১.
আলেখ্য তোমার হরিণসূচিত হোক।
ফালিফালি তরমুজে যে গণহত্যার সকাল ছড়িয়ে থাকে, যে সিঁদুরপ্রতিজ্ঞা বহুগামিতার দিকে উদাস চেয়ে রয়— তার ঝর্ণা-ঘাগড়ায় সলমাচুমকির কাজ কেন করতে চাইছ? থৈথৈ বর্ষায় কীভাবে কুড়িয়েছ রাশিরাশি ভূর্জপত্র, ভেসে চলা তালপাতার পুঁথি আর ফারখত? আর সব ডাকুচিঠি, সুবিলপত্রের কোণায় কোণায় লেখা উপশহরের গুপ্ত কিছু সংকেত— আধা যন্ত্রনির্ভর আধা কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উঠে আসা ম্লেচ্ছভাষায়। বাস্তুসাপ যেভাবে আগলিয়ে রাখে আমাদের প্রান্তিক জীবনযাপন, অদৃষ্ট, গোলাঘর।
ক্ষেতে গমের শীষে টপ্পাগানের মতো আটকে থাকা টুকরো-টুকরো ময়ূখমালী কি তুমি, যে তোমায় ছুঁতে রাত্রি হয়ে, স্নায়ুরোগীর অনিঃশেষ রজনী হয়ে ফিরতে হয় বারবার? ঝাড়বাতির আলোয় মুখাগ্নির আগে জেনে নিয়েছ, এডোয়ার্ডের নষ্ট ফোয়ারার ছায়ারা বাতিতে জমে উঠেছিল কিনা? বরফঢাকা দারুকারখানার অদূরে, বনসাই থেকে বৃক্ষদের বুনোজীবনে মুক্তির কালে কে বলেছিল তোমায় নজরুলের অনূদিত হাফিজের কবিতাকে ভালোবাসতে? হাড়িকাঠের প্রবল জানোয়ারটির মতো কিছু হাবাহাসি, অসতর্ক পাহাড়িট্রাকের চাকার দাগে বাঙ্ময় হোক। ব্যাখ্যাতীত বলেই সকল গৌরব, মেঘবর্ণ বীণা আমাদের অবাক দুপুরকে, বিস্মিতার লিবিডোকে কয়েদ করতে পারেনি! মুগ্ধতা তবে কি এক বিভ্রম, বাঁধানো দাঁতের করুণা?
২.
যে মৌল আহ্বানে মৃত্যু নেই, যে মাদি ভালুকের তাচ্ছিল্যে মৃত্যু নেই, যে কাচের ফেনায় মৃত্যু নেই— তার মশলাবাকশে জাল ও জলোচ্ছ্বাসের কোন প্রতিবিম্ব তৈরি হয়েছিল? টোল বন্ধ থাকলে খড়িমাটি স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে দুঁদে লবিস্টের প্রজাপতির-নকশা-করা অন্তর্বাসের মতো। তবুও অসংখ্য মনিপাথরের প্রত্যাখ্যান থেকে কানাকানি থেকে শুভেচ্ছানীলা বেছে নিতে হয় কালারব্লাইন্ডকে। দুনলা বন্দুক নয়, জোড়া বালিহাঁসের দিকে তুমি সর্বদা তাক করেছিলে শোপেনহাওয়ারের বেদনা।
৩.
আলেখ্য তোমার ধুলটসূচিত হোক।.
হ্রেষাধ্বনির আতংকের গহিন থেকে ছুটে এলো যে চিনামাটির তৈরি খেলনা চিনেযোদ্ধারা, অহল্যার হাওয়া ঊনপঞ্চাশের দিকে— তার পানে শতমুখী তীরের সাহায্যে ছুড়েছ সুন্দরবনের তামাম মৌচাক-পোড়া ছাই— দাগী তথ্যমিডিয়া, মধুধনকুবেরের অজ্ঞাতেই! বিবাহপ্রথা চিরকালীন যতিচিহ্নময়। ফলে অপ্রতীকী জজবার পাশে হাওয়াকলসারিকে প্রায়শ এড়িয়ে যেতে চেয়েছে আমাদের ডাকপায়রা, তেরোপার্বণের অতীত সমগ্র।
৪.
আশালতা সুঠাম হওয়াই ভালো, পর্ণ থেকে ফিরে কিংবা প্রতিবেশিনীর বুটিক শপে। স্তনের ক্রমবিকাশের মতো সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের উচ্চফলনশীল মায়া ও বাস্তবতা জুড়ে। আশালতা কেন যে সামুদ্রিক মাছের শুটকি পছন্দ করেছিল শুধু? মেঘস্পর্শী উঁচু নিতম্বের মতো দরিয়ার পেল্লাইসব লহর ছোঁয়ার হিম্মত হয়নি আমার কোনোদিন, এমনকি ভূগোলবইয়ের ছবিতেও! রেলের সতর্কলণ্ঠন না হয়ে কী করে জানবে, ফটো সেনসেটিভ মরুতক্ষকের আকাঙ্ক্ষা আর হাপিত্যেশসমূহ? অবদমন ছাড়া কি সৌন্দর্যের সীমায় পৌঁছা যায়? আশালতার গর্ভকুসুমে প্রবালশিকারীকে কি ঢুঁড়ে পেয়েছিলে তুমি অবদমিত এক আয়না ছাড়া?.
আমার সকল ট্র্যাজেডির শুরু সেই থেকে। তোমার চেয়েও তোমার পূর্ণতায় আমি ভয় পেয়েছি, আম্মা।
৫.
স্পেসশিপের লেজে সাইবার ক্যাবল বেঁধে তার অপরদিক বেঁধেছ নৈঋতমেঘে— সেই ক্যাবলে শুকাতে দেয়া সিল্কের নাইটিতে হা-মুখ গুঁজে তুমি বয়ষ্কাকাতর হয়ে পড়ো! রজকিনীর কাটাহাত কি তখনো আসমানকে ভস্ম করে দিয়ে বেঘোরে কর্কটক্রান্তি রেখাকে আছড়াচ্ছিল? ন্যুড ছবির স্টুডিওতে আমি চিন্তিত সাঁর্ত্রকেই পাঁয়চারি করতে দেখেছি, বারবার। প্রতিক্রিয়াশীলতা আসলে কী? দয়মন্তীকে, তার হিংস্র অবদমনকে আমি ফ্রয়েড দিয়ে নয়, খোজা-সাপুড়ের ত্রিনয়ন যোগে বুঝতে চেয়েছি! চেয়েছি গনিমতের মালের প্রতীকী অর্থের আড়ালে নিজ দেহভিত্তিক গোপনবার্তাটা বুঝতে, প্রকৃত সুষমবন্টনের বিহিত করতে। কিন্তু গরিবী ফুসফুস নিয়ে তুমি গোদারের ব্রেথলেস দেখবে কীকরে? তীর্থযাত্রা তো সেথা দূরের রুবাই! তাহলে যে সাম্পানবিকল মাঝি ভাষামুক্তির পানে নৈঃশব্দ্যলুণ্ঠনের পানে ধায়, তার বৈকুন্ঠব্যঞ্জনে কি বনএলাচও রইবে? অথচ সাপ ও বেজির জালওয়ায় বীণাবাদনের কিছু আশ্বিন, সংস্কৃতির অলক্ষ্যে কোথাও-বা স্পষ্টতা চেয়েছে। এই যে বিশ্ববিভুঁইয়ে আমি তোমায় যাবতীয় বিস্মরণ হতে বাঁচিয়ে চলেছি, কালবৈশাখীর হাত থেকে ফুলের ঔজ্জ্বল্য রক্ষা করার মতো, তাহলে আমিও কি তোমার দূরসম্পর্কের অভিভাবক নই? আমায় ভালবাসো না কেন ওগো পালক-ওড়া মোড়?
৬.
ধরো, আমি তোমার বক্সিং রিঙে পর্যুদস্ত এক সাইবার-হ্যাকার; যে তোমার সাইকেল না চালানোর তাবৎ স্মৃতি চুরি করে, নিশীথহাতির পালে হ্যালোজেনের বল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল! ধরো, আমি তোমার কপার ইরিডিয়াম বিষয়ক গীতিকাব্য; ষোল শো ষোলয় সুরাটে অস্ত্রকারখানায় আমরাই এসেছিলাম মহাকাশ গবেষণার আগামবার্তা নিয়ে, সাপ ও সূর্যের ডার্ক ওয়েভ নিয়ে : ঘুমের বাইরে কে আর মননে রাখে কাকে? ধরো, আমিই তোমার ৯ই ফেব্রুয়ারির বেণীমাধব, বেণীসংহার— যে কিনা একশো বিরাশি দাগে পাশাপাশি শুয়ে আছেন কুশলপাতার বাঁশি হয়ে। ধরো, আমি তোমার কোথাও নেই, তবু মনে রেখো।
৭.
মহুয়াগাছের রসালো ফুল নীলগাইদের বিশেষ পছন্দ, যেমন মানুষের পছন্দ অমানুষের মন। মরা কুকুরকে ঘিরে একটি কুকুর যেভাবে শপথগাথা গড়ে তোলে, মানুষ মানুষের পাশে মালাকার হয়ে দাঁড়ায় না। ফলে বিপ্লবের এতসব সুকৃতি, রেডিওতে অনুরোধের আসর, আর যত অবগুণ্ঠন— মহুয়াগাছের গল্পে নীলগাইয়ের রতিমোচনের কাছে তা কিছুই না! তোমার বাড়িয়ে দেয়া হাত আমার ধরতে না চাওয়ার শনিবারে একটা সুইং চেয়ার সেইথেকে দুলছে।.
আমি তো আর বণিক নই যে তোমার আড়াল কুড়িয়ে আমি সম্পূর্ণা হতে পারবো না!
৮.
মোমের বন্দুক নিয়ে এসেছি অরণ্যঘড়ি খুন করে ফেলব, গুহাচিত্ররা ঘুরেফিরে বেড়ানো পাহাড় কেটে বানানো সূর্যমন্দির পকেটে পুড়ে চম্পট দেব, কাত করে ফেলব রাজনীতির বাঞ্চোত মনুমেন্টসমূহ— মানুষ বাঁচে কেন? এত মানুষের রক্তাক্ত কলিজা পোড়াবে এত দম আছে নাকি কসমিক ফুয়েল-স্টেশনের? মরতে পারো না তুমি আইডিয়া-বেইসড আলোফলকদের গুড়িয়ে দিয়ে? কেন বেঁচে থাকব আমরা নিজের রক্ত-উপচ্ছায়া-যৌনাঙ্গ চিবিয়ে গলিত না খেয়ে? নিয়তি হলো আমাদের আব্বা-আম্মা আর ভাই। একমাত্র আব্বা-আম্মা আর ছোট ভাই শুধু আমার নিয়তি— না চিনলে, চোদমারানি মরে যা। মরে আব্বার পায়ের চটির বিলাপগীতিকার অন্ত্যমিল হয়ে ফিরে আসিস রে মন, মরে কিছুটা তবু বাঁচিস।.
ভালোবাসা পাপ। ভালো না বাসা হলো চাঁদের সবুজ গহ্বর, হারামি সান্নাটা ছাড়া যার আর কোনো হেভি মেটাল ড্রামার নেই।
৯.
একপাল যৌন-উন্মত্ত গণ্ডার তেড়ে আসছে তোর দিকে— গুঁতিয়ে-গুঁতিয়ে পিষে ফেলবে তোর মহাকাশচর্চা, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দানিকেনের হ্যাজাকবাতি এবং পাবলিকের ভাবসম্প্রসারণের মধ্যে তোর মিনিংলেস বেঁচে থাকা। অভিভাবক হিসাবে চাকরি এক জঘন্য স্যাটায়ার নাটক, কুত্তায়ও চোদে না! আর ঐদিকে দেখো, খানকির পোলারা শ্বাস ও শোষণের নব নব ম্যাটান্যারেটিভ দিগন্ত পল্লবিত করে তুলছেন সেলেবদের বনস্থলী জুড়ে! যেমন রাক্ষুসী বলতে প্রথমেই মনে এলো তোর কালো জিভের শাশুড়ির কথা। তবু রক্তে পাতার প্রদীপ জ্বালিয়ে নিত্য কেউ শুভকামনা জানাচ্ছে তোকে, খনিসিঁড়িতে তোর ঘুমিয়ে পড়ার পর— এমনসব আড়াল, আহুতি আজও অহিংস আন্দোলনের নতুন প্যারাডাইম দাঁড় করাচ্ছে কোথাও! তোর সহৃদয় হয়ে অসহ্য বেঁচে আছি আমরা, পরাগ।
১০.
পিছুটান না থাকলে তুমি বেহালা বাজাতে যেও না, সেতু গড়ে উঠবে না। হিচহাইকারের জীবনীতে ক্ষমাহীন সুন্দরীদের স্থান, প্রস্থান কিংবা আজটেক প্রতিশোধ— এসব আমায় ব্যাহত করেছে। এও দেখেছি, সামান্য পেঁয়াজফুলের মায়ায় বয়স্ক ব্যাঙটি, মধুর টানে আসা খুদে মাছিদের শিকার করছে না, বরং সন্ধ্যে হওয়া অব্দি এইসব এতিম মনোচাঞ্চল্যকে পাহারা দিয়ে গেছে, এক লৌকিক জাদুকরের মতো। দুনিয়ায় এনার্কিজমের বাইরে আসলেই কি কিছু আছে? সবটাই এন্টি-ক্লাইম্যাক্স, বিশাই অব্দি এক ডুবোনৌকো, পোনামাছভর্তি, মাছ হলো তোমার আমার মাঝের ওহি-বিনিময়। নিকট অতীত বলেও আসলে কিছু হয় না! তুমি চলে গেছো, এইটা আমার মৃত্যু— আমিই ঈশ্বরের বেহালা, বাজাও।
বাংলা কবিতায় অমিত রেজা চৌধুরীর উত্থান নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে, বগুড়ায় বসবাস করেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা— বিভিন্ন মাধ্যমে তার বিচরণ অবাধ। একসময় দেশের প্রথিতযশা লিটলম্যাগাজিনগুলোয় লিখেছেন নিয়মিত। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথেও ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত ছিলেন এবং এখনও সেই বিশ্বাস লালন করেন। কী এক অজ্ঞাত কারণে গদ্যরচনার জগৎ থেকে এখন অনেকটাই দূরে অবস্থান করেন। কোনো বই প্রকাশিত হয়নি।