রাশি বইয়ের ভেতর পোষা ইঁদুরগুলোর দাঁত আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। শরীর আরও মসৃণ। ইঁদুরগুলো রাতের ব্যাঙগেলা অন্ধকারে এমন হৈ-হুল্লোড় করে যে, আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠনালি দিয়ে শিশিরের অস্ফুট শব্দ ঝরে পড়ে। কখনো কখনো আতঙ্কিত হয়ে উঠি এই চিন্তায়—যদি কোনোদিন ঘুমের ভেতর ইঁদুরেরা শঙ্খিল অন্ধকার সুড়ঙ্গ ছেড়ে ধাড়ি বিড়ালটা হত্যা করে আমার মাথায় চেপে বসে? আর আমার প্রতিটি পৃষ্ঠা ইঁদুরের কুট কুট কুট কুটে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে?
যেন ঘুমিয়ে না পড়ি সেজন্য কপাটভাঙা ঘুলঘুলির সামনে দাঁড়াই। দেখি একফোঁটা নক্ষত্র একটি গৃহকোণে চূর্ণ আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে। আয়নাটা বিচূর্ণ। কীভাবে সে বিচূর্ণ; আমি জানি না, অথবা জানি। আয়নার অজস্র কোণে মিউ মিউ শব্দমেঘের অথবা নিঃশব্দমেঘের সকল অণু-পরমাণু রক্তগন্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে। অথবা চূর্ণ আয়নার অজস্র কোণ থেকে ভেসে আসছে লক্ষ লক্ষ সিংহের খেলাধুলা। আরেকটি গৃহকোণে যাই। দেখি বাতাসে ধ্বনিময় নদী দৌড়ে চলেছে। আমি নক্ষত্রের আলোয় নদী স্থাপন করি। জল আমার পা ছুঁয়ে দিলে দেখি আমি শুয়ে আছি অন্ধকার গৃহকোণগুলোর মৃত্যুসদনে। দেখি ধূলিধূসর প্রচ্ছদে ঢাকা আমার শরীর নদীজলস্রোতে ভেসে যাচ্ছে ইঁদুরের সুড়ঙ্গপথের দিকে।
৩.
পুরোনো বইয়ের নেশা আমাকে এতটাই বুঁদ করে তুলেছিল যে, কাগজ ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কম দামে কেনার মতো বই অনেক অনেকদিন পর শেষ হয়ে যায়। তখন আমি শহরের লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারা শুরু করি। লক্ষ করলাম, শহরের লাইব্রেরিটিই আসলে আমার বসবাসের একমাত্র ঘর। দেয়াল ও দরজা নেই, টয়লেটবিহীন; কেবল কতগুলো গৃহকোণের সমষ্টি এবং মৃদু আলো-বাতাস আসা-যাওয়ার একটি কপাটাভাঙা ঘুলঘুলিই তার স্থাপত্য। নিজেরই ঘরের কোনাকাঞ্চি থেকে পুরোনো বই চুরি করা রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হলো। কোনোদিন বই গাপ করে দিতে না পারলে বিশেষ কোনো পৃষ্ঠা কেটে বা ছিঁড়ে নিয়ে আসতাম। যেভাবে ধর্ষণের পর কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়, অথবা ক্রসফায়ারের মতো, একটা গুলিতেই হৃৎপিণ্ড ছেঁদা করে ফেলে। পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নেওয়ার বিষয়টিও আমার কাছে এমন শৈল্পিক হয়ে উঠেছিল যে, আমি আমারই একটি গৃহকোণ থেকে নিখোঁজ কণ্ঠস্বরচিহ্নিত দুর্লভ প্রাচীন বই অথবা বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে চুরি করে আরেক গৃহকোণে নিয়ে যাচ্ছি, বিড়ালের নিঃশব্দ মিউ মিউয়ে।
একদিন বই চুরি অথবা নিদেনপক্ষে বিশেষ কোনো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে আনবার জন্য উপস্থিত হয়েছিলাম লাইব্রেরির প্রায় পরিত্যক্ত অংশে। সেখানে অজস্র পুরোনো বইয়ের ছেঁড়া, ঝরে যাওয়া, ভাঙা টুকরো পৃষ্ঠা স্তূপীকৃত। কপাটভাঙা ঘুলঘুলি দিয়ে ছিটকে পড়া মৃদু আলো-অন্ধকারে ফাঙ্গাস, ব্যাকটেরিয়া, তুঁতে, ধুলো ইত্যাদির মিশ্রিত গন্ধ আমার শ্বাসপ্রশ্বাস মন্থর করে দেয়। সকল ইন্দ্রিয় বিবসিত হয়ে ওঠে। একটা হিম ঠান্ডা সরীসৃপ আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। মনে হয়, মিশ্রগন্ধ চিরে অসংখ্য চাপা কণ্ঠস্বর ফিসফিসিয়ে উঠছে। অনেক অনেকদিন অজস্র কোনাকাঞ্চিওয়ালা একটা অন্ধকার ঘরে একা থাকার অভ্যাস আমাকে অতিপ্রাকৃত ভয়ের কাছে কখনো পরাস্ত করেনি। হঠাৎ মাথার ভেতর ঘুম ঘুম ধাড়ি বিড়ালটা মিউ মিউ কান্না করে উঠলে ইঁদুরেরা আমার মাথার মিউ মিউয়ে গুলি ছোড়ে। ধাড়ি বিড়ালটার বিনবিনে মিউ মিউ রক্তস্রোতে ভেসে গেলে আমি মরে যাই। তবু শহর থেকে আচমকা নিরুদ্দেশ অথবা গুম কিংবা নিখোঁজ মানুষের স্মৃতি, স্বপ্ন ও কণ্ঠস্বরকে শব্দভাণ্ডারে রূপান্তরিত করার এবং কাগজে উৎকীর্ণ প্রাচীন একটি বই অথবা তারই বিশেষ একটি পৃষ্ঠা চুরির আকাঙ্ক্ষা আমাকে এতটাই আত্মমগ্ন করে তুলেছিল, আমি আমার মনের সকল ইচ্ছা একটি কেন্দ্রবিন্দুতে স্থির করলাম। স্মৃতি থেকে শহর, রাস্তার জনকোলাহল, লোকদেখানো ভদ্রতা, সামাজিকতার মানবিক গুণাবলি—সকল অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে দিলাম। এমনকি আমার ঘরের কোনাকাঞ্চিতে পোষা ইঁদুরের বিবিধ খেলাধুলা চাক্ষুস করা অথবা তাদের কুট কুট কুট শুনতে পাওয়ার মতো শ্রুতিটুকুও যেন আমাকে অন্যমনস্ক করতে না পারে, সেজন্য কানের অস্তিত্ব ভুলে গেলাম। সকল শ্রবণ শূন্যতাবোধে স্থির ও একাগ্র হয়ে এলে মনে হলো আমি তখন সম্পূর্ণ নির্ভার। চারপাশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তখন আমিই সেখানে একক, অদ্বিতীয়। আমি হাঁটতে থাকি লাইব্রেরির আরও প্রান্তবর্তী কোণের দিকে। ঘুলঘুলির অস্পষ্ট আলোয় আমার ছায়া কেঁপে ওঠে এবং চারপাশে নেমে আসে নিশ্ছিদ্র স্তব্ধতা। অন্ধকার ঘরের কোনাকাঞ্চিতে থাকার ফলে আমার দৃষ্টিশক্তি ছিল প্রখর। অস্তগামী সূর্যের বিলীয়মান মৃদু আলোর যেটুকু ঘুলঘুলি ভেদ করে ভেতরে আসতে পেরেছিল তাতে অন্ধকার হয়ে উঠেছিল আরও ঘণীভূত, তীব্র। তথাপি চারপাশে ছড়ানো বইয়ের ছিন্ন পৃষ্ঠার শব্দাবলি পড়তে আমার কোনো অসুবিধা হলো না। বরং পরস্পর সজ্জিত অক্ষরগুলো হয়ে উঠল আরও সজীব, আরও জীবন্ত ও ধ্বনিময়। কালো অক্ষরগুলো ফিসফিস কণ্ঠস্বরের বিচ্ছিন্ন কিছু স্বরলিপি ইঁদুরের কুট কুট কুট কুটে বেজে উঠল। ধীরে ধীরে সেসব কণ্ঠস্বর দীর্ঘদিন বাকরুদ্ধ ও বন্দি থাকার পর, মনে হলো, তারা আমার দরজা ও দেয়ালবিহীন গৃহকোণে রাতজুড়ে অঙ্কুরিত বীজের একখণ্ড মুখস্থ জীবনপ্রাণালি খুঁজে পেয়েছে। অন্ধকারের ঘন কুয়াশাভেদী সেসব কণ্ঠস্বর আমার শ্রুতিকে পরিপূর্ণ আচ্ছন্ন করে তোলে। আমি সকল নিরুদ্দেশ মানুষের বাকরুদ্ধ কণ্ঠস্বর বেজে ওঠা ছিন্ন পৃষ্ঠাগুলো নিজের অস্তিত্বের অংশ করে নিই। তবু আমার অস্বস্তি হতে থাকে। আমি অনুভব করি, আমার চারপাশে ছেঁড়া, রুগ্ন, ভাঙা পৃষ্ঠার ঘূর্ণিপাকে কুয়াশার দেয়াল বিস্তৃত হচ্ছে। সেসব ভাঙাচোরা, কীটদষ্ট, আগুনে পোড়া যন্ত্রণাকাতর পৃষ্ঠাগুলো এমনই অস্পৃশ্য, রাষ্ট্রের অবহেলিত জনগণের মতো অলক্ষ্যে সেসব পড়েছিল।
চারপাশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তখন আমিই সেখানে একক, অদ্বিতীয়। আমি হাঁটতে থাকি লাইব্রেরির আরও প্রান্তবর্তী কোণের দিকে। ঘুলঘুলির অস্পষ্ট আলোয় আমার ছায়া কেঁপে ওঠে এবং চারপাশে নেমে আসে নিশ্ছিদ্র স্তব্ধতা।
আচমকা ছায়া ছায়া নিবিড় অন্ধকারে আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ি। এই প্রথম আমার পতন ঘটে। এই প্রথম উপলব্ধি হলো আমার ক্রোধ। পতনের অনিবার্য পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর মনে হলো, আমার দুঃখ, বিষাদ, লজ্জা, ব্যথার অনুভূতি অথবা অসহায়ত্বের বোধ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। তখন মাথার ভেতর আচমকা রং বর্ণনা করতে না পারা ধাড়ি বিড়ালটা বাতাসবিদীর্ণ মিউ মিউ করে ওঠে। তার তীক্ষ্ণ কণ্ঠধ্বনি স্যাঁতসেঁতে বাতাসে মিহি সুতার মতো দুলতে থাকে। সে কি কান্না করছে? অন্ধকার আর ইঁদুরের সমুদ্র ঠেলে প্রস্থানপথের দিশা না পেয়ে সে কি চূর্ণ আয়নায় লক্ষ লক্ষ সিংহের হুংকারে আটক হয়েছে? অথবা মৃত্যু? দেখি ছায়া দ্রবীভূত অন্ধকারে বিড়ালটার কর্তিত লেজ লাফাচ্ছে। দেখি পোষা ইঁদুরগোষ্ঠী সুড়ঙ্গের ছায়ায় দলে-উপদলে চক্রকারে ঘুরছে। একটা অস্পষ্ট রংজ্বলা প্রচ্ছদের কোনা দেখে ভয় হয়। ভাঙাচোরা কাগজের স্তূপ আর ছায়ার বিস্তার থেকে বেরিয়ে আসে রংবেরঙের আলখাল্লা পরা আমার মৃত শরীর বয়ে বেড়ানো ফেরিওয়ালার মুণ্ডু। অতিশয় প্রাচীন কণ্ঠস্বরচিত্রিত বইয়ের মাঝে পুরোনো কাগজের ঝাঁকা মাথায় আমি দোমড়ানোমোচড়ানো তুলট কাগজ হয়ে পড়ে আছি। আমি তুলট কাগজের টুকরোগুলো তুলে নিতেই ইঁদুরের দল এক লাফে আমার মাথার ভেতর ধাড়ি বিড়ালটাকে হত্যা করে।
এভাবে আমার মাথার ভেতর বিনবিনে মিউ মিউ বারবার মরে গেলে দেখি কাগজ ফেরিওয়ালারা কত কিছু জানে। তারা বলে, ইঁদুরেরা পৃথিবীর সকল আলো ছেঁদা করতে পারে গুলি ছুড়ে। তারা যার খায় তারই সর্বনাশ করে। তারা কাগজ খায় আর গুলি হাগলে তাদের অজস্র গুলি আমার মিউ মিউ ছেঁদা করে দেয়, তখন প্রাচীন বইয়ের পৃষ্ঠায় নীল ময়ূরটি পাখা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে আমার মাথার ভেতর কোনাকার ঘরের কপাটভাঙা ঘুলঘুলি দিয়ে।
৪.
আমার সংগ্রহে যত প্রাচীন বই তত গৃহকোণ। এবং সেখানে তত ইঁদুরের হুল্লোড়। অনেক অনেকদিন পর, ইদানীং ইঁদুরগুলোর হৈ-হুল্লোড় অন্যান্য রাতের চাইতে উচ্চস্তরে পৌঁছালে মনে হয়, তাদের হৈ-হুল্লোড় আমার মৃত্যুজ্বরগ্রস্ত তন্দ্রার ভেতর রাষ্ট্রের সকল অভিযোগ ছাপিয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠছে। তবে ইঁদুরেরা নির্লজ্জ নয়, শরীরের গন্ধ তারা ভাসিয়ে দেয় বাতাসের স্থাপত্যে, তারা সারারাত কাগজ খায় আর হাগে লোকচক্ষুর আড়ালে। গুলি পটি করার সময় কি ইঁদুরেরা চিৎকার করে? ইঁদুরদলের চ্যাঁচামেচি অথবা কুট কুট কুট পটি করার শব্দের ভেতর, আমি অনুভব করলাম, আমার মাথার কোনাকাঞ্চিতে বিড়ালের মুণ্ডুকাটা লাশ জমে উঠছে। আমার গৃহকোণে চূর্ণ আয়নায় লক্ষ লক্ষ বিড়ালের মৃত মুণ্ডু ভেসে ওঠে। কোথাও বৃক্ষ ও মেঘ ভেঙে পড়ার শব্দ হয়। কোথাও দাহ্যমুখী স্ফুলিঙ্গের প্ররোচনাময় আত্মহত্যার শব্দ দৌড়ে যাচ্ছে। শব্দগুলো অভাবিত তন্দ্রার ছলছলে নদীর অতলে ডুবে থাকা শ্যাওলা মনে হয়। শব্দগুলো মিলিয়ে যায় অথবা নতুন শব্দের উত্তেজনায় ভাসতে থাকে। শব্দগুলো জোনাকি হয়ে ওড়ে। বিবিধ শব্দের ভেতর আমার শরীর মৃত্যুসদনে পরিণত হওয়ার আগেই আমি মাথার কোনাকাঞ্চির কপাটভাঙা ঘুলঘুলি আরও উন্মুক্ত করে দিই। যেন নক্ষত্রের আলো প্রতিফলিত হতে পারে একটি গৃহকোণের আয়নায়। দেখি ইঁদুরের পটি অথবা গুলিতে আয়না বিচূর্ণ। অতঃপর চূর্ণ আয়নাটি টেনে আনি আরেকটি গৃহকোণে—ঝড়ের খোঁজে। অতঃপর আরেকটি গৃহকোণে যাই—নদীর সন্ধানে। অতঃপর অন্য গৃহকোণে যাই—একটি ময়ূরপালকের খোঁজে।
কপাটভাঙা ঘুলঘুলির বাইরে দেখি শহরে উৎসব। সামরিক বন্দুকে আয়নায় প্রতিফলিত আলো গুলিবিদ্ধ করার শব্দে শহর উত্তাল।
কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যসমালোচক। জন্ম ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে, মেহেরপুর শহরে। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। ‘ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী’ [২০০৫] প্রথম গল্পগ্রন্থ। ২০১০ সালে প্রকাশ হয় দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘নির্জন প্রতিধ্বনিগণ’। তারপর ‘প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প’ [২০১১], ‘জোনাকিবাবুই’ [২০১৮] এবং উপন্যাস ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’ [২০১৪]। সম্পাদনা : ‘মাহমুদুল হক রচনাবলি’ [বাংলা একাডেমি, ২০২০] সমালোচনামূলক বই ‘মাহমুদুল হক : সৃষ্টি ও শিল্প’ [২০২১]।