পশ্চিমের আকাশ গাঢ় হয়ে আসে সন্ধ্যায়। ক্রমশ মুছে যেতে থাকে সূর্যের দাগ। কোথাও সুর ওঠে মাগরিবের, কোথাও সন্ধ্যাপূজার উলুধ্বনি। এমন সময়ই বোধ করি নগেন স্যার মারা যান চুপচাপ। কেউ টের পাই না। আর পরদিন সকালে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে ভীষণ মন খারাপ হয়। অথচ আমিই একশ একুশবার তার মৃত্যু কামনা করেছি। তথাপি আরাধ্য এ মৃত্যু কেমন অপরাধী করে ফেলে! মনে হয় নানাশাহ ফকিরের তাবিজ, যা আমি পুঁতে এসেছিলাম নগেন স্যারের বাড়ির পাশের আনোহাবৃক্ষের শিকড়ে— সেই তাবিজের তেলেসমতিতেই বুঝি মারা গেলেন তিনি। আমি জানি— বিশ্বাস করি এইসব তাবিজ-কবচের ফকিরি আদতে ভুয়া। তারপরও নগেন স্যারের মৃত্যুর শীতলতা আঁকড়ে ধরে আমার হাত। আমি আঙুলের ভাঁজ খুলতে পারি না। আঙুল জড়িয়ে যায় আঙুলে…
সকাল ন’টা সাড়ে নটা হবে। খবর এলো সাভারে রানাপ্লাজা ধসে গেছে। বহুলোক নাকি ভবনের নিচে চাপা পড়েছে। আমার আবু দাউদের কথা মনে হলো। ছোটো বোনের স্বামী। সাভারে কোনো এক গার্মেন্টসের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার সে। ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে। কোনো এক খারাপ খবরের আশঙ্কায় যখন মূহ্যমান তখন মুজাহিদ ফোন করে জানাল নগেন স্যার মারা গেছেন।
২.
সকাল ন’টা সাড়ে নটা হবে। খবর এলো সাভারে রানাপ্লাজা ধসে গেছে। বহুলোক নাকি ভবনের নিচে চাপা পড়েছে। আমার আবু দাউদের কথা মনে হলো। ছোটো বোনের স্বামী। সাভারে কোনো এক গার্মেন্টসের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার সে। ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে। কোনো এক খারাপ খবরের আশঙ্কায় যখন মূহ্যমান তখন মুজাহিদ ফোন করে জানাল নগেন স্যার মারা গেছেন। নগেন স্যারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমার মন খারাপ হয়। ভয় হতে থাকে হয়তো আবু দাউদেরও মৃত্যু সংবাদ আসতে পারে। আমি মুজাহিদের ফোন রেখে। ছোটো বোন রাখিকে ফোন দেই। একবার রিং হতেই সে ফোনটা ধরে। না, আবু দাউদ বাসাতেই আছে। ফোন সাইলেন্ট হয়ে যাওয়ায় টের পায় নাই। ফলত স্বস্তি আসে। এবং নগেন স্যার ভাবনায় আসেন। নগেন স্যার ছিলেন নগেন স্যার। আমাদের মফস্বল শহরের নবারুণ বিদ্যানিকেতনের বিএসসি শিক্ষক। গণিত পড়াতেন। তার চাকরি আর বছর দুয়েক ছিল। কিন্তু আমার তর সইছিল না। তিনি অবসর নিলে তার শূন্য পদেই বিএসসি শিক্ষক হিসেবে আমার নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি সব ঠিকঠাক করে রেখেছি। এর জন্য বেশ কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। এমপি মহোদয়কে দিতে হয়েছে লাখ দশেক টাকা। সামনের বছর নির্বাচন। যদি কোনো কারণে এমপি বদলে যায়, তবে আম ও থলে দুটিই হারানোর ভয় আছে। এই দিকে বিয়েটা আটকে আছে আমার। চাকরিটা হলেই শিউলিকে বিয়ে করব। বয়স বাড়ছে। চাচ্ছিলাম— নগেন স্যারই যেন চাকরিটা ছেড়ে দেন। দুই বছরের বেতন অগ্রিম দিয়ে দেওয়ার অফারও করেছিলাম। শুনে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। আর কথা বলেননি। অথচ কেউ নেই তার। স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন বছর সাতেক আগে। জ্ঞাতিগোষ্ঠী সব ওইপাড়ে। একমাত্র মেয়ে সন্ধ্যাকেও সেই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কৌশলে। কেন যে তিনি একা একা পড়ে ছিলেন মাস্টারির চাকরিটা আঁকড়ে ধরে এই দেশে বুঝে আসতো না। হীরু মেম্বার কতবার বলেছে, ‘কাকা, চাকরি শেষ হলে ইন্ডিয়ায়ই তো চলে যাবেন, কেউ তো নাই আর আপনার এখানে। বাড়িটা দিয়া যান আমাকে। আপনাকে পুষায়ে দেবো।’ কিন্তু নগেন স্যার তার কথাও শোনেন নাই। ফলত একদিন একা চুপচাপ মরে যেতে হলো।
৩.
আমার আর সন্ধ্যার প্রেম হয়েছিল। সন্ধ্যা হলো নগেন স্যারের মেয়ে। সে বছর আমি এসএসসিতে গণিতে ফেল করে দলছুট। বন্ধুরা সব ভর্তি হয়ে যায় কলেজে। আমাদের মফস্বল শহরে দুইটি উচ্চ বিদ্যালয়। পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং নবারুণ স্কুল। আমি ছিলাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। পাটিগণিত, বীজগণিত যেমন তেমন, জ্যামিতি আমার মাথাতেই ঢুকত না। কেউ একজন বলল, ‘জ্যামিতি শিখতে হলে নবারুণ স্কুলের নগেন স্যারের কাছে যাও।’ কিন্তু নগেন স্যার প্রাইভেট পড়ান না। স্যারকে গিয়ে ধরলাম— ‘পড়াতে হবে আমাকে। অঙ্কে ফেল করেছি। আপনার স্কুলের ছাত্র তো নই। আপনার কাছে শিখতে হলে তো প্রাইভেটই পড়তে হবে।’ পড়াতে রাজী হলেন। প্রতিদিন বিকেলে স্কুল ছুটির পর তার বাসায়। যা হয়, স্যারের কাছে পড়তে গিয়েই সন্ধ্যার প্রেমে পড়ে যাই। সন্ধ্যা এমন সুন্দর আর মায়ামাখা ছিল যে প্রেমে পড়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।
সে বছর আমি এসএসসিতে গণিতে ফেল করে দলছুট। বন্ধুরা সব ভর্তি হয়ে যায় কলেজে। আমাদের মফস্বল শহরে দুইটি উচ্চ বিদ্যালয়। পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং নবারুণ স্কুল। আমি ছিলাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। পাটিগণিত, বীজগণিত যেমন তেমন, জ্যামিতি আমার মাথাতেই ঢুকত না। কেউ একজন বলল, ‘জ্যামিতি শিখতে হলে নবারুণ স্কুলের নগেন স্যারের কাছে যাও।’
৪.
স্যারের বাসাটা ছায়া ঢাকা। পুরনো ইটের দালান। দালান ঘেঁষে আনোহাবৃক্ষ। সামনে উঠোন। উঠোনের পর টিনের ছোটো রান্নাঘর। পেছনে ঘন জঙ্গল। তারপর দীঘি। একপাশটা খোলা। সুশীতল সেই বাসার বারান্দায় অপেক্ষা করতাম স্কুল ছুটির পর স্যার ফিরে এসে জ্যামিতি পড়াবেন বলে। তখন বাসায় থাকত সন্ধ্যা আর তার এক বিধবা মাসিমা। মাসিমা দুপুরের খাবার পর রান্না ঘরের বারান্দায় পাটি বিছিয়ে একটা পিড়ি মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে নিতেন। কোনো কোনো দিন আমার পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙত তার। আর সন্ধ্যা তখন নিউ টেনে। নবারুণ স্কুলে পড়ে। স্যারের বাসার পেছনের দীঘিটার মতো স্থির দুটি চোখ তার। ফর্সা মুখ; না গোল, না লম্বাটে। ঢেউ খেলানো চুল পিঠ ছড়িয়ে। সন্ধ্যাকে আগে থেকেই চিনতাম। সন্ধ্যার সৌন্দর্যের কথা এই মফস্বল শহরের সবাই জানত। পাইলট স্কুলের ছাত্রদের কেউ কেউ নবারুণ স্কুলের রাস্তায় ভিড় করতাম সন্ধ্যাকে এক নজর দেখার জন্য। সেই সন্ধ্যার কাছাকাছি এসেই বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা হতে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
নগেন স্যার জ্যামিতি পড়াতেন। বলতেন, জ্যামিতি খুব গুরুত্বপূর্ণ, বুঝছো, পৃথিবীতে মূলত ভূমি নিয়েই মানুষের প্রথম কেওয়াজ। ভূমিই প্রকৃত সম্পদ। ভূমির ভাগেই গ্রাম, পৃথক বাড়ি, পৃথক দেশ। এটার পরিমাপ ঠিক মতো শেখা উচিত।
৫.
নগেন স্যার জ্যামিতি পড়াতেন। বলতেন, জ্যামিতি খুব গুরুত্বপূর্ণ, বুঝছো, পৃথিবীতে মূলত ভূমি নিয়েই মানুষের প্রথম কেওয়াজ। ভূমিই প্রকৃত সম্পদ। ভূমির ভাগেই গ্রাম, পৃথক বাড়ি, পৃথক দেশ। এটার পরিমাপ ঠিক মতো শেখা উচিত। আমিও শিখতে চাইতাম। কারণ আমাকে পাশ করতে হবে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকত সন্ধ্যার দিকে। সে হয়তো উঠোনে কোনো বই নিয়ে জলচৌকিতে বসে পেয়ারা খাচ্ছে। আমার মন পড়ে থাকত তার দিকে। আর স্যার হয়তো বলে যেতেন একটা ত্রিভুজের তিন বাহু আরেকটি ত্রিভুজের তিন বাহুর সমান হলে ত্রিভুজ দুটি সর্বসম হবে। আর আমার মন খারাপ হয়ে যেত। আমি আর সন্ধ্যা কেন সর্বসম হতে পারি না! আমাদের তিন বাহু সমান না। হয়তো তিনটা কোণ সমান। ফলত আমরা সর্বসম নই। সে হিন্দু, আমি মুসলমান। আমার কিছুই ভালো লাগত না।
৬.
স্যার ফেরার অনেক আগেই আমি তার বাসায় গিয়ে বসে থাকতাম। একদিন মাসিমা যেন কোথায়। তখন দীর্ঘ বিকেলের দিন। সন্ধ্যা একা। বারান্দায় বসে আমি দেখলাম ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা তার ঢেউতোলা চুলে চিরুনি টানছে। দুরু দুরু বুকে সাহস নিয়ে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আয়নায় আমাকে দেখে সে মাথায় চিরুনি রেখেই স্থির হয়ে গেল। আমি তার খুব কাছাকাছি। শরীর থেকে ম্লান স্নিগ্ধ ঘ্রাণ। বুক পকেটে করে নিয়ে আসা গোলাপটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। বললাম— ‘তোমাকে ভালোবাসি, সন্ধ্যা। আমি মরে যাচ্ছি। দোহাই স্যারকে বলো না।’ বলেই দৌড়ে পালালাম সেদিন। পরদিনও যাইনি স্যারের বাসায়। তারপর দিন গেলাম ভয়ে ভয়ে। ভেবেছিলাম স্যারকে হয়তো সন্ধ্যা সব বলে দিয়ে থাকবে। স্যারকে ভয় পাচ্ছিলাম বটে, তবে মনে এইটুকু সাহস ছিল— ওরা তো হিন্দু, কী আর করবে! বড়ো জোর পড়াবে না, বাড়িতে নালিশ দেওয়ার সাহসও করবে না। সন্ধ্যার নিকট ‘ক্ষমা চাহিয়া’ একটা পত্র লিখে নিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক। স্যার জ্যামিতি পড়ালেন। গাছের ছায়া দিয়ে কীভাবে জমি মেপে ফেলা যায় শেখালেন। বললেন— পৃথিবীর সব গাছ আকাশের দিকে বাড়ে। গাছের ছায়া দিন দিন দীর্ঘতর হয়। কেবল আমার বাড়ির উঠোনের আনোহাবৃক্ষের ছায়া কীভাবে যেন হ্রস্ব হচ্ছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে ভূমির পরিমাণ। অন্যদিকে হিরু মেম্বারের জমির সীমা এগিয়ে আসছে আনোহাবৃক্ষের দিকে।
আমি এইসব শুনি, বুঝি না। আড় চোখে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যার পিঠ জুড়ে ঘন সন্ধ্যার বন। ঠোঁটচাঁপা হাসি।
৭.
কে জানত একটা গোলাপেই আমার আর সন্ধ্যার প্রেম হয়ে যাবে। প্রেম মানেই চিঠি লেখালেখি। সুযোগ পেলেই স্পর্শ স্পর্শ খেলা। দিন দিন ভেঙে পড়তে থাকে সীমার দেয়াল। স্যারের না ফেরা আর মাসিমার ঘুমের পাশে আমাদের ঠোঁটে জমা হয় গোপন জ্যামিতি। বাতাসে ভাঙে আড়াল বৃক্ষবন। আহ! সেইসব ফুরিয়ে যাওয়া দুপুরের পর দীর্ঘ দীর্ঘ বিকেল। আমি আর সন্ধ্যা— সন্ধ্যা জারুল ফুল। স্যার হয়তো শেখাতেন কীভাবে n সংখ্যক স্বাভাবিক সংখ্যার বর্গের সমষ্টি নির্ণয় করতে হয়। আমি ভাবতাম সন্ধ্যার ঘ্রাণে ভেজা বিকেলের আয়তন। স্যার বলতেন, সামান্তরিকের কর্ণ পরস্পরকে দ্বি-খন্ডিত করে। আমার মন পড়ে থাকত বর্তুল তুলোবনে। সময় এক চৌকস ঘোড়া। কেবলি ছুটে চলে। দক্ষ সোয়ারি না হলে ছিটকে ফেলে দেয়। আমরা তখন শিক্ষানবীস। আবেগাক্রান্ত। দিকশূন্যহীন। একদুপুরে মাসিমাকে ঘুমে রেখে ঘরের ভেতর আমরা চুম্বন আবিষ্কার করি। তখন ভোটের মৌসুম। দীর্ঘ মিছিল— ‘অমুক মার্কা দেখিয়া ভোট দিন হাসিয়া।’ মিছিলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মাসিমার। আর ঘরে এসে দেখেন আমাদের জোড়বদ্ধ ঠোঁট। কী কেলেংকারির বিষয়! আমরা ছিটকে বহুদূর।
স্যারের না ফেরা আর মাসিমার ঘুমের পাশে আমাদের ঠোঁটে জমা হয় গোপন জ্যামিতি। বাতাসে ভাঙে আড়াল বৃক্ষবন। আহ! সেইসব ফুরিয়ে যাওয়া দুপুরের পর দীর্ঘ দীর্ঘ বিকেল। আমি আর সন্ধ্যা— সন্ধ্যা জারুল ফুল। স্যার হয়তো শেখাতেন কীভাবে n সংখ্যক স্বাভাবিক সংখ্যার বর্গের সমষ্টি নির্ণয় করতে হয়। আমি ভাবতাম সন্ধ্যার ঘ্রাণে ভেজা বিকেলের আয়তন।
৮.
ওই ঘটনার পর কয়েকদিন আমি আর যাইনি স্যারের কাছে পড়তে। দূর থেকে স্যারকে দেখি বাসায় ফিরতে। বাসায় আগের মতোই নির্জনতা। ভেতরে সন্ধ্যা কী করছে কীভাবে সামলেছে ভেবে ভেবে অস্থির হয়েছিলাম। তারপর একদিন ফের সাহস করে জ্যামিতি বই নিয়ে হাজির হলাম স্যারের বাসায়। স্যার তখন স্কুলফেরত। হাত মুখ ধুয়ে বিকেলের জলখাবারে। আমাকে দেখে বারান্দায় বসতে দিলেন। বাটিতে চিড়ে দই আর কলা গুড় দিয়ে বললেন— খাও। সন্ধ্যা তার মাসিমার বাড়ি গেছে, বরিশালে। এই খেয়ে আছি। তারপর জ্যামিতি শিখি। একে একে প্রমাণ করে দিতে শিখি সমস্ত উপপাদ্য। বিকেলে পর বিকেল শেষ হতে থাকে। সরকার পাল্টে যায়। আমার পরীক্ষাও শেষ হয়। কিন্তু সন্ধ্যা আর বরিশাল থেকে ফেরে না।
আমি পরীক্ষায় পাশ করে যাই। কলেজে ভর্তি হই। নতুন নতুন প্রেমে পড়ি। প্রেম ভাঙে। প্রেম গড়ে। নগেন স্যারকে কোথাও দেখলে সন্ধ্যার দাগটুকু গোপনে টের পাই। আর ভীষণ রাগ হতে থাকে।
৯.
হিরু মেম্বার বলে— নগেন মাস্টর তার মেয়েটারেও ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিছে। খুব শীঘ্রি হেও যাবো গা। তারপর মিটমিট করে হাসে। সময় সব ক্ষত মুছে দিতে জানে। হয়তো দাগ থেকে যায়। যন্ত্রণা থাকে না আর। সন্ধ্যার স্মৃতি একটা সূক্ষ্ম দাগের মতো বুকের ভেতর জমে থাকে। আমি পরীক্ষায় পাশ করে যাই। কলেজে ভর্তি হই। নতুন নতুন প্রেমে পড়ি। প্রেম ভাঙে। প্রেম গড়ে। নগেন স্যারকে কোথাও দেখলে সন্ধ্যার দাগটুকু গোপনে টের পাই। আর ভীষণ রাগ হতে থাকে। মনে হয়— এই মালাউন দেশ ছেড়ে যায় না কেন, বাল! চলে গেলেই পারে! দিন দিন কেমন ভেঙেচুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তারপরও একা একা কেন পড়ে আছে! তারপর একদিন আমিও বিএসসি-এমএসসি পাশ করি। একশ সাঁইত্রিশটা চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থ হই। একদিন নবারুণ স্কুলের কমিটির সদস্য হিরু মেম্বার বলে, ‘তুমি তো মিয়া নবারুণ স্কুলের মাস্টর হইতে পারো। নগেন মাস্টরের পোস্টটাই তো খালি হইবো।’ ঠিক। এই চাকরিটাই আমার ধরতে হবে। আমিও টাকা পয়সা ঢেলে সমস্ত ব্যবস্থা করি। কিন্তু নগেন স্যার রাজী হন না। রিটার্য়ডের আগে তিনি চাকরি ছাড়বেন না। অথচ আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। বিয়ে করা দরকার। আমি চুপচাপ দিন গুনি স্যারের অবসরের। মনে মনে ভাবি— পৃথিবীতে কত মানুষ মরে টরে যায়, স্যার কেন মরে যায় না! ঘাড়ত্যাড়া ফাউল লোক! তারপর অনুতপ্ত হই। কারো মৃত্যু কামনা করতে নেই। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই বটে, কিন্তু ভেতর থেকে প্রত্যাশা মরে না। গভীর রাতে স্যারের বাসার আনোহাবৃক্ষের শিকড়ে পুঁতে দিয়ে আসি নানাশাহ ফকিরের তাবিজ। স্যারের যেন মন বদলায়, যেন ইন্ডিয়ায় চলে যায়। কিন্তু দিন পাঁচেক পরে নগেন স্যার পৃথিবী ছেড়েই চলে যান।
১০.
স্যারের মৃত্যু আমাকে নিজের কাছেই অপরাধী করে তোলে। শুধু চাকরিটার লোভে আমি তাঁর মৃত্যু কামনা করেছি। অথচ তিনি কত যত্ন করেই না বিনা পয়সায় আমাকে একটা বছর পড়িয়েছেন। শিখিয়েছেন জ্যামিতি বিষয়ক বিদ্যা। ফলত আমার পাশ করা হয়। স্যারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন পনেরো পর ভারত থেকে কাকে যেন সঙ্গে করে নিয়ে সন্ধ্যা আসে। বারো বছর পর সন্ধ্যাকে দেখি। কেমন নারীদের মতো দেখতে হয়েছে সন্ধ্যা। এক বিকেলে পুকুর ঘাটে তার সাথে দেখা করতে যাই। সময় আমাদের পৃথক করে দিয়েছে। অলঙ্ঘনীয় দূরত্বে দাঁড়িয়েও গভীর অধিকার বোধ থেকে অভিমানমূলক প্রশ্ন করে বসি— আমরা কি পালিয়ে যেতে পারতাম না, দূরে কোথাও? কেন সে ভারত চলে যেতে রাজী হলো?
এক বিকেলে পুকুর ঘাটে তার সাথে দেখা করতে যাই। সময় আমাদের পৃথক করে দিয়েছে। অলঙ্ঘনীয় দূরত্বে দাঁড়িয়েও গভীর অধিকার বোধ থেকে অভিমানমূলক প্রশ্ন করে বসি— আমরা কি পালিয়ে যেতে পারতাম না, দূরে কোথাও? কেন সে ভারত চলে যেতে রাজী হলো?
সন্ধ্যা জানায় সেই বিকেলে, চুমুকাণ্ডে মাসিমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরদিনই মাসিমা তাকে নিয়ে বরিশাল চলে যায়। তারপর নির্বাচন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংহিসতার শিকার হয় তারা। এক রাতে মাসিমাদের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়। ধর্ষিত হয় তাদের মেয়েরা। এবং সন্ধ্যাও। ফলত তার আর এখানে ফেরা হয় না। দেশ ছেড়ে গিয়ে সম্মান বাঁচাতে হয়। সন্ধ্যার কথা শুনে শুনে সন্ধ্যা নেমে আসে।
১১.
বাড়ি পুকুরসমেত সমস্ত জমিজমা হিরু মেম্বারের কাছে বিক্রি করে দিয়ে সন্ধ্যা ফিরে গেছে ইন্ডিয়ায়। সেখানেই তার স্বামী সন্তান সংসার। আমি এখন নবারুণ স্কুলের বিএসসি টিচার। ছেলেমেয়েদের অঙ্ক শেখাই। জ্যামিতি পড়াই। শিউলিকে বিয়ে করেছি। শিউলি হিরু মেম্বারের মেয়ে। সেই সূত্রে নগেন স্যারের বাসাতেই আমাদের সংসার। বিকেলে স্কুল শেষে বাড়ি ফিরি। সমূহসুখে জীবন যাপন করছি। কিন্তু কিছুতেই শিউলির ঠোঁটে চুমু আঁকতে পারি না। কেবলই মনে হয় আনোহাবৃক্ষের নিচে নানাশাহ ফকিরের তাবিজ পোঁতা আছে। যে তাবিজ মানুষকে দ্রুত আরেক দেশে নিয়ে যায়। গভীর রাতে কোথায় যে পুঁতে রেখেছিলাম তাবিজটা! আর খুঁজে পাই না। ফলত আমার কিছুই ভালো লাগে না। আনোহাবৃক্ষের ছায়া আরও দীর্ঘ হতে থাকে।
জন্ম বাংলাদেশে। প্রকাশিত গল্পের বই ‘আনোহাবৃক্ষের জ্যামিতি’।