রবিবার, নভেম্বর ২৪

আমাকে আঁকো উঁকিমারা ক্যানভাসে : শিবলী মোকতাদির

0

Motif-01

প্রকৌশল


মাটিতে—মামণি অটোজের উঠোনে সেরে ওঠার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি শকট। অভিজ্ঞ, মাঝারি বা সদ্যযুক্ত সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত। কেউ নাটবল্টু জোড়া লাগাচ্ছে। কেউ টায়ার কেটে টিউবের ফুটো পরীক্ষা করছে। বার্নিশে ব্যস্ত স্বয়ং প্রোপ্রাইটর! সবই প্রকৌশলগত কাজ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করছে তারা—ক্রিকেট নিয়ে, পারিবারিক কলহের জের টেনে রঙ্গরসিকতার কথা বলছে। বিড়ি-সিগারেটের পাশাপাশি হরদম চলছে স্ল্যাং। মোদ্দাকথা প্রকৌশল মানুষের সুকুমার বৃত্তিকে নিরঙ্কুশ গ্রাস করতে পারেনি এখানে।

ওদিকে মহাকাশে একটি মাইক্রোপ্রসেসর নিয়ে চরমতম ব্যস্ত এক মহাকাশচারী। মনোযোগ তিল পরিমাণ সরলেই পণ্ড হবে সব। তিনি তটস্থ। এভাবে দিনের পর দিন একই কাজ করতে করতে নিজের অজান্তেই মাইক্রোপ্রসেসরের অঙ্গ হয়ে উঠেছেন তিনি। তথাকথিত ভাবাবেগ, রোমাঞ্চ, মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা এমনকি সেক্স—সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দক্ষ যান্ত্রিক হয়ে উঠেছেন তিনি।

চারিদিকে বিধ্বস্ত বসন্তের দিন। ঢং ঢং আওয়াজে শেষ হলো ছুটির স্কুল। গোপন প্রেমের মতো নিকটে ডেকে নিলাম কিছু ওস্তাদ ও সাগরেদকে। কথা হলো প্রকৌশলের প্রকরণ নিয়ে। মন্দ্রস্বরে জানতে চাইলাম—তারা বলল। ব্যাখ্যায় ব্যক্তি, বস্তুর ভরকেন্দ্রকে আশিডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছেদ করে দেখাল। তবু ধোঁয়াশা যায় না। নদীর নাব্যতা বাড়ে না।

ভাবনা থেকে খানিকটা দূরে অলস এক সঁজনে গাছ। ডালে অন্ধ দোয়েল, তক্কেতক্কে আছে। সবার উত্তর শেষে দীর্ঘ শিস দিয়ে বোঝাল—তফাৎটা আসলে কিছুই না! এ হলো মাটি আর মহাকাশের!


পিকাসো


মনে মনে মনে পড়ে যায়
আকাশে গুনেছি তারা যত
বিবিধ বনে নিচু রাস্তায়
দেখা হলো বিধিসম্মত

তুমি কাঁদছিলে আমি ভ্রমে
দিয়েছি পালক পোশাকের
নিভেছে গান ক্রমশ ক্রমে
যেন আমি চিনি তাকে ঢের

রূপ দেখে রচে রচয়িতা
হাঁস এল সাদা বেলিফুলে
ময়ূরের মন পেলে বৃথা
কে কাটে, তুমি কি দংশিলে?

সুর ওঠে শিরা বয়ে বয়ে
মাটিতে মানুষ হেঁটে যায়
করিনি প্রকাশ ব্যথা সয়ে
নদী নত কূলে অযথায়

কিছু আছে পাখির বাতিক
তোমাকে ডাকে ঘুমের ঘোরে
রোজ এসে কানপড়া দিক
কিছু জ্ঞান আনো অগোচরে

একটা দাবী হোক বিরোধী
তোমার নয়নে ফালা ফালা
অন্ধ প্যাঁচা আঁধারে যদি
ডেকে আনে অন্তর্জালা

ছিটকে ছিটকে যাবে রেণু
প্রথমে আহির ভৈরবী
ফাঁটা বাঁশে বাঁধা পড়ে বেণু
এই রাগে গলা-কাটা ছবি!

কিছু থাক গণপরিসরে
প্রতিমার মতো আঁকা চোখ
লতাপাতা দিয়ে চেপে ধরে
প্রাণকাটা প্রকটিত শোক

প্রেমের পাশে লুপ্ত কায়া
অযথা বাজে রেশমি চুড়ি
খাদের কিনারে ক্ষীণ ছায়া
কেটে চলে যায় দূরে ঘুড়ি

ছাড়পত্রে আমাকে ছাড়ো
লিখো—কতটুকু ভালো আছো
নিয়েছে মন অধিকারও
এঁকেছে দালি ঠিক পিকাসো।


মধুমঙ্গল পান্ডে


জাহাজ থেকে নেমে গ্রামের দিকে হা-করে তাকিয়ে আছে মধুমঙ্গল পান্ডে। অভাবের প্রভাবজনিত ঘাত-প্রতিঘাত নিংড়াতে, নকশালের নলের বারি খেয়ে দেশ ছেড়েছিল। তিন দশক পর এই প্রত্যাবর্তন। তুলির স্বেচ্ছাচারে যত্নসৃষ্ট সেই গ্রাম! একেবারেই বিলুপ্ত। টিপে টিপে নির্মাতার নির্দেশে এগোচ্ছে পরিণত মুখে অপরিণত হাসিকে লটকে রেখে। গ্রাম, গোধূলি আমলে নিচ্ছে না কেউ-ই। পরিচিত পথের মতো অচেনা পথিকও না দেখেই পাশ কেটে যাচ্ছে।

হতযৌবন ও বলহীন নাগরিক বুটজুতো পরলেই পাল্টে যায় তার চলন ও জীবন—মধুমঙ্গল পান্ডে মহাবর্ণময় হয়েও সকলের চোখে দণ্ডায়মান শ্বেতপাথরের অনুপম মর্মরমূর্তি ছাড়া আর কিছু নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ বড়োই বেমানান, বড্ড ব্যাকডেটেড এখানে—উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়!


কূটনীতি


বোধগম্য করে তোলো
মুচকি হাসি দিয়ে দৃশ্যান্তরে দেখাবে আখেরি বিশ্লেষণ
সরো, সরে যাও মতবাদ
সুপ্ত ব্যথায় ফুটে আছে পল্লবিত আনোখা মেয়ের মন।

প্রতিপাদ্য হয়ে অতি কাঁচা
আমাকে দুশমন ভাবে, লোক-লোকান্তরে বিদ্বেষপ্রসূত
সারফেস থেকে সরে যাও
রিভার্সে খুলে ফেলো সব, এমনকী সুঁই থেকে সুতো।

অতি অনুজ্জ্বল ও ব্যাতিক্রমী
সৌরজগতের নিঃসঙ্গ তারার গন্ধে মর্মে বেঁধে কটুস্বাদ
অকাতরে চলো নিরুদ্দেশে
তোমাকে বোঝাই, কিছুটা পড়াই প্রাঞ্জল পদ্যে মেঘনাদ।

শিকার হবে না হতাশার
কেউ যদি ডাকে—ছদ্মনামে প্রবন্ধে দেবে তার পটভূমি
উপসংহারে পলিসি রাখবে
কবিতায়—নদী, পাখি, প্রেম-পরকীয়া আর আমি-তুমি।


লজ্জা


অনাবিল আনন্দ রেখে চলে গেছো আত্মগোপনে
গৃহের জঙ্গলে বসে আছো জট বেঁধে।
যেটুকু দৃষ্টিপাত তাকে দিকভ্রান্ত করো না কখনো
কাঁকনের শব্দ থেমে গেলে দেখি—
মাঠে-মাঠে ফুটেছে ধান গণ্ডিবদ্ধ অর্থ সহকারে।

চাঁদ আসে চঞ্চলতা নিয়ে, টপাটপ প্রহরে প্রহরে
বৈষম্যের বিষচিত্র থেকে নেমে আসো,
আমাকে আঁকো উঁকিমারা ক্যানভাসে
তোমার স্থানিক গল্পে জেগে তোলো অনাহারি উৎপলে।

ভালোবাসা—মৃদু থেকে তীব্রতা পেলে
প্রেক্ষাপটে ভয় এসে ভর করে কিঞ্চিৎ
চেনা দুই মেরুর চিত্রকল্প শৈলীর সম্ভাবনা ভেঙে
পিছনের আকাশ আলোড়িত হয়
কী করবে, কোথায় লুকাবে—পড়ে যায় এই দোলাচলে!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, প্রাবন্ধিক। জন্ম : ১১ জুন ১৯৬৯ বগুড়া, বাংলাদেশ। প্রকাশিত গ্রন্থ : ধানের রচনা দিলে পত্রে (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দের নান্দনিক পাঠ (প্রবন্ধগ্রন্থ), নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ), সোনার কার্তুজ (কাব্যগ্রন্থ), রৌদ্রবঞ্চিত লোক (মুক্তগদ্য), ব্যবহারিক বিস্ময় (কাব্যগ্রন্থ), দুর্ভিক্ষের রাতে (কাব্যগ্রন্থ), কায়া ও কৌতুকী (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দকথা (প্রবন্ধগ্রন্থ), লুপ্ত সভ্যতার দিকে (কাব্যগ্রন্থ)

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।