পিয়াস মজিদের ‘এইসব মকারি’ যত না কাব্যগ্রন্থ, তার চাইতে বেশি এ সময়ের স্ক্রিনশট— কন্টেম্পোরারি স্ন্যাপশট অফ সময়ের সচল বা অচলায়তন। কবি বা লিখিয়ে তাঁর ব্যক্তিজীবনের আতশ কাঁচ দিয়ে চলমান গড্ডালিকা প্রবাহ দেখেছেন কিছুটা (সবটা নয়) নৈর্ব্যক্তিকভাবে। তাঁর স্যাটারারিক বায়াস বা মকারি খানিকটা নিজেকে ও— শুধু অন্যদের নয়। তাই এই নেশা-কাটানো মকটেল অফ নেশাধরানো জীবন ও জীবিকার কাব্য উপভোগ্য হয়েছিল। অন্তত আমি পড়বার সময়।
‘আপাতত স্পোর্টস আওয়ার/ ছুটি হওয়ার আগে/ শানানো যাবে ভেতরের জানি দোস্ত জানোয়ার,/জানোয়ার ঘুমিয়ে গেলে কিসের মানুষ!’
এই শেষের (পৃ: ১৪) এক লাইনে পিয়াস যে জীবনবোধ ঢুকিয়েছেন, তা ‘অধুনালুপ্তই’ বলা চলে। অন্তত আমার খুব চোখে পড়েনি। ‘শুরু হোক শাস্ত্রীয় ব্লোজব।’ (পৃ: ১৮) কী চমৎকার করেই না অতীত-আকঁড়ানো বনেদী অভিজাতের প্রেম, রতি, কাজ, সামাজিকতার ব্যবচ্ছেদ করেছেন তিনি। পড়তে ভালো লাগে, বুঝতেও। তাই ‘এইসব মকারি’ আদ্যপান্ত ব্যক্তিমানুষের সেই স্ববিরোধিতার আত্মকথন, যাকে আমরা না গিলতে পারি, না ফেলতে। (এই যেমন পিয়াস বলছেন, ‘হে রুমি-রাত/হে কনফারেন্স অব বার্ডস, তোমাকে বুঝতে হবে/ফেলে আসা ও ঘনিয়ে আসা/জতুগৃহের জিও পলিটিক্স’)
কী চমৎকার করেই না অতীত-আকঁড়ানো বনেদী অভিজাতের প্রেম, রতি, কাজ, সামাজিকতার ব্যবচ্ছেদ করেছেন তিনি। পড়তে ভালো লাগে, বুঝতেও। তাই ‘এইসব মকারি’ আদ্যপান্ত ব্যক্তিমানুষের সেই স্ববিরোধিতার আত্মকথন, যাকে আমরা না গিলতে পারি, না ফেলতে।
যাতে স্পষ্ট আমাদের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্যানভাসে ব্যক্তিমানবের অসহায়, কিন্তু সক্রিয় যোজনার আভাস— যাতে দূরদর্শিতার অভাব হয়তো নেই; কিন্তু স্বভাব পাল্টাবে না। তাই তাঁর আপ্তবাক্য, ‘দোলাচলের মন/তুমি এবার লিঙ্গসর্বস্ব হও…’। কী চমৎকার আত্মশ্লাঘা— যাতে কামসর্বস্ব শরীরী ভালোবাসা থেকে গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট বা জিডিপিতে নিজেদের স্থান পাকা করে নেবার আত্মবিশ্বাস রয়েছে।
‘শস্য ছাড়া আর কার হয় শুমার’— বটেই তো আদমশুমারির গণনা যখন চূড়ান্ত প্রশ্নবিদ্ধ, তখন শস্যের ওজন ছাড়া আর কীসেই বা ভরসা রাখা যায়, বলুন?
যে দুধপোষা জীবনে ‘শৈশবে ফেলে আসা’ লতানো ‘নিহিলিজম’ ‘প্রাক-চল্লিশের রাতে এসে হামা’ খায়, তাকে তার স্খলন আর স্খালনের দায় ‘ফরেস্ট অফিসারের মেয়ে’র কাঁধে চাপানো যায় বৈকি।
তাই ‘টুপটাপ ঝরে পড়া একলা রাতের কেতনে’ ‘চোখের ভেতর’ থাকা ‘জলের বুনন’ ‘শাড়ির শরীর থেকে/হিমাকে মুক্ত করে’। ‘কৃষ্ণ হাওয়া/হাওয়ায় হাওয়ায়’ আর ‘শ্রী রাধার ক্রমবিকাশ’ রাজদ্বারে ঘুরে ঘুরে/ভিক্ষা’ করে বা ‘ভিক্ষাভাষা’ উপার্জন করে। আর তারপর ‘নিরক্ষর মরে পচে থাকার/প্র্যাক্টিস করা, /কোন কালে কবিতা লেখার/স্মৃতি মনে আসা।’ (পৃ: ৩৫)
‘আকাশে নিচু হয়ে বসে দেখা/পাতালচুম্বী স্বপ্নেরা’ ‘প্রেম-পিরিতির জাতীয়করণ’ করে ‘ভালোবাসা নামের সামষ্টিক বদমায়েশিতে ভরে’ তোলে পিয়াসের ‘পৃথিবীর অশান্ত কানন।’ (পৃ: ৩৫) তাই তিনি নি:সংকোচে মেনে নেন তার বর্তমানকে, ব্যর্থতাকে, না-পুরুষজনিত অপ্রাপ্তির বাস্তবতাকে ‘তোমার নিঃসঙ্গ মুকুটের’ ‘নিদ্রারিত ভোরের বারান্দা থেকে’ ‘কবিতাজীবী কালের ক্যানভাসে/ফুটনোট হয়ে ঝুলে থাকি।’ (পৃ: ৩৬)
পিয়াসের এই বিগত-হয়ে-যাবার হতাশা, আদতে আমাদের সকলের।
যে দীর্ঘশ্বাস আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির যাপিত জীবনের পলি জমে, পিয়াস মজিদ তাঁর রূপক নির্ভর সাবলীল ভাষায় তার প্রস্থচ্ছেদ করেছেন দুর্দান্ত দক্ষতায়। তাই ‘এই সব মকারি’— এক নিশ্বাসে বা এক বৈঠকে পড়ে ফেলবার মত প্রাঞ্জল (এবং স্লিম) হলেও তাকে ভাবতে, বুঝতে, পড়তে হয় আরেকটু বেশি সময় নিয়ে।
‘জন্মান্তর, পরকাল সব কাছিমের কান্নায় মাখামাখি হয়ে/কনফেশন ও কফিনবক্সের আয়তন বাড়ায়।’ তাই তো পিয়াসের আত্মজিজ্ঞাসা নিজের কাছেই—
‘দৈর্ঘ্যে বেড়ে ওঠা/ অনন্ত মৃত্যুর দামে/ ইচ্ছের ইজেলে হারামখোর নিজেকে আঁকতে/ শিল্পীর যতটা সৎসাহস লাগে/ সেটা কোন গুমনামি বাবার দরবারে?’
যেহেতু ‘জন্মান্তর, পরকাল সব কাছিমের কান্নায় মাখামাখি হয়ে/কনফেশন ও কফিনবক্সের আয়তন বাড়ায়’, তাই ‘জেনে নেয়া গেছে’ ‘বেঁচে থাকা বজায় রাখতে’ ‘যেসব উত্তরে বিব্রত হতে হয়/যেসব প্রশ্ন না করাই শ্রেয়।’ (পৃ: ৪৩) কবি তাঁর নিজের লিমিটেশন বা সীমাবদ্ধতা কিংবা অক্ষমতা বা অপারগতা খুব ষ্পষ্টভাবেই জানেন।
সমাজ, সংসার ও সময়ের পরতে পরতে যে দীর্ঘশ্বাস আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির যাপিত জীবনের পলি জমে, পিয়াস মজিদ তাঁর রূপক নির্ভর সাবলীল ভাষায় তার প্রস্থচ্ছেদ করেছেন দুর্দান্ত দক্ষতায়। তাই ‘এই সব মকারি’— এক নিশ্বাসে বা এক বৈঠকে পড়ে ফেলবার মত প্রাঞ্জল (এবং স্লিম) হলেও তাকে ভাবতে, বুঝতে, পড়তে হয় আরেকটু বেশি সময় নিয়ে। তাহলেই সময়ের চালচিত্রে জীবনের যে চলচ্চিত্রের পিয়াস ‘ক্রিটিক’ করেছেন, তার মূল স্বাদটা পাওয়া যায়। আফটার-টেস্টও থাকে বৈকি, আর সেটাও কম উপাদেয় নয়।
একজন আচরণিক অর্থনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী (কণ্ঠশীলন) এবং লিখিয়ে—যিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়) প্রায় দু’দশক ধরে গবেষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়বার পর বছর তিনেক কুইন্স ইউনিভার্সিটি অফ বেল্ফাস্টের পরিবেশ অর্থনীতি বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ স্টুডেন্ট এবং ব্যাবসা অধ্যয়ন বিভাগে গবেষণা সহযোগী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। আবৃত্তি ও রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি মঞ্চনাটকের (পালাকার) সঙ্গে সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছিল।