বাস্তবতাটা এখন বোধহয় মেনে নেওয়াই ভালো। ফুটবল তার ভূ-রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা হারাতে বসেছে।
মার্কিন সাংবাদিক ফ্রাঙ্কলিন ফয়্যার ২০০৪ সালে একটা বই লিখেছিলেন। শিরোনাম ছিল: ‘ফুটবল কীভাবে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করে: বিশ্বায়নের একটি অসম্ভাব্য তত্ত্ব (How soccer explains the world: an unlikely theory of globalization)। বইটিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ফুটবল খেলার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর আলোকপাত করেছিলেন তিনি। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উদাহরণ তুলে ধরে ফুটবলের বৈশ্বিক রূপটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন ফয়্যার, বিশেষ করে বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে এটি কী ভূমিকা রাখছে সেটি। বিখ্যাত সেই বইয়ের শিরোনামকে পাল্টে দিয়ে এখন বলতে হবে: ফুটবল এখন আর বিশ্বকে ব্যাখ্যা করছে না। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত আসরটি থেকেই বিশ্বকাপের ভূ-রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা হারানোর পালা শুরু। এ আসরটিই দেখিয়েছিল, বৈচিত্র্য হারিয়ে গোটা দুনিয়া কীভাবে অভিন্ন একটি স্থান হয়ে উঠছে।
নিশ্চিতভাবেই একটি বিশাল পরিবর্তন এটি, কারণ ঐতিহ্যগতভাবেই বিশ্বকাপ ছিল একটি ভূ-রাজনৈতিক উৎসব। ১৯৩০-এ যাত্রা শুরু হয় এর, ঠিক একই সময়ে উদ্ভব ঘটেছিল ফ্যাসিবাদেরও। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য বছর দশেক বন্ধ থাকার পর উন্মাতাল জাতীয়তাবাদের রঙে রঙিন হয়ে ফের যাত্রা শুরু করে বিশ্বকাপ। জার্মানির হাতে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় দেশগুলো তখনও জার্মানির ওপর ক্ষুব্ধ, যেটি খেলার মাঠেও প্রতিফলিত হলো। ওদিকে লাতিন আমেরিকান দেশগুলো তখনও ফ্যাসিবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭০-এর আসরে আফ্রিকার দেশগুলো প্রথমবারের মতো দৃশ্যপটে আবির্ভুত হবার পর জাতীয়তাবাদের ধুয়া তোলার জন্য বিশ্বকাপকে ব্যবহার শুরু করে আফ্রিকার ক্ষমতাসীন নানা সরকার।
ভূ-রাজনীতির ব্যাপক ছাপ পড়তে থাকে বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপ প্রভাবিত করে রাজনীতিকে। ১৯৬৯ সালের কথা। পরবর্তী বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বিতর্কিত তিনটি ম্যাচকে ঘিরে সত্যি সত্যি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এল সালভাদর ও হন্ডুরাস।
ভূ-রাজনীতির ব্যাপক ছাপ পড়তে থাকে বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপ প্রভাবিত করে রাজনীতিকে। ১৯৬৯ সালের কথা। পরবর্তী বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বিতর্কিত তিনটি ম্যাচকে ঘিরে সত্যি সত্যি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এল সালভাদর ও হন্ডুরাস। সে সময় ইউরোপের অনেক দেশের কাছেই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হিসেবে বিবেচিত হতো পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচটি। ১৯৭৪ সালের ফাইনালে জার্মানদের কাছে পরাজয়টি ছিল ক্রীড়া ক্ষেত্রে ওলন্দাজদের সবচেয়ে বড়ো জাতীয় বিপর্যয়। উইম ভ্যান হানেগেম নামে এক ডাচ মিডফিল্ডারের বাবা ও দশ বছর বয়সী ভাইসহ পরিবারের ছয় সদস্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বোমাবর্ষণে প্রাণ হারিয়েছিল। ইংল্যান্ড ফুটবল দলের অনানুষ্ঠানিক সংগীত থ্রি লায়ন্সের মূল উপজীব্যও জামানির কাছে পরাজয়। এরকমই অনেক তিক্ততার সাক্ষী হয়ে আছে সে সময়ের বিশ্বকাপের আসরগুলো। উগ্র জাতীয়তাবাদের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ছিল ‘বিপক্ষ দল চুরি করে জিতেছে’—এ মানসিকতা। ১৯৬৬-র আসরে আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর ইংল্যান্ডের কোচ আলফ রামজে আর্জেন্টাইনদের ‘পশু’ বলে গালি দিয়েছিলেন। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারণেই টুর্নামেন্ট থেকে তাদের বিদায় ঘটেছিল বলে মনে করত সিংহভাগ পর্তুগিজ আর আর্জেন্টাইন। ১৯৮২-র বিশ্বকাপে সোভিয়েতদের দখলে থাকা পোল্যান্ডের কয়েকজন ফুটবল সমর্থক পোল্যান্ড-সোভিয়েত ইউনিয়নের ম্যাচে একটা ব্যানার নিয়ে যায় যাতে স্রেফ লেখা ছিল—‘সলিডারনস্ক’, যা ছিল পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত বিখ্যাত ট্রেড ইউনিয়নের নাম। সে ম্যাচ ড্র করে পরবর্তী রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল পোল্যান্ড।
আজ কয়েক দশকের ব্যবধানে কোথায় হারিয়ে গেল উত্তেজনার বারুদে ঠাসা, যুদ্ধের গন্ধমাখা সেসব দিন!
এখন যুযুধান দুই দলের সমর্থক পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে খেলা দেখে, একসঙ্গে ভুভুজেলা বাজায়, একে অন্যের সঙ্গে জার্সি বিনিময় করে। টিভি ক্যামেরা তাদের দিকে তাক করা হলে দুজনে মহানন্দে একসঙ্গে হাত নাড়ে। জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা থেকে বিশ্বকাপ রূপ নিয়েছে এখন সার্বজনীন মহোৎসবে। কেউ আর এখন জার্মানিকে ঘৃণা করে না, বরং তাদের দলটি এখন বহুজাতিকতার বিজ্ঞাপন। দখলদার কোনো দেশ এখন দখলকৃতের সঙ্গে খেলছে না। লৌহ যবনিকার আড়ালে থাকা দেশ উত্তর কোরিয়া নাকি ২০১০ বিশ্বকাপে চীনা নাগরিকদের পাঠিয়েছিল উত্তর কোরিয়ার সমর্থক সাজিয়ে। তবে পর্তুগালের কাছে ৭-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়ার সময় চুপচাপই চলে গিয়েছিল। এখন আর বিশ্বকাপের মঞ্চ ছেড়ে চলে যাবার সময় ষড়যন্ত্রের অভিযোগে চেঁচামেচি করে না কোনো দল।
কীভাবে ঘটল এ ঘটনা?
প্রথমত, পৃথিবীই বদলে গেছে। একুশ শতকের প্রথম দুই দশকে একনায়ক, উগ্র জাতীয়তাবাদ, দেশে দেশে যুদ্ধ, ধূমায়িত অসন্তোষ—এগুলোর প্রকোপ অনেকটাই কমে আসে। এ সময়ের বেশিরভাগ যুদ্ধই গৃহযুদ্ধ।
২০১০ সালে স্পেন যে তিকিতাকা বা অন্তহীন পাসনির্ভর খেলা খেলে বিশ্বকাপ জয় করল সেটি কিন্তু তাদের নিজস্ব শৈলী নয়। এটি তারা পেয়েছে বার্সেলোনায় খেলতে আসা ওলন্দাজ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে। যেসব দেশ অন্য দেশের স্টাইলকে আয়ত্ত করতে পারেনি তারা খারাপ করছে। তাই বলে বলছি না ফুটবল থেকে জাতীয়তাবাদী জজবা ধুয়েমুছে গেছে, তবে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের জয় মানেই জয়ী জাতির শ্রেষ্ঠত্ব—এমন দাবি এখন আর কেউ করে না।
ফুটবলও বদলে গেছে। একসময় বিশ্বকাপের আসরে নিজস্ব ফুটবল শৈলীর পসরা মেলে ধরতে আসত বিভিন্ন দেশ। ওলন্দাজরা ছিল আক্রমণাত্মক, ইতালিয়ানরা রক্ষণাত্মক, জার্মানরা বাজে খেলেও জিতত, লাতিন আমেরিকানরা বল নিয়ে কারিকুরি করত, ইংরেজরা হাঁসফাঁস করত আর হারত। প্রতিটি দল মনে করত অন্য দলের স্টাইল হয় অনৈতিক নয়তো অশুভ। এখন কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেছে। বিশ্বকাপে এখন বিশ্বায়নের জিকির। কম বেশি সবাই এখন একই স্টাইলে খেলে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, প্যারাগুয়ের মতো দলও এখন ইউরোপের একঘেয়ে, সুসংগঠিত স্টাইল আয়ত্ত করেছে। মনে হচ্ছে আধুনিক ফুটবলে ভালো করার চাবিকাঠি এখন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জাতীয় শৈলীকে কম গুরুত্ব দেওয়া। উদাহরণ স্বরূপ, ২০১০ সালে স্পেন যে তিকিতাকা বা অন্তহীন পাসনির্ভর খেলা খেলে বিশ্বকাপ জয় করল সেটি কিন্তু তাদের নিজস্ব শৈলী নয়। এটি তারা পেয়েছে বার্সেলোনায় খেলতে আসা ওলন্দাজ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে। যেসব দেশ অন্য দেশের স্টাইলকে আয়ত্ত করতে পারেনি তারা খারাপ করছে। তাই বলে বলছি না ফুটবল থেকে জাতীয়তাবাদী জজবা ধুয়েমুছে গেছে, তবে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের জয় মানেই জয়ী জাতির শ্রেষ্ঠত্ব—এমন দাবি এখন আর কেউ করে না। এটা এখন স্রেফ মজামাস্তিতে মেতে ওঠার উপলক্ষ্য। ২০০৬ বিশ্বকাপের সময় ‘ডয়েসল্যান্ড’ স্লোগানে রাস্তাঘাটে উল্লাস করার মাধ্যমে ‘আনন্দ উল্লাসের জাতীয়তাবাদ’ (Carnival nationalism) নামে নতুন ব্র্যান্ডের জাতীয়তাবাদ উদযাপন করে জার্মানরা। এই জাতীয়তাবাদ কারো জন্য ভয়ের কারণ ছিল না। তাদের নিজেদের জন্য তো নয়ই।
ফুটবলের বিশ্বায়ন যদি বদলে যাওয়া এই ধারাকে ধরে রাখতে পারে তাহলে কেবল খেলাটির জন্যই নয়, গোটা পৃথিবীর জন্যই সেটি হবে ইতিবাচক একটি ব্যাপার।
[নোট: ফরেন পলিসি পত্রিকায় সাইমন কুপারের ‘সকার এক্সপ্লেইনস নাথিং’-এর আংশিক অনুবাদ]
জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।