বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

নাটুয়ারপাড়া-২ : মুহাম্মদ শাওয়াব

0

যেখানে শহরের শেষ, সেখান থেকেই শুরু এই নদী। যেন তার সমস্ত সন্তাপ নিয়ে বসে আছে। বিহ্বল হাওয়ার পিঠ থেকে নেমে নদী থেমেছে নাটুয়ারপাড়া খেয়াঘাটে। এই খেয়াঘাট তার রূপ দেখায় একান্ত গোপনে।

নিঃসঙ্গ সাউন্ডবক্সের গান ছাপিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনের মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হাটের পরদিন। নৌকার আনাগোনা তুলনামূলক কম৷ এমন দিনে ক্লান্তি ঝেড়ে নাটুয়ারপাড়া খেয়াঘাট নির্ভার থাকে ভাতঘুমে থাকা নববিবাহিতার মতো। নৌকা ভিরেছে৷ যাত্রীরাও নামছে নির্ভার। তাদের মনের ভেতর রাত ও দিন। যেন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। নদীগন্ধা মন নিয়ে তারা ভুলে যায় ভুলে যাওয়ার অসুখ।

নৌকা ভিরেছে৷ যাত্রীরাও নামছে নির্ভার। তাদের মনের ভেতর রাত ও দিন। যেন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। নদীগন্ধা মন নিয়ে তারা ভুলে যায় ভুলে যাওয়ার অসুখ।

পৃথিবীর অন্য অনেক জায়গার মতো এখানেও এখন বিকেল৷ নৌকা থেকে নামা, পরবর্তী নৌকায় উঠতে চাওয়া যাত্রীদের ভীড়। দোকান হয়েছে। হাটবারের ভাতের হোটেল অন্যবারে হয়ে যায় মনোহারী দোকান। অন্ধকার অন্ধকার একেকটি দোকানও যেন নদীর মতো— অপার রহস্যের সূতিকাগার। দোকানীদের রূপকথা, ইতিহাস আশ্রিত গল্পের ক্যারেক্টার মনে হয় কখনো কখনো। যদিও ভোলা ময়রাকে কোনোদিন খুঁজে পাইনি আমি। ঘাটে কোনো মিষ্টির দোকান নেই। কোনো রাজবাড়ি না থাকাও এর একটা কারণ হতে পারে।

দৃষ্টিসীমাজুড়ে অন্তত দুই শতাধিক তরুণ, বয়স্ক নৌকা, হাতেগোনা স্পিডবোট৷ একেকটা নৌকার গল্প আছে নিশ্চয়ই, আছে বৈরাগ্যভাব ভুলে জীবিকার তাগিদ— যেমন থাকে মানুষের।

যমুনার কোলে সারাদিন দুলে ওদেরও ঘুম পায় খুব।

 

০২.
হুটহাট আসবে, সর্বাঙ্গে, প্রতিটা শিরা-উপশিরায় ঠান্ডা স্রোতের অনুভূতি জাগিয়ে চলে যাবে স্পীডবোটের গতিতে— এমনই তো বৈশিষ্ট্য জেনেছি লিলুয়া বাতাসের। আসার পর থেকেই অবিরাম বয়ে চলেছে যে হাওয়া, তাকেও মনে হচ্ছে লিলুয়া বাতাস। পাখির ডাক কিংবা স্নেহের ছায়ার মতো বুকপকেটে পুরে নেওয়া যায় একে। শীত আসছে।

এ সময়ে গাছের হাটে পাওয়া যায় শীতকালীন গাছ। নানা জাতের নানা গাছে সবুজে সবুজে আরও সবুজ হয়ে ওঠে এটুকু। পাওয়া যায় সিজনাল শাক-সবজি ও ফলের গাছ। সপ্তাহের দুইদিন হাট। এই দুইদিনই বেশ দাপটে থাকে এটুকু। প্রকৃতিকে অধিক ঋতুবতী করার মধুর পায়তারা জমে ওঠে এখানে। যেহেতু আসছে শীত, মৌচাকে মৌমাছির ফেরার মতো পাখিরাও আসছে নাটুয়ারপাড়ার বুকে। বেড়ে যাচ্ছে পাখিদের ঝাঁক। ঘাট-ই যেহেতু একমাত্র প্রবেশপথ, পাখিরাও আসছে এ পথে, নিয়মের হেরফের না করে। এপথে মানুষ, পাখি, মালামাল প্রবেশ করে নাটুয়ারপাড়ায়৷ আসে সমস্ত শুভ ও অশুভ। উদ্‌ভ্রান্ত চোখে স্কুল ব্যাগ কাঁধে নদী পার হয়ে এই ঘাটে কেউ কেউ হয়ে যায় লাখপতি অনায়াসে।

একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। শালিকের ঝাঁক৷ আজন্ম পরিচিত মনে হচ্ছে এদের। কৃষ্ণাঙ্গ শালিকের বেশে এরা তবে পূর্বপরিচিত শঙ্খচিল? ধানসিড়ি ও যমুনার অবয়বে থাকতেও পারে কিছু মিল।

 

০৩.
ঘাট থেকে যমুনার যে হতাশাগ্রস্ত করুণ রূপ দেখা যায় এখন, সে চিত্র খুব বেশি পুরোনো না। শীতে মরণযন্ত্রণা বেড়ে যায় ভীষণ। ক্ষয়িষ্ণু বাতাসের সাথে নদীর বুক চিরে জেগে ওঠে চর। সেই চর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে নৌকা থামায় নাটুয়ারপাড়ায় ফিরতে উন্মুখ, যমুনায় ঘুমানো অশরীরী যাত্রীর দল। নৌকা থেমে যায়। প্রশ্নের মতো ঘাপটি মেরে থাকে যমুনার যৌবন।

যতটা নিস্তেজ হতে থাকে যমুনা, সমানুপাতিক হারে বেড়ে যায় লোকালয় থেকে ঘাটের দূরত্ব। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে থাকে উজ্জ্বল বালুচর— যেখানে গোপনে লেখা যায় আপনের নাম। কোনো এক কুয়াশাজড়ানো ভোরে অচেনা বাদামচাষী মুছে দিয়ে পুঁতে দেবে চাড়া।

কোনো কোনো বাদামে তিনমাস-ঘুমিয়ে-থাকা ঋতুতেও ঘুমাতে পারে না কেউ কেউ। ঘুমকে যমের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে নিদ্রাহীনতায় ভোগাদের শরণাপন্ন হওয়ার চল আছে বৃক্ষজাত মাফিয়ার কাছে। জেনে রাখা ভালো, ভেতরের অসম মিশ্রণে কমে যায় আয়ু ধীরে ধীরে।

রহস্য নিহিত থাকে বাদামেও। কোনো কোনো বাদামে তিনমাস-ঘুমিয়ে-থাকা ঋতুতেও ঘুমাতে পারে না কেউ কেউ। ঘুমকে যমের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে নিদ্রাহীনতায় ভোগাদের শরণাপন্ন হওয়ার চল আছে বৃক্ষজাত মাফিয়ার কাছে। জেনে রাখা ভালো, ভেতরের অসম মিশ্রণে কমে যায় আয়ু ধীরে ধীরে।

ক্রমশ মিথলজিক্যাল ক্যারেক্টারে পরিণত হওয়ার দিকে এগোলেও, এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঘোড়া দেখা যায় নাটুয়ারপাড়ায়। বালুময় ঘাটে প্রধাণতম মালবাহী যান হয়ে ওঠে ঘোড়ার গাড়ি। বস্তাবন্দি মালামাল নিয়ে ঘোড়ারা আরও বেশি ঠ্যালা-বন্দি হয়। জানা যায়, ঘোড়ারা মূলত অসহায় জিন। কোনো এক জীবনের পাপের শাস্তি তারা ভোগ করছে নাটুয়ারপাড়ায়। কারো কারো প্রায়শ্চিত্ত ফুরিয়ে যায় মাত্রাতিরিক্ত বোঝাইয়ের ভার সইতে না পেরে— ভয়ানক করুণ মৃত্যুতে।

চড়ে থাকা অশরীরী যাত্রির ইশারায় থেমে থেমে যায় নৌকা। আগে রওনা দেওয়া অদক্ষ মাঝিকে ডিঙিয়ে ঘাটে পৌঁছানো প্রবীণ মাঝির শিশুসুলভ সংক্রামক উচ্ছ্বাস দেখে আনমনে ভুলে যাওয়া যায় নদী-মরণের ইতিহাস।

 

০৪.
সূর্য অস্তমিত হয়। ক্রমে কমে আসে শোরগোল। সান্ধ্যআইন না থাকলেও নাটুয়ারপাড়া ঘাটে আছে ‘লাস্ট ট্রিপ’। দিনের শেষ নৌকা। কোনো কারণে এ নৌকায় যেতে না পারলে নাটুয়ারপাড়ায় থেকে যেতে হবে আরও একটি রাত। লাস্ট ট্রিপে যাত্রী থাকে কম, তাড়া থাকে বেশি। যেন সমস্ত গ্রামের তাড়া নিয়ে ওপারের নৌকায় তারা পেরিয়ে যাচ্ছে নদী। ওরা চলে গেলে এখানকার মানুষেরা হয়ে যাবে নির্ভার! অস্বাভাবিক চালক কখনো কখনো হারিয়েও যেতে পারে সদলবলে।

লাস্ট ট্রিপে যাত্রীদের পারাপার বন্ধ হলেও চলতে থাকে জেলেদের ছোটো-ছোটো নৌকা। চলমান-ভাসমান সংসার সাথে নিয়ে। একটুখানি বায়নাবিলাসী না হতে পারার আক্ষেপে হয়তো ওদের বুকের ভেতর জেগে ওঠে বিরহী যমুনার চর। তাতে কি ওদের বেঁচে থাকা আড়ম্বরহীন? মোটেও না! এইসব নৌকা থেকে খড়কুটো নিয়ে পাখিরা সাত পাকে না ঘুরেই সাজায় মধুর সংসার।

লাস্ট ট্রিপে ঘরে ফিরতে পারে না যারা, নাটুয়ারপাড়ার চাঁদনি বালুচরে তাদের আত্মায় এসে ভর করে কোনো এক কবি। আকাশে আলোর কবিতা লিখে তারা নিরুদ্দেশে হারিয়ে যায়। তারপর, সেসব কবিতার ঈঙ্গিত ধরতে চাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে কোনো এক দৈবতৃষ্ণায় প্রতিনিয়ত ঢলে পরে নেশাতুর ঘুমে। এই খবর রাখে বিষণ্ণ যমুনার জল।

লাস্ট ট্রিপে ঘরে ফিরতে পারে না যারা, নাটুয়ারপাড়ার চাঁদনি বালুচরে তাদের আত্মায় এসে ভর করে কোনো এক কবি। আকাশে আলোর কবিতা লিখে তারা নিরুদ্দেশে হারিয়ে যায়। তারপর, সেসব কবিতার ঈঙ্গিত ধরতে চাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে কোনো এক দৈবতৃষ্ণায় প্রতিনিয়ত ঢলে পরে নেশাতুর ঘুমে। এই খবর রাখে বিষণ্ণ যমুনার জল।

 

০৫.
ঘাটপাড়ের অন্ধকার দূরীকরণের দৃঢ় সংকল্পে ব্রত হয়ে আসন্ন উৎসবের উন্মত্ততায় অবিরাম জ্বলে চলে অবাধ্য জোনাকির দল। ওদের সাড়া দিতে সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় মাতে সহস্রাধিক ঝিঁঝিঁ। নষ্ট হওয়া ল্যাম্পপোস্টে বাসা বেঁধেছে বিষময় ভিমরুল। বাইকের সারির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে চতুর শেয়াল। গাছেদের ফাঁক গলে পড়ে যে চাঁদ, তার ইশারা বুঝতে চায় হয়তো। চেইনমাস্টারের ব্যাগ থেকে আসা কয়েনের ঘুঙুর-শব্দে নুয়ে পড়ে আর্দ্র লজ্জাবতী। কুলিদের ভাগ-বাটোয়ারা দেখার লোভে খানিক দেরিতে নীড়ে ফেরে পাখি-দম্পতি। নিঃসঙ্গ সাউন্ডবক্স থেমে যায় সারাদিনের ক্লান্তিতে।

এতো এতো সর্বনাশ, অভিযোগ, সুখ ও অসুখের পরেও সূক্ষ্মতম অনেককিছুর এই ঘাট, এই যমুনা যেন মায়ের সাথে প্রতিমা দেখতে আসা ঘ্রাণময় রঙিন সেই কিশোরীর চোখ, ঘোর সর্বনাশের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও যাতে হারানো যায় প্রথাভুলে। ডুবুরির প্রশিক্ষণ ভুলে ডুবে যাওয়া যায় অতল গভীরে।

হিমরাত্রি হতে থাকে ক্ষয়। একটা বনের শূন্যতা নিয়ে অসীমের কাছাকাছি মাতৃত্বে নাটুয়ারপাড়া খেয়াঘাট সমস্ত রাত জেগে থাকে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া গ্রামে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে। লেখালেখি করেন; পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।