বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

জনিক নকরেক : আমার অসম্পূর্ণ এক গল্পের নায়ক : সাদিকা রুমন

0

মান্দিদের আদি ধর্ম সাংসারেক অনুসারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে গণ্য হন তিনি। যৌবনে অনেক ঘুরে বেড়ালেও জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো পাতাঝরা বনগুলোর একটি মধুপুর শালবনের এক প্রাচীন গ্রাম চুনিয়ায়। পরে চুনিয়াই ছিল তাঁর পৃথিবী। এই পৃথিবী বিস্তৃত হয়েছে তাঁর গ্রামবাসী থেকে শুরু করে দেশ ও দেশের বাইরের অগণিত শ্রেণি-পেশা-লিঙ্গ-ধর্ম-জাতির মানুষের মধ্যে। উন্মুক্ত সংহতির এই জ্ঞানবলয়ে জনিক নকরেক পেয়েছেন দার্শনিকের মর্যাদা। ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। 

জনিক নকরেকের প্রয়াণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘শ্রী’ একটি আয়োজনের ঘোষণা দেয় সেসময়। কিন্তু পর্যাপ্ত লেখা না পাওয়ায় পুরো আয়োজনটি আর সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। সাদিকা রুমনের এই লেখাটি তিনি শ্রী-র অনুরোধে তখন লিখে পাঠিয়েছিলেন। আমরা অপেক্ষা করছিলাম যদি আরও কিছু লেখা পাওয়া যায়! যায়নি। তাই সম্পূর্ণ একটি সংখ্যার পরিকল্পনা বদলে আচ্চুকে নিয়ে ভালো লেখা পাওয়া সাপেক্ষে আমরা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

সাংসারেকের শেষ পুরোহিত জনিক নকরেক, প্রিয় আচ্চুর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাই।


দিন তারিখ ঠিক করে স্মরণ নেই। হেমন্তের কোনো এক দিনে বেঁচে থাকার দৃশ্যহীন দলিলে অদ্ভুত এক অধ্যায়ের সংযুক্তি ঘটে।

সন্ধ্যা নেমেছে তখন। মধুপুরে থেমে যান বদল করে উঠি একটা সিএনজিতে। ও পথটা অচেনা নয়। বরং শৈশবের স্মৃতি জড়ানো খুব আবেগভরা একটা পথ। তবু সেই সন্ধ্যায় মধুপুর অচেনা ঠেকে। বহু চেনা ময়মনসিংহগামী পথটাও পাতলা অন্ধকারে অচেনাই হয়ে যায়। আমরা ছিলাম দুজন। কেউ-ই কোনো কথা বলি না। নিঃশব্দে ঢুকে যাই অন্য এক পৃথিবীর ভেতর অন্ধকার এক সুরঙ্গ দিয়ে। সুরঙ্গ ভেদ করে, অন্ধকারে ভীরু আলো ফেলে ফেলে এগিয়ে চলছে সিএনজি।

চিঠিদিনের জীর্ণ সাক্ষ্যকে বাঁচিয়ে রাখা পোস্ট অফিসটার সামনে আমরা নামি। পরাগ দা আর অলিভার আমাদেরকে নিয়ে যেতে এসেছিল। কিছুদূর হেঁটে এসে ব্রিজটার ওপর দাঁড়াই। ঠিক সে মুহূর্তটাতে একটা দৃশ্যই গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছিল। আর কিছু সত্য নয়, আর কিছু মূর্ত নয়। সে দৃশ্য জুড়ে ছিল—এক আকাশ তারা আর এক পৃথিবী জোনাকি। অথবা এক পৃথিবী তারা আর এক আকাশ জোনাকি। এই দৃশ্যটাকে চিরকালের মতো চোখে গেঁথে নিয়ে গল্পের সে গ্রামটাতে প্রবেশ করি। চুনিয়া।


আচ্চু

সাংসারেক ধর্মের শেষ পুরোহিত জনিক নকরেক


সেই স্বপ্নগ্রাম জীবনের নতুন একটা অধ্যায়ই শুধু নয়, আমার ভাবনার ঘরেও বড়ো একটা বদল ঘটিয়ে দেয়। হিমসন্ধ্যায় টিমটিমে আলোজ্বলা এক উঠোনে গিয়ে উঠি। সে যেন সত্যি ‘হেথা নয়, অন্য কোথা!’ বাড়িটা জনিক আচ্চুর। মাটির গাঁ ঘেঁষে যিনি রচনা করেছেন মহত্তম এক বেঁচে থাকা।

চুনিয়া গ্রাম আমাকে আশ্চর্য করে। আশ্চর্য করে প্রতিটি মানুষ। বৃক্ষ। এমনকি রোদ। কেন যেন মনে হতে থাকে, আশ্চর্য স্বচ্ছ এ রোদ; আলো আর ছায়ার বিভাজন যেন এখানে ভীষণ সুস্পষ্ট। এই আলো, এই রোদ, এই ছায়া এই বৃক্ষের নির্যাস নিয়ে একশ বছরেরও অধিক কাল সূর্যকে করপুটে নিয়ে হেঁটে চলছেন যে প্রগাঢ় প্রপিতামহ তিনি আমার জীবনবোধে নতুন একটা মুখ উন্মুক্ত করেন, পরবর্তী জীবনের সঙ্গে গভীর এবং উল্লেখযোগ্য দিকচিহ্ন হয়ে থেকে যান।

কিন্তু আচ্চু কিংবা তাঁর গোষ্ঠীর এতে অনুযোগ নেই। আচ্চু চেয়েছেন, তাঁর কথা-অভিজ্ঞতা-আচারকে সময় দলিল হিসেবে টিকিয়ে রাখুক। দেওয়ার মতো স্থানের সংকট নেই আচ্চুর। উন্মুক্ত তাঁর উঠোন, উদার তাঁর বারান্দা-ঘর। তাঁর ঘর-বারান্দা বন পর্যন্ত বিস্তৃত। বনও তাঁর ঘর।

জনিক নকরেক এবং চুনিয়া গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছুনোর পেছনে নিতান্ত ব্যক্তিস্বার্থই কারণ ছিল। যেমন হয়ে থাকে—গবেষণা। সত্যি বলতে, এই উদ্দেশ্যটি আমাকে আড়ষ্ট করত। কিন্তু আচ্চু কিংবা তাঁর গোষ্ঠীর এতে অনুযোগ নেই। আচ্চু চেয়েছেন, তাঁর কথা-অভিজ্ঞতা-আচারকে সময় দলিল হিসেবে টিকিয়ে রাখুক। দেওয়ার মতো স্থানের সংকট নেই আচ্চুর। উন্মুক্ত তাঁর উঠোন, উদার তাঁর বারান্দা-ঘর। তাঁর ঘর-বারান্দা বন পর্যন্ত বিস্তৃত। বনও তাঁর ঘর। আর এই ঘর-বারান্দা-বন মিলেই তাঁর ধর্ম। যে ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে ইহলৌকিক মঙ্গল এবং প্রাণ-প্রকৃতির মঙ্গল। সেই ধর্মটাকে বয়ে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত হেঁটে গেছেন নিঃসঙ্গ পথে। শত বছরেরও বেশি তিনি পায়ের পাতায় নিঃসঙ্গতা বয়ে হেঁটেছেন। সে পথে আর কেউ হাঁটেনি। যারা হাঁটত তারা ছেড়ে গেছে। তিনি একা রয়ে গেছেন প্রহরী হয়ে, রক্ষক হয়ে। নিরলস বলে গেছেন তাঁর হেঁটে আসার গল্প, বিশ্বাস আর যাত্রার গল্প। সে গল্প জেনেছে পৃথিবী। পৃথিবীর কেউ কেউ। যারা জেনেছে, ভিন্ন উৎস থেকে আসা এই আলোটুকু আমূল জানতে তারা উদগ্রীব হয়েছে। অনুভব করেছে, এ গল্প ভিন্ন এবং এ গল্প প্রয়োজনীয়। পৃথিবীর জন্য। অস্থির এই পৃথিবীর জন্য। জনিক নকরেক যে ধর্মের কথা বলেন তা কেবল ধর্ম নয়, প্রকৃতির পাঠ। তাঁর সেই ধর্ম, সেই আদিধর্ম সাংসারেক বস্তুত আমাদের নিয়ে যায় জীবন এবং প্রকৃতির কাছে। জীবনকে ঘিরেই এর আচার, প্রকৃতিকে ঘিরেই প্রকাশ।

মুমূর্ষু ধর্মটিকে সহমরণে নিয়েই তিনি চিতায় উঠলেন। চিতা নিবে গেল। কিন্তু জনিক নকরেক আর তাঁর জীবনধর্মের আভা লেগে রইল চরাচরে। হয়তো অনুসরণ করার পথিক রইল না, কিন্তু জানতে চাওয়া, খুঁজে বেড়ানো একান্ত বন্ধু, উৎসুক আগন্তুক রইল বলেই বিশ্বাস করি। যারা প্রকৃতির এই কোলের সন্তান আর তাঁর জীবনধর্মকে খুঁজতে খুঁজতে হয়ে পড়বে পৃথিবীরই আপনজন।


আচ্চু ৪

আসমা বীথির তোলা আলোকচিত্রে জনিক নকরেক


দৃশ্যমান সেই গল্পগুলো পৃথিবীর জানা। সেই জানার পুনরাবৃত্তিতে যেতে চাই না, আমি কেবল সেটাই বলতে চাই যা আমার অন্তর্গত। যাদের সৌভাগ্য হয়েছে জনিক নকরেককে কাছ থেকে দেখার তাঁরা প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনোভাবে ঋদ্ধ হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। ব্যক্তি আমার ক্ষেত্রে বলব, তিনি স্পর্শ করেছেন আমার চৈতন্য। তিনি এবং তাঁর গ্রাম।

যেখানে গেলে মনে হয়, আমিও এই প্রকৃতিরই ছোট্ট একটা অংশ। তাঁর কাছাকাছি গিয়ে আমারও মনে হয়েছে, ‘এই বন যে আমার মাগো আমি তারই ছেলে’ কিংবা ‘এই বন যতদূর ঠিক ততদূর আমার বাড়ি’। বনের বেদনা বুকে এসে বেজেছে আরও বেশি করে।

আক্ষরিক অর্থেই জনিক নকরেক আর চুনিয়া গ্রাম পৃথিবীর দিকে আমার তাকাবার ভঙ্গিটির বদল ঘটিয়েছে। তাঁকে দেখার আগে প্রকৃতিকে আমি দেখেছি দর্শক হয়ে। কিন্তু তিনি নিয়ে গেছেন প্রকৃতির অন্তঃস্থলে। যেখানে গেলে মনে হয়, আমিও এই প্রকৃতিরই ছোট্ট একটা অংশ। তাঁর কাছাকাছি গিয়ে আমারও মনে হয়েছে, ‘এই বন যে আমার মাগো আমি তারই ছেলে’ কিংবা ‘এই বন যতদূর ঠিক ততদূর আমার বাড়ি’। বনের বেদনা বুকে এসে বেজেছে আরও বেশি করে। হয়েছে অপরাধবোধ—দূরের শৈশবে টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহগামী সড়ক দিয়ে যেতে যেতে বাসের জানালা দিয়ে মান্দি শিশুদের দেখতাম কিংবা মান্দি মানুষদের। অচেনাকে দেখার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। আমরা নই, ‘অন্য কেউ’ ভেবে সেই তাকানোটুকু আমাকে অপরাধী করে। যদিও তা শৈশবের, পরিপক্ক বোধ জন্মাবার আগে। সেই দৃষ্টি বিসর্জন দিয়েছি অনেক আগেই। তবু জনিক নকরেক পাশে বসার জায়গাটুকু দিয়ে, ‘আম্বি’ বলে ডেকে নতুন করে জানিয়ে দেন, আমি তাঁদেরই লোক। তিনি আমার কাছে গল্প হয়ে ওঠেন। চুনিয়া আমার কাছে গল্প হয়ে ওঠে। জনিক নকরেক আমার অসম্পূর্ণ এক গল্পের নায়ক। যে গল্প আমি অহর্নিশ বয়ে বেড়াই পৃথিবীকে বলবার ইচ্ছা নিয়ে।


আরও পড়ুন : জনিক নকরেককে নিয়ে আসমা বীথির লেখা : গানচিরকার আগুন


তিনি আমার কাছে বিস্ময়কর এক পুস্তকও বটে। বিস্ময়কর এবং বিরল। সময় এবং প্রকৃতির অনন্ত পাঠ যাতে ধৃত। পুস্তকটি যতই পাঠ করা হবে, যতই তাঁর কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে ততই লাভ এই পৃথিবীর। অনাড়ম্বর এক জীবনে তিনি ধারণ করেছিলেন প্রকৃতিলব্দ অসীম জ্ঞান। যে জ্ঞান ভার চাপিয়ে দেয় না, স্বাতন্ত্র্য আর শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা তৈরি করে না। কেবল মনকে এগিয়ে নিয়ে যায় সহজ এক জীবনের উঠোনের দিকে।

শত যোগ কুড়ি বছর ধরে লিখে চলা জীবন্ত পুস্তকটির পৃথিবীজীবন শেষ হয়েছে। অগণিত কথা, ব্যথা, অসমোঝতা, সংগ্রাম, নিঃসঙ্গতা চোখ বুজে উঠে গেছে চিতায়। কাছ থেকে দেখিনি। দূর থেকে দেখেছি সে চিতার আগুন। আর ভেতরে কে যেন তাড়া দিয়েছে, অসম্পূর্ণ গল্পটা এবার বলো। তাঁকে পৌঁছে দাও আরও ঢের মানুষের কাছে। তাঁকে জানা ফুরিয়ে যায়নি এখনো। বরং শুরু হলো জানার।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম টাঙ্গাইল জেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে তিনি এম. ফিল করছেন ‘গারো জাতিগোষ্ঠী: সংস্কৃতি, সাহিত্য ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি’ নিয়ে। কবিতা দিয়ে শুরু করলেও শিশুসাহিত্যের প্রতিই তাঁর মূল আগ্রহ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।