রাধার সাথে একবার শিবের দেখা। মহাদেবের তো সূর্যসমান মুখচ্ছবি। নীরবে হেসে রাধিকার সামনে দাঁড়ালেন। প্রচণ্ড তেজে চারিদিক জ্বলে উঠল। মানবী রাধার পক্ষে চোখ মেলে তাকানো যেন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। কৃষ্ণকাতর বিষণ্ণ মন নিয়ে তাই তিনি মহাদেবকে প্রত্যাখ্যান করলেন ।
সম্বর সম্বর মহিমা তব, হে ব্রজেশ ভৈরব,
আমি ব্রজবালা,
হে শিব সুন্দর, বাঘছাল পরিহর, ধর নটবর-বেশ
পর নীপ-মালা৷
কৃষ্ণ শিবের তুলনায় অধিক মানবিক। শিবের চেয়ে অনেক বেশি প্রেমিক। গোয়ালিনী রাধিকা ব্রজবালা। ভৈরবের তীব্রতা তাঁকে টানে না। বাঘছালের জৌলুস আনন্দ-বিস্ময় হয়ে তাঁকে আকর্ষণ করে না।
পার্বতী নহি আমি, আমি শ্রীমতী
বিষাণ ফেলিয়া হও বাঁশরী-ধারী ৷৷
শ্রীমতি রাধা, কৃষ্ণ আর শিবের সাথে তুলনায়, কৃষ্ণকে এগিয়ে রাখলেন। বিষাণের ভীষণ আওয়াজের বদলে তিনি চান বাঁশের বাঁশির প্রেম-উচাটন সুর।
আহীর-ভৈরব রাগের ওপর ভিত্তি করে রচনা করা ‘অরুণ-কান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানে এই যে গল্পটি পাওয়া যায়, তা সচরাচরের ধর্মীয় বা পৌরাণিক গল্পের চেয়ে অনেকখানি ভিন্ন। শিবের সাথে রাধার সাক্ষাতের গল্প কেবলই নজরুলের কবি, গল্পকার মনের কল্পনাজাত । মজার ব্যাপার হলো ‘আহীর’ মানে গোয়ালা আর ‘ভৈরব’ তো শিব। হয়তো এই রাগের নামের কারণেই গল্পটির উদ্ভব। যে কারণেই হোক না কেন গানটির কথা থেকে দুটো বড়ো মন্তব্যে পৌঁছানো যায় নজরুলের গান সম্পর্কে:
ক. নজরুলের গান আসলে গল্পও বলতে জানে। সুর, রাগ, পরিবেশনা রীতি ইত্যাদি ছাড়াও কেবল গল্প থাকার কারণে ‘পোয়েটিক ফিকশন’ বা ‘মিউজিক্যাল স্টোরিটেলিং’ হিসেবে এসব গানের গুরুত্ব যথেষ্ট।
খ. গানে নজরুল পুরাণের বিনির্মাণ করেছেন এক দারুণ ভিন্ন ধারায়, অনন্য যোগ্যতার সাথে।
মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা যেভাবে রবীন্দ্রনাথে এসে আরও রঙিন হয়ে ফুটেছে। নারসিসাস যেমন গ্রিক পুরাণের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল অস্কার ওয়াইল্ডের গল্পে। নজরুল তেমনি কালী, কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, শিব, রাধাকে অন্য রঙে এঁকেছেন। কখনো কখনো কেবল রঙের বদল নয়, কিংবদন্তির কালী, কৃষ্ণ, রাধা নজরুলে এসে সময়ে সময়ে যেন অন্য দেবতা, অন্য প্রেমিক, অন্য বৃক্ষের ভিন্ন ফুল।
ক.
১৮৯৪ সাল। পোয়েমস ইন প্রোজ নামে একটি মোটামুটি নতুন ধরনের বই প্রকাশ করেন আইরিশ কবি, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ড। গ্রিক পুরাণের নার্সিসাস, বাইবেলের শেষ বিচারের গল্প ইত্যাদি নিয়ে বেশ কয়টি কাব্যিক গল্পের সংকলন। কবিতায় গল্প বলা নতুন কিছু নয়। মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতন প্রাচীন এবং বিখ্যাত লেখাগুলো আসলে সুদীর্ঘ কবিতায় বলা অতিদীর্ঘ গল্প। সেখানে আমারা কবিতার মাত্রা, ছন্দ, অন্ত্যমিল সবই পাই। যা পাই না তা হলো ব্যক্তি আবেগের সহজ প্রকাশ, অল্প কথায় প্রকাশ করা বিশাল অনুভূতির স্বাদ। অস্কার ওয়াইল্ড এই অপূর্ণতাকে পূরণ করে দিলেন। আমরা পুরাতন কবিতার মাত্রা, ছন্দ, অন্ত্যমিল পেলাম না কিন্তু আবেগী ভাষা পেলাম, কবিতার মতন জমানো অনুভূতি পেলাম।
গানেও তেমনি গল্প থাকতে পারে। যাত্রা, নাটক, সিনেমার গানে হামেশাই গল্প থাকে। তাহলে নজরুলের গানে গল্প খুঁজতে চাওয়া বা খুঁজে পাওয়ার বিশেষত্ব কী?
বিশেষত্ব হলো গানকে, সুর, তাল, লয়, রাগ-রাগিনীকে নজরুল কেবল গল্প বালার নিছক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেননি। বরং গল্পকে করেছেন সংগীতের প্রকাশ বা বিকাশের অন্যতম অনন্ত আকাশ। গল্পের আকাশ থেকে গানের বৃষ্টি যে খুব সহজেই নামতে পারে নজরুল তা করে দেখিয়েছেন। অনেক সময় আগে থেকে আগে সুর, রাগিনী নির্ধারণ করে গল্প রচনা করেছেন। সুর প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে গল্প। ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ এই সাংগীতিক গল্প বলার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
নজরুল সৃষ্টি করলেন ‘উদাসী ভৈরব’ নামের এক নতুন রাগ। সেই রাগের প্রকাশ করতে রচনা করলের উদাসী শিব নিয়ে এক গল্প। ‘সতী-হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে’ শিরোনামের এই গানের গল্পে শিবের বিষাদগ্রস্ত, উদাস, বিরহী এক রূপ পাওয়া যায়। বিষাণ, ত্রিশূল সব ফেলে দিয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন মহাদেব। মাথার জটাজুড়ে যেন স্থির গঙ্গার ধারা, ‘নিস্তরঙ্গা’। তাঁর ললাটের আলো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। দেবী-হারা অসহায় এই অন্য শিবের ওঙ্কার ধ্বনিতে বিরহকাতর প্রেমিকের চিরন্তন কান্নার সুর। সেই কান্নার মায়ায় ‘ভগবান শঙ্কর’ ভক্ত মানবের চোখে এখন অতি আপন মানুষের মতন। সুন্দরতর দেবতা।
দুই করে দেবী-দেহ ধরি’ বুকে বাঁধে
রোদনের সুর বাজে প্রণব নিনাদে।
ভক্তের চোখে আজি ভগবান শঙ্কর—
সুন্দরতর হ’ল পড়ি মায়া ফাঁদে।
খ.
নজরুল পুরাণে মগ্ন ছিলেন। কৃষ্ণ আর কালীকে তাঁর গানে পরম আরাধ্য মনে হয়। কিন্তু এই আরাধনায় পূজার চেয়ে প্রেম বেশি। যতখানি ভক্তি, তার চেয়ে বহুগুণ ভালোবাসা। ধর্মের চেয়ে সেখানে মানবতা বেশি। স্বর্গ নরকের চেয়ে পৃথিবীর প্রকাশ এই সব গানে অধিক গুরুত্ব পায়। কালী যেন আর রক্তচক্ষুধারী প্রবল দেবী নন। বরং এক অতি অভিমানী মেয়ে। অবুঝ, মায়াময়। কালীকে মাতা জ্ঞান করে সন্তান হিসেবে নয়, এখানে কবি যেন দেবীর পিতা। স্নেহের উদ্বেগে, আদরের আবহে মেয়ের রূপ, স্বভাব আর আবেগের বর্ণনা করে চলেছেন।
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে কে দিয়েছে গালি—
রাগ ক’রে সে সারা গায়ে মেখেছে তাই কালি।।
যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে
আরও মধুর লাগে তাহার হাসি–মুখের চেয়ে
বাবার মন। মেয়েকে রাগিয়ে নিজের আবেগ বেঁধে রাখতে পারেন না। চোখ ফেটে জল গ’লে আসে। মেয়ে সেই জলের ভাষা বুঝতে পেরে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেন কোনো দেবালয়ের গল্প নয়, দেবী-ভক্তের ভক্তি-আশীর্বাদ বিনিময় নয়। পিতা আর কন্যার মধুর, মায়াবী, স্বচ্ছ, মানবিক সম্পর্ক। জবা ফুল ভক্তি বা ভয়ে অর্পণ নয়, ভালোবেসে স্নেহে কাতর উপহার।
রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে,
দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে;
আমার রাগী মেয়ে, তাই তারে দিই জবা ফুলের ডালি।।
আরেক গানের গল্পে যেন কবি নিজেই মাতৃরূপ ধারণ করেন। কন্যা কালীকে খানিক স্নেহসিক্ত ভর্ৎসনাও করেন। মেয়ের ঘরে মন বসে না, তাই যেন মায়ের উদ্বেগের অন্ত নাই। কালী কেন অন্য জায়গা ফেলে শ্মশানচারী, তাই নিয়ে তাঁর আর দুশ্চিন্তা কাটে না।
ওরে সর্বনাশী! মেখে এলি এ কোন চুলোর ছাই!
শ্মশান ছাড়া খেলার তোর জায়গা কি আর নাই।।
মায়ের অবাধ্য অবুঝ মেয়ে, যেন না বুঝে গায়ের রং এমন অঙ্গার করে এসেছে। সেই কালো রং মা চোখের জলে ধুয়ে দেবেন। একদম চিরাচরিত বাঙালি মায়ের মতোন কবি দেবীকে কন্যাজ্ঞানে সম্বোধন করছেন ‘হাড়-জ্বালানী মেয়ে’ বলে।
ওরে হাড়-জ্বালানী মেয়ে, হাড়ের মালা কোথায় পেলি,
ভুবনমোহন গৌরী রূপে কালি মেখে এলি!
তোর গায়ের কালি চোখের জলে
আমি ধুইয়ে দেবো আয় মা কোলে;
তোরে বুকে ধরেও রি জ্বলে, আমি দিই মা গালি তাই।।
আরেকটি গানের কথায় পাওয়া যায় শ্যামার অর্থাৎ কালীর এক অভিনব অবতারের গল্প। নজরুল লিখছেন কালী তাঁর কোনো এক আবেগাক্রান্ত ভক্তের সামনে এসে দাঁড়ালের শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণ হয়ে।
‘শ্যামা বলে ডেকেছিলাম, শ্যাম হয়ে তুই কেন এলি?’
শ্যামা থেকে শ্যামে রূপান্তর। ভক্তের গেরুয়া বসন পরিণত রাধার অঙ্গদে।
‘মোর গেরুয়া রাঙা বসন কেড়ে দিলি রাধার সোনার চেলি।’
এ যেন ভক্তির উপহারস্বরূপ প্রেম লাভ। মাতৃরূপ ছেড়ে প্রেমিক হিসেবে দেবশক্তির আবির্ভাব। অথবা হিন্দুধর্মের দুই প্রধান ধারা, শাক্ত আর বৈষ্ণবের মধ্যে মেলবন্ধনের প্রয়াস এই গল্পধর্মী গান।
দেব, দেবীকে ভয় বা ভক্তির করার চেয়ে বরং ভালোবাসাতে বললেন কবি নজরুল। অনেকটা বৈষ্ণব আর সুফি ধারার মতন হলেও কবি এখানে স্বকীয়। কারণ কালী, শিব, কৃষ্ণকে তিনি নিজস্ব কায়দায় সৃজনশীল সাহিত্যের চরিত্র করে তুলতে পেরেছেন। রক্ষণশীল পুরাণের থেকে তিনি প্রচুর নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সমস্তকে তিনি অনেক সময় ‘রোমান্টিক কাব্যে’ পরিণত করেছেন। নজরুলের শ্যামাসংগীত, কীর্তন বা অন্যান্য পুরাণ-কেন্দ্রিক অনেক গান তাই, বলতে গেলে, সাংগীতিক গল্প (মিউজিকাল স্টোরি)। সুর সরিয়ে নিলেও এরা গুরত্বপূর্ণ। কারণ চাইলেই এইসব গানকে বিচিত্র, অভিনব, স্বকীয় ধারার গল্প হিসেবে পড়া যায়।
আমাদের প্রায় সবারই নজরুলের গান গাওয়া বা শোনা হয়। এবার চলুন নজরুল সংগীতের বই খুলে গল্প পড়ি।
* গানের কথাগুলো নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ও রশিদুন্ নবী সম্পাদিত ‘নজরুল সংগীত সংগ্রহ’ থেকে নেওয়া।
আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে, ১৯৯০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছোটগল্প ও কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ২০১০ সালে । এখন পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বই দুইটা, অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান (২০১৬) ও যুদ্ধ যুদ্ধ রুদ্ধ দিন (২০২০)। প্রথম গল্প সংকলন বছরের দীর্ঘতম রাত প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।