প্যাডেলের একেকটা বৃত্ত শেষ হতে রাস্তার শারীরিক অবস্থা এবং যাত্রীর সংখ্যা ও ওজনভেদে গড়ে তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা করে প্রশ্বাস নিতে হয় তাকে, ছাড়তে হয় প্রায় সমসংখ্যক নিশ্বাস—ঘুণেপোকা যেভাবে কুরে কুরে আসবাবের ভেতর ফাঁপা করে দেয় ঠিক সেইভাবে নিজের ফুসফুস খেয়ে ফেলেছে সে। ঠিক মধু নিংড়ে নেওয়ার পর মৌমাছির চাকের মতোই অবস্থা তার শ্বাসযন্ত্রের। বিড়ি খাওয়ার অনেক অসুবিধা, কিন্তু সুবিধাও আছে একটা— কেউ বয়স কত জিজ্ঞেস করলে, পাতার বিড়ি খাওয়া আরম্ভের আরও সাড়ে সাত বছর যোগ করে নিঃসংশয়ে বলে দেওয়া যায় নিজের বয়স। স্কুল শেষ করে কলেজে আর যাওয়া লাগেনি, সামর্থ্যের চুলোয় খড়ির সরবরাহ না থাকায় সেই আধোজ্বলা আগুন থেকে আলো আর ছড়ায়নি। কিন্তু ছাত্রজীবন তো শেষ হয় না—এখনো জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র সে। জীবনে পাশ-মার্কস এগুলোর কোনো মূল্য নেই, এখানে টিকে থাকাটাই শিরোপা।
এই শহরে ভাগ্য ঠিক সেইভাবে খুলে যায়, উঠতি বেশ্যার হাতে টাকা গুঁজে দেবার পর যেভাবে সে আলগা করে দেয় তার পেটিকোটের গিঁট, এর আগ পর্যন্ত বড়োজোর বুকে হাত—তাও ঘামদগ্ধ চিটচিটে ব্রেসিয়ার আর নোংরা উৎকট রঙের ব্লাউজের ওপর দিয়ে। এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই।
এই শহরে ভাগ্য ঠিক সেইভাবে খুলে যায়, উঠতি বেশ্যার হাতে টাকা গুঁজে দেবার পর যেভাবে সে আলগা করে দেয় তার পেটিকোটের গিঁট, এর আগ পর্যন্ত বড়োজোর বুকে হাত—তাও ঘামদগ্ধ চিটচিটে ব্রেসিয়ার আর নোংরা উৎকট রঙের ব্লাউজের ওপর দিয়ে। এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। প্রায় সবারই ইজ্জত ঠোঁট আর মুখ থেকে গিয়ে ঠেকে নাভি ও বুকের মধ্যবর্তী স্থানে—এই জায়গাটাতেই নাকি ক্ষুধা নোঙর ফেলে। বিঘা চারেক জমি, হালের দুইটাসহ আটটা গরু-গাভি-ছাগল, হাঁসমুরগি আর এঁটো জীবন—এই সব মিলে—সে, বড়ো ভাই, তার বউ আর দাদির সংসার চলে যাচ্ছিল—সে জীবনেও বারবার রিকশার চেইন পড়ার মতো এসেছিল ছেদ। ভাঙনের ফোঁস যে এত বিষাক্ত হবে তা কী জানত কেউ? মানুষের মুখে মুখে উড়ে উড়ে আসছিল খবর। আল্লা নাকি নদী ভাঙনের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে। জ্যৈষ্ঠের আগুনের চাইতেও তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে নদী। খেয়ে ফেলছে মাইলের পর মাইল।
পুরোনো সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে তরকারি ছাড়া ভাতের দলার মতো গলায় আটকে যায় শ্বাস, অনেক কষ্টে ঢোক গেলে সে, ঢোকের সাথে সাথে শ্বাসটারও গতি হয়। কী ভয়াবহ ছিল সে রাত! ভাবতেই আবার বিষম খায়। গত কয়েক দিন থেকেই মসজিদের মাইকে আজানের সাথে সাথেই ঘোষণা হচ্ছিল, যার যা আছে, তা নিয়ে যতটা পারা যায় তা নিয়ে নিরাপদে চলে যাবার। দু’দিন পরে মসজিদকেও বোরোর পান্তার মতো সাবাড় করে দিল রাক্ষুসে নদী। আল্লাহর ঘর যখন রক্ষা পেল না তখন সবাই বুঝে গেল, রক্ষা তাদেরও নাই।
কী নিতে পারবে কী পারবে না এই দোলাচলে—ভায়ের বউ ভরা পোয়াতি, পোয়াতি গাভিটাও, চার হাত পা নিয়ে অবশ দাদি, বিছানায়। বাপ-মা বলতে তাদের এই একমাত্র দাদিই, বছর কয়েক আগে, কী যেন হয়েছিল সেদিন, ভূমিকম্পের মতো বার কয়েকের জন্য কেঁপে উঠেছিল দাদি, প্রস্রাব-পায়খানা করে দিয়েছিল, কেটে গিয়েছিল জিভ, মুখের কোণ বেয়ে গড়গড় করে বেরিয়ে এসেছিল লালা-থুতু-ফেনা-রক্ত; তারপর থেকেই দাদি স্থির, নিজের জবান খেয়ে ফেলা বিছানাবন্দি এক ছাতুর দলা। ইশারায় কী যেন বলেছিল দাদি, যা-ই বলুক সে নিজের মতো একটা অর্থ দাঁড় করিয়ে নিয়েছিল, স্বামী-সন্তান যে মাটিতে শুয়ে আছে সেখান ছেড়ে দাদি কিছুতেই যাবে না, এমনই কিছু একটা। তার একার পক্ষে দাদির খাটলা টানা সম্ভব ছিল না। পুরো মণ্ডলপাড়ায় নেমে এসেছিল কেয়ামত, কেউ কাউকে সাহায্য করার মতো অবস্থায় ছিল না সে রাতে। খাটলা টানার চেয়ে বরং গরু দুইটার দড়ি ধরে তাদের টেনে নিরাপদে নিয়ে যাওয়া ছিল সহজ, লাভজনকও। ভেসে গিয়েছিল দাদি, ভেসে গিয়েছিল সকল স্মৃতি। কিছু দিন পর ঘর হারা ভাবিও মরে বেঁচেছিল, মরে বেঁচে গিয়েছিল তার পেটও। কিছু দিনের মধ্যে ভাইও ছেড়ে দিয়েছিল নিজেকে—বেঁচে থাকার প্রতি অনীহা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশ্রদ্ধা এসব নিয়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমায় ভাই। সে-ও নিঃস্ব, একা।
স্মৃতিগুলো আচমকা ছিঁড়ে যাওয়া তসবির দানার মতো গড়িয়ে পড়ছে এদিকওদিক। ঢাকা শহরে এসেই রিকশা চালানো শিখে ফেলে সে। গ্যারেজে রিকশা জমা দেওয়ার সাথে রোজকার জমার ত্রিশ টাকা দিতে না পারলে পরের দিন রিকশা পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত, যেভাবে এ শহরে আসার পর অনিশ্চিত ছিল প্রতিটি দিন। সারা দিন রিকশা চালিয়ে গ্যারেজে রিকশা জমা দিয়ে সেখানেই দু’লোকমা খেয়ে রিকশার সিট মাটিতে ফেলে তাতেই মাথাটা গুঁজে শুয়ে পড়ত সে। একা মানুষ—খাওয়াদাওয়া না হলেও চলত কিন্তু বিড়ি তার শ্বাসের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। হাতে কিছু টাকাও অবশ্য জমতে আরম্ভ করে। গ্যারেজে জুয়া চলত সারা রাত—অবশ্য এক-টাকা দু-টাকার জুয়া কখনো জেতেনি সে। কিছু দিন পর গ্যারেজটাও পালটে ফেলতে হয়েছিল। তার ঘুম হতো না, ঘুমাতে না পারলে পরের দিন রিকশা চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। গ্যারেজ পরিবর্তনের কারণ অবশ্য আরও একটা ছিল।
সে যখন আসে, এত মানুষ ছিল না এ শহরে, ছিল না এত জটিলটা, ছিল না মানুষের নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে এত ঠোকাঠুকি, ছিল না মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ডুগডুগি বাজানোর প্রতিযোগিতা। নতুন গ্যারেজে এসে ভালোই কাটছিল রাতগুলো—দিনগুলো তো রাস্তায় রাস্তায়। ভেতরে ভেতরে তেতে উঠছিল আরেকটা পেট-ভাতে মিটত না এর ক্ষুধা। এ ক্ষুধা মেটাতে সে বেছে বেছে মেয়েদের রিকশায় তুলত। আর মেয়েরাও—বিশেষ করে জোয়ান মেয়েগুলো এমন মোলায়েম ভাবে বলত, ‘মামা যাবেন?’ সে না করত না, তাতে ভাড়া দু’চার টাকা কম হলেও। এতে অবশ্য লাভ হতো দুইপক্ষেরই। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না, তা যত দামি ঘোলই হোক না কেন? নতুন গ্যারেজে ঘোল নয় দুধের সন্ধান পেয়েছিল সে। অন্ধকার গ্যারেজে চার হাত বাই চার ফিট চাদর ঘেরা জায়গা ভাড়ায় মিলত। অন্ধকার আরও ঘনিয়ে এলে চার বাই চারে নেমে আসত চাঁদ, হোক তা এঁটো! নতুন পেটের নতুন ক্ষুধা মেটানোর খাদ্য দামেও ছিল সস্তা। মানুষ বেশি দিন নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পারে না—সে-ও পারেনি। প্রায় প্রতিরাতেই মণিমালা হয়ে ওঠে তার চার বাই চার ফিটের সম্রাজ্ঞী। কিন্তু মণিমালা কারো সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকতে চায়নি। এঁটো চাঁদ হয়ে থাকাতেই বেশি লাভ তার। প্রতি রাতের লাভ সে খাটাত বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বারান্দায় খুকখুক কাশি আর কফের বিছানায় সেঁটে থাকা যক্ষাক্রান্ত তার নিজের সম্রাটের জন্য। মণিমালার অনিচ্ছুক অপারগতায় গ্যারেজ পালটাতে বাধ্য হয় সে। অবশ্য এর কিছু দিনের মধ্যে পালটে যায় তার জীবনের গতিপথ।
সে আজও জানতে পারেনি কে তার মা, কে তার বাবা। অবশ্য সে এখন জানতেও চায় না, কী হবে জেনে? শুধু জেনেছে কোনো এক সাহেবের বাড়িতে কাজ করত কুলসুন নামের উনিশ বছর বয়সের এক তরুণী, তার পেট জানান দিলে সাহেবের স্ত্রী আর সাহেব মিলে তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে পেট খালাস করে নিতে বলেছিল, কুলসুন পারেনি, পারেনি প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়াতেও—যাদের পেটে অনেক ক্ষুধা তাদের প্রতিবাদের লোকমা দ্রুত চালান হয়ে যায় মুখে।
তরু নতুন ঘরের স্বপ্ন দেখালে ঘরহীন সে হয়ে ওঠে স্মৃতিমেদুর। তার মনে পড়ে যায় বাড়ির আঙিনার শিউলিতলার কথা, মনে পড়ে নিষ্ফলা ডালিম গাছটার কথা, দাদির ঘরের ওপরে ঝুঁকে থাকা নিমগাছের হৃদয় শীতল ছায়া, সজনে ফুল, আরও আরও কত কিছুর কথা। ধানমন্ডি লেকপাড়ের একটা বাড়ির গেট হতে রাত দশটার দিকে বের হয়ে মেয়েটি তার রিকশায় উঠেছিল। কথায় কথায় সে জেনেছিল মেয়েটির নাম তরু—প্রতিদিনই এ বাসা থেকে কাজ শেষ করে দশটার দিকেই বেরোয়। যেভাবে পদ্মা একরোখা টানে সবকিছু নিজের উদরে পুরে নিয়েছিল প্রায় একই রকম টানে সে-ও দশটা বাজার ঠিক মিনিট দশেক আগে প্রতিদিন ওই বাসার সামনে এসে দাঁড়াত। কাজ শেষ করে বেরুত তরু, কিছু না বলেই উঠে পড়ত রিকশায়। সে কামরাঙ্গীরচরে নামিয়ে দিত তরুকে। নামিয়ে দিয়ে ফিরত গ্যারেজে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকত তরুর শরীরের ঘ্রাণে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শরীরের ঘ্রাণের বদলে তরুর হৃদয়ের ঘ্রাণে মেতে ওঠে সে। মেতে ওঠে তরুও। তরু, সে নিজেই এই নাম দিয়েছে নিজেকে। নাম দেওয়ার জন্য মা-বাবা, কেউ একজন থাকতে হয়, তেমন কেউই ছিল না তার। সে আজও জানতে পারেনি কে তার মা, কে তার বাবা। অবশ্য সে এখন জানতেও চায় না, কী হবে জেনে? শুধু জেনেছে কোনো এক সাহেবের বাড়িতে কাজ করত কুলসুন নামের উনিশ বছর বয়সের এক তরুণী, তার পেট জানান দিলে সাহেবের স্ত্রী আর সাহেব মিলে তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে পেট খালাস করে নিতে বলেছিল, কুলসুন পারেনি, পারেনি প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়াতেও—যাদের পেটে অনেক ক্ষুধা তাদের প্রতিবাদের লোকমা দ্রুত চালান হয়ে যায় মুখে। অবশেষে অন্ধকারের চাদরের আড়ালে কোনো এক সন্ধ্যায় জন্ম হয় তরুর, না তরু নামে জন্মায়নি সে, জন্মের সময়ই কুলসুন আজীবনের ছুটিতে গেলে কুয়াশা আর শীতের, গ্রীষ্ম আর বর্ষার আশ্রয়ে বড়ো হতে হতে বুঝতে পারে তার নাম তরু হওয়া উচিত। তখন থেকেই সে নিজের নাম দিয়ে ফেলে তরু, তরু খাতুন। তরু চাকরি করে। চাকরিই তো, মাস শেষে যারাই নিদৃষ্ট অঙ্কের মাইনে পায় তারা সবাই চাকর।
রাতের শান্ত নদীস্রোতে বেহিসেবি চাঁদ যেভাবে ঢেলে দেয় বুনো জোছনার অবাক ঢেউ সৃষ্টিকর্তা ঠিক সেভাবেই অবাক সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছিল তরুর শরীরে। তরু নিজেকে বানিয়ে রেখেছিল দীর্ঘ দিন না মাজা পিতলের বাসন, কিন্তু বাপ-মা না থাকা অনাথ তরু তার স্নেহের ঘষামাজা পেয়ে হয়ে উঠেছিল ঝকঝকে তকতকে। এমনই ঝকঝকে, সে যেন হয়ে উঠেছিল লাল মাটি দিয়ে লেপে রাখা তাদের বাড়ির আঙিনা। তরুর স্বচ্ছ অবয়বে সে স্পষ্ট দেখতে পেত নিজেকে। তার ভয় হতো তরুকেও কী তেমন কোনো ভাঙন নিশ্চিহ্ন করে দেবে। সে তো পদ্মার আগ্রাসন থেকে আগলে রাখতে পারেনি কোনো কিছুকেই, সে কী পারবে আগলে রাখতে তরুকে?
বিয়ের বছর নতুন মুখ দেখতে না দেখতেই তাদের হৃদয় উজালা করে পৃথিবীতে এসেছিল যমজ আলো। রিকশা ছেড়ে তত দিনে সে বেবিট্যাক্সি চালানো ধরেছিল। এতগুলো বছর পর তার জীবনে সুখের অচিন পাখি একটু একটু করে পাখা মেলতে আরম্ভ করেছে। তরু আর অন্যের বাসায় কাজ করে না, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে কড়াইল বস্তির জীবন ছিল লেকের ওপারের আলো থকথকে জীবনের চেয়ে ঢের ভালো। কিছু দিনের মধ্যেই বস্তি ছেড়ে ভাড়াবাসায় ওঠার জোর প্রচেষ্টা চালায় সে। কিন্তু আগের মতো বেশিক্ষণ ট্যাক্সি চালাতে ভালো লাগে না, বাচ্চা দুইটার কথা মনে পড়লেই তড়িঘড়ি করে ফিরে আসে সে। তরুও, একা—বাচ্চাদের সামলাতে হিমশিম খায়।
সেদিন সন্ধের পর একটা বড়ো ভাড়ায় গার্মেন্টের মাল নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে টঙ্গি গিয়েছিল সে। মাল নামিয়ে বেবিট্যাক্সি রেখে একটু চা-বিড়ি খাবারের জন্য দাঁড়িয়েছিল পাশের দোকানে। গরুর প্রস্রাবের মতো চায়ের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টান দিচ্ছিল বিড়িতেও। দোকানে এক নাগাড়ে বেজে চলা রেডিওতে তার মনোযোগ আটকে যায় হঠাৎ। রেডিওর খবরে সহসা কানের পর্দা ঝলসে যায় তার। কড়াইল বস্তি আগুনে পুড়ছে। ঢলে পড়ার আগে যেভাবে ঘূর্ণয়মান লাটিম এলোমেলো চক্কর দেয় তার মাথাটাও ঠিক সেভাবেই চক্কর দিয়ে ওঠে। সাথেসাথেই বেবি স্টার্ট দেয় সে। ছুটতে থাকে বাজপাখির গতিতে। ফেরার সময় বারবার মনে পড়ছিল নদীতে ভেসে যাওয়া তার বাড়ির কথা—নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল তার শেকড়, করেছিল ঘরহীন, এমনকি বাবা-মায়ের কবর পর্যন্ত ধুয়ে নিয়ে গেছিল রাক্ষুসে নদী।
কিছু দিন পরপরই গলায় ক্ষমতার ঘেউ ঘেউ বাধা কুকুরের বাচ্চারা বস্তির দখল নেবার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগায়। নিঃস্ব মানুষগুলোর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এরা মানুষগুলোকে সাপলুডুর গুটি বানায়। কুকুরের বাচ্চারা কেউ ঘরভাড়া তোলে, কেউ অবৈধ বিদ্যুতের লাইনের টাকা, কেউ গ্যাস লাইনের টাকা। ঘরপোড়া মানুষের ঘরহারা মানুষের হাহাকার এরা বুঝবে কোথা থেকে। মরা মাছের চারপাশে যেভাবে অগুনিত মাছি থকথক করে, কড়াইলের গোডাউন বস্তির ঘন ঘরগুলোতে বাস করে তার চেয়েও ঢের বেশি মানুষ। সে যতক্ষণে ফিরে আসে, দেখে আগুনের লোভে পুড়ে যাওয়া সাত ফিট বাই আট ফিটের ছাপরাগুলো মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোবা শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চিহ্ন বলতে মধ্য বয়স্কা নারীর ধসে যাওয়া স্তনের মতো কোনোমতে তাদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক তাকায় সে। বস্তির আগুনে অস্থায়ী ঘরগুলো পোড়ে, কখনো কখনো ঘরের জিনিসপত্র, মানুষ পোড়ে না। এই পোড়া শ্মশানের মতো জায়গায় আবার অস্থায়ী ঘর ওঠে, এমনকি যে যেই ঘরে ভাড়া থাকত অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই আবার সেইসব ঘরেই ওঠে, শুধু পরিবর্তন হয় ইজারাদারের। চারপাশে মানুষের আহাজারি আর আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে পুরো কড়াইল। মানুষের দৌড়াদৌড়ি আর হুড়োহড়ি চলছে। ঘর থেকে যে যা পেরেছে নিয়ে বেরিয়ে ছুটছে এদিক-ওদিক। বস্তির আগুন নেভানোর জন্য দমকল বাহিনী সবসময়ই আসে আগুন নেভার পর। মানুষের দগদগে ক্ষতে লবণ পানি ঢালার কাজটা দমকলকর্মীরা বেশ দক্ষতার সাথেই করে। আগুন নেভার পর আসার জন্য তাদের মুখেও পুরে দেওয়া হয় আহার।
সে তরুকে খুঁজছে, আর খুঁজছে তরুর কোল। না কাউকেই পাচ্ছে না। আশপাশে পরিচিত কান্নার কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের জিনিসপত্র কিছু না নিয়েই তরু সম্ভবত সরে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। আগুনের ধোঁয়ামাখা কুণ্ডলী আর ধ্বংসস্তূপের ছায়ায় ভাসছে গুলশান লেক। ভয়ে জড়সড়ো হয়ে গেছে লেকের পানিও। তরুকে তখনো পায়নি সে। তরুকে না পেলে বাচ্চাদের পাবে কীভাবে? পরের দিন দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যায় কে যেন বলেছিল, পুরোটা পুড়ে যাওয়া তরুর মতো দেখতে একজন ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি। ছুটে গিয়েছিল, পোড়া মুখগুলোয় তরুর মুখের ছবি খুঁজেছিল—যার পোড়া মুখ তরুর মতো দেখতে তার শুধু মুখ নয়, ঝলসে গিয়েছিল সারা শরীর, ঝলসে গিয়েছিল দৃষ্টিশক্তি, শ্বাসযন্ত্রে আগুনের শিখা গোখরা সাপের মতো ছোবল দেওয়ায় কণ্ঠশক্তি বিষে বিষাক্ত হয়ে মরে গিয়েছিল। পুরো শরীরে তুলোয় পেঁচানো বিধায় তার তলপেটের তিলটাও দেখতে পায়নি, আর আগুন কি তিলকে ছাড়বে? হাত দুটো পুড়ে কুঁকড়ে গেছে।
বেওয়ারিশ রোগী হিসেবে কে যেন ভর্তি করে দিয়ে গেছিল। চোখের মণি দেখে তরুকে চেনা তার কাছে ছিল একের পরে দুই এর মতো কিন্তু এ হিসাব একের পরে দুই হয়ে নেই তা বুঝে গেছে সে। পুরোটা দিন মেডিক্যালের আইসিইউ-র বারান্দায় বসে থাকত সে। নিজেকে তরুর স্বামী হিসেবে পরিচয় দিলেও ডাক্তাররা বিশ্বাস করতে চাইত না কিন্তু দিনের পর দিন যখন পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া, কথা বলতে না পারা, চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া, শরীরের চামড়ায় পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়ানো মানুষটিকে তারা নিজেরাও চিনতে ব্যর্থ হয়েছিল, তার খোঁজে যখন আর কেউ আসেনি তখন ডাক্তাররাও বিশ্বাস করা আরম্ভ করেছিল, সে যা দাবি করেছে তা-ই সত্য। কিন্তু তার আশা ছিল হয়তো তরুর মতো দেখতে পোড়া মাংসপিণ্ডটা তরুই। হয়তো তরুর হাতের তালুতে লুকিয়ে রেখেছে তাদের দু’জনের বাঁচার তাবিজ দুইটাকে। হয়তো তরুর মতো সে একবারের জন্য হলেও ডেকে উঠবে, হয়তো দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবে। এসবের কিছুই হলো না। সতেরো দিনের দিন তরুর মতো তরু কিছু না বলেই চলে গেল না বলার দেশে। তরুর মতো দেখতে সেই মৃতদেহটাও পায়নি সে, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কোথায় যেন মিইয়ে গেছিল।
সে এখন বেবি ট্যাক্সি চালায় না। খায় না। ঘুমায় না। সে ঘুমায় না, খায় না। ট্যাক্সিও চালায় না। প্রতিদিন এলোমেলো পোশাকে একবার করে ঢাকা মেডিক্যালে আসে, কফ থুতু মেখে দাঁড়িয়ে থাকা বারান্দার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকে শ্বাসের পর শ্বাস। রাত পার হয়ে যায়, দিন পার হয়, রোগী আসে, রোগী মরে, সুস্থ হয়ে চলে যায় কেউ কেউ। তরুর মতো আর একজনও আসে না। চালা টেনে নেওয়া লাউ গাছের মতো নুইয়ে পড়া কড়াইলের গোডাউন বস্তিতে গিয়ে বসে থাকে মাঝে মাঝে। সে বুঝে গেছে, যার ঘর নেই তার ঘরের মানুষেরাও থাকে না। সে তো সামান্য একটা ঘরই চেয়েছিল। তবে কি ঘরই তাকে চায় না! বুঝতে পারে না সে। তরু নেই, বাচ্চা দুইটাও তার সাথেই। দিন যায়, রাত যায়, ঘন কুয়াশার ঘোর ঠেলে জেগে ওঠা ভোরের মতো পুনরায় জেগে ওঠে কড়াইল বস্তি। আগের অনেকেই ফিরে আসে, আসে নতুন মানুষ। শুধু ঘর নেই তার, নেই তরু, নেই বাচ্চারা। দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকা তবিবর ব্যাপারীরা আছে। কড়াইল বস্তির নতুন দখলদার তবিবরের পেছনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে ক্ষমতা। ক্ষমতার পেট্রল দিয়ে তবিবর জ্বালিয়ে দিয়েছিল কড়াইল। এখন সে-ই ঘরগুলো থেকে নিয়মিত ভাড়া তুলবে, নতুন করে কেউ আবার জ্বালিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত। এই ভাড়ার ভাগাভাগি হবে তবিবর তার তার ক্ষমতাবাপদের মধ্যে।
দিনের পর দিন ঢাকা মেডিক্যালের বারান্দায় বসে থাকা জীবনের শেষ হয় তার। সাদা শাড়ি আর তিনকোনা টুপি পরা নার্স— যাকে সে কয়েকমাস ধরে দেখছে, দেখতে দেখতে দুইজনের চোখ-সওয়া হয়ে গেছে, কোনো দিন কথা না হলেও হয়ে গেছে পরিচয়, এক দিন নাইট ডিউটিতে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে কেন সে দিনের পর দিন বসে থাকে এখানে, এই বারান্দায়? কোনো উত্তর দেয় যা সে, মৃত্যুর পর থেকে শরীরে পচন ধরার আগে যেভাবে দৃষ্টি হয়ে যায় ঘোলাটে ঠিক তেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নার্সের দিকে। নার্স তাকে কিছু বলতে চায়, বলতে গিয়েও থমকে যায় অযাচিত স্পিডব্রেকারে যেভাবে শ্লথ হয়ে যায় তার বেবির গতি ঠিক তেমনি, অবশেষে বলেই ফ্যালে— সে শোনে—ঘর হারানোর গাঢ় বেদনার চেয়েও গাঢ় এ বেদনা। নার্স জানায়, যে মারা গেছে, এত দিন যাকে সে ভেবে এসেছিল তরু, আগুনের লেলিহান শিখা যার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল, কেড়ে নিয়েছিল স্বর, শরীরের প্রায় পুরো অংশ পুড়ে যাবার ফলে যার হাত পর্যন্ত দেখতে পারেনি সে, ভারী ব্যান্ডেজে মোড়ানো সেই নারী, যাকে অবশেষে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছিল সে আসলে অন্য কেউ নয়, সে-ই তরু। পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া তরু এ কথা শুধুমাত্র এই নার্সকেই বলেছিল যে সেই তরু। এ-ও বলেছিল বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে পানি আনতে গেছিল, যখন ফিরে আসে তখন ঘর ভাসছে আগুনে। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে। কেউ এগিয়ে আসেনি, সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আগুন নেভাতে চেষ্টা করলে তবিবর আর তার দলের ভাড়াটে গুন্ডারা আগুন নেভাতে দেয়নি। তরু পারেনি, পারেনি বাচ্চাদের আগুনের ভয়াবহ নিশ্বাস থেকে বাঁচাতে, কিন্তু সে আগুন থেকে বেরিয়ে আসেনি, বাচ্চাদের ফেলে পালিয়ে আসেনি, বাচ্চাদের প্রশ্বাসই যে তার প্রশ্বাস, সে আগুনের লেলিহান লোভের সাথে লড়ে গেছে। তরু এ কথা তার স্বামীকে বলতে পারেনি বা বলতে চায়নি, শুধুমাত্র বলেছিল নার্সকে, এ-ও বলেছিল নার্স যেন এ কথা বলে না দেয় তার একান্ত একা মানুষটাকে, তরু তো পারেনি তার আরও একলা হওয়া ঠেকাতে, পারেনি তার যক্ষেরধন সন্তানদের রক্ষা করতে।
গাঁ ঝাড়া দিয়ে ওঠে সে, ফিরে আসে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে, আর কখনো সেখানে যাবে না, এই তার সিদ্ধান্ত। সে বুঝে ফেলে এভাবে শূন্য মাঠে কাটা ধানের মুড়ির মতো বেঁচে থেকে লাভ নেই, এভাবে বারবার মরে বাঁচার নাম বেঁচে থাকা নয়—নতুনভাবে বাঁচার জন্য নতুন পথ তৈরি করতে হবে তাকে, নিজের বানানো পথে বেঁচে থাকবে সে—যে পথ পদ্মাকে রুখে দিতে পারবে, রুখে দিতে পারবে কড়াইলের আগুন। এভাবে বারবার তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিতে দেবে না সে—সে হোক মাতাল পদ্মা, হোক ক্ষমতাবাপের আশীর্বাদপুষ্ট তবিবর অথবা হোক সে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা।
নিজে যেটা পারিনি তাকে দিয়ে আমি সেই কাজগুলোই করিয়ে নিতে চাই, সমাজ আমাকে যেভাবে দেখে আমি চাই ঠিক তার বিপরীত দৃষ্টিতে দেখুক তাকে। সে দ্রুত বাড়ছিল, তারচেয়েও দ্রুত বাড়ছিল আমার ক্ষমতা, আমার আর্থিক সংগতি, আমার সাহস।
দুই.
সতেরো তলার আমার অফিসের দক্ষিণের জানালাটা খুলে দাঁড়িয়ে আছি, আস্থাহীন শহরের দূষিত প্রশ্বাস ব্যতীত বাঁচা সম্ভব নয়, তাই মাঝেমাঝেই জানালা খুলে দাঁড়াই এখানে। এখান থেকে কড়াইল বস্তির মাথা থেকে কোমর অব্দি চোখে পড়ে অনায়াসে, জানালার আরও কাছে ঘেঁষে নিচে তাকালে নির্বিঘ্নে চোখ চলে যায় গোড়ালি পর্যন্ত । এসি চলছে, আমার পরনে পছন্দের স্যুট, দুনিয়ার সবচেয়ে দামি কাপড়গুলোর একটি এই, ‘ভিকুনা’, বেন্টলি না কী ব্র্যান্ডের জুতো, গতবার ফ্রান্স থেকে ফেরার সময় এনেছিল ছেলেটি। অসম্ভব কর্মঠ ও বুদ্ধিমান এবং মেধাবী এ ছেলে—বাবাকে দেখেনি, মা দীর্ঘ দিন ধরে একটু একটু করে মারা যেতে যেতে অবশেষে একেবারেই মারা যায়। মারা যাবার সময় আমার হাতেই গুঁজে দিয়ে যায় তাকে, ছেলেটির বয়স তখন কথা বলার বয়সেও পৌঁছেনি। তখন থেকেই এ ছেলে আমার সাথেই আছে। আমার এই একা শেকড়হীন জীবনে সদ্য ফোটা একটা কুঁড়ির মতো সে— ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম এ বাঁধন যতটা ডালপালায় বাড়ছে ঠিক ততটাই তার শেকড় গ্রোথিত হচ্ছে আমার অস্তিত্বের গভীরে। নিজে যেটা পারিনি তাকে দিয়ে আমি সেই কাজগুলোই করিয়ে নিতে চাই, সমাজ আমাকে যেভাবে দেখে আমি চাই ঠিক তার বিপরীত দৃষ্টিতে দেখুক তাকে। সে দ্রুত বাড়ছিল, তারচেয়েও দ্রুত বাড়ছিল আমার ক্ষমতা, আমার আর্থিক সংগতি, আমার সাহস। কাঁটাবিছানো পথে রক্তাক্ত হতে হতে কীভাবে কাঁটা সরিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে হাঁটতে হয় তা শিখে যাচ্ছিলাম দ্রুত। এবড়োখেবড়ো পথ পেছনে ফেলে মসৃণ পথের সন্ধানে আমি যে আরও সফল হব এ ব্যাপারে আমার প্রাক্তন জীবন থেকে সকল জীবনীশক্তি শুষে নেওয়া বর্তমান তা বোঝার সক্ষমতা দিয়েছে। বুঝে গেছি বাঁচার প্রত্যাশা থেকে ভয় সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলতে না পারলে তা সকল সম্ভাবনার দুয়ারে তালা দেবে, চাবি ফেলে দেবে জীবনসমুদ্রের জেলখানায়, সে চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে না কখনো, না পাবার ফলশ্রুতিতে নিজেদের বানানো জেলখানায় কয়েদি থাকা অবস্থাতেই মৃত্যু ঘটবে সকল সম্ভাবনার।
এই ছেলেটিকে পরিপূর্ণ একটা সম্ভাবনা বলেই মনে হয়েছে আমার। মা মারা যাবার সময় ছেলেটির ছোট্ট হাত আমার হাতে তুলে দেয়, আমার হাতের মধ্যমা ধরেই অপুষ্ট দৃষ্টিতে সে একবার আমার দিকে তাকিয়েছিল, একবার তার মায়ের দিকে, সম্ভবত মা তাকে আমার ব্যাপারে আগেই বলে রেখেছিল, হয়তো বলেছিল, সে মারা গেলে আমি তার আশ্রয়ের একটা সম্ভাবনা হয়ে উঠতে পারি, হয়তো অন্য কিছু বলেছিল, ঠিক জানি না। পরবর্তীতে আমরা একজনকে আঁকড়ে ধরি, আমরা হয়ে উঠি পরস্পরের স্বার্থ—একে অন্যের ছায়া মেখেই বড়ো হতে থাকি আমরা। সে বরাবরই আমার সামর্থ্যের সাথে টেক্কা দিয়ে গেছে। আমিও দেখতে চেয়েছি সে কত দূর দৌড়াতে পারে! স্কুলে ভর্তির পর থেকেই পড়াশোনায় দুর্দান্ত রকমের ভালো করতে থাকে সে। জীবন আমাকে পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়নি, আমি দেখতে চেয়েছি সে কতটা পারে!
সবাই ভেবে নিল খুনটা আমিই করেছি। মানুষের ভেবে নেওয়া ভুলকে ভাঙাতে চাইনি। যে খুন আমি করিনি সে খুনের সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় আমাকে, হাত-পা বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে তাদের ইচ্ছেপূরণ না হওয়া পর্যন্ত পেটায়, চুপ থাকি আমি। শারীরিক কষ্ট আমার অনুভূতির স্তরকে ছুঁতে অক্ষম তা ইতোমধ্যে জেনে গেছি। পেটাতে পেটাতে নিজেদের ঘামে স্নান করে তারা, ঘাম শুকিয়ে লবণ হলে আবার পেটানো আরম্ভ করে, শুধুমাত্র একটা কথা বলিয়ে নেওয়ার জন্য যে, খুনটা আমিই করেছি। তারা অবাক হয়, কার সাথে যেন কথা বলে, তার কথামতো সাধ্যমতো আবার পেটায়, পেটাতেই থাকে। হয়তো টেলিফোনের ওপারের তিনি পুনরায় ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, খুনের দায় আমি নিয়েছি কি না! না নেওয়া পর্যন্ত হয়তো তারা আমাকে পেটাতেই থাকবে বা আমি মরে না যাওয়া পর্যন্ত। জীবনে এতবার মরেছি, মৃত্যু এখন আমাকে দেখলেই ভয় পায়। তাদের মারে আমার শরীরের রক্ত ঝরে ঠিকই কিন্তু তাতে তারা তাদের ঈপ্সিত সাফল্য পায় না, না পেয়ে আরও মারে, রক্তাক্ত শরীরে মারগুলো পিছলে যায়, আমি মরতে মরতে ফিরে এসে চমকে দেই তাদের। খুন আমি করিনি, হ্যাঁ এটা ঠিক, গত তিনমাস ধরে মধ্যরাতে পদ্মার শান্ত স্রোতে চাঁদের আলো যেভাবে চকচক করত ঠিক তেমনি চকচকে ধারালো কোপদাটা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম এবং এটাই ছিল আমার একমাত্র কাজ। কাউকে খুন করার চেয়ে, তার মনে খুন হবার ভয় ধরিয়ে তার আত্মবিশ্বাসে নেংটি ইঁদুরের দল ছেড়ে দেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছিলাম। চাইনি সে দা-এর এক কোপে মরুক—চেয়েছি প্রতিটা নিশ্বাসে সে মৃত্যুর লাল চা পান করুক। সে অবশ্য খুন হয়—যারা খুন করে তারা তার অক্ষিকোটর থেকে চক্ষু দুটোকে উপড়ে ফেলে, জিহবার অগ্রভাগ কেটে নেয়, দুই হাত এবং পা থেকে বিছিন্ন করে ফেলে আঙুলগুলোকে, শোনা কথা বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে ক্ষুধার্ত কুকুরগুলোর সামনে ছিটিয়ে দিলে তারা তা মুহূর্তেই সাবাড় করে দেয়। আমাকে পেটাতে পেটাতে খুনের দায় স্বীকার করাতে না পেরে থানাও হতাশ হয়ে পড়ে, এখনকার মতো ক্রসফায়ারে তখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি বন্ধুক, না হলে হয়তো কোমরে কোপদা গোঁজা অবস্থায় আমার মৃতদেহ পাওয়া যেত কোনো কবরের গর্তে বা শহরের বগলের আড়ালে। অবশেষে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, এত মার আমি কীভাবে সহ্য করছি! স্বীকার করে নিলেই তারা আমাকে ছেড়ে দেবে এমন আহাম্মকিতে ভরপুর প্রস্তাবও দেয়। আমি বলি, খুনের দায় আমি স্বীকার করে নেব তবে তোমাদের কাছে নয়, তোমরা যাকে ফোন করো, তার সামনে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেব। তোমরা বা তোমাদের ফোনের ওইপার যদি রাজি থাকে তবে জানিও। ফতনায় ঘনঘন টোকা দেওয়া পুঁটি হয়ে অপেক্ষায় থাকি, কাজ হয়—আমার মতো সামান্য পুঁটি শিকারে ব্যর্থ ছিপের মালিক চূড়ান্ত অপমানবোধ করেন এবং স্বেচ্ছায় চানা খেতে রাজি হওয়ার আমার দেওয়া প্রস্তাবে এগিয়ে আসেন। আমাদের দেখা হবার রাত, সে ছিল এক ঘুটঘুটে রাত, আলোয় মোড়ানো ঢাকা শহরে এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা থাকতে পারে তা আমার বিশ্বাসের ধারাপাতের বাইরে ছিল। আমরা মিলিত হই, থানায় ঘনঘন ফোন করা তিনিও আসেন, সাথে আসে তার পোষা পা চাটার দল। থানা থেকে বের হয়ে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছিলাম, তবিবরের ক্ষমতাবাপের সাথে দেখা করার জন্য কিছুটা প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। কৌশলে জায়গাটা আমিই নির্ধারণ করি, কী ভেবে তিনি রাজিও হন। মুখোমুখি নয়, আমি বসি মাটিতে, খানিক ওপরে তিনি বেঞ্চিতে। আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন আমি খুনটা করেছি, উত্তরে কিছু বলি না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, মাঘশীতের রাতে গাঢ় জমাটবাধা কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা কুশর খেতের মতো ঘন আমার দৃষ্টি, তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে ভয় দেখাস! তোর এত সাহস! জানিস এই মুহূর্তে কুত্তার মতো তোকে গুলি করে এখানে পুঁতে রেখে যেতে পারি!’ আমি জানি তিনি তা পারেন, কেন করেননি জানি না। হয়তো তবিবরকে তার আরও কিছু দিন প্রয়োজন ছিল। আমি খালি পায়ে, ছোটোবেলায় হাডুডু খেলার সময়ে লেংটি মারার মতো করে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত লুঙি, মারের চিহ্নগুলো বাঘের শরীরের ডোরাকাটা দাগের চেয়েও উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করছে। থানায় পা ওপরে আর মাথা নিচে করে ঝুলিয়ে রাখার কারণেই কী না মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের সব রক্ত দুই চোখে এসে জমেছে—ডুবন্ত সূর্যের মতো দুইটা চোখ। নিজেকেই চিনতে পারছি না—আমি অবশ্য এমন একজনকেই নিজের ভেতরে দেখতে চেয়েছি। ইতোমধ্যে বুঝে গেছি আমার আয়ুর সময়ঘড়ির ব্যাটারি খুব বেশি অবশিষ্ট নেই, হয়তো তবিবরের চেয়েও করুণ মৃত্যু আমার ওপর ঢেলে দিয়ে তিনি বস্তিবাসীকে বোঝাতে চাইছেন তার পোষা কুত্তাকে হত্যার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে। অথচ খুনটা আমি করিনি।
দুনিয়া পালটাচ্ছে, পালটে যেতে থাকি আমিও, যেভাবে পালটে গেছে পদ্মা তীরবর্তী মাইলের পর মাইল ভূমির চালচিত্র। আমিও বুঝে নিচ্ছিলাম কীভাবে পিছল এঁটেল মাটিতে গোড়ালি গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শিখে নিচ্ছিলাম কীভাবে নিজের অস্তিত্ব—গভীর থেকে পরিষ্কার করতে হয় শ্যাওলা। আমাদের জগতে নতুন নতুন পালক লাগছে, সেই পালক ক্রমশ সেজে উঠছে বাহারি রঙে।
হাতের তালুর ভেতরেই আমার স্বস্তি হয়ে বড়ো হতে থাকে ছেলেটা, একইসাথে হাতের রেখাতেও দ্রুতই আসতে থাকে পরিবর্তন—না ভয় আমি পাইনি বরং বুঝতে পারছিলাম ভয়ের ইজারাদার হয়ে উঠছি ক্রমশ। আবার এও বুঝতে পারছিলাম স্বস্তি ও ভয় এক তালুতে স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠতে পারে না কিছুতেই। তাই ছেলেটিকে একটা ভালো বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই, সে বেড়ে উঠুক বেড়ে ওঠার নিয়মে—মেঘে ও বৃষ্টিতে, ঝড়ে ও বাতাসে, আলো ও অন্ধকারে। সে আমার নিকট ক্যারামের বোর্ডে স্ট্রাইক থেকে দূরে কিন্তু পকেটের একদম কাছে থাকা রেডের মতো হয়ে উঠতে থাকে। কপালে সাদা বা কালো যা-ই আসুক, গুটিগুলোকে সামলে নিয়ে আমার জন্য রেড হয়ে ওঠা ছেলেটির লক্ষ্যে পৌঁছানোর রাস্তা পরিষ্কার রাখার ব্যাপারেও সচেতন হয়ে উঠতে থাকি আমি। নিরাপদ দূরত্ব থেকে তাকে ছায়া—জল—রোদ দেই, যেন সে শেকড়ে ও আকারে বৃক্ষ হয়ে উঠতে পারে। সে-ও বড়ো হচ্ছিল দ্রুতই, আমিও তা-ই চাচ্ছিলাম। মাতাপিতাহীন ছেলেটি দ্রুত বুঝে গেছে স্রোতে ভেসে যাওয়া সহজ কিন্তু স্রোতের বিপরীতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে যেতে পারলে পালটে ফেলা সম্ভব স্রোতের গতিপথ, রুখে দেওয়া সম্ভব ভাঙন, গড়ে তোলা সম্ভব নতুন বসতি, এমনকি গহিন অতলও খুঁজে পেতে পারে তল। দুনিয়া পালটাচ্ছে, পালটে যেতে থাকি আমিও, যেভাবে পালটে গেছে পদ্মা তীরবর্তী মাইলের পর মাইল ভূমির চালচিত্র। আমিও বুঝে নিচ্ছিলাম কীভাবে পিছল এঁটেল মাটিতে গোড়ালি গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শিখে নিচ্ছিলাম কীভাবে নিজের অস্তিত্ব—গভীর থেকে পরিষ্কার করতে হয় শ্যাওলা। আমাদের জগতে নতুন নতুন পালক লাগছে, সেই পালক ক্রমশ সেজে উঠছে বাহারি রঙে। সমস্যা হলো আমি যাকেই আঁকড়ে ধরেত চেয়েছি তখনই সে আমার হাত থেকে পিছলে গেছে। আমি আর কাউকে আঁকড়ে ধরতে চাই না, যে আসে আসুক, যে যেতে চায় যাক। জীবনের করাতপথ তো আমাকে কম ক্ষতাক্ত করেনি!
যেমনটা চাচ্ছিলাম তেমনটাই ঘটছে—চাচ্ছিলাম তিনি উত্তেজিত হোন, উত্তেজিত হয়ে একটা ভুল করুন, কিন্তু তিনি তো আমার চেয়ে কম সেয়ানা নন—বারবার জিজ্ঞেস করে উত্তর পাচ্ছিলেন না। বনানী এগারো নাম্বার রোডের শেষমাথায় গুলশান লেক ঘেঁষা পানি উন্নয়ন বোর্ড কোয়ার্টারের পেছনে গাছগাছালির আড়ালের অন্ধকারময় জায়গাটায় আমরা মিলিত হয়েছিলাম। ঢাকা শহরের ভেতরে এত স্তব্ধ একটা জায়গা থাকতে পারে তা কারো কল্পনাতেও আসার কথা নয়—কিন্তু খুঁজে পেয়েছিলাম আমি এবং সযত্নে আড়ালে রেখেছিলাম। আমার মাথা বরাবর একটা পিস্তল তাক করে তিনি আমাকে শাসাচ্ছিলেন, সবকিছু হারানো আমার মতো নিঃস্ব একজনকে তিনি শাসাচ্ছেন, এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিচ্ছিল। না ভয় আমার করছিল না, আঘাতে আঘাতে পাথর হয়ে উঠেছিলাম, তা হয়তো তিনি জানতেন না। আমার মতো একজনকে মেরে ফেললে এ শহরের একটা কাকপক্ষীও ডেকে উঠবে না এমনি বলছিলেন তিনি। আমি চাচ্ছিলাম আরও উন্মত্ত হোন তিনি, উত্তেজনার বশে বড়ো ধরনের একটা ভুল করে বসুন, তাতে আমার উদ্দেশ্য সফল হয়। শহরের হৃৎপিণ্ডে বসে থাকা রক্তচোষা জোঁকের মতো গাঢ় অন্ধকার আমাদের চুষে খাচ্ছিল। আমি উবু হয়ে তার সামনে বসেছিলাম। ধনুকের মতো আমার পিঠে তার ইঙ্গিতের আঘাতগুলো কথা বলছে অবিরত—না থানা থেকে কেউ আসেনি। তবে তার সার্বক্ষণিক কুকুরের দল আশপাশেই ছিল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে বাহবা দিচ্ছিলাম আমি। উহুঁ, কিছু না বলার সিদ্ধান্তেই অটল থাকার ব্যাপারে অনড় ছিলাম—দেখতে চাইছিলাম তবিবরের ক্ষমতাবাপ হয়ে ওঠার জন্য আসলে কী কী লাগে, কীভাবে এরা তবিবরদের আঙুলের ডগায় নাচায়, আর তাদের ইশারায় মানুষের মুখে আগুন ঢেলে দিতেও ইতস্তত করে না তবিবররা। ধরেই নিয়েছিলাম, সেদিনই আমার শেষ দিন। বুঝতে পারছিলাম তার হাতের পিস্তলটার রক্ত গরম হয় উঠছে, যখন তখন আমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারে তা। জানি আমার মতো একজনের লাশ গুলশান লেকের উচ্চবিত্ত জলে ভাসলেও কারো কিছু যাবে আসবে না, আর আমার মৃতদেহকে তবিবরের হত্যাকারী হিসেবে চালিয়ে দেওয়া আরও সহজ হবে। ট্রিগার চালানোর জন্য তিনি আঙুল বাঁকা করার মুহূর্তেই আমিও বেঁকে বসলাম। আমার রোদে পোড়া তামাহৃদয় একবার বেঁকে বসলে তা সহজে সোজা হবে না তা হয়তো তিনি বুঝতে পারেননি। এখানে আসার আগেই গাছপালার আড়ালে দড়ি দিয়ে মুখ বেঁধে রাখা চটের একটা ব্যাগ রেখে গিয়েছিলাম। তাকে একটা জিনিস দেখাব বলে অনুমতি নিয়ে আড়াল থেকে ব্যাগটা বের করে আনি। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ব্যাগের মুখ খুলে আমার সেই ধারালো দা তার সামনে রাখি। তিনি তখনো আমার দিকে পিস্তল তাক করেই আছেন, আমার দা বের করা দেখে হো হো করে হাসেন, এবং পিস্তল নাচিয়ে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়ে বারবার বলেন, আমার দা-এর চেয়ে তার পিস্তল হাজারো গুণ শক্তিশালী, হাসতে হাসতেই ক্রোধে উন্মাদ হয়ে যান, আমার বুক বরাবর পিস্তল তাক করে ট্রিগারে শক্তি চালানোয় মনস্থির করেন। না আমি ভয় পাইনি, যার কিছু থাকে না তার ভয়ও থাকে না। ব্যাগের ভেতর হাত চালিয়ে একটা কাটামুণ্ডুর চুল মুঠি করে ধরে তার সামনে উঁচিয়ে ধরলাম। ভেবেছিলাম দা কিম্বা পিস্তলের চেয়েও শক্তিশালী অস্ত্র মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া, মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া আর খোয়াড়ের ইজারা নেওয়া একই কথা—ধরো, ভরো, আদায় করো—ব্যস, এই তো কাজ। আমার সাহসের চুলোয় শুকনো খড়ি ঠেলে দিয়েছি আমি, দেখা যাক! যারা খুন করে ফেলে রেখে যায় তবিবরকে, মুণ্ডু কেটে রেখে যায় আমার ডেরায়, তারাও হয়তো আমারই মতো নিঃস্ব, অত্যাচারিত, তারাই হয়তো চেয়েছিল আমি দেখা করি তবিবরের বাবার সাথে, হয়তো তারাই চেয়েছিল আমি হয়ে উঠি তাদেরই ভেতরের অন্য কেউ একজন—কী দেখেছিল আমার ভেতর তাও জানি না।
জমাট দইয়ের মতো পরিস্থিতি এখানে। আমার হাতে ঝুলতে থাকা মুণ্ডুটির মুখে গুলশান লেকের ওপার থেকে চুইয়ে আসা অবিশ্বাসী আলোর যতটুকু এসে পড়ছে তাতে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না মুণ্ডুটি কার! যারা খুন করেছিল তারা তবিবরের অক্ষিকোটর থেকে তার চোখ দুটো উপড়ে নিয়েছিল। আমার দিকে পিস্তল তাক করে রেখেই চোখ বুজলেন তিনি, বুজলেন নাকি অন্ধ হয়ে গেলেন তা বুঝতে পারছিলাম না আমি! চোখ গেছে তবিবরের আর অন্ধ হলেন তিনি, জীবন গেছে তবিবরের মতো মৃত দেখাচ্ছে তাকে! চোখ খোলামাত্রই তিনি আমার চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিলেন। বুঝতে বাকি রইল না, বল নিয়ে আমি গোলপোস্টের দিকেই দৌড়াচ্ছি—গোলপোস্ট যত দূরে সরুক না কেন, গোল দেওয়া থেকে আমাকে রুখতে পারবে না কেউ, অপেক্ষা শুধু সময়ের। নিজেকে সামলে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার মধ্যেই কিছু একটা বলতে গেলেই মুণ্ডুটিকে সজোরে নিক্ষেপ করলাম আভিজাত্যের অহংবোধে ফুসতে থাকা গুলশান লেকে, মানুষের জীবনশ্বাসে আগুন দিতে দিতে অনেক ক্লান্ত তবিবর, ঘুমাক সে গভীরে। এখন তিনি গুলি চালালেও সমস্যা নেই আমার, আমি অন্তত তরুকে কিছু একটা বলতে পারব, আমার তরু, আমার দুই সন্তান!
নিকট অতীতকে তালুর উলটো পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে সামনে এগুতে থাকি আমি। সামনে এগুনো ব্যতীত আর কোনো রাস্তা খোলা থাকে না আমার—যেভাবে ছিল না সর্বগ্রাসী পদ্মার। এক লহমায় সে খেয়ে ফেলেছিল আমার তৎকালীন বর্তমানকে। দিনে দিনে বুঝতে পারছি নদীর কোনো দোষ থাকে না, নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে স্রোত তাকে যেভাবে যেদিকে যেতে বলে সেভাবেই যেতে হয় তাকে, যায় বলেই হয়তো টিকে থাকে। হয়তো স্রোতের দেখানো পথে না হাঁটলে হারিয়ে যেতে হয় নদীকেও। স্রোতের ভেলায় চড়ে বসেছি আমিও, স্রোত আমাদের যেদিকে যেভাবে নেবে সেদিকেই যেতে থাকব, কারণ আমাদের কারো হাতেই বৈঠা নেই। অবশ্য স্রোতকে শাসন করার উপায় শিখে গেলে কী উজান কী ভাটি সবই চলে আসে ইশারার নাগালে। আমিও শিখে নিচ্ছি সে উপায়।
সেই রাতের ঘটনার পর সবকিছু দ্রুত পালটে যেতে আরম্ভ করল। না আমাকে সেদিন তিনি আর কিছু বলেননি, বলতে পারেননি, ফিরে গিয়েছিলেন, ফিরে গিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার অফিসে। সেই প্রথম সম্মানের সাথে গুলশান এক নম্বর চত্বরে দাঁড়াই আমি। না এরপর আর থামিনি। সব হারানোর বেদনাকে প্রার্থনায় রূপ দেই—বাড়ি হারানো, দাদির ভেসে যাওয়া, ভায়ের আত্মহত্যা, আমার প্রতিটি শ্বাস হয়ে থাকা তরুকে হারানোর বেদনা, বাচ্চাদের হারানো—না ঘুমাতে পারিনি আজ অবধি। বুঝে গেছি একমাত্র মৃত্যুই আমার চোখে ঘুম এনে দিতে পারে। সেদিন আমাকে তার চেম্বারে ডেকে কড়াইলের দায়িত্ব দিতে চান তিনি, আমাকে নতুন তবিবর বানাতে চান। এসবের কিছুই চাইনি আমি, শুধু তার চোখে ভয় দেখতে চেয়েছিলাম। আমি না করিনি কিন্তু তিনি জানতেন না আমার লক্ষ্য! তার জানার প্রয়োজন নেই, নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হই, রাজা হতে সক্ষম আমি, শুধুমাত্র রাজা বনে থাকা ভীতু মানুষদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে পারলেই হলো, একজন ভালো ম্যানেজার হয়েও উঠতে হবে, হয়ে উঠতে হবে একজন মধ্যস্থতাকারী।
ক্রমেই গুলশানের আকাশ আমার নখদর্পণে আসা আরম্ভ করে। কোথায় কাক ওড়ে আর কখন শকুন তা জানতে এখন আমার দুই দণ্ডও লাগে না। সময় লাগে না কে কোথায় কার কোলে বসে মাতলামি করছে তা জানতে। কে কোনো ঠিকাদারি পাচ্ছে বা কোথায় কে কাকে আটকে আদায় করে নিচ্ছে অঢেল সুবিধা। না আমি কড়াইল বস্তির দায়িত্ব নিইনি, পারিনি ফি বছর আগুন লাগা বন্ধ করতেও, পারিনি ঠেকাতে করুণ মৃত্যুও, চাইলেও হয়তো পারতাম না। শুধু ভয় ধরাতে চেয়েছি তাদের হৃদয়ে। তারা এখন ভয়ার্ত সহিস—আর আমি ছুটন্ত ঘোড়া।
তবিবরের কাটামুণ্ডু দেখে যিনি সেই সন্ধ্যায় গুটিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিও মারা যান, আচমকা। না অসুস্থ হয়ে নয়— সময়ের অসহায়ত্ব দিনে দিনে একটু একটু করে তাকে মৃত্যুর কিনারে টেনে নিয়ে গেছে। আমি শুধু কিনার থেকে অতল গভীরে পড়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করেছি। তার একমাত্র মাদকাসক্ত ছেলে এক সন্ধ্যায় বাসার ছাদে উঠে নিজের দুই হাতের রক্তনালিতে ছুরি চালায়। রক্তক্ষরণের ফলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, নিজের এই পরিণতির জন্য বাবাকেই দোষারোপ করে সে। তিনি দৌড়ে ছাদের সিঁড়িতে গিয়ে দেখেন ছাদ থেকে দরজায় ছিটকিনি দেওয়া। আমিও ছিলাম তার সাথেই, অনেক চেষ্টার পর দরজা খোলা হলে দেখা যায় ছেলে আর ছেলে হয়ে নেই, সে হয়ে গেছে দীর্ঘ দিন গাছের গুঁড়ির চাপায় পড়া ফ্যাকাশে ঘাস। না, চেষ্টা করলে দরজা আমি খুলতে পারতাম, কিন্তু খুলিনি, আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম সন্তানের মৃত্যুর সময় কিছুই করতে না পারার বেদনা কেমন! তরুও তো ঠিক এমনই করেছিল আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে! পারেনি।
যখন পতন অবশ্যাম্ভাবী তখন তা সব দিকে থেকেই আসে। তাকে আরও দুর্বল করে দিতে তার স্ত্রী-র পরকীয়ার খবর প্রমাণসহ খুঁজে বের করে জানাই তাকে। তিনি আরও গুটিয়ে যান। না মানুষকে দিনের পর দিন অত্যাচার করার ফল যখন আসা আরম্ভ করে তখন তা সুদে আসলে আস্তে থাকে। কিছু দিনের মধ্যেই তার চৌদ্দ বছরের কন্যাও ধর্ষিত হয়, শিকার হয় হত্যাকাণ্ডের, তাও নিজেরই বন্ধু বলয়ের দ্বারা। মামলা হয়, কিন্তু হয়তো তিনিও জানতেন মামলা চলবে মামলার নিয়মে, বিচার কাঁদবে সময়ের অত্যাচারেই। তিনি এক দিন হুট করে মারা যান, বাথটাবে ডুবে মারা যান তিনি, সেখান থেকে তার পোশাকহীন মৃতদেহ বের করে আনে পুলিশ।
আমি নিড়ানি নিয়ে মাঠে নামি, অপ্রয়োজনীয় আগাছার শেকড় ধরে তীব্র আক্রোশে তুলে আনি, ফেলে দেই ভাগাড়ে। দিনে দিনে বাড়তে থাকে আমার হাতের সংখ্যা, বাড়তে থাকে আমার ফুসফুসের সক্ষমতা, আমার আঁকা আকাশের ছায়াতলে এসে জমতে থাকে অনেক তববির ও তাদের পাতিপিতারা।
এরপর চলে যায় অনেকগুলো বছর। আমি নিড়ানি নিয়ে মাঠে নামি, অপ্রয়োজনীয় আগাছার শেকড় ধরে তীব্র আক্রোশে তুলে আনি, ফেলে দেই ভাগাড়ে। দিনে দিনে বাড়তে থাকে আমার হাতের সংখ্যা, বাড়তে থাকে আমার ফুসফুসের সক্ষমতা, আমার আঁকা আকাশের ছায়াতলে এসে জমতে থাকে অনেক তববির ও তাদের পাতিপিতারা। পতনোন্মুখ রাজ্য নিজের পতন ঠেকাতে নতুন রাজার খোঁজে হন্যে হয়ে এদিকওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে তা বুঝতে সময় লাগে না আমার।
সময়ের পাপ আর নোংরামি থেকে দূরে রাখতে এ লেভেল পাশের পরই ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আমেরিকা। খুব ভালো ফলাফল করে সে, আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা আরম্ভ করছে। তাকে নিষেধ করি সে যেন ফিরে না আসে এই অন্ধকার খোঁয়াড়ে। তরু গ্রুপ অফ কোম্পানিজের সকল সম্পত্তি উইল করে দেওয়া আছে হয়েছে তরু ফাউন্ডেশনের নামে— এই ফাউন্ডেশনের সাহায্যপ্রাপ্ত ছিন্নমূল শিশুরাই বড়ো হয়ে ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব নিয়েছে, দূরে থেকেও ছেলেটিই বাকিটা করে। দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাচ্ছি বুঝতে পেরেও তাকে আসতে নিষেধ করি, কর্ণপাত করে না আমার কথায়, ফিরে আসে সে।
আমার ফুরিয়ে যাওয়ার সেই সনির্বন্ধ সন্ধ্যায় মুখোমুখি বসি আমরা—একটা গল্প শোনাতে চাইলে না করি আমি, আমরা দুইজনই অনেক আগে থেকেই জানি ‘মণিমালা’ সম্পর্কে আমাদের কে ছিলেন!
জন্ম : ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ালেখা শেষে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। লেখালেখি করেন প্রাণ থেকে। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: ‘যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব’, ‘অতীতা, দুঃখরা পাখি হয়ে গেল’, ‘বাংলাদেশে হৃদয় মেশে’, অনুজ্জ্বল চোখের রাত (কবিতা)। গল্পগ্রন্থ: ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’। এই পাণ্ডুলিপির জন্য তিনি জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা থেকে ইতিকথা মৈত্রী সাহিত্য সম্মাননা-২০১৭ লাভ করেছেন।।