এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ড. অমিত চক্রবর্তী ও সংকর্ষণ রায়। আকাশবাণীর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছিল আশির দশকের গোড়ায়। শ্রী-র ‘শতবর্ষে সত্যজিৎ’ সংখ্যার জন্য সাক্ষাৎকারটি শ্রুতিলিখন করেছেন শাফিনূর শাফিন।
প্রশ্ন : সাহিত্যে বিজ্ঞান; বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য— এই নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে এবং আজকাল একটা বিজ্ঞানভিত্তিক বা সায়েন্স ফিকশন— এসবও বিশেষভাবে লেখা হচ্ছে। কিন্তু আমার নিজের একটা ধারণা যে সাহিত্য বিজ্ঞানভিত্তিক না হলে, সেটা সার্থক হয় না। আচ্ছা সত্যজিৎবাবু এই বিষয়ে আপনার কী মনে হয়?
সত্যজিৎ : হ্যাঁ, মানে, একটা তো গেল যাকে কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলা হয়। সেটা সায়েন্স ফিকশনই বলুন বা সায়েন্স ফ্যান্টাসিই বলুন, সেটা তো একটা আলাদা জাতের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, সাধারণ গল্পে আপনি যদি মানুষদের নিয়ে, মানুষদের কথা লেখেন বা সেখানেও একটা বিজ্ঞানের দিক তো সবসময়ই এসে যাচ্ছে— যেটা মনস্তত্ত্ব বলা যেতে পারে। যে মানুষের মন, বিশেষ করে আমার ছবিটবিতে, আমার গল্পটল্পতে মানুষের মন একটা বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক, তাদের ব্যবহারের— কথাবার্তা, ব্যবহার, সবকিছুর মধ্যে যে একটা সত্য যেটাকে বলে, বা, যে ট্রুথটার দিকে আমরা যেতে চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : অর্থাৎ সত্য বিজ্ঞানসম্মত হবে?
সত্যজিৎ : দৈনন্দিন জীবনে যে অভিজ্ঞতা বা মানুষ চেনা-জানা, এমনকি দেশবিদেশ সম্বন্ধেও যে সমস্ত কথা লেখা হয় বা শহর সম্বন্ধে বা আরেকটা দিক যে মানুষের… বিভিন্ন স্তরের মানুষ সম্পর্কে যে লেখা, গ্রাম সম্বন্ধে লেখা— সবসময়ই একটা বিজ্ঞানের দিক— সেরকমভাবে দেখতে গেলে তো থেকে যাবেই। যেটা প্রথম কথা বললাম, মনস্তত্ত্বর দিকটা তো থাকবেই! সেইটা তো একটা বড়ো ব্যাপার। সেখানে সে বিজ্ঞানটা নিয়ে পড়াশোনা করা না থাকলেও চলে। মানুষের অবজার্ভেশানের উপরেই, মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সত্যটাকে চিনে নেওয়া— এই ক্ষমতাটা তো সাহিত্যিকের থাকতেই হবে।
প্রশ্ন : না, একটা কথা বলি, আপনি যে একটা অবজার্ভেশনের কথা বললেন, সেটাও তো একটা সায়েন্টিফিক মেথড। মানে, বিজ্ঞানেরই একটা সেটা মেথড তো?
সত্যজিৎ : হ্যাঁ, মেথড তো বটেই!
প্রশ্ন : সেখানেও বিজ্ঞানটাই থাকছে আরকি ওর মধ্যে।
সত্যজিৎ : হ্যাঁ থাকছে। কিন্তু সেটা সম্বন্ধে আমরা যে সবসময় খুব সচেতন, তা নয়। সেটাকে আলাদা করে একটা বিজ্ঞান নাম দিয়ে তাই নিয়ে বই লেখা। তাও হয়। ভাষা নিয়েই হয়। ভাষারও বিজ্ঞান রয়েছে। মানুষের কথাবার্তা, বিভিন্ন স্তরের মানুষের, বিভিন্ন জাতের মানুষের, বিভিন্ন অবস্থার মানুষের, বা বিভিন্ন ক্লাসের মানুষের— তাদের কথাবার্তার মধ্যে যে তফাত রয়েছে সেটাও আজকাল বিজ্ঞানের মধ্যে পড়ে গেছে। লিংগুস্টিক্সের মধ্যে চলে যায়। কাজেই সেরকম ধরতে গেলে আপনার গপ্পের যেকোনো উপাদানকেই—সেটাকে একটা দিক—তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক দিক— সেটা দেখিয়ে দেয়া যেতে পারে। এবং সেটার প্রতি যদি আমরা…আমাদের আনুগত্য বা সেটাকে মেনে চলা বা সেটা যাতে ভুল না হয়, সেখানে ত্রুটি না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা মানেই বিজ্ঞানটাকে বাঁচিয়ে চলা বা বিজ্ঞানটাকে যথার্থ…
প্রশ্ন : তাহলে কি মনে হয় লেখকদেরকে—সব লেখকেরই বিজ্ঞান সচেতন হওয়া দরকার? বা… কী বলেন? মানে বস্তুজ্ঞান বা যেগুলো প্রয়োজন— আজকের পৃথিবীটাকে যদি ঠিকমতো আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে না জানি তাহলে এমনি যারা বিজ্ঞানভিত্তিক লেখক নন বা বিজ্ঞানসাহিত্য সৃষ্টি যাঁরা করছেন না, তাঁরাও বোধহয় সার্থক লেখক হতে পারেন না।
সত্যজিৎ : মোটামুটিভাবেতো সেটা তো বলতেই হবে। তবে তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞানের একেবারে আধুনিকতম যে সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা বা চর্চা হচ্ছে, সেই সম্বন্ধেও জানতে হবে— সেটা নাহলেও হয়তো চলে। কেননা সেতো আজকাল তো সব সায়েন্সেই— ধরুন, সে এস্ট্রোনমি বলুন, বায়োলজি বলুন, মাইক্রোবায়োলজি বলুন, এই বলুন… সব এমনভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এমনভাবে তার পরিধিটা বেড়ে যাচ্ছে এবং সেটা নিয়ে এত গভীরভাবে আলোচনা হচ্ছে যে, তার হদিশ রাখা সকলের পক্ষে, সকল সাহিত্যিকের পক্ষেই দুষ্কর…
প্রশ্ন : সকল সাহিত্যিক আপনি বলছেন, ধরুন আজ অন্য একটা বিষয়ের বিজ্ঞানী, তার পক্ষেও অন্য আরেকটা বিষয়ের বিজ্ঞানে কী ধরণের গবেষণা হচ্ছে সে খোঁজ খবর রাখাও খুব মুশকিল এখন।
সত্যজিৎ : খুবই মুশকিল!
প্রশ্ন : এত স্পেসিফিক এবং এত বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে…
সত্যজিৎ : ভয়ানক বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : আমি বলছি সাধারণভাবে মোটামুটি তো আমাদের থাকা উচিত এবং না থাকলেও তো চলে না!
সত্যজিৎ : সেটুকু তো খবরের কাগজ পড়লেও অনেকে জানতে পারে। যারা খবরের কাগজ পড়ে। তার জন্য যে মোটা মোটা বই পড়তে হবে সবসময় বা সব যে একেবারে লেটেস্ট পত্রিকাগুলো পড়তে হবে— এমনও কথা নেই। কাজেই মোটামুটিভাবে শিক্ষিত যে মানুষ বা যাঁদের আমরা সাহিত্যিক বলব, তাঁদের হয় জানা উচিত নাহয় তারা জানে— অনেকক্ষেত্রেই জানে। আর যদি না জানে, তারা জানলে তাঁদের লেখা আরও সমৃদ্ধ হবে।
প্রশ্ন : আচ্ছা এবারে একটু কল্পবিজ্ঞানের ব্যাপারে আসা যাক। না, এই প্রসঙ্গে আপনি, সংকর্ষণ বাবু, কিছু বলার আগে আমি বলি। একটু আগে সত্যজিৎবাবু বললেন যে সায়েন্স ফিকশন বা সায়েন্স ফ্যান্টাসি দুটোকেই কল্পবিজ্ঞানের গল্প বললেন। যেটা এখন বলা হয় আরকি! কিন্তু এই দুটোর মধ্যেও তো একটা তফাত করা হয়ে থাকে? মানে সায়েন্স ফিকশন যেটা অনেক বেশি… এটা আপনি যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।
সত্যজিৎ : না বলছি…বলার মধ্যে এইটা হচ্ছে কি— এক ধরণের গল্প। যেমন আমি উদাহরণ দিচ্ছি, যদি একটা গপ্প লিখতে হয় যে মানুষ… যেমন বহুকাল আগে জুল ভার্ন লিখেছেন ‘জার্নি টু দ্য মুন’ বা ইত্যাদি ইত্যাদি, চাঁদে যাওয়া নিয়ে, বা অন্য কোনো গ্রহে যাওয়া নিয়ে, মানুষ যাচ্ছে— যদি একটা গপ্প লিখতে হয়—তাহলে স্বভাবতই—আমরা ফিল্মেও এটা দেখেছি ‘2001’ ছবির কথা আমার মনে পড়ছে। বিশেষ করে ‘স্পেস ওডিসি’। তাতে যে সমস্ত বিজ্ঞানের তথ্য থাকবে সেগুলো একজন বৈজ্ঞানিকও নিশ্চয়ই—যাতে তার চোখে বা তার কাছে ভুল না ঠেকে— সেটা করতেই হবে। যেখানে মানুষে কি করছে না-করছে সেটা আজকাল সকলেরই জানা বা কোন জিনিসটা সম্ভাব্য বা কোন জিনিসটা সম্ভব নয়, সেটা সকলেরই জানা। কাজেই সেই বিষয় লিখতে গেলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতেই হবে, এবং বিজ্ঞানটা যথাযথ হতে হবে; তাতে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোতে কোনো ভুল থাকলে চলবে না। কিন্তু আবার আরেক ধরণের গপ্প হয়—যেমন আমিই লিখেছিলাম— যেটা একবার ছবি হওয়ার কথা হয়েছিল কিন্তু হয়নি। যাই হোক! ‘এলিয়েন’ বলে একটা চিত্রনাট্য আমি লিখেছিলাম, যাতে ব্যাপারটা ছিল অন্য গ্রহ থেকে একটি প্রাণী পৃথিবীতে আসছে। এখন তার যে মহাকাশযান বা তার যে বিজ্ঞান বা তার যে টেকনোলজি— সেটা সম্বন্ধে তো মানুষ এখনো কেউ জানে না। সেখানে আমাকে অনেকখানি কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এবং সেইখানে কেউ যাচাই করে দেখতে যাবে না এটা হয় কি না-হয়। কেননা কি যে হয় না-হয় সে আমরা এখনো জানি না। অন্য গ্রহ, যে গ্রহ আমাদের থেকে অনেক বেশি টেকনলজিক্যালি এগিয়ে রয়েছে তারা যে কোথায় পৌঁছেছে, তাদের পক্ষে কি সম্ভব না-সম্ভব সেটা আমরা জানি না। তাহলে সেখানে অনেকটা কল্পনার আশ্রয় আমরা নিতে পারি। সেখানে আমরা কাব্যের জগতে চলে যেতে পারি। আমরা দর্শনের জগতে চলে যেতে পারি। কিন্তু মানুষ যখন কিছু করছে, দেখানো হচ্ছে বা এমনকি যদি আজ থেকে ৫০ বছর পরে সে কী করছে তাও দেখান হয়। তাহলেও আজকের দিনে টেকনোলোজি যে অবস্থায় রয়েছে, সেটার কথা চিন্তা করে আমাদের এগুতে হবে।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এ প্রসঙ্গে আমার সত্যজিৎবাবুর লেখাই মনে পড়ছে একটা। বেশ কিছুদিন আগে উনি সায়েন্স ফিকশন বা সায়েন্স ফ্যান্টাসি সম্বন্ধে এক জায়গায় লিখেছিলেন—আমি আপনার লেখায় পড়েছি—তাতে আপনি এইচ জি ওয়েলসের লেখার তুলনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, টাইম মেশিনে উনি বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘বোতাম টিপলাম, চলে গেলাম’। এখন ধরুন, এভাবে আপনি যে ‘এলিয়েন’ ছবির কথা বললেন, সেখানেও একটা বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য যেটুকু বিজ্ঞান আনা দরকার সেটা তো আনতেই হবে?
সত্যজিৎ : হ্যাঁ, তাতো আনতেই হবে। কেননা এমন তো কিছু বলতে পারে না যে এক্কেবারে পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগ নেই; এরকম গ্রহ বা এরকম প্রাণী কল্পনা করা কঠিন। কেননা কতকগুলো খুব বেসিক লেভেলে এমিনো এসিড বলুন, এ বলুন ও বলুন, যার থেকে প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে সেটাতো দেখা যাচ্ছে সব জায়গায় এক। প্রথমত পৃথিবীর মধ্যে সমস্ত প্রাণীর মধ্যে এক। এবং এখনো যেটা অনুমান করা হয়, যে, অন্য গ্রহে যদি কোনো প্রাণী থাকেও, তাহলেও তাদের প্রাণের…
প্রশ্ন : মৌল উপাদানটা…
সত্যজিৎ : মৌল উপাদানটা বোধহয় একই হবে।
প্রশ্ন : আচ্ছা একটা কথা এ সম্বন্ধে আমি বলি যে, মানে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কল্পনা মানে সাহিত্যিকের কল্পনা নিশ্চয় বিজ্ঞানীর কল্পনাকে ছাপিয়ে গেছে। কারণ ‘জুলেভার্নের’ কল্পনা যেখানে গিয়েছিল তৎকালীন বিজ্ঞানীদের কল্পনা সেখানে পৌঁছোয়নি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বোধহয় আমার মনে হয় যে, যারা বিজ্ঞানভিত্তিক লেখক, যে বিজ্ঞান সাহিত্যিক, তাদের বোধহয় বৈজ্ঞানিকরা অনুসরণ করেছেন। এরকম তো হয়েছে অনেক? তাই না?
সত্যজিৎ : তাদের বৈজ্ঞানিকরা অনুসরণ করেছেন। এখন এটা তো বটেই, সত্যি কথা যে আজকাল যাঁরা বড়ো, নামকরা যাঁরা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পলেখক, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু নিজেও বৈজ্ঞানিক। যেমন আর্থার ক্লার্কের উদাহরণ রয়েছে। এবং আর্থার ক্লার্ক, এখন যে ইনসাট যে স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা তিরিশ বছর আগে তাঁর গল্পে সেটা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছিলেন।
প্রশ্ন : বা ধরুন যে অসিমভদের সময়ে, ১৯৪০-এর প্রথমদিকে, তখন এটম বম্ব সম্বন্ধে ম্যানহাটন প্রজেক্ট। কেউই জানতোই না সাধারণ লোক, তখন ওরা গল্পে এনেছেন। তখন সে সময় যেসব সায়েন্স এবং সায়েন্স ফিকশন যে পত্রিকাগুলো বেরোচ্ছে তাতে এ ধরণের গল্প ছিল যে এটম বম ফেলা হচ্ছে বা এ ধরণের কন্সেপ্ট…
সত্যজিৎ : নিশ্চয়। সেতো দেখতে গেলে আপনি যদি ৪০০/৫০০ বছর পিছিয়ে যান, সেখানে তো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কী-না করেছেন বলুন! তিনি তো কতো কি যে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন তখনকার যুগে বসে— যখন বিজ্ঞানের যুগ সবে শুরু হচ্ছে বলা যেতে পারে। তখন বসে বসে সেই এরোপ্লেন, হেলিকপ্টার, হ্যানো ত্যানো, গ্র্যামোফোন কী-না তার কল্পনার মধ্যে এসেছে! কাজেই মানুষের কল্পনা যে কতদূর যেতে পারে, এবং বিজ্ঞানটা পিছিয়ে থাকলেও ক্রমে ক্রমে চেষ্টা করে সেই কল্পনা— যদি তার মধ্যে সেই সম্ভাবনা এতটুকু থাকে বা সেটা যদি টেকনোলজিক্যালি তার পসিবিলিটির সামান্যতমও থাকে তাহলে একদিন না একদিন সে গিয়ে ধরে ফেলবে, এবং সেটা বাস্তবে পরিণত হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : আমাদের পুরাণ কাব্যের কল্পনাও তো এরকম হয়েছে যে…
সত্যজিৎ : ওরে বাবা! সেতো আছেই! আমি শুনেছি যে সেতো আমাদের ইয়েই রয়েছে— আমাদের শাস্ত্র নিয়ে। যেমন একটা শোনা যায়, খুবই সম্ভবত সত্যি— হিটলারদের ওয়ার অফিসে, জার্মানিতে, সমরাঙ্গন বা ওই যুদ্ধসংক্রান্ত কিছু পুঁথি ছিল, সংস্কৃত পুঁথি। জার্মানিতে তো বহু ইন্ডোলজিস্ট আছে, বহু সংস্কৃত পণ্ডিত আছেন। এবং তারমধ্যে থেকেই নাকি—সেই প্রথম—ওই যে ওদের সেই মিসাইলের ধারণা নাকি তার থেকেই আসে, এরকমও শোনা গেছে।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এবারে আমরা আপনার কথায় একটু আসতে চাই। সেটা হচ্ছে এই যে, আপনি এই বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা বা কল্পবিজ্ঞানমূলক যে কাহিনি বা উপন্যাস, যা লিখছেন, এই লেখার মধ্যে আপনি কী করে এলেন?
ধরুন, আমরা দেখেছি উনিশশো বিশ বা উনিশশো ত্রিশের দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্র বা অনেকেই লিখেছেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প বা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। কিন্তু ‘প্রফেসর শঙ্কু’র মতো একটা বিজ্ঞানীর চরিত্র নিয়ে গল্প লেখা, এবং কল্পবিজ্ঞানে সায়েন্স ফ্যান্টাসি, এই প্রথম আমরা পেলাম ঠিক ষাটের দশকে। এইরকম একটা চরিত্র। এইরকম অসাধারণ একটা চরিত্র আপনি ইন্ট্রডিউস করলেন। সেটা কী করে হলো সেটা একটু জানতে চাই।
সত্যজিৎ : হলো মানে আমার তো এমনি লেখার কোনো প্রশ্নই ছিল না। আমি তো কোনোদিন যে লিখব বা সাহিত্যিক হবো বা গল্প ভাবতে হবে আমাকে বসে, লিখতে হবে, এ আমি কোনোদিন ভাবিনি। আমি বিজ্ঞাপনের আপিসে কাজ করতাম, তারপর সেটা ছেড়ে ফিল্মে ঢুকলাম। ফিল্মের কাজ করছি তখন একদিন আমার বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় হঠাৎ বললেন যে ‘সন্দেশ’টাকে আবার বের করলে কেমন হয়? তা সেটা মনে ধরল ব্যাপারটা এবং তার ছ’মাসের মধ্যেই ১৯৬১তে ‘সন্দেশ’ আমরা আবার নতুন করে বার করি। সুভাষ এবং আমি সম্পাদক ছিলাম। এবং ‘সন্দেশ’ বেরোনোর পর স্বভাবতই আমার মনে হলো যে এবার একটু লেখা লিখতেই হয়তো হবে! আর কিছু না হোক ‘সন্দেশ’কে ফিড করার জন্যে। তা প্রথম গল্পই কিন্তু আমার বলতে পারেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প; যদিও সেটা ‘প্রফেসর শঙ্কু’র গল্প না, সেটা হচ্ছে ‘বংকুবাবুর বন্ধু’। এটা আমার জীবনে প্রথম বাংলা গল্প। এবং পরে এই গপ্পোটা— পরে যদি সেটার প্রসঙ্গে আসা যায় পরে আসা যাবে, সেটা হচ্ছে এই গপ্পোই ভিত্তি ছিল পরে যখন আমি ফিল্মের চিত্রনাট্য করি। যাই হোক, ‘বংকুবাবুর বন্ধু’ লেখার পর আমি দু-একটা ভূতের গল্প এ-গল্প সে-গল্প লিখে তারপর আমার মনে হলো যে এই শঙ্কু ধরণের একটা চরিত্র, ডায়েরি ফর্মটার কথা মনে হলো, যে, এটা হতে পারে এবং এটা বোধহয় সাবকনশাসলি আমার খানিকটা কাজ করেছিল ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’— আমার বাবার লেখা, সেটা আমার ভয়ানক একটি প্রিয় লেখা। সেটাতেই উনি কোন্যান ডয়েলের ‘লস্ট ওয়ার্ল্ড’ বা অজ্ঞাত জগতকে নিয়ে একটু ঠাট্টা করেছিলেন। সেখানে বাবা যেগুলো তৈরি করেছিলেন একেবারেই কাল্পনিক কিছু প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ার, তাদের নামধাম, স্বভাব-চরিত্র সবই তার সঙ্গে এমনি কোনো বই খুলে সেসব জানোয়ারকে পাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন : যেন পুরোটাই মজা করার জন্যে!
সত্যজিৎ : পুরোটাই মজা করার জন্য। পুরোটাই ঠাট্টা করার জন্য। লেগ পুল করার জন্যে। বলা যেতে পারে, ওইটা নিয়ে রসিকতা, রঙ্গ-রসিকতা। তা আমারও প্রথম যেটা— শঙ্কু— যেটা ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’ তার মধ্যে এই মেজাজটা বর্তমান। শঙ্কু যদিও ডায়রি লিখছে এবং আপাত দৃষ্টিতে তাকে সিরিয়াস বলে মনে হবে, কিন্তু তার প্রথম যে ইনভেনশন— যে নস্যাস্ত্র, স্নাফ গান, যে নস্যির বন্দুক, সেটা মারলে মানুষকে কতবার যেন… ছাপ্পান্নবার হাঁচতে হবে— এই ধরণের কতকগুলো ব্যাপার ছিল। তা সেইটা লেখার পরে কিন্তু ক্রমে ক্রমে শঙ্কু সিরিয়াস হয়ে গেছে। শঙ্কু সিরিয়াস হয়ে গেছে, কেননা ওইটে লেখার পরে আমি ভীষণভাবে বিজ্ঞানসংক্রান্ত কাগজপত্র, বইপত্র পড়তে আরম্ভ করলাম এবং আরও অন্যান্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা। তখন একটা ভীষণ নেশা চাপল, অ্যাসিমভ বলুন আর্থার ক্লার্ক বলুন, ব্র্যাডব্যারি, তারপর থিওডর স্টারজিয়ন ইত্যাদি বিদেশের যারা নামকরা লেখক তাদের লেখাও ভীষণ পড়তে আরম্ভ করলাম। এবং তারপরে কতকগুলো সায়েন্স ফিকশনের একেবারে প্রধান মূল কতকগুলো বিষয়বস্তু বা থীম আছে, সেগুলো একটার পর একটা ধরে ধরে আমি শঙ্কুর মধ্যে দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করতে লাগলাম। সে ইনভিজিবিলিটিই বলুন বা লঞ্জিভিটির ব্যাপার বলুন, ব্রেইনের ব্যাপার বলুন, বাইরের থেকে প্রাণী আসার ব্যাপার বলুন বা এখান থেকে বাইরের কোনো গ্রহে যাওয়ার ব্যাপার বলুন— কতগুলো স্ট্যাপল—যাকে বলে কতগুলো— একেবারে মূল থিম সায়েন্স ফিকশনের রয়েছে— যেগুলো প্রত্যেক সায়েন্স ফিকশন লেখকই একবার না একবার ব্যবহার করেছেন…সেইগুলো, সেই থিমগুলো নিয়ে নিয়ে। আর কতকগুলো জায়গা সম্বন্ধে তো আমাদের ভয়ানক ফ্যাসিনেশান থাকে। নিশ্চয় আপনারও আছে, সংকর্ষণবাবুর নিজের। যেমন ইজিপ্ট, অ্যাফ্রিকার কিছু অংশ, মরু অঞ্চল। এই ধরণের কতগুলো প্রাচীন সভ্যতা। কিন্তু তার মধ্যেও যে কতগুলো অদ্ভুত বা আজকের দিনেও আমাদের কাছে যেগুলো খুব অবাক বলে। এমনকি পিরামিড তৈরির ব্যাপারটাই এত একটা অদ্ভুত জিনিস। এইসবগুলো, প্রাচীন সভ্যতার প্রতি আমার একটা ভয়ানক টান রয়েছে। সেগুলো আধুনিক আজকের দিনের বুদ্ধিতে…
প্রশ্ন : আধুনিক বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না এইরকম অনেক জিনিস আছে।
সত্যজিৎ : অনেক অনেক জিনিস আছে। পিরামিডের কন্সেপ্ট তো— আজকাল তো ক্রমে ক্রমে আরও কত বেরোচ্ছে। আমি নিজে সম্প্রতি ‘সন্দেশে’ একটা লিখেছি সেই নাজকার লাইন সম্বন্ধে আপনারা কেউ জানেন কিনা জানি না। দক্ষিণ আমেরিকায় নাজকা বলে একটি ছোট্ট জায়গা আছে, পেরুর ঐদিকে, যেখানে সে প্রথম বোধহয় বছর চল্লিশেক আগে এরোপ্লেনে ওর উপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখল জমিতে একেবারে বিশাল বিস্তৃত সমস্ত জিওমেট্রিক নকশা। পাখি, মাকড়সা, জানোয়ার এত বড়ো যে আপনি জমিতে বসে কিন্তু সেগুলো বুঝতেই পারবেন না। শুধু উপর থেকে একটা এলিভেশন থেকে অন্তত পাঁচ ছশো ফুট হাজার ফুট উপরে উঠে গেলে…
প্রশ্ন : ডানিকেনের বইতে এর উল্লেখ আছে।
সত্যজিৎ : ডানিকেনের বইতে উল্লেখ আছে এবং এ নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন জার্মান ভদ্রমহিলা সেখানে আজ দশ বছর ধরে থেকে এটা বোঝবার চেষ্টা করছেন, কেন করা হয়েছে। ডানিকেন তো সোজা বলে দিয়েছে বাইরের থেকে স্পেসশিপ আসবার সুবিধা হবে বলে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন এইগুলো নিয়ে—এইগুলো প্রত্যেকটাই কিন্তু আমার গল্পে ক্রমে-ক্রমে ক্রমে-ক্রমে শঙ্কু—শঙ্কুর সঙ্গে সঙ্গে অন্য চরিত্রও এসেছে—তার বন্ধুবান্ধব এবং শঙ্কুর ধর্মটা হচ্ছে কি— শঙ্কু প্রথমে গিরিডিতেই থাকত মোটামুটি। তারপর শঙ্কুকে… তারপর ফেলু যখন এলো ফেলো চরিত্র। ফেলুকে আমি ভারতবর্ষের মধ্যেই মোটামুটি রেখে, ভারতবর্ষের অনেকগুলো জায়গায় তার নানারকম এডভেঞ্চারের কাহিনি বলতে লাগলাম আর শঙ্কুকে সারা পৃথিবীতে…
প্রশ্ন : ঘোরাচ্ছেন
সত্যজিৎ : চষে বেড়াতে লাগালাম।
প্রশ্ন : আচ্ছা এই সূত্রে আমি একটু বলে নিই; আপনি বলছিলেন শঙ্কু এখন অনেক বেশি সিরিয়াস। তাছাড়া আমরা একটা জিনিস লক্ষ্য করছি যে আপনার গল্পে যেটা আগে ছিল না, এখন ক্রমশ বেশি পাচ্ছি; যেমন : একটা ল্যাবরেটরির একটা এক্সপেরিমেন্টের একটু ডিটেইলস।
সত্যজিৎ : হু হু…
প্রশ্ন : এইগুলো কিন্তু বেশি করে করে এখন আসছে। তার মানে আপনি আরও বেশি বিজ্ঞান নির্ভর হয়ে আরও বেশি করে বিজ্ঞানের ডিটেইলসগুলোকে আনছেন আরকি!
সত্যজিৎ : হ্যাঁ সেটার জন্য আমাকে পড়াশুনাও করতে হচ্ছে একটু বেশি। আমি প্রথম যখন শঙ্কু আরম্ভ করি তখন আমার সে পড়াশুনার দৌড়টা অনেক কম ছিল। তারপর আমি কতকগুলো পত্রিকা রাখতে আরম্ভ করি। বইটই ভালো পেলেই আমি তৎক্ষণাৎ কিনি। সেগুলো পড়ি। এবং এখন তো একটা বই রাখলে তো চলে না। আবার দু-বছর তিন বছরের মধ্যে নতুন নতুন বেরোচ্ছে। এত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে সে কল্পনার বাইরে। কল্পনার বাইরে এখন যা চলছে! কাজেই যথাসম্ভব তার সঙ্গে সঙ্গে পা মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি এবং তার মধ্যে যেগুলো শঙ্কুতে কাজে লাগানো যায় সেগুলো কাজে লাগিয়ে দিই। তবে শঙ্কুর মধ্যেও এবং ফেলুদাতেও—এর আগেও একটা জিনিস যেটা এনেছি—সেটা একেবারে, এখনো সেটা কী বলব! সেটা প্যারাসায়েন্সের পর্যায়ে এখনো যেটা রয়েছে— প্যারাসাইকোলজি বলুন, প্যারানরম্যালের পর্যায়ে যেটা রয়েছে, সেটাতেও আমার কম উৎসাহ নেই। কম কৌতূহল নেই।
প্রশ্ন : আচ্ছা এটা সম্বন্ধে আপনার নিজের মতামত কী একটু বলুন।
সত্যজিৎ : আমার নিজের মতামত; আমি যাকে বলে, আমার মনটা এই ব্যাপারে খোলা। আমার বিশ্বাস যে, এই ধরণের ঘটনা ঘটে। আমি নিজে দেখেছি। আমার পরিবারে ঘটেছে। প্রত্যক্ষ না হলেও আমার এত কাছের লোকের ঘটেছে যে তাকে প্রায় প্রত্যক্ষই বলা চলে এবং সেটা না মানবার কোনো কারণ নেই। এবং আমার একটা ধারণা রয়েছে এগুলো বছর তিরিশ চল্লিশের মধ্যে সব বিজ্ঞানের আওতার মধ্যে এসে যাবে। এগুলো এখনো হয়তো— সেই কারণটা হয়তো পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু আস্তে আস্তে সেটা তার পার্টিক্যাল ফিজিক্সের মধ্যেই হোক, যার মধ্যেই হোক— একটা এসে যাবে।
প্রশ্ন : এবং আমরা জানি অনেক বিজ্ঞানী এখন এ বিষয়ে কাজও করছেন।
সত্যজিৎ : অনেক জায়গায়। সোভিয়েত রাশিয়ায় কাজ হচ্ছে, বিশেষভাবে কাজ হচ্ছে। এই যে কিরলিয়ান ফটোগ্রাফি…
প্রশ্ন : আচ্ছা একটা কথা এবার বলি। আমরা শুনেছিলাম ‘প্রফেসর শঙ্কু’র ব্যাপারটা নিয়ে। আমার মনে হয়, একটা দিকে যদি এবার আসি আমরা, এই ধরুন এই সায়েন্স ফিকশান বা সায়েন্স ফ্যান্টাসি লেখার একটা তাগিদ যেটা, এটা লেখার দরকারটা বেশি করে আছে কিনা বা প্রয়োজনটা কোথায়? এইটা নিয়ে কিছু বলুন।
প্রয়োজন মানে এর ফলে কোনো… ধরুন আজকে একটা বড়ো কথা যে বিজ্ঞানের লেখালেখি, বিজ্ঞান কমিউনিকেশন, একটা লোককে বিজ্ঞানের সত্যগুলো জানানো সেটা সায়েন্স ফিকশানের মধ্য দিয়েও হচ্ছে, সায়েন্স ফ্যান্টাসি বা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের মধ্য দিয়েও হচ্ছে। আসল হচ্ছে যে, এটা নিয়ে লোকের মনে একটা বিজ্ঞানের আগ্রহ জন্মানো, একটা চেতনা, এই বিজ্ঞানকাহিনির মধ্য দিয়ে এটা কি সম্ভব? কতখানি সম্ভব?
সত্যজিৎ : সম্ভব মানে কী— ধরুন আমার গল্প যদি লোকের ভালো না লাগত; বা যাদের জন্য লেখা, কিশোর কিশোরীদের যদি ভালো না লাগত, তাহলে হয়তো আমি ওটা নিয়ে আর লেখার উৎসাহ পেতাম না।
প্রশ্ন : এরকম কি জানতে পেরেছেন যে আপনার এই লেখার প্রেরণায় সে হয়তো বিজ্ঞান চর্চায় নেমেছে। এরকমও তো হতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমি একটু বলে নিই আর্থার সি ক্লার্ক যখন কলিঙ্গ পুরস্কার নিতে এসেছিলেন উনি কিন্তু একবার বলছিলেন এই কথা যে আমরা হিসেব রাখিনি যে সায়েন্স ফিকশন পড়ে কত লোক বিজ্ঞানকে প্রফেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে। বিজ্ঞানকে ভালোবেসেছে। এটা আপনি মনে করেন যে, এটাও একটা দিক আছে এটার?
সত্যজিৎ : দেখুন, সায়েন্স ফিকশন পড়ে আমি অন্তত সায়েন্স ফিকশন লেখায় নেমেছি। আমার একটা তো উপকার হয়েছে। সে প্রেরণাটা তো আমি পেয়েছি এবং সেটা লিখছি। এবং তার ফলে আরো পাঁচজন যে সেরকম কোনো প্রেরণা পাবে না সেটা যে সবসময় লেখার বা সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়েই প্রকাশ পাবে, সেটা নাও হতে পারে। সে নিজে সে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারে। তার যদি জিনিসটা সম্বন্ধে একটা যথেষ্ট আগ্রহ জাগে তাহলে সে সেটা নিয়ে আরও চর্চা করতে চাইবে না কেন? সেতো শুধু আমার গল্প পড়ে সব জানবে না। সেটা তেমনই যদি কৌতূহল বা আগ্রহ হয় তাহলে তাকে নিজে থেকে চাড় করে আরও পাঁচ রকম জিনিস পড়তে হবে। শেষকালে সেটাকে সে একাডেমিক ডিসিপ্লিনের মধ্যে নিয়ে নিতে পারে। কোনো টেক্সট বই হয়তো কিশোর কিশোরীদের পড়বার আগ্রহ ততো নাও থাকতে পারে। কিন্তু তারা প্রথম জানছে গল্পের মধ্য দিয়ে। এবং সেখানে গপ্পোটা খুব বড়ো কিন্তু। গপ্পের প্লট অত্যন্ত বড়ো জিনিস এবং তারসাথে সেটা তথ্য ভারাক্রান্ত যেন না হয়ে পড়ে। কখনো মনে হবে না যে এইসব তথ্যগুলো পরিবেশন করবার জন্য আমি গপ্পটা লিখছি। প্রধান হচ্ছে গপ্পো, গপ্পের রস। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে, তার মারফত সে কতকগুলো জিনিস জেনে যাচ্ছে। কতকগুলো দিকে তার উৎসাহ জাগ্রত হচ্ছে। তারপর সেটা সে পরে কাজে লাগাতে পারে।
প্রশ্ন : এছাড়া কি আপনি মনে করেন না যে আজকে যে ভবিষ্যৎকে আমরা চিনি না জানি না, মানে, সায়েন্স ফিকশন এর বেশিরভাগ লেখকই ফিউচারোলজির দিকটা নিয়ে চর্চা করেন। ভবিষ্যতে কী হতে পারে না-পারে সেটা একটা— ধরুন আজকে রকেট যখন ছিল না, রকেটের কথা পড়েছি। একটা মন তৈরি হয়েছে। বা এটম বম ছিল না এটম বমের কথা পড়েছি, মন তৈরি হয়েছে। আজকেও ২০০০ সালে ২০২০ সালে কী হতে পারে পৃথিবীর চেহারা তা নিয়ে যখন বিজ্ঞান গল্পকাররা বলছেন, আমরা একটা ধারণা নিচ্ছি তার থেকে। তা এটা কি আমাদের সাহায্য করবে না অনাগত ভবিষ্যতের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে? একটা প্রস্তুতি।
সত্যজিৎ : আমরা তো আর সেই ভবিষ্যতের সময় থাকব না। এই জেনারেশনটা তখন তো— জেনারেশানটা তো বদলে বদলে যাচ্ছে। নিশ্চয় আখেরে…
প্রশ্ন : না, কিন্তু আপনার যারা মূলত পাঠক তারা তো কিশোর কিশোরী।
সত্যজিৎ : হ্যাঁ তাতো বটেই! তারা একদিন বড়ো হবে।
প্রশ্ন : তাদের কল্পনার মধ্যে যেটা রয়ে গেল, পরে হয়তো সেইটে একটা বাস্তবে রূপ নিতেও পারে।
সত্যজিৎ : নিতেও পারে। কিছুই আশ্চর্য নয়। তবে আমরা তো নিজেদের অত বড়ো বলে মনে করি না। যারা সত্যি করে বড়ো বড়ো লেখক যেমন অ্যাসিমভ বা ক্লার্ক, তাঁদের যে বিজ্ঞানের ভিত্তিটা রয়েছে সেটা তো আমাদের নেই। কাজেই আমাদের অনেকটা নির্ভর করতে হয় কল্পনার ওপর। কল্পনা এবং প্লট। এবং গল্পের মজাটার উপর। তার সঙ্গে সঙ্গে যতটুকু পারি সেটা খুব একটা এবসার্ড যাতে কিছু না হয় বা সেটা অবিশ্বাস্য বা অবাস্তব না হয় তার জন্য আমাদের খানিকটা পড়াশুনা করে নিতে হয়।
প্রশ্ন : আচ্ছা এবারে আমরা একটু বিজ্ঞানভিত্তিক ছবির প্রসঙ্গে আসি। মানে বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনির উপরেই তো ছবিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এখন তো বিদেশি অনেক ছবি আসছে, তার অধিকাংশ বিজ্ঞানভিত্তিক দেখা যাচ্ছে।
এবং সত্যজিৎবাবু নিজেও একসময় বলেছেন, কিছুদিন আগে আমার মনে পড়ছে যে উনি বলেছিলেন যে ওঁনারও একটা পরিকল্পনা আছে এই ধরণের একটা সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম করার এবং সেটা হয়তো ঠিক ওই স্পেস ওডিসি ধরণের অত বড়ো, অত চমকদার না হলেও, ওঁনার মনে হয় একটা পরিকল্পনা আছে। তা এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এখন কী ভাবছেন?
সত্যজিৎ : হ্যাঁ ওটার পরিকল্পনা আজকের না। ওটা আমার চিত্রনাট্য লেখা হয় ১৯৬৭তে। পনের বছর আগে। ওটা, ইন ফ্যাক্ট, আমি একবার লন্ডন গিয়েছিলাম, তখন স্ট্যানলি ক্যুবরিক ‘স্পেস ওডিসি’ তুলছেন। আর্থার ক্লার্কের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তার আগেই এই ‘বংকুবাবুর বন্ধু’র উপর ভিত্তি করে একটা, ওই গপ্পো না, কিন্তু ওই বাইরে থেকে স্পেসশিপ আসার ব্যাপারটা রয়েছে, একটা আইডিয়া— একটা কল্পনা আমার মাথায় ছিল। পরিকল্পনা। তা আমি আর্থার ক্লার্ককে বলাতে বলল, ‘বাহ, এতো বেশ লাগছে! তুমি গিয়ে লেখো’। তারপর আমি কলকাতায় ফিরে এসে পুরো চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। সেটা অনেকদূর এগিয়েছিল। কলাম্বিয়া কম্পানি সেটা… আমি হলিউডে কাটিয়েছিলাম ছ’সপ্তাহ। তবে আমার হয়ে যিনি মধ্যস্থতা করেছিলেন তার কতকগুলো গোলমালের ফলে শেষ পর্যন্ত ছবিটা হয়নি। কিন্তু তার বহু আইডিয়া— কলাম্বিয়া কম্পানি ছবিটি করবে বলে আমার চিত্রনাট্যের বহু সাইক্লোস্টাইল্ড মিমিওগ্রাফড কপি, অন্তত শ’খানেক, সেই ওদের আপিসে ছিল। তারমধ্যে থেকে চার আনা, পাঁচ আনা, দশ আনা করে আইডিয়া দুটি ছবিতে লেগে গেছে। এক হচ্ছে ‘ক্লোজ এনকাউন্টারস অভ দ্য থার্ড কাইন্ড’, আর একটি সেই স্পিলবার্গেরই নতুন একটি ছবি হয়েছে ‘এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল’ বলে ইটি নাম দিয়ে ছবি হয়েছে। এখন এমন অবস্থা এসছে যে আমার আর ‘এলিয়েন’ করা সম্ভব না। করলে বলবে যে আমি ওর থেকে নিয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে উল্টো।
প্রশ্ন : এই ঘটনাটা আমাদের একদমই জানা ছিল না! এই ছবিটা কি আপনি ইংরেজিতে করবেন ভেবেছিলেন?
সত্যজিৎ : না। ওটা বাইলিংগুয়াল ছবি ছিল। আমার একেবারে বাংলাদেশের গল্প। একটি গ্রামে একটি পদ্মপুকুরে এসে একটি স্পেসশীপ ঝপাং করে পড়ে, তারমধ্যে একটিমাত্র এলিয়েন চরিত্র রয়েছে। সে বোধহয় মেশিনটা বিকল হয়েছে এবং চরিত্রটিও বোধহয় একটুখানি বিকল। কিন্তু পরদিন তার একটা পোর্ট হোলের মধ্যে দিয়ে ভোরে যখন সূর্যটা ওঠে, এটা মাঝরাত্রে ঘটনাটা ঘটে এবং যেই পড়লো জলের মধ্যে অমনি দেখা যায় চোখের সামনে যে সমস্ত পদ্মগুলো ফুটে উঠল। It’s a benevolent force. এইটে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু তারপরে সেই পোর্ট হোলের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো এসে যেই এলিয়েন ক্রিয়েচারটির, এই প্রাণীটির গায়ে পড়াতে সে আবার সজীব হয়ে উঠল। সূর্যের আলোতে তার প্রাণ পেল এবং তারপর সে রাত্রেবেলা মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে এবং তাকে ঘিরে নানারকম প্রতিক্রিয়া। গ্রামে চাষাভুষো আছে, একটি জার্নালিস্ট ছেলে আছে, সে গ্রাম সম্বন্ধে একটা সমীক্ষা করতে এসছে। তার স্ত্রী আছে, তার নতুন বিয়ে হয়েছে। সেই মেয়েটি আবার গ্রামের মেয়েদের ফ্যামিলি প্লানিং-ট্যানিং ইত্যাদি নিয়ে নানারকম রিসার্চ করছে। দুজনেই একসঙ্গে রিসার্চ করে। একটি মাড়োয়ারি আছেন। তিনি একটি—ড্রাউট এরিয়া ওটা— সে একজন আমেরিকানকে দিয়ে খুব আধুনিক একটা ড্রিলিং মেশিন বসিয়েছে— জলের জন্য। এখন মজা হচ্ছে কি, সেই পুকুরের উপর দিয়ে সেই স্পেসশিপটির একটি চুড়ো বেরিয়ে রয়েছে, সোনালি রং তার। সেই মাড়োয়ারিটি মনে করেন এটি একটি মন্দির, এর ব্লাস্টিং হয়েছে তারজন্য ভেতর থেকে বেরোচ্ছে। অর্থাৎ জলের থেকে তুলে বার করে নিয়ে এই মন্দিরকে সে আবার প্রতিষ্ঠা করবে। এই ধরণের সব ব্যাপার। একমাত্র আমাদের বাঙালি জার্নালিস্টটির সন্দেহ হয়। কেন কতকগুলো ঘটনা ঘটছে। যে ক্রিয়েচারটি বেরিয়ে আসে, যে প্রাণীটি, সে অতি একটি ক্ষুদ্র, দেখলে মনে হবে একটি দুর্ভিক্ষে না খেতে পাওয়া একটি বাচ্চা ছেলে বুঝি এইরকম। তার চোখ নেই, সকেটস আছে এবং তারমধ্যে নানারকম দৃষ্টি আছে। সে এক্সরে ভিশন আছে, সে মাইক্রোস্কোপিক ভিশন আছে। তার একটা রং, রশ্মির রং আলাদা। এমনকি সে মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে পারে! বৃদ্ধতম গ্রামের যে অধিবাসী— সে মারা যাচ্ছে, তার শ্মশানের একটি দৃশ্য আছে। এইরকম অনেক ব্যাপার আছে জানেন? খুব মজার! আলটিমেটলি সে আমেরিকানটিকে গিয়ে সেই আমাদের বাঙালি জার্নালিস্ট বলে যে আমার মনে হচ্ছে এখানে স্পেসশিপ একটা রয়েছে। ও বললে, তোমার মাথা খারাপ? এই পোড়া দেশে স্পেসশিপ আসতে যাবে কেন? আমাদের এত বড়ো বড়ো সব শহর রয়েছে পশ্চিমে, এখানে সে কী করছে? তার কী দরকারটা কি আসার? তারপর শেষে যখন নিজেরও সন্দেহ হয় সে বন্দুক-টন্দুক নিয়ে একটা ব্যাপার করতে যায়। কিন্তু তার আগে আমাদের যে এলিয়েন ক্রিয়েচারটি—যে প্রাণীটি— সে এসছিল কিছু স্পেসিমেন সংগ্রহ করতে। দুটো ব্যাঙ, একটা সাপ, কিছু গাছ, কিছু ফুল এবং একটি খুব গরীব ছেলে— হাবা বলে—সে একটা অর্ফান ছেলে—সে ভিক্ষে করে বেড়ায়— তাকেও নিয়ে যাচ্ছে। কেননা সে ধরে ফেলেছে যে এর এখানে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ও যখন সেই বন্দুক চালাতে যাচ্ছে— বন্দুক চালানোর সঙ্গে সঙ্গে ওদিকে ওর কিন্তু যন্ত্র এখন তৈরি হয়ে গেছে। সে যন্ত্রকে নিয়ে উঠে চলে গেল। গ্রামের লোকেরা ভাবল, বাহ! আমেরিকান সাহেব আমাদের জন্য্য কি সাংঘাতিক একটি অদ্ভুত কাজ করল! অ্যামেরিকান নিজে বুঝতে পারছে, ‘আমি কিছুই করিনি!’
প্রশ্ন : তা এইটা করুন না আপনি!
সত্যজিৎ : এটা জানি। এটা এখন সম্ভব। আগে খুব অদ্ভুত কঠিন ছিল কতগুলো ব্যাপার। এখন জলের মতো সহজ হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : করুন না!
সত্যজিৎ : দেখি! আমি… ওই আমার একটা ভয়! কতকগুলো পরিবর্তন করতে হবে। কেন না, কতকগুলো আইডিয়া ও মেরে নিয়েছে। এই অ্যামেরিকান ছবিটি কিছু আইডিয়া মেরে নিয়েছে।
প্রশ্ন : তা হোক। তাহলেও আপনি যেভাবে বললেন যে কাহিনিটা এটা অপূর্ব হবে।
সত্যজিৎ : এবং তারপর আমি ওইটা দেখিয়েছি ওর চোখের মধ্যে দিয়ে। সেখানেও আমাদের একটা ইয়ে হবে। একটা অব্জেক্ট। একটা পাতা। কিংবা একটা পোকা। পোকার দিকে দেখতে দেখতে সেই মাইক্রোস্কোপিক দৃষ্টি নিয়ে গিয়ে গিয়ে সমস্ত স্ক্রিনে তার ইন্টারনাল সিস্টেম, তার ব্লাড, তার ধমনী, সমস্ত… তার রক্ত সমস্ত দেখা যাচ্ছে!
প্রশ্ন : ফিল্মের দিক থেকেও কিন্তু প্রচুর স্কোপ রয়েছে।
সত্যজিৎ : এখানের মজাটা হচ্ছে, এখানে আমার বিজ্ঞানটা… আহা, পার্থিব বিজ্ঞানটা যেটুকু দেখানো হবে সেটা ঠিকই থাকবে। কিন্তু ছেলেটার স্পেসশিপের ভেতরটা— তারমধ্যে ওসব কোনো যন্ত্রপাতি বা বোতাম টোতাম নেই। সমস্তটাই ভেইনস এন্ড আরটারিসের মতো চেহারা। সেটাও যেন একটা—
প্রশ্ন : একটা লিভিং বিইং…
সত্যজিৎ : একটা লিভিং বিইং। এবং তার কতকগুলো জিনিসে ওইখানে ইয়ে করলে সেগুলো তবে জ্যান্ত হয়। সবসময়ই সেটার মধ্যে একটা প্রাণ রয়েছে। দপদপদপ করে জ্বলছে। এবং বহুদিনের আগের ভাবা জিনিস এটা আমার। এখনও করলে— এখনও আবার রিভাইভ হবার চেষ্টা হচ্ছে। অ্যামেরিকা থেকে এখনও চিঠি আসছে কিন্তু আমার এমন একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে ওটায় ফিরে যেতে মনটা চায় না আরকি! যদি আরেক… আর আজকাল তো বহু আকছার স্পেস ফিকশন হচ্ছে। এবং সত্যি কথা বলতে কি, টেকনিক্যালি অসাধারণ একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ওরা।
প্রশ্ন : আচ্ছা, আপনি ওদের স্টুডিও ফ্যাসিলিটি পাবেন না? পেতে পারেন নিশ্চয়ই!
সত্যজিৎ : হ্যাঁ, এই ছবি করতে হলে এমনিও আমাকে কোপ্রডাকশন ছাড়া সম্ভব না। আমাকে বাইরের টাকা নিতেই হবে। কারণ এটা খরচ, খরচের ব্যাপার। ওই যে প্রাণীটি, তার চলাফেরা— সে ভারী অদ্ভুত! এমনকি সে একটা গাছের পাতার উপরেও দাঁড়াতে পারে, তার এতো ওজন কম! প্রায় একেবারে ওয়েইটলেস বলা যেতে পারে। সেইরকম আদ্ধেক ওড়ে। আদ্ধেক লাফিয়ে এরকম চলে। একদিন সে অ্যামেরিকানটা কোত্থেকে একটু… সাঁওতাল আছে কাছে, সাঁওতালের ওখানে গিয়ে একটু হাঁড়িয়া ফাড়িয়া খেয়েছে। সাঁওতাল নাচ হচ্ছে। সে একটু মত্ত অবস্থায় ফিরছে একটা বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে। তার পেছন পেছন আসছে সেই ক্রিয়েচারটি। তা ও হঠাৎ পেছন ফিরে দেখে কে রে বাবা! এখন ও ভেবেছে বুঝি দুর্ভিক্ষের কেউ। ও পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে। এবং শেষে যখন এলিয়েন চলে যাচ্ছে তখন দেখছে কপালে তার আধুলিটা লাগানো রয়েছে!
প্রশ্ন : যাক! সত্যজিৎবাবু আজকে অনেকক্ষণ সময় দিয়েছেন আমাদের। সংকর্ষণবাবু আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। আমাদের এই আলোচনাটা, আমার ধারণা, আমাদের শ্রোতাদের অত্যন্ত ভালো লাগবে।
মূলত কবি। পাশাপাশি অনুবাদ করেন। একটা ইংরেজি ওয়েবজিন ‘প্রাচ্য রিভিউ’র কবিতা বিষয়ক সম্পাদক। জন্ম ২১ এপ্রিল ১৯৮৭, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আর কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। প্রথম কবিতার বই নিঃসঙ্গম।