মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

নাম তাঁর শ্রী মাহমুদুল হাসান মাছুম : বিপুল অধিকারী

0

‘ভুট্টা ক্ষেতজুড়ে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।
কোন মানুষজন দেখা যাচ্ছে না পেছনে,
তাহলে কে তাড়া করেছিল আমাকে?’

হ্যাঁ, কেউ কবিকে তাড়াই করেছিল সেদিন সাত-সকালে, যখন এই হা-মুখ শহরে আমাদের অনেকেরই শেষ রাতের কাঁচা ঘুম ভাঙেনি; কিংবা যখন অনেকেই আমরা ঘুম জড়ানো চোখ কচলে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছিলাম কর্মক্ষেত্রের দিকে; কিংবা দীর্ঘ জ্যামে আমরা কেউ কেউ আটকা পড়েছিলাম; আর এইরকম একটা সকাল আমাদের সকলকে, বিশেষত আমরা যারা কবির আত্মার নিকটবর্তী, খুব অপরাধী করে দিয়ে গেছে।

এই হা-মুখ শহরে আমাদের অনেকেরই শেষ রাতের কাঁচা ঘুম ভাঙেনি; কিংবা যখন অনেকেই আমরা ঘুম জড়ানো চোখ কচলে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছিলাম কর্মক্ষেত্রের দিকে; কিংবা দীর্ঘ জ্যামে আমরা কেউ কেউ আটকা পড়েছিলাম; আর এইরকম একটা সকাল আমাদের সকলকে, বিশেষত আমরা যারা কবির আত্মার নিকটবর্তী, খুব অপরাধী করে দিয়ে গেছে।

এই অপরাধ থেকে আমাদের কোনো মুক্তি নেই— মুক্তির পথ বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। যে মৃত্যু কবিকে তাড়া করেছিল— সেই মৃত্যুই শেষমেশ তাঁকে পৌঁছে দিল এক হিমঘরে, ধিরে এই ত্রস্ত নগরী থেকে অনেক দূরের এক মফঃস্বল শহরের তাজা সবুজ পিরানের নিচে, সোঁদা মাটির বিছানায়। চির ঘুমে। হায়! পালিয়ে যাবার সুযোগ কবি সেদিন আর পাননি। যেমনটি কবি নিজেই তাঁর এক কবিতায় বলেছেন—

‘প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
সুন্দর সুন্দর নরম স্পর্শকাতর
কষ্টগুলোর আর্তচিৎকার এড়িয়ে যাচ্ছি’

জীবদ্দশায় প্রতিনিয়ত তিনি পালিয়েই বেড়াতেন; স্পর্শকাতর অনেক কিছু থেকে গা বাঁচিয়ে, নোংরা কাদা-জল না মাড়িয়ে, ব্যস্ত নগরীর রংমাখা সংসদৃশ মানুষদের আড়াল করে তিনি তাঁর অষ্টপ্রহর সাজাতেন। তিনি নিরবতার ছত্রে ছত্রে তাঁর প্রখর আর সরব উপস্থিতির জানান দিতেন। খ্যাপাটে কিন্তু চিৎকার করতেন না; প্রতিবাদী, কিন্তু বড্ড সংযত তাঁর কন্ঠস্বর; বিনম্র তাঁর চলন। আমরা কবিকে এভাবেই পেয়েছি।

‘শহর প্রতিনিয়ত সাজ বদলায়

বদলায় বিদঘুটে অলিগলির ঠিকানা—
গ্রামের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই
নেই কোনো রং করা সাজ-সজ্জা।’

কাছে পাওয়ার কথা যদি বলি, আমি তাঁকে দলগত ভাবে কখনো নয়; সব সময় তাঁকে দৃশ্যত নিজ আড্ডাবলয়ের বাইরে, যে বলয়ে কবি অসীম দা থাকতেন, কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদ থাকতেন, অভিনেতা কচি খন্দকার থাকতেন, কবি টোকন ঠাকুর থাকতেন, ভব শতাব্দী থাকতেন, চারুপিন্টু, রেজা ভাই থাকতেন— এতসব চন্দ্রখোচিত মানুষজনের বাইরে আমি তাকে একা পেতাম।

তিনি দলগত সে আড্ডার মোড়ক ফেলে সমস্ত একা হয়েই আমার কাছে ছুটে আসতেন তাঁরই কবিতার মতো করে,

‘মানুষ দূরে সরে যেতে যেতে
ভীষণ রকম একা হয়ে যাক,
একা থাকতে থাকতে নিজেকে জানার চেষ্টা করুক’

হয়তো, তিনি একা হয়ে নিজেকে জানার জন্যই আমার কাছে আসতেন। আর আমি যেন তাঁর আয়না হয়ে উঠতাম। আমার সাথে তিনি তাঁর কবিতাভাবনার চেয়ে খুব বেশি একাকীত্বই ভাগাভাগি করতেন; তাঁর জীবনযাপনের নানা ছন্দপতনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতেন; পাওয়া না পাওয়ার কোনো অভিযোগ তাঁর ছিল না; উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো চতুরতা, ভনিতাকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না; একেবারে নিরেট অকপট ছিলেন তিনি। যতদিন গেছে অস্তাচলে, নিজের প্রতি তাঁর সীমাহীন অবহেলাই আমার কাছে বড়ো প্রকট হয়ে উঠেছে। আর বিপরীতে ঠিক ততটাই সিরিয়াস হতে দেখেছি অন্যের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে, বিশেষত পাহাড়ের নাম না-জানা অজস্র কোমলমতি ছেলেমেয়েদের জন্য, যারা ঢাকায় পড়ালেখা বা ক্যারিয়ারের জন্য অবস্থান করে বা ভবিষ্যতে করবে।

তাঁর জীবনযাপনের নানা ছন্দপতনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতেন; পাওয়া না পাওয়ার কোনো অভিযোগ তাঁর ছিল না; উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো চতুরতা, ভনিতাকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না

সে আর এক অদ্ভুত ভাবনা তাঁর! অভাবনীয়!!

পাহাড় যেন তাঁর রক্তে প্রেয়সীর মতো চুম্বন এঁকে দিত হরহামেশা। এ দিবালকের মতো সত্য আর প্রবল প্রকাশ্য। আমরা কে না জানতাম সে প্রেমের আখ্যান। তাঁর শরীর, হয়তো, এই সমতলে পড়ে থাকত; কিন্তু তাঁর ভেতরটা দিবানিশি পড়ে থাকত পাহাড়ে পাহাড়ে। তিনিই তো এমন করে লিখতে পারেন—

‘পাহাড়ে অব্যহতি নিয়ে
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে দিনের ইচ্ছে—
আর দুহাতে দুটো চাঁদ নিয়ে
রাতভর দাঁড়িয়ে থাকে ঈশ্বর।’

তাই তো পাহাড়ের সেইসব কোমলমতি ছেলেমেয়েরা তাঁকে পিতাই মানতো। আমার কাছে তিনি যখন নিরেট একা হয়ে আসতেন, এক সন্তানের কাছে যেন তিনি আর অন্য সন্তানদের ভালোমন্দর ফোয়ারা ছুটাতেন।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে সব শুনতাম; আর মানসপটে সেইসব কমলমতিদের সারল্যগাথা জীবনের নানা ছবি এঁকে নিতাম। এবং তাদের চাক্ষুস করার জন্য একবার কবির কাছে আবদারও করেছিলাম, ‘ভাই, একবার পাহাড়ে যেতে চাই। নিবেন আমারে?’ তিনি হেসেছিলেন, প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন; কিন্তু হলো না। হয়তো হবে কখনো। কিন্তু তাঁর মতো করে কখনো হবে না আর— এ আমি জানি।

মাছুম ভাইয়ের কবিতা? হ্যাঁ, কবিতাই তো। মাছুম ভাই কবিতাই লিখতেন। সেসব কতটুকু কবিতা হয়ে উঠত বা শেষ পর্যন্ত সেসব অকবিতা কি না— তা আগামী সময় নির্ণয় করুক, বরাবর অন্য কবির বেলায় যে রকম করেছে। সময়ের চেয়ে নিশ্চয় আমরা বড়ো কোনো বিচারক নই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাছুম ভাইয়ের কবিতা পছন্দ করতাম; এখনও যেমন করি। আর পছন্দ করি বলেই তাঁর ‘বংশোদ্ভূত জোনাকির শহর’-এর প্রকাশনার পেছনের কারিগর হতে পেরেছিলাম। সে বড়ো কৃতিত্বের বিষয় তো কিছু নয়। আমি তাঁকে একজন প্রকৃত কবি হিসাবেই সময়ের পিঠে প্রখর আঁচড় কাটতে দিতে চেয়েছিলাম। হয়তো দিয়েছেনও।

কখনো কখনো, বলা যায়, একরকম জোর করেই তাঁর কাছ থেকে কবিতা চেয়ে নিয়েছি। আর সেসব কবিতা পশ্চিম বাংলার জানাশোনা লিটল-ম্যাগ-সম্পাদক বরাবর পাঠিয়েছি। সম্পাদকগণ সাদরে সে সব প্রকাশও করেছেন। তবে এসব তিনি মনেপ্রাণে কখনই চাইতেন না। পরে যেন আর না চাই, তাই পালিয়ে বেড়াতেন। নক দিলে রেসপন্স করতেন না। বড়ো অদ্ভুত এক কবিজীবন তাঁর! বড়ো নির্লিপ্ত, সম্মোহনহীন। আবার বিকেন্দ্রিক। তাই তো, পশ্চিমবাংলার লিটল ম্যাগে কবিতা প্রকাশের ব্যাপারে তিনি বরাবর নাখোশ ছিলেন। তিনি একদমই চাইতেন না এসব। আমাদের ঢাকাকেই তিনি বাংলা সাহিত্যের রাজধানী বলে মানতেন। ওপারের দাদাগিরি তাঁর দু চোখের বিষ ছিল। পরে আমি তাঁকে আর উত্যক্ত করিনি। তাঁর বেদনার কারণ হয়ে আর দাঁড়াইনি কখনো। আলগোছে এড়িয়ে গেছি। জেনে বুঝে আর আঘাত করিনি কবিকে।

‘যত ইচ্ছে আমাকে আঘাত করো
বিলুপ্ত নদীর চিত্রকর্ম হয়ে বেঁচে থাকবো—
তবুও আমার কবিতাকে দুঃখ দিও না কখনো
ভেজা শালিকছানার মতো
কুঁকড়ে অনায়াশেই হঠাৎ মরে যাব।’

মাছুম ভাইয়ের আরেকটি শক্ত দিক আছে— তা হলো তাঁর ইজম ভাবনা। আমি কখনই তাঁকে বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত হতে দেখিনি। সে পলিটিক্যালই হোক বা জাতিগত প্রশ্নেই হোক। একবার হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক কাণ্ড করে ফেললেন মাছুম ভাই। ফেসবুকের প্রোফাইলে তিনি তাঁর নামের পূর্বে ‘শ্রী’ যুক্ত করে দিলেন। লিখলেন, শ্রী মাহমুদুল হাসান মাছুম। অন্যদের চোখে বিষয়টি পড়েছে কি না, আমার জানা নেই। এই হলেন আমাদের মাছুম ভাই। তিনি যে একই সাথে সমতলের আবার পাহাড়েরও— একই অঙ্গে শিব আবার পার্বতী— তেমনি তিনি যেমন মুসলমানের আবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, সাঁওতালেরও। তিনি দেশেরও যেমন, তেমনই আন্তর্জাতিকও। সর্বোপরি, মানুষ সত্যই তাঁর প্রকৃত রূপ— এ আমরা সকল বন্ধুজন বুঝেছিলাম অন্তর দিয়ে।

একজন প্রকৃত কবিতাকর্মী বা কবির তাই তো হবার কথা। তিনি তা হয়েছিলেনও। কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায়, আড্ডায়, লেখালেখিতে তার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন। তাঁরই কবিতায় আছে সেই প্রতিধ্বনি—

‘বিপ্লবের প্রেক্ষাপট অনুপস্থিত—
পুঁজির ফাঁদে আটকে গেছে বিপ্লবীদের অস্তিত্ব
রাষ্ট্র খারিজ করেনি আমাকে—একটা প্লাস্টিক পরিচয়পত্র দিয়েছে মাত্র
বিনিময়ে খারিজ করেছি রাজনীতিকে।’

আমাদের কবি মাছুম ভাইও ওই বয়সের শারীরিক কাঠামো নিয়ে কোনো না কোনো ভাবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগতভাবে। এ আমি জেনেছি অকপটে তাঁর নিজকন্ঠেই, যখন তিনি খুব একাকী হয়ে আমার কাছে এসেছেন, গাল-গপ্পে মেতেছেন পারিপার্শ্বিকতা ভুলে। কাজেই, তিনি একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু বাস্তব এই, তিনি সগৌরবে নিজেকে কখনোই মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেননি।

যে বয়সে কবি প্রয়াত হলেন, খেয়াল করলে দেখবেন, সেই বয়সের সকলেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষকারী। সজ্ঞানে। সমহিমায়। কেননা, তখন তাদের বয়স হয়তো ১২, ১৩ বা ১৪। আমাদের কবি মাছুম ভাইও ওই বয়সের শারীরিক কাঠামো নিয়ে কোনো না কোনো ভাবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগতভাবে। এ আমি জেনেছি অকপটে তাঁর নিজকন্ঠেই, যখন তিনি খুব একাকী হয়ে আমার কাছে এসেছেন, গাল-গপ্পে মেতেছেন পারিপার্শ্বিকতা ভুলে। কাজেই, তিনি একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু বাস্তব এই, তিনি সগৌরবে নিজেকে কখনোই মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেননি। যদি করতেন, আর কোনো প্রকারে মুক্তিযোদ্ধার লিষ্টে নাম লেখাতেন, হয়তো পারতেনও, সে পলিটিক্যাল যোগাযোগ তার ছিলও; তবে নিশ্চয়ই গার্ড অব অনার নিয়েই কবরে যেতে পারতেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। এতটাই নির্লিপ্ত ছিলেন আমাদের মাছুম ভাই। কবি শ্রী মাহমুদুল হাসান মাছুম ভাই।

‘এখনই মোক্ষম সময়
বিরতির পর পালিয়ে যাবার—
নদীর জল নেমে গেছে অতি দূরে,
শুন্য খাঁ-খাঁ বালির মাঠ পেরিয়ে
পৃথিবীর বিরল উপত্যকায় এসো—
এসো নির্জন জোছনার ছায়া মারিয়ে।’

[হিমঘরে পাখিসঙ্গ/বিরল ইচ্ছে]

প্রিয় মাছুম ভাই, হে সখা, আমরাও, আপনার বন্ধুজন, এই নির্জন জোছনার ছায়া মাড়িয়ে, শূন্য খাঁ-খাঁ বালির মাঠ পেরিয়ে, অতিদূর নেমে যাওয়া নদীর জল ছুঁয়ে একদিন ঠিক পৌঁছে যাব সেই বিরল উপত্যকায়। অপেক্ষায় থেকো বন্ধু!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।