আমাদের এই বাড়িটা ভেঙে ফেলা হবে।
ঠিক কবে, এখনও সঠিক বলতে পারছি না। হয়তো কাল পরশু। কিংবা দু-তিন মাস পরে। শুধু জানি ডিসিশন ফাইনাল। এই শব্দবন্ধটাই খানিক আগে বড়ো মামা নানুর ড্রয়িংরুমের কাচের টেবিলটায় দুইবার কিল মেরে বললেন। আমরা ছোটোরা দু-চারজন বাইরে থেকে শুনেছি। বড়োদের হইচই ছাপিয়ে যখন নানুর কান্নার শব্দ একবার কানে এলো, বুঝলাম এখানে আমাদের আর থাকাটা ঠিক হবে না। আমার ছোটো বোন টুবাই, আমি আর আপ্পি সুড়সুড় করে চলে এলাম আরেকদিকে। খেলাধুলো একটা কিছু করা যেত। মনের দিক থেকে তেমন সাড়া পেলাম না। আপ্পিও কেমন গুম হয়ে বসে আছে। টুবাইয়ের মাথায় মাঝে মাঝে একটা দুইটা নতুন খেলার আইডিয়া আসছে হয়তো। আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাচ্ছে। আমি আপ্পির দিকে ইশারা করে ওকে প্রতিবার বোঝাচ্ছি এখন খেলা খেলা করলে যেকোনো সময় গালে চড় পড়তে পারে। আপ্পি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। হঠাৎ চোখমুখ দু-হাতে ঢেকে কাঁদতে শুরু করল। টুবাই ঘটনা কিছু বুঝতে পারছে না। কনফিউজড ভাবে তাকাচ্ছে। একবার আমার দিকে আর একবার আপ্পির দিকে। এই আকস্মিক ঘটনায় ওর ভূমিকা ঠিক কি হতে পারে তা নিয়ে টুবাই চিন্তিত। ঘটনা আমি কিছুটা বুঝতে পারছি। আর তা পারছি বলেই ভাবলাম কিছু না বলে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। টুবাই এত ভাবনাচিন্তার প্রেশার আর নিতে পারল না। জোর গলায় জানতে চাইল, ‘অ্যাই আপ্পি, কাঁদো কেন, অ্যাই তুমি কাঁদো কেন?’ আপ্পি কোনো সদুত্তর দিলো না। ‘তোরা খ্যাল, মেইন গেটের বাইরে যাবি না’ বলে নিজের ঘরে চলে গেল।
মানুষের মনের ওপর আবহাওয়া একটা বড়ো প্রভাব বিস্তার করে। আমার কথাই ধরা যাক। বাইরে বৃষ্টি হতে থাকলে আমি একদম পড়ায় মন বসাতে পারি না। এরকম ঝিম ধরা বৃষ্টিও আমার বেশ ভালো লাগে। মনে হয় একলা কোথাও বসে থাকি। টুবাই হাই তুলছিল। ওকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে আমি ছাদে চলে এলাম।
উঠোনে গিয়ে খেলার মতো পরিস্থিতি নেই। বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকেই। এসময় এমন বৃষ্টি হবার কথা না। অঘ্রাণ পেরিয়ে পৌষ আসি আসি করছে। নিম্নচাপ-টাপ হতে পারে। আবার নানুর ভাষ্য অনুযায়ী শীত নামানো বৃষ্টিও হতে পারে। মানুষের মনের ওপর আবহাওয়া একটা বড়ো প্রভাব বিস্তার করে। আমার কথাই ধরা যাক। বাইরে বৃষ্টি হতে থাকলে আমি একদম পড়ায় মন বসাতে পারি না। এরকম ঝিম ধরা বৃষ্টিও আমার বেশ ভালো লাগে। মনে হয় একলা কোথাও বসে থাকি। টুবাই হাই তুলছিল। ওকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে আমি ছাদে চলে এলাম।
চিলেকোঠার বাড়তি ছাদটুকুতে মাথা আড়াল করে পা দুটোকে ভেজার প্রশ্রয় দিয়ে বসতেই সত্যটা আঘাত করল। এত দিন টের পাইনি, শেষে কিনা চিলেকোঠার ক্ষয়ে আসা সানশেডের এই অবহেলিত বর্ধিত অংশ, যাকে কিনা আমরা ছোটো ছাদ বলি, সেই ছেলেবেলা থেকে, ফেলে আসা শৈশবের সবচেয়ে বড়ো প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াল! পনেরো বছর বয়সের হিসেবে চিন্তাভাবনা বেশি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। কিংবা কে জানে, লোকে হয়তো সবসময় বয়সে দার্শনিক হয় না। দার্শনিক হতে জীবনে যা লাগে তা হলো একটা ধাক্কা!
স্থির চোখে বৃষ্টির ফোঁটা কীভাবে নিচে পড়ে সাধারণের মধ্যে মিশে যায় দেখছিলাম। আমরা মানুষ হয়ে যখন জন্মাই, এক-একজন কী ভীষণ আলাদা, কী ভীষণ সতন্ত্র হয়ে আসি এই মর্ত্যে। তারপর যত বয়স বাড়ে, আমরা অসাধারণদের উদাহরণকে সামনে রেখে একটু একটু করে সাধারণ হয়ে উঠি। হয়তো এই সাধারণ হয়ে যাওয়াটা খারাপ না। বাবাও তো সাধারণ। সরকারি ব্যাংকার। সকালে হাতে একটা ফাইলের ব্যাগ আর একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বের হন। যখন ফেরেন, তখন হয়তো হাতে থাকে এক ডজন কলা, মাঝে মধ্যে ডাল পুরি। অফিসের কোনো মিটিং থাকলে, বা বিশেষ করে ব্যাংক ক্লোজিংয়ের দিন, বাবা রাত করে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু হাতে থাকে বিরিয়ানীর প্যাকেট। আমরা বাচ্চাকাচ্চারা সেই খাবার দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বাবা নিজে খাননি। কিন্তু আমাদের এই ঝাঁপিয়ে পড়া দেখেন প্রশান্তি নিয়ে। সাধারণ মানুষের সাধারণ গল্পেও কী অসাধারণ সব মায়া লেপটে থাকে! সুখী পোকামাকড়ের ঘরবসতি! অসাধারণই হতে হবে এমনটা তো নয়। তবে আমরা পাঠ্যপুস্তকে কেবল অসাধারণদের প্রশস্তি পড়ি কেন? কেন বইয়ের লিখিয়েদের মনে হয় না এই ব্যাপারটি অনেক সময় সাংঘর্ষিক হয়ে দেখা দিতে পারে? হতে চাইলাম রবীন্দ্রনাথ, হতে হলো ব্যাংকের রিসেপশনিস্ট। তখন যদি নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়, সে দায় কার? স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা ভালো, কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে সহজভাবে নেবার শিক্ষা কে দেবে?
কতোক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। মাঝে একবার মেইন গেট খোলার শব্দ শুনলাম। বড়ো মামাদের গাড়িটা কেমন গর্জন করতে করতে বেরিয়ে গেল। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা যেত। ইচ্ছে করল না। গাড়ির শব্দটা মিলিয়ে যেতেই বাড়ির সেই চিরচেনা রূপটা ফেরত এলো। পশ্চিম রণাঙ্গন এখন শান্ত। নিচে না গিয়েও বেশ বুঝতে পারছি ফলাফল কী। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে। আমাদেরও হয়তো জুটেছে অল্পবিস্তর। তবে এই জোটাটা বোধহয় উচ্ছ্বাসের বিষয় নয়। বাড়ি যদিও একটা নিরেট বস্তুগত জিনিস, তবু তার কী মায়া! একটা আস্ত মানুষের মতো যেন। আমরা তো সাধারণ মানুষ। এই বাড়িতে আমাদের কত সাধারণ গল্প তার অসাধারণ মায়া নিয়ে মাখামাখি হয়ে আছে। এইসব নোনা ধরা দেয়াল, চড়ুইয়ের সংসারপাতা ঘুলঘুলি, আগাছাভরা সানশেড, উঠোনজুড়ে নানুর করমচা, নয়নতারা, পাথরকুচি গাছ, সব যেন আমাদের শৈশবের বন্ধু। সহোদরের মতো একসাথে বেড়ে ওঠা। বড়ো মামা টেবিল দাবড়ে বলছিলেন ‘ফর বেটার ফিউচার’; পনেরো বছর বয়সে বেটার ফিউচারের সংজ্ঞা যে কি, তা হয়তো আমার জানার কথা না। তবু মনে হচ্ছিল সে ফিউচার আমার চাই না। বাসা একবার ভেঙে গেলে তা কি আর ঘর হয় কখনও?
মা খেতে ডাকছে। উঠতে গিয়ে মনে হলো না গেলেই বা ক্ষতি কী! কিছু সময় এক জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্যে বসলেই আর উঠতে ইচ্ছে করে না। সেখানে আস্ত একটা বাড়ি! আমি তো আমি, আমার মায়ের জন্ম, বেড়ে ওঠাও এই বাড়িতে। এই স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে মা যাবে কেমন করে? এই বাড়ির অস্তিত্বের সাথে মায়ের অস্তিত্বটাও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। বাড়ির সাথে সাথে মায়ের অস্তিত্বটাও কি ভেঙে যাবে না?
আমাদের জন্মের পর থেকেই আমরা এই গাছটাকে দেখে আসছি। যেন কোনো শতাব্দী প্রাচীন মহীরুহ আগলে রাখছে আমাদের গোটা পরিবারটাকে। আমগাছটাকে নিয়ে একটা মজার স্মৃতি আছে আমাদের ভাইবোনদের। টুবাই তখনও হয়নি। লোডশেডিং হলে মোমবাতি জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ পড়ালেখার চেষ্টা চলত। একটা সময় বাবাই ঘোষণা করতেন মোমের আলোয় পড়া ঠিক না। চোখ নষ্ট হবে।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। উঠে গিয়ে ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়াই। নিচে নানু সুফিয়াকে বলছেন উঠোনের পানি কেঁচে নিতে। সুফিয়া চেষ্টা করছে। তবে নানু যেভাবে চাচ্ছেন, সেভাবে হচ্ছে না। আহা! এইসব দৃশ্যও একসময় অচেনা হয়ে যাবে। এই বাড়িটা যখন ফ্ল্যাটে পরিণত হবে, তখন বৃষ্টি হলে আমাদের আর পানি কাঁচতে হবে না। শীতের দিন উঠোনের ঝরাপাতা একসাথে জড়ো করে আর আগুন পোহানো হবে না। এগুলো যদিও আপাতদৃষ্টিতে ঝামেলার কাজ। ফ্ল্যাটে হয়তো পানি নিষ্কাশনের সহজ কোনো ব্যবস্থা থাকবে। গাছই যেহেতু নেই, পাতা পোড়ানোর ঝামেলাও নেই। আম গাছটা ছাদের রেলিং টপকে অনেকটা নেমে এসেছে। আমাদের জন্মের পর থেকেই আমরা এই গাছটাকে দেখে আসছি। যেন কোনো শতাব্দী প্রাচীন মহীরুহ আগলে রাখছে আমাদের গোটা পরিবারটাকে। আমগাছটাকে নিয়ে একটা মজার স্মৃতি আছে আমাদের ভাইবোনদের। টুবাই তখনও হয়নি। লোডশেডিং হলে মোমবাতি জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ পড়ালেখার চেষ্টা চলত। একটা সময় বাবাই ঘোষণা করতেন মোমের আলোয় পড়া ঠিক না। চোখ নষ্ট হবে। আমি, আপ্পি, বাবা, মা বারান্দায় গিয়ে বসতাম। গাছ থেকে টুপটাপ আম পড়ার শব্দ হতো। সেই শব্দকে লক্ষ করে অন্ধকারের ভেতর ছুটতাম আমি আর আপ্পি। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ!
সম্পত্তির হিসাবনিকাশ আমি বুঝি না। আমার এই বয়সে হয়তো বোঝার কথাও না। তবু কেমন যেন মনে হলো, আমরা যখন বড়ো হবো; আমি, আপ্পি, টুবাই—আমরাও কি এরকম করব সম্পত্তি নিয়ে? সেরকম দিন এলে আমি খুব সম্ভবত শুরুতেই বলে দেবো আমার সব কিছু আপ্পির আর টুবাইয়ের। আমার কিচ্ছু চাইনে।
সারাটা দিন ভীষণ অন্যরকম গেল। কেউ তেমন কথা বলছে না। বড়োরা যখন স্বাভাবিক কথাবার্তা না বলে, ছোটোদের যে কী একটা অস্বস্তি হয়! টুবাই একা একাই লুডো খেলে আর ঘুমিয়ে কাটাল সারা দিন। আমি মাঝে খেলেছিলাম কিছুক্ষণ। টুবাইয়ের সাথে সাপলুডো খেলা মহা মুশকিল। ওকে সাপে কাটলে ও কিছুতেই নিচে নামতে রাজি না। ওর সহজ প্রশ্ন, ‘আমি তো ওকে (সাপকে) কিছু করি নাই, ও আমাকে কামড়াবে কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। যেটা জানা আছে, বা বলা ভালো, যতো বড়ো হচ্ছি, যা বুঝতে পারছি, তা হলো, কিছু না করলেও সাপে কামড়ায়। মধ্যবিত্ত সাধারণ বাবা-মা’রা সন্তানদের কোনো ঝামেলায় জড়াতে ছোটোবেলা থেকেই নিরুৎসাহিত করে। এসময় ‘বোবার শত্রু নাই’ প্রবাদবাক্যটি বেশি ব্যবহৃত হয়। বাস্তবতা তা নয়। বোবারও শত্রু থাকে। সে বোবা যতই নিরুপদ্রব, মিত্রভাবাপন্ন হোক না কেন! এসবই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙল বৃষ্টির ছাঁটে।
বৃষ্টি যে ফের হবে এরকম একটা আভাস শোবার আগেই পাচ্ছিলাম। তবু জানালা টানতে ইচ্ছে হলো না। জানালা খোলা না থাকলে আমার কেমন দম বন্ধ লাগে। মনে হয় দেয়ালগুলো চেপে আসছে টুঁটি চেপে ধরতে। আপাত আড়াল যে শব্দেরা, অন্ধকারে তারা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। অচেনা সেইসব শব্দে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। আরও কিছু ব্যক্তিগত অস্বস্তি আছে। যার জন্য মূলত আমার উর্বর মস্তিষ্ক দায়ী। সাপ এবং তাবৎ সরীসৃপ শ্রেণীকে নিয়ে আমার প্রচণ্ড ভয়। এবং একই সাথে কেন যেন একটা নিষিদ্ধ আগ্রহ কাজ করে। জানি ঘুমুতে পারব না, তবু এই আগ্রহ অদম্য। এই আচরণ পতঙ্গসুলভ। আগুনে মৃত্যু লেখা আছে, তবু আগুনের দিকে এগিয়ে যেতে কী এক প্রচণ্ড টান কাজ করে। অন্ধকার ও নৈঃশব্দ্য গাঢ় হলে মনে হয় খাটের নিচে মেঝে নয়, সমুদ্র। ধেয়ে আসছে উত্তাল ঢেউ। আর সমুদ্রের আদিম গর্ভ থেকে জেগে উঠছে এক প্রকাণ্ড সরীসৃপ। এইসব ভাবনা এড়াতে জানালা খোলা রাখি। নিশ্চিত করি আলোর উৎস। যেন দূরে কোনো বাতিঘরের আলো পথ দেখায় দিশেহারা এই উত্তাল সমুদ্রে।
বৃষ্টির ছাঁটে মায়া আছে। আরও আছে শৈশবের প্রগাঢ় আহ্বান। তাই বিরক্ত হই না তেমন। বরং ভালোই লাগে। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি ফের। স্বপ্নে আমার প্রিয় শৈশব ভেসে ভেসে আসে। অথবা ভেসে ভেসে চলে যায়। আমি প্রচণ্ড আকুলতা নিয়ে তাড়া করি তাকে। দেখি আমি আর আমার বোন একটা প্রায় মাঠের মতো বড়ো বারান্দায় ছুটোছুটি করে ইটের টুকরো জোগাড় করছি। তৈরি হচ্ছে প্রাচীর। রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাথরকুচির পাতা জড়ো করি। খেলতে খেলতে খিদে পেলে করমচা গাছ থেকে করমচা পেড়ে খাই। সবুজ করমচাগুলো কষ-কষ। পাকা, লালচে কালোগুলো ফুরিয়ে গেলে সেই কষ-কষ করমচাই খাই। মাঝে মাঝে ঝরে পড়া কাঁচা তেঁতুলও খাই। তেঁতুলের পাতাও কিন্তু খেতে টক টক, ভালোই লাগে!
রাফি আর নদী আপুরা ছুটিতে এলে আমরা জোলাভাতি করতাম। বড়ো হয়ে যাদের সাথেই কথা বলেছি, জোলাভাতি শব্দটা আর কাউকে ব্যবহার করতে শুনিনি। বনভোজন, পিকনিক, এসব কেতাবি শব্দ বলে লোকে। অভিধানেও খুব সম্ভবত জোলাভাতি শব্দটা নেই। আর থাকলেও বা, জোলাভাতির যে মায়া, অভিধানের সাধ্য কী ধরার! আমার আর রাফির মূল কাজ থাকত উঠোন থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে আনা। গাছের মরা ডাল, ঝরা পাতা, এসব। নানু একটা মাটির চুলা বের করে দিত। নানু আর মা-খালাদের কাছ থেকে চাল, ডাল, ডিম, আনাজপাতি এসব সংগ্রহ করে আপ্পি আর নদী আপু রান্নাবান্না করত। সে যে কী এক মজার খেলা!
বাড়িটা ভাঙার দিন আমি বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার পনেরো বছরের জীবনে এই প্রথম আমি বাবার চোখে পানি দেখলাম। আমার চোখেও পানি আসছিল। কিন্তু দেয়ালে প্রথম আঘাতটার পর কি হলো জানি না, আমি একদম শক্ত হয়ে গেলাম। প্রিয় আমগাছটা নেই, তার লাশ বিক্রি হয়ে গেছে কুড়ি হাজার টাকায়। নড়বড়ে ছোটো ছাদ খসে পড়েছে প্রথম আঘাতেই। ঘুলঘুলি ছেড়ে প্রবাসী হয়েছে চড়ুই পরিবার। আমার বোনদের জোলাভাতির উঠোনে শুরু হয়েছে পাইলিং-এর কাজ। এ বাড়ি তো আমার নয়! আমি বাবার হাত ছেড়ে আমাদের ভাড়া বাসার দিকে এগিয়ে যাই। সেখানেই আমরা পতঙ্গের মতো নতুন সংসার পেতেছি। বাড়ির কাজ শেষ হলে এই সংসার ভেঙে ফের আরেক জায়গায় দৌড়ে যাওয়া। তারপর হয়তো অন্য কিছু। অন্য কোথাও। পতঙ্গের মতো, এই আগুন ফেলে আরও অধিক আগুনের কাছে! যখন জানি ঘর বলে কিছু নেই, ঘর আর হবে না কখনও, পুড়ে যাবার ভয়কে বড়ো তুচ্ছ মনে হয়!
দীর্ঘ একাডেমিক নাম আবরার আহসান চৌধুরী। ডাকনাম আসিফ। পৃথিবীর অদ্ভুত রেজিস্টার খাতাগুলোয় কোথাও মিডল নেম লেখে না, কোথাও আবার পদবি লেখে না। তাছাড়া আবরার নামটা মায়ের দেয়া। আর আসিফ, বাবার। লেখার খাতায় আর গানের খাতায় তাই আসিফ আবরার নামটাই পাকেচক্রে রেজিস্টার হয়ে গেল।
একাডেমিক পড়াশোনা সেন্ট জোসেফ, নটরডেম, বিইউপি আর নর্থসাউথে। টুকটাক গান আর আবৃত্তি শেখা ছায়ানট আর বৈকুন্ঠে। গুচ্ছের একাডেমিক আর প্রফেশনাল সনদ প্লেন বানিয়ে উড়িয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেন প্রায়ই, হয়ে ওঠে না। বেঁচে থাকতে টাকাপয়সা লাগে বলে সপ্তাহে পাঁচ দিন কর্পোরেট সেজে থাকতে হয়।
প্রথম কবিতার বই ‘কলম্বাস! কাছে এসো’ বেরোয় ২০১৬-তে। তারপর ২০১৮-তে সাই-ফাই/ ফ্যান্টাসি ঘরানার উপন্যাস ‘টুকুন, তিতিন আর কাফকিন’। ২০২২-এ হরর উপন্যাস ‘বিলায়াল’। নিজের হেভিমেটাল ব্যান্ড করার বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০২৩-এ কিশোর উপন্যাস ‘আই হ্যাড আ ব্যান্ড’। একটা সময়ের পর পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, সব থেকেই স্বেচ্ছা বিরতি নিয়েছিলেন, কারণ মূলত অলসতা।
হেভিমেটাল গানবাজনা চলছে বহুদিন। সে আরেক গল্প।
পরিচয় দেবার পর মনে হয় আসল কথাই বলা হলো না। পরিচয় মূলত অন্য হাতে লেখা ইতিহাস। তা দিয়ে কি আর সব সময় মানুষ বোঝা যায়? মাঝে মাঝে তো এরকমও মনে হয়, ভদ্রলোক এক পরাজিত জেনারেল। হু হু বাতাসের দিনে হঠাৎ হুংকার ছেড়ে বলেন, ‘সোলজার! বলে এসো! তার কোনো চিঠি আমি পাইনি কখনো!’