রবিবার, নভেম্বর ২৪

আমার বাবা কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম : তামান্না হাসান

0

বাবাকে নিয়ে লিখতে বসেছি কবি টোকন ঠাকুরের অনুরোধে। দু’হাজার শব্দের মধ্যে লিখতে বললেন। ভাবতে বসলাম, বাবাকে নিয়ে আসলে কি লিখব? অনেক স্মৃতি, অনেক অনুভূতি জড়িত বাবার সাথে। দু’হাজার শব্দের মধ্যে সন্তান কি তার বাবাকে প্রকাশ করতে পারে? পারা যায় না আসলে… কতশত স্মৃতি, কতশত ঘটনা হুরমুর করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমার এই লেখা আসলে ছাপার উপযোগী হবে কি না জানি না, আমি শুধু বাবাকে আমি যেভাবে জানি তার কিছুটা প্রকাশ করার জন্য কলম হাতে ধরেছি। আমার এই এলোমেলো লেখাকে ক্ষমা করবেন…

প্রথমেই বাবার পরিবারের ছোট্ট একটি পরিচয় দিয়ে নেই। আমার দাদু মরহুম মোসলেম উদ্দিন ও দাদী হাসনাহেনা। অনেক সাধনা করে ৯ বছর পর রাজশাহী শাহ মখদুম বাবার মাজারে মানতের পর বাবার জন্ম হয়। বাবার নাম রাখা হয় মাহমুদুল হাসান মাছুম। শুধু পরিবারের নয় বংশের বড়ো ছেলে তিনি। তাঁর ছোটো এক ভাই শহিদুল ইসলাম পিন্টু ও দুইবোন কুমকুম ও কল্পনা। আমার দাদু মোসলেম উদ্দিন একজন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে বাবার জন্ম হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। এখন যদিও সকলের কাছে তিনি কবি হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তিনি আমার আর আমার পরিবারের কাছে একজন সাধারণ মানুষ, সাধারণ একজন বাবা। এই সাধারণ মানুষটা আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন।

কেমন ছিলেন এই মানুষটা তা স্বল্পকথায় আসলে বলা ভীষণ মুশকিল। ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি সকলে বাবাকে ভীষণ ভয় করত। তাঁর রাশভারি গলার ডাক শুনলে অনেকে ভয়ে হিসু করে দিত বলে ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছি। বাবাকে আমরা দুইবোনও ছোটোবেলায় ভীষণ ভয় পেতাম। কি পরিমাণ ভয় পেতাম তা বোঝার জন্য ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। ছোটোবেলায় আপু আর আমি একবার আইসক্রিম কিনে খাচ্ছিলাম। সে সময় যখন তখন আইসক্রিম কিনে খাওয়া আমাদের বারণ ছিল। আইসক্রিম খাওয়ার সময় জানালা দিয়ে দেখতে পাই যে বাবা আসছেন। বাবাকে দেখে ভয়েই দুইবোন জানালা দিয়ে আইসক্রিম ফেলে দেই। ঘটনাটা বাবার মনে ভীষণ নাড়া দেয়। বাবা বিষয়টা দেখে আমাদের দুইবোনকে সাথে নিয়ে আবারও আইসক্রিম কিনে দেন এবং তিনি ঠিক করেন তিনি মেয়েদের বন্ধু হবেন এবং পরবর্তীতে তিনি তা-ই হয়েছিলেন।


মাহমুদুল হাসান মাছুম

আত্মজা ও মাহমুদুল হাসান মাছুম | ছবি: লেখক


ছোটোবেলার বেশ কিছু ঘটনা বা মুহূর্ত ছবির মতো চোখের সামনে ভাসছে। যেমন: বাবা আমাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন, মাথায় ঝুঁটি বেঁধে দিচ্ছেন, আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন এমন অনেক কিছু। আমি মাছের চোখ খেতে খুব ভালোবাসতাম, রাতে ঘুমিয়ে পড়লেও বাবা আমাকে ডেকে তুলে পাশে বসিয়ে আবারও খাওয়াতেন। তাঁর পাত থেকে খাবার তুলে আমার প্লেটে দিতেন। এরপর যখন আমি কিছুটা বড়ো হলাম বাবা আমাকে নিয়ে বাজারে যেতেন। আজও মনে আছে প্রতিমাসের বাজার আমায় সাথে নিয়ে করতেন। বাজার কিনে সব রিকশায় তুলে দিতেন, আর আমি নিয়ে আসতাম।

এক রাতের ঘটনা বলি। আমার বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। কোন ক্লাসের ঘটনা মনে নেই, এটুকু মনে আছে যে পরের দিন আমার ইংরেজি পরীক্ষা ছিল। আমি আমাদের রুমে পরীক্ষার পড়া রিভাইস দিচ্ছিলাম। পাশের রুমে বাবা টিভি দেখছেন আর জোরে জোরে হাসছেন। কিছুক্ষণ পরেই বাবা আমার ঘরে উঁকি দিয়ে বললেন, ‘কি করছিস।’ বললাম, ‘রিভাইস দিচ্ছি, কাল পরীক্ষা।’ বাবা বললেন, ‘অনেক পড়েছিস, আর পড়তে হবে না। ভীষণ সুন্দর একটা মুভি দেখাচ্ছে টিভিতে। না দেখলে মিস করবি। একা একা দেখতে ভালো লাগছে না। আয় একসাথে মুভিটা দেখি।’ একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেলেন আমাকে, বাপ বেটি মিলে রাত জেগে মুভিটা দেখলাম। মুভিটার নাম ছিল Baby’s Day Out। এমনই ছিলেন আমার বাবা।

দুটি সন্তানই মেয়ে হওয়ায় বাবা-মাকে অনেকেই ছেলেসন্তান নিতে বলতেন। দুজনেই মুখের উপর বলে দিতেন ‘আমার মেয়েরাই আমার ছেলে। শেষ বয়সে ওরাই আমাদের দেখবে।’ স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন অনেক আত্মীয় আমাদের দু-বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেও বাবার সামনে এই কথা তোলার কেউ সাহস পেত না। কারণ, বাবার সাফ কথা, মেয়েরা পড়ালেখা করবে, শিক্ষিত হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তারপর বিয়ে।

আমরা দুইবোন। আমার বড়োবোন তাসনুভা হাসান ছন্দা আর আমি তামান্না হাসান তনু। দুটি সন্তানই মেয়ে হওয়ায় বাবা-মাকে অনেকেই ছেলেসন্তান নিতে বলতেন। দুজনেই মুখের উপর বলে দিতেন ‘আমার মেয়েরাই আমার ছেলে। শেষ বয়সে ওরাই আমাদের দেখবে।’ স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন অনেক আত্মীয় আমাদের দু-বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেও বাবার সামনে এই কথা তোলার কেউ সাহস পেত না। কারণ, বাবার সাফ কথা, মেয়েরা পড়ালেখা করবে, শিক্ষিত হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তারপর বিয়ে। পাত্রের লাখ টাকা, বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি বাবাকে টলাতে পারেনি এই সিদ্ধান্ত থেকে। ২০০৩ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নাট্যকলা’ বিভাগে চান্স পাই তখনও বাবা ভীষণ খুশি ছিলেন। কেন আরও ভালো সাবজেক্ট পেলাম না এসব একবারও বলেননি। তাঁর সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এটুকুই তাঁকে ভীষণ গর্বিত করত।

আধুনিক, মুক্তমনা, উদারমনা, প্রাণীপ্রেমী, আড্ডাবাজ, তারুণ্যে ভরপুর ছিলেন আমার বাবা। বয়সের চেয়ে ছোটোদের সাথে মিশতেও দ্বিধা করতেন না। তরুণরাই এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে— এটিই ছিল তাঁর বিশ্বাস। তাই তরুণদের সাথে মিশে তরুণরা কি ভাবছে তা তিনি বোঝার চেষ্টা করতেন। তবে শুরুতেই বাবা এমন ছিলেন না। প্রথম দিকে বাবার মধ্যেও দ্বিধা দেখেছি। ছোটোদের সাথে মিশলে আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকে অনেক কথা বলত। বাবা প্রথমদিকে মানুষের কথায় কষ্ট পেতেন, পরের দিকে আর কেয়ার করতেন না। আমরাও বাবাকে কখনো বারণ করতাম না। কারণ আমরা বাবাকে চিনতাম, জানতাম, তাঁর ভাবনাগুলোকে বুঝতাম। তাঁর ভাবনার জগত সবসময়ই ছিল, কিন্তু তা সময়ের সাথে সাথে আরও পরিপক্ক হয়েছে এবং সেই সাথে বাবা দ্বিধাহীনভাবে নিজেকে ততদিনে প্রকাশ করতে শিখে গেছেন।

বাবা সবসময়ই গল্প করতে ভালোবাসতেন। সমাজ, সংস্কৃতি, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, রাজনীতি, ধর্ম সবকিছু নিয়ে আমাদের পারিবারিক আড্ডা হতো। রাত দুইটা তিনটা অবধি তিনি আম্মা, আপু, ছোটোমামা আর আমার সাথে সকল বিষয় নিয়ে আড্ডা দিতেন। আম্মা আপু একসময় ঘুমিয়ে গেলেও আমার সাথে চলত তাঁর আড্ডা। বাবা নিজেও একজন নাট্যকর্মী ছিলেন। যুবক বয়সে রাজনীতিও করেছেন। শুনেছি মায়ের সাথে বাবার পরিচয় নাটক করতে গিয়েই। কারণ মা (সামছুন ডে লায়লা, ডাকনাম বিউটি) নিজেও একজন নাট্যকর্মী ছিলেন, মঞ্চে অভিনয় করতেন। বাবা-মার সেই গল্পগুলো বাবার কাছে শুনতে চাইতাম, বাবাও আনন্দ নিয়ে বলতেন। বাবার কাছে থেকে অনেক শুনেছি যে তিনি রাতে একাকী নওগাঁ কেন্দ্রীয় গোরস্থানে গিয়ে বসে থাকতেন। গোরস্থানের শান্ত পরিবেশ তাঁর ভালো লাগত। মৃত্যু নিয়ে তাঁর একটা মুগ্ধতা কাজ করত। জীবন নিয়ে তিনি অনেক চিন্তা করতেন।


মাহমুদুল হাসান মাছুম ২

নদী ও পাহাড় প্রেমিক কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম | ছবি: লেখক


আমার সাথে বাবার বরাবরই একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমি যখন ছুটিতে ঢাকা থেকে বগুড়ায় যেতাম বাবা আমাকে সাথে নিয়ে রিকশায় ঘন্টাচুক্তিতে ঘুরে বেড়াতেন সারাটা শহর। সারা শহর ঘোরার সময় বাবা সংসারে এই সময়ের মধ্যে কী হলো, কী করতে চান, আমার মতামত কী, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, জীবনে কী করতে চাই এগুলোর সাথে সাথে সমাজ, সংস্কৃতি, নাটক, কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতেন। আমাদের দুজনের একান্ত আড্ডা ছিল সেটি। আড্ডা শেষ হতো বাপবেটি একসাথে কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে পছন্দের কিছু খাওয়ার মধ্য দিয়ে। পুরো শহর ঘোরার সময় আমার হাত ধরে থাকতেন, হাত ধরেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন, পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে গর্ব নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতেন, যেন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী এক হাতিঘোড়া মেরেছি। আমি লজ্জা পেলেও বাবার চোখেমুখে খুশির ছটা দেখতে পেতাম…

আমি তাঁর বন্ধু ছিলাম আর আপু ছিল তাঁর মা… আপুর বিয়ের পর বাবা একা হয়ে গিয়েছিলেন। আপুকে সবসময় ছন্দা-মা বলেই ডাকতেন। বাবার মাথা ব্যথা করছে, মাথায় তেল দিতে হবে, আপুকে ডাকবেন। তাঁর কাপড় পরিষ্কার করতে হবে, আপুর হাতে দেবেন। কিছু খেতে মন চাইবে, আপুকে বলবেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কোথায় রাখবেন, আপুকে বলবেন..। আপু ছিল তাঁর আপন জায়গা… ভরসার জায়গা আর আমি ছিলাম বন্ধু। আপুর বিয়ের পর আমি রুমে একা থাকতে পারতাম না। প্রায় রাতেই ঘুম ভাঙত দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে। ঘুম ভাঙার পর বাবার কাছে গিয়ে ঘুমিয়ে পরতাম। অনেক বড়ো হয়েও এমনকি ৩/৪ মাস আগেও দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে বাবার পাশে গিয়েই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবা পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন… আমার সেই নিশ্চিন্ত জায়গাটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে…

বাবার শৈশব কেটেছে মহাদেবপুর থানার হরিপুর গ্রামে। হরিপুর গ্রামের গল্প, রাত জেগে যাত্রাপালা দেখে রাতের অন্ধকারে গ্রামের রাস্তা দিয়ে একলা বাড়ি ফেরার গল্প, মাছ ধরার গল্প আমরা মজা করে বাবার কাছে থেকে শুনতাম। বাবা মাটির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করতেন। তাঁর মধ্যে কখনো কোনো কিছু নিয়ে অহংকার করতে দেখিনি। বাবা গল্পের ডালি খুলে বসতেন, আর আমরা গোগ্রাসে সব গিলতাম। যুবক বয়সে নওগাঁ চকদেব পাড়ায় থাকতে বন্ধুদের সাথে নিয়ে কীভাবে মজা করে মুরগি চুরি করে সবাই মিলে পিকনিক করতেন, কীভাবে বন্ধুরা মিলে কারো গাছের ডাব চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন সেই ঘটনাগুলো আমাদের শোনাতেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার বয়স ছিল ১০ বছর। সেই সময়টা তিনি নওগাঁ শহরে তাঁর নানার (করিম ডাক্তার, নওগাঁর যে কেউ করিম ডাক্তারের নাতি মাছুম বললেই বাবাকে চিনবে) বাসায় ছিলেন। নিজে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না করলেও গেরিলা মুক্তিবাহিনীকে গোপনে সবজিব্যাগের মধ্যে করে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে কীভাবে সহযোগিতা করতেন সেসব গল্প শোনাতেন। এমন অসংখ্য গল্পে আমাদের রাত থেকে ভোর হয়ে যেত। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না করলেও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে কখনোই তিনি কোনকিছু দাবি করেননি। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেইনি, যারা সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদের তিনি ঠিকই চিনতেন। তাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাব পেতে দেখে আফসোস করতেন। কিন্তু নিজে কখনোই নিজেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে জাহির করেননি, কোনো ফায়দা লোটার চেষ্টা করেননি।

বাবার বেশ কিছুটা সময় কেটেছে রাঙামাটিতে ঠিকাদারি ব্যবসায়। আমার জন্মের সময়টায়ও বাবা রাঙামাটিতেই ছিলেন। বাবার মুখেই আমরা প্রথম রাঙামাটির গল্প, পাহাড়িদের জীবনাচরণ সবকিছুর গল্প শুনেছি। আমি যখন রাঙামাটি, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন জায়গায় ট্রেকিং করে বেড়াই, পাহাড়ে যাই, পাহাড় থেকে ফিরেই সবকিছুর গল্প শুনতে চাইতেন। পাহাড়িদের তিনি সবসময়ই ভালোবাসতেন। তাদের প্রতি বাবার মায়া কাজ করত।

যারা বাবার সাথে মিশেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে বাবা ভীষণ একরোখা, ঘাড়ত্যারা, বদমেজাজি, শর্ট টেম্পারড একজন মানুষ ছিলেন। বাপের এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমার মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে। কিন্তু বাবাকে বুঝিয়ে বললে বাবা মেনে নিতেন। বাবা ভীষণ বাস্তববাদী এবং যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। সবাইকে কাছে টানার, আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা বাবার ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই বাবা মানুষের আস্থার জায়গায় পরিণত হতে পারতেন। আমার বন্ধুরাও বাবার বন্ধু ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বাবা আমার ক্যাম্পাসে আসতেন এবং আমার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতেন। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার বন্ধুদের অনেকের সাথেই বাবার আলাদা একটা যোগাযোগ ছিল। তাঁরা আলাদা আড্ডা দিত, তাঁদের আলাদা গল্প হতো।

বাবা কখনোই বৈষয়িক ছিলেন না। তিনি টাকা-পয়সা, সম্পত্তি, বাড়ি-গাড়ির পিছনে কখনো ছোটেননি। মাঝে মাঝে আমরা রাগ হয়েছি এসবের প্রতি তাঁর উদাসীনতা দেখে। তিনি শুধু কর্মে বিশ্বাস করতেন আর সময়কে বিশ্বাস করতেন। সময়ই সবকিছু বলে দেবে বলে বিশ্বাস করতেন।

বাবা অনেক ভীরের মাঝেও একা ছিলেন। বাবাকে আমি কিছুটা বুঝতে পারতাম। বাবার দুঃখ, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, অভিমান এগুলো বুঝতাম। সৃষ্টিশীল মানুষরা আবেগী হয়। বাবাও আবেগী ছিলেন, কিন্তু উনি আবেগকে চাপা দিয়ে রাখতেন। উপরে উপরে তিনি অনেক শক্ত মনের মানুষ ভাব ধরে থাকতেন, কিন্তু তাঁর ভেতরটা অনেক কোমল। বাবা কখনোই বৈষয়িক ছিলেন না। তিনি টাকা-পয়সা, সম্পত্তি, বাড়ি-গাড়ির পিছনে কখনো ছোটেননি। মাঝে মাঝে আমরা রাগ হয়েছি এসবের প্রতি তাঁর উদাসীনতা দেখে। তিনি শুধু কর্মে বিশ্বাস করতেন আর সময়কে বিশ্বাস করতেন। সময়ই সবকিছু বলে দেবে বলে বিশ্বাস করতেন।

আমার প্রতি বাবার কেন জানি না খুব আস্থা ছিল। আমি শক্ত মনের, সব সামাল দিতে পারি এসব উনি বিশ্বাস করতেন। কিন্তু আমার সকল শক্তি ছিলেন আসলে বাবা। উনি বটবৃক্ষের মতো আমাদের আগলে রেখেছিলেন। গত ঈদে বাবাকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম পছন্দমতো কিছু কিনে নেওয়ার জন্য…বাবা সেই টাকা থেকে আমার জন্য আর তাঁর একমাত্র নাতনি সিঁথির জন্য জামা কিনে আনেন… শেষ বয়সে তিনি যে তাঁর সন্তানদের কিছু দিতে পারতেন না এটা তাঁকে কষ্ট দিত…

বাবা, আমরা কিছু চাইনি, আমরা কিছুই চাই না তোমার কাছে। তুমি সুস্থভাবে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাক এটাই সবসময় চেয়েছি। কিন্তু তুমি আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে! আমাদের একলা করে চলে গেলে! তোমার সেই প্রিয় গোরস্থানে তুমি এখন বাবা-মায়ের সাথে শুয়ে আছ! আমাদের কি দেখছ তুমি? আমাদের কি শুনতে পাচ্ছ? তোমার স্ত্রী, যাঁকে তুমি সকলের অমতে ভালোবাসে বিয়ে করেছিলে— তাঁকে একা করে রেখে গেলে? তোমার প্রিয় বিড়ালগুলোর কী হবে বাবা? লাল্টু, কাজলি, উমারু, ধলি, টুকটুকি, এ্যাশ, ভুতু, টম, টাইগার, তিতলী, কঙ্কা ওরা সবাই তোমার পথ চেয়ে আছে। তুমি কি অভিমান করে বীরের কাছে চলে গেলে? বীর, আমাদের খরগোশ, যাকে তুমি আহত অবস্থায় উদ্ধার করে এনেছিলে। সেই বীরকে বাঁচানোর জন্য ওর বুকে তুমি পাঞ্চ করছিলে, মুখে ফুঁ দিয়ে অক্সিজেন দিচ্ছিলে, তবু বাঁচাতে পারোনি তাকে। তুমিও একইভাবে চলে গেলে?!

বাবা, সকলে দেখো তোমায় কত ভালোবাসে। আমরা ছাড়াও অসংখ্য মানুষ তোমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। সবাইকে তোমার ভালোবাসা এতোটাই বিলিয়েছ যে সকলের মনমন্দিরে তুমি গেঁথে গেছ। তোমার কবিতা নিয়ে আজ মানুষ কথা বলে। আমার সাধারণ বাবা আজ মানুষের কাছে অসাধারণ হয়ে উঠেছে। তুমি বেঁচে থাকাকালীন এই পৃথিবী, এই সমাজ, এই দেশ তোমাকে যে সম্মান দিতে পারেনি, দোয়া করি আল্লাহ পরকালে যেন তোমাকে সকলের মাঝে সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে আসীন করেন।

বাবা, আমি চেষ্টা করে যাব তোমার যোগ্য মেয়ে হওয়ার। আমার উপর যে দায়িত্ব তুমি অর্পণ করে গেছ তা পূরণ করার আমি চেষ্টা করে যাব বাবা। তুমি আমাকে বটবৃক্ষ হতে বলেছিলে। আমি তোমার মতোই বটবৃক্ষ হবো যার ছায়ায় সবাই শীতল হতে পারবে। আমায় আশীর্বাদ করো বাবা, তোমার দেওয়া দায়িত্ব আমি যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবির ছোটো কন্যা।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।