১.
তরু পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মা ডাকছে, তরু শুনে যা। পাতা ডাকছে, আয় আয়! রোদ খেলছে, বৃষ্টি নামছে। তরু আজ কারো কথা শুনবে না। তরু হাঁটছে, তরু দৌড়াচ্ছে। তরু আজ সিনেমার মতো বড়ো হয়ে যাচ্ছে। তরু, ফিরে আয় বাবা। তরু নাহ, তরু আজ আর ফিরবে না। পাতার ওপর দিয়ে, রোদের ভেতর দিয়ে তরু আজ চলে যাবে ওই দূরে। যেখানে মাউথ অর্গান বাজাতে বাজাতে স্কুল পালানো ছেলেটি চলে গেছে, সেই লাল পাহাড়ে তরুও চলে যাবে। একেবারেই যাবে। আর ফিরবে না।
২.
দুপুর পেরিয়ে গেছে, তরু ফিরছে না। মা তখনো ডাকছে আয়, আয়। তরু সায় দেয় না। ওই তো তরু। গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। মা এগিয়ে যায়, নাহ তরু নেই। দুপুরের মরীচিকা। আছে শুধু তরুর মাউথ অর্গান। মা ফের চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘তরু তরু’ সেই ডাকের প্রতিধ্বনি ফিরে আসে। তরু ফেরে না। পুকুরে জাল ফেল, কেউ বড়ো রাস্তায় যাও, পাশের বাড়িতে খোঁজ নাও। তরু তরু—ফুল, পাখি, লতাপাতাও ডাকছে।
এবার তারাও সঙ্গী তরুর। একটু এগুতেই, স্কুল পালানো ছেলেরা মেঘের ফাঁক গলে দেখে তরুকে। অই তরু, যাস কই? এদেরও পাত্তা দেয় না তরু। সে আজ কাউকে পাত্তা দেয় না। কাউকে গুনে না। একটু পর তারাও যোগ দেয় তরুর দলে।
৩.
তরু চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? তরু এখন লাল পাহাড়ের পেটে। পাতাকুড়ানি মেয়েরা ডাকে—তরু আয় খেলি। তরু ফিরেও তাকায় না। সামনে অর্গান বাদক তরুকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। পাতাকুড়ানি মেয়েরা দৌড়ে আসে, তারাও তরুর পিছু নেয়। তরু একবার তেড়ে আসে। একটু পর তারা আবার আসে। তরু তাদের আর কিছু বলে না। এবার তারাও সঙ্গী তরুর। একটু এগুতেই, স্কুল পালানো ছেলেরা মেঘের ফাঁক গলে দেখে তরুকে। অই তরু, যাস কই? এদেরও পাত্তা দেয় না তরু। সে আজ কাউকে পাত্তা দেয় না। কাউকে গুনে না। একটু পর তারাও যোগ দেয় তরুর দলে। তরু এবার আর কিছু বলে না। মুচকি হাসে। মাউথ অর্গান বাজানো ছেলেটি আগে আগে, তার পেছনে তরু, এরপর পাতাকুড়ানি মেয়েরা এবং স্কুল পালানো ছেলেদের দল।
৪.
তরু তরু—চারপাশে শুধু এই ডাক শোনা যাচ্ছে। তরু কোথাও নেই৷ মাইকিং হচ্ছে, হারানো বিজ্ঞপ্তি, নেভি ব্লু শার্ট আর ঘিয়ে রঙের প্যান্ট। ডান পাশে সিথি। কিন্তু তরু নেই। মা কাঁদছে, বাবা পাগলপ্রায়। পুকুরের জালে তরু নয়, ধরা পড়ে ৬ কেজির কাতল। পাড়াজুড়ে মাতামাতি। তরু নেই কোথাও। শুধু পরে আছে তার মাউথ অর্গান।
তার কথাতেই লাল পাহাড়ে সকাল, দুপুর আর রাত হয়। রোদ ওঠে, বৃষ্টি নামে, মেঘ ওড়ে। তার কথাতেই বজ্রপাত। তবু সব ভেদ করে দূর থেকে মিহি আওয়াজ। তরু তরু ডাক। কান্নার শব্দ। হাত নেড়েও সেসব থামাতে পারে না সে।
৫.
উত্তর পাড়ায় কান্নার রোল, পাতাকুড়ানো মেয়েদের দল নিখোঁজ। বিশ্বাস পাড়ায় শোর স্কুল পালানো ছেলেরা হারিয়ে গেছে। কান্না আর কান্না। ভারী বাতাস। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তরু তরু, পাতার শন শন শব্দ, আর স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি।
৬
অর্গান বাদক হারিয়ে গেছে বহু আগে। এখন তরুর হাতে অর্গান, মাথায় মুকুট। লাল পাহাড়ের চূড়া তার সিংহাসন। পায়ের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে মেউল। তাদের মাড়িয়ে রাজপাটে অভিষেক তরুর। একটু আড়ালে তরুকে পাহারা দেয় সাতটি বানর। তার কথাতেই লাল পাহাড়ে সকাল, দুপুর আর রাত হয়। রোদ ওঠে, বৃষ্টি নামে, মেঘ ওড়ে। তার কথাতেই বজ্রপাত। তবু সব ভেদ করে দূর থেকে মিহি আওয়াজ। তরু তরু ডাক। কান্নার শব্দ। হাত নেড়েও সেসব থামাতে পারে না সে। ঘুমুতে গেলে শব্দের জোর আরও বাড়ে। সারাক্ষণ শুধু তরু, তরু। এক নাগাড়ে এই ডাকে কানে তালা লেগে যায়। তবু থামে না সেই ডাক। মায়ের ডাক শুধু বাড়তে থাকে। তরু আয় আয়।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
জন্ম ১৯৮৮, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই : সূর্যাস্তগামী মাছ (কবিতা) ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার (কবিতা) শেফালি কি জানে (না কবিতা, না গল্প, না উপন্যাস) ক্ল্যাপস ক্ল্যাপস (কবিতা) দ্য রেইনি সিজন (কবিতা) প্রিয় দাঁত ব্যথা (কবিতা) বিষাদের মা কান্তারা (উপন্যাস) সন্তান প্রসবকালীন গান (কবিতা)