আমার নারীরা
ওরা সব মদিলিয়ানির
গভীর কামরায় বসে থাকা
দীর্ঘাঙ্গি নারীরা
লম্বা হাতের আঙুলে বসে থাকা প্রজাপতি
আর যে আকাশে ওড়ে
কালো রাতে নীল ফুল হয়ে
সেই নারী, শাগালের
আমার নারীরা কী রকম?
রক্তিম সূর্যের দিকে
পিঠ মেলে দিয়ে
ওরা কি পোহাচ্ছে রোদ?
মনাস্টেরির আকাশে
তারা হয়ে জেগে আছে?
মড়কের দিনগুলি
মড়কের দিনগুলি আমরা গান করে
কাটালাম। শুধু পান করে কাটালাম
দেহ থেকে পরস্পর স্নেহ ও আমিষ।
একটা ক্ষতচিহ্নের ভেতর ঘুমিয়ে
রয়েছি যেনবা একটা ক্ষতচিহ্নের
সজীবতা হয়ে। মানুষের বারান্দায়
চেলো ও গিটার হয়ে, ভায়োলিন হয়ে
আমরা কাটালাম মড়কের দিনগুলি।
শহরের জনহীন রাস্তার ফাটলে
গজিয়ে উঠেছি ফুল। শিশুদের কানে
লালাবাই হয়ে আমরা বেজেছি রাত্রিতে।
আর দু’হাতের মাঝে ফুলে ওঠা গম,
গমের সৌরভ উড়ছে বাতাসে বাতাসে।
মড়কের শেষে, অনন্ত সূর্যের ভোরে…
পোয়েট্রি
হঠাৎ করেই এমন হল
শীতে জমাট হ্রদের
পাশে জনশূন্য কেবিনে ছুটি
কাটিয়ে আসার পর সে
একটু একটু
করে বদলে গ্যালো
ধীরে ধীরে তার স্বাতন্ত্র্যের জায়গা
গুলি পোয়েট্রির জায়গাগুলি
প্রকাশিত হতে থাকে
আমরা দেখি
জলে ঝুঁকে একটানা
সে কথা বলে যাচ্ছে নিজের
সাথে দুইশ বছর
আগে পোয়েট্রি করা
লোকেদের সাথে
জেলকোভা
ঘুমিয়ে রয়েছি আমি জেলকোভা গাছের ছায়ায়
ঘুমিয়ে রয়েছি যেন অসীম অনন্তকাল ধরে
এই আমি প্রাণহীন জেগে থাকি ঘুমের ভেতরে
বাতাসের ক্রোধ এসে থেকে থেকে আমাকে কাঁপায়
আমি কি ছিলাম ভিড়ে মানুষের অথবা পশুর
ভুলে গেছি ছিলো কিনা প্রাণ দেহে কোনো এক কালে
ছিলাম উদ্ভিদ কোনো মূল যার গভীর পাতালে
মুখরা নারীরা ছিলো যার ছায়া থেকে বহুদূর
স্মৃতি ও বিস্মৃতি আসে নিয়ে সেই নারীদের মুখ
ঝরে গেছে মন থেকে নতগ্রীবা যারা খুব ধীরে
তাদের শ্বাসের তাপ আজ তবু লাগে তো শরীরে
ঘাম-কাম-লোভহীন শুয়ে আছি মাটির অসুখ
ঘুমিয়ে রয়েছি আমি জেলকোভা গাছের ছায়ায়
বাতাসের ক্রোধ এসে থেকে থেকে আমাকে কাঁপায়
পরিচয়
আমার আইডেন্টিটি কী?
একটা কবিতার বই লিখি একরকম
তারপরে আরেকটা
আরেকরকম লিখি
কীভাবে দাঁড়াবে?
একটা কবিতা কুকুর লিখে
কুমির বানাতে চাই
পরেরটায়
তারপর
এগুলার ভেতর
রিডার মাথা ঢুকিয়ে দেখে
মরুভূমির মাঝখানে
এক ভ্যালি
সবুজ, গাছপালা দিয়ে ঘেরা
মাঝখানে অদ্ভুত এক শালের চিমনি
থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে
গান শোনা যাচ্ছে কোনো মহিলার
আমার বন্ধুরা
আমার বন্ধুরা দূরের পৃথিবীতে
এখনও বেঁচে আছে এখনও শুনে শুনে
কূজন পাখিদের তাদের ঘুম ভাঙে
এখনও কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের মার্জিনে
তেরচা হাসিসহ লাঠির বিস্কুট
ধোঁয়াটে দুধ-চা শান্ত বেঞ্চির
বাতাসে বসে বসে ব্যারেন পৃথিবীতে
রঙিন শব্দের ম্যাজিক লিখে রাখে
গ্রামের জমিজমা গবাদি পশুদল
কিছুই নাই আর বাবা তো মরে গ্যাছে
আর মা আসমানে সঙ্গী তারাদের
তবুও বেঁচে আছে কেন যে বেঁচে আছে
শহুরে রাস্তায় ঘিঞ্জি নোংরার
নর্দমার পাশে কেন যে বসে বসে
এখনো লেখে ওরা বিশাল জগতের
রহস্যের কথা কেবল কবিতায়
আমার বন্ধুরা হঠাৎ মরে যাবে
হঠাৎ মরে গ্যালে ওদের মৃতদেহ
বওয়ার মত কাঁধ আমার থাকবে না?
হেমিংওয়ে
সাদা হাতিদের মত দেখতে পাহাড়েরা আসে
আমাদের স্বপ্নে। যখন সমুদ্রাভিযানের রোমাঞ্চকর কাহিনী বলার মতন
সব মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ আকাশে
চাঁদের পাশেই অতিকায় সূর্য দেখা যাচ্ছে যেন রোমন্থন
করছে কেউ রাত জেগে এমন দেশের কথা
যেখানে দিনের শেষ নেই কোনো।
যেইদিকে চোখ যায় শুধু সাদা হাতিদের নীরবতা
পাহাড়ের মত অতিকায়— বুকে, মগজে সঘন।
আর সেই মুহূর্তেই জেগে ওঠে মৃত মহিলাটি
ফিউনারেল হোমে। সুদীর্ঘ ঘুমের শেষে সাদা
ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে তার রঙ থেকে। ঘুরে সে এসেছে, পরে সবুজ বর্ষাতি
জীবনের মত, তুষার-চিতার পিছে পিছে, মৃত্যুর ধবল উপত্যকা!
যেইখানে সাদা ফুলে ভরা সারি সারি গাছ আছে এক অনন্ত বাগানে;
চিরদিন আমাদের নীরবতা সাদা হাতিদের দল হয়ে ঘুমায় সেখানে।
নন-লিনিয়ার
এতোটাও সরলরৈখিক না বলেই মনে হয়। শরবতের গ্লাসের নিচে জমে থাকা চিনির মতোই মিনিংগুলা কবিতার তলদেশে, অন্ধকারের জটিলতায় গিয়ে জমা হয়। আশেপাশেই মেগালোডনেরা তৎপর- নাইট্মেয়ারের মত অতিকায়। তারপরও প্রতিদিনই ডুবুরিরা লাফ দিয়ে নামছে। হারিয়ে যাচ্ছে তাও…
হক্কাইদো
অনেক শুনেছি হক্কাইদোর কথা। মুরাকামির যুবকেরা জীবনে কখনো হক্কাইদো যায়, নিজেকে খুঁজতে। আমি যদিও খুঁজি না। নিজের ভেতরে অন্ধকার করিডোরগুলা পাহারা দেই বরং মাসাই যোদ্ধার সতর্কতায়। তারপরও হক্কাইদোর কথা মনে পড়লে ভাবি সমুদ্রের পাশে একটা দীর্ঘ মহাসড়কে খুব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাব, জানালা নামিয়ে রেখে। ঘাড় ঘুরালেই সমুদ্র। চুল এলোমেলো করে দেয়া মহাসড়কের বাতাস মিশেছে সমুদ্রের বাতাসের সাথে। আলাদা করা যাচ্ছে না। জীবন এই সমবায়ের বাইরের কিছু তো না আসলে…
ম্যাডনেস থেকে – ১
ম্যাডনেস থেকে বের হয়ে আসা পাখি
জিজ্ঞেস করে কুহুতান মানে’টা কী?
আমি বলি তুমি ম্যাডনেস বুঝো আগে
শুনো আগে এই বাতাসের সলিলকি
আবহাওয়া-বার্তা জানালো তুষার-ঝড়
সরে গেছে আরো উত্তর-পশ্চিমে
আমি আর পাখি চৌদিকে দেখি আলো
ফুটতেছে যেন কফি সাদা হল স্কিমে
ঘুমহীনতার একাকী প্রিটেনশাস
কফিমগ হাতে এসে বসি জানালায়
যেদিকে তাকাই নীপাতা গাছেরা যেন
প্রহরীর মত জাগ্রত নিরুপায়
আলবার্টায় এখন অনেক শীত
শূন্যের নিচে তাপমাত্রার কাঁটা
এমন দিনেই মনে পড়ে বার বার
লুইজ লেইকে বেড়াতে যাবার কথা
দু’দিকে পাহাড় জলে পড়ে যার ছায়া
লেইকের শেষে অতিকায় শ্যাতো এক
জানালার থেকে দেখা যায় লাল নীল
কায়াকিং করা মানুষের মৃদু বেগ
স্বচ্ছ পানিতে সাদা সাদা দাগ তুলে
নীরবতা ভাঙে এইসব জলতান
এর চেয়ে বেশি জীবনের মানে নাই
একটা জানালা, স্বচ্ছ জলের গান
শুনতে শুনতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি
সন্ধ্যা হয়েছে আকাশে চাঁদের গোল
ঘরের কোথাও আমি ছাড়া কেউ নাই
তুষারের ‘পর জ্বলছে আলোর ফুল…
কবি। জন্ম: ২৯ নভেম্বর, সিলেট। বর্তমান নিবাস যুক্তরাষ্ট্র। পেশায় মোটর প্রকৌশলী। যন্ত্র প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থঃ আন্তোনিয়োর মেঘ (২০১৬) তারাবাক্সে বসে লেখা (২০১৯) মকিংবার্ড (২০২০)। যোগাযোগ: ac05074@gmail.com