এক.
এই স্বচ্ছ জলের খালটার পাড়ে রাজ্যের বাতাস লুটোপুটি খায় সারা দিন। এর দু-পাড়ের সারি সারি নারকেল, লেবু, জারুল, শিশু, কড়ই গাছের হরেক রকমের সবুজ পাতা সারা পৃথিবীর বাতাসকে এখানে টেনে এনেছে বলে মনে হয়। এমন উথাল পাথাল হাওয়ার জন্যই রূপার ভালো লাগে এই খালের পাড়, এই জারুল, কড়ইয়ের সারি সারি গাছের আগল। এক শরীরভরা আগুন নিয়ে রূপা যখনতখন এসে বসে সবুজ ঘাসের পাটি পাতা খালের উঁচু করে বাঁধানো ধারে। তিস্তা থেকে কেটে আনা এই সরকারি খালকে এই অঞ্চলের লোকে বলে ক্যানেল, এই খাল কাটার সময় সরকারি লোকেরা ‘ক্যানাল’ বলেছিল, সেখান থেকেই লোকমুখে ক্যানেল নামটাই প্রচলিত হয়ে গেছে। এর দু-পাড়ের মানুষের স্নানের জল, কাপড় কাচা, পাট জাগানোর জল থেকে খরার দিনে জমি চাষের জল পর্যন্ত যোগায় এই ক্যানেল আবার ভরা বর্ষায় ওপার থেকে তিস্তার বান ঠেকাতে নদীর বাঁধ খুলে দিলে দুপাশের দু-চার গ্রামে ছোটোখাটো প্লাবনও ঘটিয়ে দেয়। তবে রূপার এই ক্যানেল পছন্দ এর হুড়হুড়ানি হাওয়ার জন্য, এ হাওয়া তার শরীর মনের সব আগুনে আদর বুলিয়ে তাকে একেবারে শীতল জলের মতো জুড়িয়ে দেয়।
সকাল নেই, সাঁঝ নেই যখনতখন ভাতারছাড়ি মেয়ের ক্যানেলের পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা বেজায় অপছন্দ আম্বিয়া বেগমের। রূপা তাই ঘর ছেড়ে বেরোলে তার অল্প কিছুক্ষণ পরেই হিসহিসিয়ে সেখানে হাজির হয়ে যায় সে, তারপর মেয়েকে নানানরকম মিষ্টি কথার চেয়ে বেশি কটু কথায় সেখান থেকে উঠতে বলে। এই উঁচু পাড়টা যে কেবল ক্যানেলের পাড়ই না, এটা যে এলাকার মানুষের চলাচলের প্রধানতম রাস্তাও বটে, সেকথা বারবার করে মনে করিয়ে দেয়। আসতে যেতে এলাকার তাবত মানুষ যে রূপার উপচে পড়া যৌবনের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়, সে কথা মনে করিয়ে দিতে দিতে আম্বিয়ার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওদিকে মায়ের এই অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে দম বেরিয়ে যাবার অবস্থা হয় রূপার, সে হাসির বেগ সামলাতে তার জামার গলা নিচু হয়ে যায়, ওড়না সরে গিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়, সে হাসি সামাল দিতে প্রবল বান ডাকে রূপার সুডৌল স্তনযুগলে। আম্বিয়ার মনে হয় হতচ্ছাড়িকে তখন মারতে মারতে বিছানায় ফেলে রাখে যেন উঠে বসতেও না পারে আর কোনোদিন। কিন্তু সে সাহস তার হয় না, এই মেয়ের বেজায় তেজ, একটা মারতে গেলে উল্টো ফল হতে পারে। আম্বিয়া তাই দাঁত চেপে শাপশাপান্ত করে¬ মেয়েকে— এত মানুষ মরে, তোর মরন হয় না!
আসতে যেতে এলাকার তাবত মানুষ যে রূপার উপচে পড়া যৌবনের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়, সে কথা মনে করিয়ে দিতে দিতে আম্বিয়ার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওদিকে মায়ের এই অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে দম বেরিয়ে যাবার অবস্থা হয় রূপার, সে হাসির বেগ সামলাতে তার জামার গলা নিচু হয়ে যায়, ওড়না সরে গিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়, সে হাসি সামাল দিতে প্রবল বান ডাকে রূপার সুডৌল স্তনযুগলে।
মায়ের কথায় আজকাল আর রাগ করে না রূপা। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর সে নিজেও কত ভেবেছে এত মানুষ মরে, সেই বা কেন এমন বাপ-মার বোঝা হয়ে বেঁচে থাকবে এমন দিনের পর দিন। কেমন একদিন ঘুমের ভেতর টুপ করে মরে গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু তারপরই আঁতকে উঠেছে সে, না, এখনই সে মরে যেতে চায় না, বেঁচে থাকতে রূপা বড়ো ভালোবাসে। এই যে এত সুন্দর কালিকাবাটি গ্রাম, ক্যানেলপাড়ের হাওয়া, ভোরসকালের সূর্য ওঠার দারুণ ছবিটা, আব্বার হাসিমুখ, এমনকী মারও পান খাওয়া টুকটুকে ঠোঁট, ওদের হারু কুকুর, ওর ছোটো ভাইটা— মরে গেলে সব কেমন টুপ করে উধাও হয়ে যাবে না ওর কাছ থেকে? আসলে উল্টো করে বললে এই সবই থাকবে, মরে গেলে কেবল সেই ওদের সকলের মাঝ থেকে নাই হয়ে যাবে। না না, মৃত্যুর কথা ভাবলে শিউরে ওঠে সে, জীবনের এখনো কিছুই দেখেনি রূপা, এত অল্প বয়সে পৃথিবী থেকে মুছে যেতে পারবে না সে। মরে গেলে ওকে কেউ মনে রাখবে না, এই পৃথিবীর কোথাও ওর এতটুকু অস্তিত্ব থাকবে না, এই ভাবনা ভাবলেই মরণ থেকে পালিয়ে যতে চায় সে।
আজও জীবন-মৃত্যুর নানান কথা চিন্তা করতে করতে ক্যানেলপাড়ে একটা জারুলগাছের ছায়ায় বসে পা দোলাচ্ছিল সে। তার মা আম্বিয়া আজ সে আসার পরেই ছুটে ছুটে আসেনি কারণ বহুদিন পর আম্বিয়া নিজেই আজ বাড়িতে নেই, তার বোনের ছেলে অর্থাৎ রূপার খালাতো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে গঞ্জিপুর গেছে। রূপাকে আজ অবশ্য খুব সাধাসাধি করেছিল যাবার জন্য। যায়নি রূপা। সেখানে গেলে নানা কৈফিয়তের জবাব দিতে পারবে না সে, অমন লক্ষ্মীমন্ত জামাইটার সাথে কেন ঘর করতে পারল না— বারেবারে সেই ছুটে আসা প্রশ্নের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার কোনো জাদুমন্ত্র ওর জানা নেই। রূপা তাই আজকাল যায় না কোথাও। আব্বা, ছোটোভাই শামীম আর আম্মা চলে যাওয়ায় বাড়িতে সে একা। অন্যদিন আম্বিয়া বেগমের বকুনির জন্য ঘরে মন টেকে না তার, আর আজ আম্মা বাড়িতে নেই বলে বাড়িটা কেমন মন খারপ করা শূন্যতা নিয়ে আছে, সেই ঘরে কেউ নেই, ওর কিছুই করার নেই। সেই হাহাকারভরা ঘর থেকে তাই প্রায় ছুটে বেরিয়ে এসেছে সে। রূপার জন্য এই ভালো, এই বিশাল সবুজ প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ টলটলে জলের খাল আর গাছের পাতা, জারুলের বেগুনি ফুলগুলোর কানাকানি। এরাই ওর বহুত আপনজন। এরা কেউ ওকে বকে না কোনোদিন, একটাও কটু কথার তীর ছোঁড়ে না ওর দিকে। বরং মাঝেমাঝেই ফুঁসে ওঠা ওর তরুণী শরীর ওরা ঠান্ডা হাওয়ায় জুড়িয়ে দেয়, মায়ের হাজারটা বাজে কথার আঘাত পাতায় পাতায় শুঁষে নিয়ে ওকে সারিয়ে তোলে।
রূপা’বু, একটা জিনিস দেকপু, খুবে মজার জিনিস— পেছন থেকে আচমকা ডেকে ওঠা সাদেকার কণ্ঠস্বরে রূপার গায়ে জড়ানো হাওয়ার মায়ার চাদরটা খানখান হয়ে ছিঁড়ে যায়। ওর ছলছল করে ওঠা চোখ মেলে সাদেকার দিকে তাকায়। সাদেকা সে দৃষ্টির গভীরতা বোঝার চেষ্টাও করে না, সদ্য কিশোরী সাদেকার এখন জীবনজোড়া রংয়ের বাহার, সারা ক্ষণ সে শুধু ‘মজার’ জিনিসের খোঁজে থাকে আর তেমন কিছু পেলে রূপাবুকে তার দেখানোই চাই। বিয়ের এক মাসের মাথায় স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের ভিটায় ফিরে আসা রূপাকে নিয়ে যার যেমনই মাথাব্যথা থাকুক না কেন, ছোটো চাচার এই একমাত্র মেয়েটার প্রতি সাদেকার নিদারুণ পক্ষপাত আছে। ছোটোবেলা থেকেই সাদেকার কাছে দুনিয়া একদিকে আর রূপাবু অন্যদিকে।
চারপাশটা সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সাদেকা ওর মোবাইল ফোনটা চালু করে। এমন একটা ফোন রূপার নেই, আহারে, কত শখ ছিল তার এমন একটা ভিডিও-ফোনের! সাদেকার ফোনের চালু হওয়া ভিডিওতে রূপা দেখতে পায় জনাকীর্ণ একটা পার্কের ভেতর একটা ছেলে আর একটা মেয়েটা নিজেদের জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে যেন পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ নেই, কোনো জনপ্রাণী নেই। সেই ভিডিও দেখে সাদেকা হেসে কুটোপাটি হয়ে যায় আর রূপার সারা গা ঝিমঝিমিয়ে ওঠে। এত এত মানুষের ভিড়েও এরা দুজন কেমন নিজেদের মতো জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েই চলেছে নিজেদের মতো!
বিয়ের পর তারেকের চুমু বা অন্য কিছুর প্রতি আকর্ষণ দেখেনি সে, তারেক এমন করে জড়িয়ে ধরে একদিনও চুমু খায়নি, হাতে পায়ে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেনি। কেবল রাতের বিছানায় রীতিমতো হাঁচড়ে পাঁচড়ে রূপার ভেতরে ঢুকেই একটু পর নেতিয়ে পড়ত তারেক
সাদেকার সামনে একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে সে। এমন করে কাউকে পাগলপারা চুমু সে কোনোদিন খায়নি, কাউকে সত্যিকারের আদর সে করেনি কখনো। এমন করে কারো ছোঁয়ায় পাগল হতে হতে হয়নি, এমন দিনে তার জীবনে কখনোই আসেনি। স্বামীকে আদর সোহাগ করা নিয়ে বিয়ের আগে কত কী স্বপ্ন ছিল তার, ততদিনে হাজেরা আর রিমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে কত উত্তেজনাকর গল্প শোনা হয়েছিল তার। অথচ তার ভাগ্যে কী হলো? বিয়ের পর তারেকের চুমু বা অন্য কিছুর প্রতি আকর্ষণ দেখেনি সে, তারেক এমন করে জড়িয়ে ধরে একদিনও চুমু খায়নি, হাতে পায়ে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেনি। কেবল রাতের বিছানায় রীতিমতো হাঁচড়ে পাঁচড়ে রূপার ভেতরে ঢুকেই একটু পর নেতিয়ে পড়ত তারেক, কী যে বিবমিষা হতো তার তখন! রূপার সত্যি মনে হতো লোকটার গায়ের ওপর বমি করে দেয়। এখন এই ভিডিওর অনিঃশেষ চুমু দেখতে দেখতে ওর শরীরের ভেতর কোথাও একটা ঝমঝম করে ওঠে, কোথাও একটা ফুঁসে ওঠা জোয়ার বয়ে যায়; ক্যানেলপাড়ের আলুথালু হাওয়াও সে জোয়ার থামাতে পারে না।
দুই.
কাল বিকেলেও কোম্পানি থেকে ফেরার পথে এ বাড়ি একবার ঢু মেরে গেছে মাসুম। আজিজ টোব্যাকো হাজিরহাটের সবচেয়ে বড়ো তামাকের ফ্যাক্টরি, সেখানে শুকনো বিভিন্ন রকম তামাক প্রক্রিয়াজাত হয়ে সিগারেট বানানোর ফ্যাক্টরিতে চলে যায়। এ পাড়ার আরও কয়েকজনের সঙ্গে মাসুমও আজিজে কাজ করে, তামাকের গুড়ো আর ধুলোর মধ্যে কাজ করতে হয় বলে ওরা বেতনটেতন ভালো দেয়। এ বাড়ি এসে মাসুম আধাঘণ্টার মতো ছিল। তার এ বাড়িতে এমন বারবার ঢু মারতে আসা আম্বিয়া বেগমের একদমই পছন্দ নয়। মাসুমের মতোন এমন জোয়ান মর্দ ছেলে কিসের কারণে বাড়িতে এত ঘন ঘন পা ফেলতে আসে, তা না বোঝার মতো অবুঝ সে নয়। এইসব অবিয়াইত্যা ছেলেপেলের ধান্দা অন্য, স্বামীর ঘর ভাঙা তার কপালপোড়া মেয়েকে কি আর বিয়ে করবে সে? তার বাপ-মা মানবে বিয়ে করতে চাইলে? না না, আম্বিয়ার খুবই মেজাজ খারাপ হয় মাসুম এলে, এই ছেলে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, রূপার ঘর থেকে বেরোনোর ওপর কড়া নিষেধ জারি করে রেখেছে সে।
রূপা অবশ্য লক্ষ্মী মেয়ের মতো মায়ের এই কথা শোনে। মাসুম যতক্ষণ এই বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ সে বাড়িতে থাকলে ঘরের বাইরে বের হয় না। এ বাড়িতে আগ্রহী যেকোনো মানুষ এলেই তার বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে না। আজকাল সে এটুকু বোঝে তার আব্বা রহমত আলীর ছিরিছাদহীন বাড়িতে মানুষজনের এত আগ্রহ কেন। তবু সত্যি কথা বলতে মাসুমের ব্যাপারটা আলাদা, ওই ছেলে যখন তেল দেওয়া চুলে মাথার বাঁ পাশে একটা টেরি কেটে এ বাড়িতে আসে আর কখনোই তাকে দেখতে না পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে ঘন ঘন হাত দিয়ে সেই টেরিকাটা চুল এলোমেলো করে ফেলে, রূপার মায়া হয়। মনে হয় একবার অন্তত বাইরে বের হয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু বের হতে পারে না আম্বিয়া বেগমের গম্ভীর মুখ আর বিশ্রী কথাগুলোর ভয়ে।
আম্মার কথাকে সে খুব ভয় পায় অথচ তার আম্মা আম্বিয়া বেগম সারা জীবন এমন ক্যাটক্যাটে খাটাশ মহিলা ছিল না। একটা সময় পর্যন্ত আম্মাকে সে গলা উঁচু করে কথা বলতে শোনেনি। সেই মহিলা আজকাল যেসব বিশ্রী বিশ্রী কথা বলে যে সেগুলো রূপার ভাবনারও বাইরে। উফ! নিজের মেয়ের নামে এত খারাপ কথা কোনো মা বলতে পারে! তার যে এমন অঢেল যৌবন, গায়ের রং কুচকুচে কালো হলেও তার শরীরের গড়ন আর মুখখানা যে পুরুষের বুকে আগুনজ্বলা কাঁপন তোলে, সে কি তার দোষ? সে যে স্বামীর ঘর করতে পারল না সেটাও কি শুধু তার দোষ? অমন একটা পুরুষ মানুষের সাথে থাকলে সারা জীবন তার শরীরভরা আগুন চাপা দেবার চেষ্টা করে যেতে হতো, সেটা কি দিনশেষে খুব ভালো হতো? সেও যদি তারপর রশনি চাচির মতো কারো হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেত সংসার, ছেলেমেয়ে ফেলে— ভালো হতো সেসব? তাও তো হারান চাচার এমন কোনো সমস্যার কথা সে চাচির কাছে শোনেনি। না, বিছানায় চাচার কোনো সমস্যা ছিল, চাচার সমস্যা ছিল সন্দেহবাতিকতা। অমন সুন্দর রশনি চাচিকে চাচা দিনরাত সন্দেহ করত আর তাই নিয়ে কী মারটাই না মারত একেকদিন! রূপা জানে, মিজান বিল্লাহর সাথে পালিয়ে যাবার আগে রশনি চাচির কারো সাথে কোনো লাইন ছিল না। নিজে বিছানায় অক্ষম বলে তারেক যে তাকে নিয়ে সন্দেহ করত না, তার গ্যারান্টি কি আম্মা দিতে পারত? আর সন্দেহ করলে রশনি চাচির মতো অমন মারের চাকা চাকা কালশিটে দাগ আর শরীরভরা ব্যথা নিয়ে সারা জীবন কাটাতে হতো তাকে? উফ, না না, তার চেয়ে আম্মার মুখ-ঝামটা হাজার গুণে ভালো।
আম্মা কাল রাতে বলছিল রূপার জন্য ও পাড়ার সমশের ভাই নাকি একটা সম্বন্ধ এনেছে। লোকটার বউ মরে গেছে, বয়সে নাকি আব্বার কাছাকাছি হবে আর আগের পক্ষের দুটো ছেলে, তাদের ঘরের নাতি নাতনি আছে। তবে খুব বড়ো ঘর, ভরা সংসার, এলাকায় প্রভাব আছে। ওদের দুই গ্রাম পরে ভরকুলে বাড়ি সেই লোকের। এই সম্বন্ধের কথা শুনেই রাগে ঘেন্নায় ওর গা রিরি করে উঠেছিল। ওয়াক থু করে এক দলা থুথু ফেলেছিল রূপা। তাই দেখে রাগে অন্ধ হয়ে আম্মা বলেছিল— মাগির ত্যাজ কত! একে তো হাঁড়ির তলার মতোন কালা কুচকুচা অং, তার উপর ফির ভাতারে নেয় না! তোক নিকা করার জইন্যে কি জমিদার লোক পাটাইবে নাকি রে?
আম্মার মুখের ওপর রূপার বলতে ইচ্ছে করছিল যে ভাতার তাকে নেয় না, এটা একটা চরম মিথ্যা কথা; অমন একটা ন্যাতানো ভাতারের সাথে সংসার করতে বয়েই গেছে তার। কিন্তু আম্মার সাথে মুখে মুখে তর্ক করে লাভের লাভ কিছুই হবে না, শুধু আরও কিছু বাজে কথা হজম করতে হবে তাকে। আম্মার বাজে কথাগুলো শুনতে শুনতে মাঝেমধ্যে নিজের ওপরেই ঘেন্না ধরে যায়। রূপা তাই কিছু না বলে চুপচাপ আম্মার কথা গিলে ফেলেছিল।
আম্মার মুখের ওপর রূপার বলতে ইচ্ছে করছিল যে ভাতার তাকে নেয় না, এটা একটা চরম মিথ্যা কথা; অমন একটা ন্যাতানো ভাতারের সাথে সংসার করতে বয়েই গেছে তার। কিন্তু আম্মার সাথে মুখে মুখে তর্ক করে লাভের লাভ কিছুই হবে না, শুধু আরও কিছু বাজে কথা হজম করতে হবে তাকে।
তবে এই সম্বন্ধের খবর শুনে মাসুমের কথা মনে পড়ছে খুব। ছেলেটা তো খারাপ না, দেখতে শুনতে ভালো, আজিজ কোম্পানিতে কাজ করে দু-চার পয়সা ভালোই কামাই করার কথা। রূপা এর ওর কাছে শুনেছে আজিজ কোম্পানি টাকা পয়সা ভালোই দেয়। আর তাছাড়া মাসুমের বাড়িতে বুড়ো মা-বাপ ছাড়া আর কেউই তো নেই। আম্মা কেন মাসুমের প্রতি এত বিরূপ তা রূপার মাথায় ঢোকে না। হয়তো মাসুম অবিবাহিত বলেই আম্মার এত ভয় তাকে নিয়ে যে তার তালাক হওয়া মেয়েকে এই ছেলে সুখী করতে পারবে না।
সুখ কিসে মেলে— এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর রূপার জানা নেই। আপাতত যদি কেউ ওকে একটুখানি ভালোবাসত মনে আর শরীরে, আদর করত, মোটা ভাত কাপড় দিত, রশনি চাচির মতো সন্দেহ না করত, বছর পরে কোলে একটা চাঁদমুখ শিশু এনে দিত, তাহলেই সে সুখী হতো। আর এইটুকু সুখ মাসুম ওকে ঠিকঠাক দিতে পারবে, এটা রূপা নিশ্চিত। অবশ্য একটা বিষয়ে সে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারবে না, যদি মাসুমও তারেকের মতো হয়? যদি জ্বলে ওঠার একটুখানি পরেই তার শরীরের আগুন নিভে যায়, তখন? তখন কি রূপা আবারও সেই বঞ্চনার জীবন মেনে নিতে পারবে সে মাসুমের জন্য হলেও?
তিন.
মাথার ভেতর উথাল-পাথাল চিন্তা নিয়ে সন্ধ্যায় আবারও ক্যানেলের পাড়ে পা ঝুলিয়ে একা একা বসেছে রূপা। আজ আকাশ জুড়ে মেঘের পশরা, বাতাসও খুব এলোমেলো বইছে, মনে হচ্ছে এই শেষ চৈত্রে হঠাৎই বুঝি ঝরঝর করে বৃষ্টি নামবে। রূপার বৃষ্টি ভালো লাগে, ততোধিক ভালো লাগে ঝড়। আজ ঝড়ও হতে পারে। ওর মনে হয় খুব বড়ো একটা ঝড় হয়ে চারপাশের সব আগুন, সব ক্লান্তি মুছে যাক। চোখ বন্ধ করে রূপা গুনগুন করে ওর প্রিয় ভাওয়াইয়া— ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে…
কাজল ভোমরা কোন দিন আসবে তার জবাব না দিলেও রূপার পেছনে ঘ্যাঁচ শব্দ তুলে একটা বাইসাইকেল থামে। গুনগুন বন্ধ করে সে পেছনে তাকায়, মাসুম। এই ঘোর দুর্যোগপূর্ব সন্ধ্যায় রূপার গায়ে একটা শিরাশিরানির অনুভূতি বয়ে যায়। সে দেখে মাসুমের তেল না দেওয়া চুলে আজও বাতাসের তোড়ে এলোমেলো টেরি আছে, সেই টেরিতে একবার হাত বুলিয়ে দেবার জন্য ওর মন আকুলিবিকুলি করে ওঠে। কিন্তু সে কিছুই না করে ঠায় বসে থাকে উল্টোদিকে ফিরে।
তার পেছনে, নিজের অতি পুরোনো ফিনিক্স সাইকেলটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মাসুম অপলকে তাকিয়ে থাকে এই কালো মেয়ের দিকে। এই মেয়ের মধ্যে কী এমন টান আছে যে সে তার জন্য সব সময় থেমে যায়, সবকিছু ভুলে সে এর বাড়ি গিয়ে বসে থাকে আম্বিয়া বেগমের কঠিন মুখ দেখার পরও? মাসুম জানে না, শুধু জানে এই মেয়েকে ছাড়া তার চলবে না কিছুতেই। কতদিন ভেবেছে সাহস করে বিয়ের কথাটা পেড়েই ফেলবে কিন্তু রূপার আম্মার দিকে তাকিয়ে সেই প্রস্তব সে প্রতিবারই গিলে ফেলেছে রীতিমতো। ওর আব্বা রহমত অবশ্য অত কঠিন মানুষ না, তারপরও মাসুম ভয়েই আজ পর্যন্ত কাউকে কিছু বলতে পারেনি। তবু এই ঘোর কালো আর বাতাসের সন্ধ্যায় রূপাকে এখানে একলা বসে থাকতে দেখে সে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়েছে।
কত কী উল্টোপাল্টা ভাবতে ভাবতে মাসুম শুনতে পায় রূপার কণ্ঠস্বর— ঠিকঠাক মতো কামটা কইরবার পাইবেন তো?
এ মেয়ের সাথে বহু বছর তার ঠিক করে একটা কথাও হয়নি, গত বছর যখন বিয়ে হয়ে গেল রূপার, কই তখনো তো তার জন্য এমন আকুলিবিকুলি করেনি মাসুমের মন! আজ হঠাৎ সেই মেয়ের প্রশ্নে মাসুম বুঝতে পারে না কোন কামের কথা রূপা বলছে এখন।
এ মেয়ের সাথে বহু বছর তার ঠিক করে একটা কথাও হয়নি, গত বছর যখন বিয়ে হয়ে গেল রূপার, কই তখনো তো তার জন্য এমন আকুলিবিকুলি করেনি মাসুমের মন! আজ হঠাৎ সেই মেয়ের প্রশ্নে মাসুম বুঝতে পারে না কোন কামের কথা রূপা বলছে এখন। সে গলা খাকারি দেয়, কী বলবে ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে— কোন কাম, রূপা?
এই প্রশ্নে খিলখিল করে হাসতে হাসতে রূপা মাটিতে লুকায়— কোন কাম? হাহা, পুরুষ মানুষের জাতটাই এমন বটে। সরে যাওয়া বুকের আঁচল নিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে একেবারে মাসুমের সামনে এসে দাঁড়ায়, দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে ওঠে— কোন কাম, বুজবার পারেন নাই, তাই তো? আসেন, তোমাক দেকাই কোন কাম…
মাসুমের শার্টের কলার টেনে ধরে পাড়ের উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে সে, আকস্মিক এই আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মাসুমের পেছন থেকে তার বাপের আমলের ফিনিক্স সাইকেলটা ধপ করে পড়ে যায়, সেটার চেইন লাগে মাসুমের পায়েও, হয়তো একটু চামড়াও ছড়ে যায় তার কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার মতো সময় রূপার এখন নেই। এখন এই ঘন হয়ে আসা অন্ধকার আর শোঁ শোঁ বাতাসের সন্ধ্যায় জনমানবহীন ক্যানেলের পাড়ে মাসুমকে একটা শিশুগাছে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রূপা তাকে পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে। ওর দুই চিকন হাত ভীষণ অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায় মাসুমের সারা উর্ধাঙ্গে। অপ্রস্তুত মাসুম প্রথমটায় হকচকিয়ে থাকে, সেই হতচকিত ভাব পাত্তা না দিয়ে রূপা নিমগ্ন হয়ে থাকে তার কাজে। তার মনে হয় তার প্রায় অনাঘ্রাত শরীরের একটি গহন ডুব প্রয়োজন। সেই ডুবসাঁতারের খোঁজে সবকিছু ভুলে যাওয়া রূপা একটু পরেই টের পায় মাসুম নামের ছেলের পুরুষালি দুই হাত অস্থির হয়ে উঠেছে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। সেই ছেলের তপ্ত শ্বাসের সাথে এই ঘনঘোর সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে মিশে যেতে থাকে রূপার সমস্ত অস্তিত্বে। বহুদিন পর নিজের শরীরে পুরুষগন্ধ মেখে নিতে নিতে রূপা ঘেমেনেয়ে ওঠে। এই গাঢ় নিবিড় অন্ধকার আর আসন্ন দুর্যাগ গায়ে মেখে মাসুমের সাথে একাকার হয়ে যেতে যেতে রূপার সমস্ত অন্তরাত্মা জানান দেয় এই মানুষটার শরীর তারেকের মতো নয়, এই শরীর এক গভীর নদীর মতো যার জলে প্রাণভরে স্নান করা যায়।
দেবদ্যুতি রায়ের জন্ম সেপ্টেম্বরের দশ তারিখ। বাংলাদেশের উত্তরপ্রান্তের রংপুর জেলায়। পড়ালেখা নৃবিজ্ঞানে, পেশায় সরকারি কর্মকর্তা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ, সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘ডাহুকের জল’ (২০২৪)।