আমরা একটা কবর খুঁজছিলাম।
এক টুকরা কাগজে লেখা ছিল ঠিকানা। সেই ঠিকানা অনুসরণ করে যে গ্রামে আমরা পৌঁছলাম সেখানে কেউই কবরের খোঁজ দিতে পারল না। উপরন্তু সবাই আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল। কেউ কেউ উল্টো প্রশ্ন করে বসল, কেন আমরা একটা কবর খুঁজছি। আমরা তাই কিছুটা গোপনে এদিক-সেদিক খোঁজ চালিয়ে গেলাম।
আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন, তার নাম বাখতাশ আবতিন। তাকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলাম এবং আমার মনে পড়েছিল, কদিন আগে তিনি মারা গেছেন। পত্রিকায় তার একটা ছবি ছাপা হয়েছিল, গায়ে কয়েদির পোশাক এবং পায়ে বেড়ি পরানো, বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন। এখনো তার পরনে সেই একই পোশাক। আমি যখন প্রথম তাকে আমারই সঙ্গে হাঁটতে দেখলাম, তখন সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম যে, নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমরা গ্রামের বাইরে এসে দেখলাম, দূরে কিছু পাহাড় এবং কাছেই চাঁদের আলোয় একটা লোক মাটি খুঁড়ছে।
আমি লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করেন?’
‘কবর খুঁড়ি,’ লোকটা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমরা গ্রামের বাইরে এসে দেখলাম, দূরে কিছু পাহাড় এবং কাছেই চাঁদের আলোয় একটা লোক মাটি খুঁড়ছে।
আমি লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করেন?’
‘কবর খুঁড়ি,’ লোকটা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল।
‘কেউ কি মারা গেছে?’
লোকটা এবার বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকাল আর এভাবে তাকানোর অর্থ এটাই যে, কেন আমি কোনো মৃত্যুর খবর রাখি না! আমি দেখলাম, লোকটার খোঁড়া গর্ত থেকে কয়েকটা ইঁদুর বেরিয়ে এলো।
আমরা যার কবর খুঁজছি, গোরখোদককে তার কথা জিজ্ঞেস করলাম। শুনে সে ভ্রু কোঁচকাল, ‘উনি তো কারা-হেফাজতে মারা যান নাই।’
‘তাহলে?’
‘তাকে গুম করা হইছে। কবর কোথায় পাইবেন?’
গোরখোদক তখন স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকল, ‘দুর্ভাগ্য! তারা কখনো কবর পান না, তাদের জানাজা হয় না। কেউ তাদের কবর জিয়ারতও করতে পারে না। তবে আপনারা কথা বলে দেখতে পারেন।
বাখতাশ পারসিক ভাষায় কিছু একটা বললেন, কিন্তু আমরা তার কথার কিছুই বুঝতে পারলাম না। গোরখোদক তখন স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকল, ‘দুর্ভাগ্য! তারা কখনো কবর পান না, তাদের জানাজা হয় না। কেউ তাদের কবর জিয়ারতও করতে পারে না। তবে আপনারা কথা বলে দেখতে পারেন।’
‘মানে? কার সঙ্গে কথা বলে দেখব?’ আমি লোকটার মুখের দিকে তাকাই। তাকে চেনা চেনা লাগে। কিন্তু আগে তাকে কোথায় দেখেছি, মনে পড়ে না।
গোরখোদক অদূরে একটা বৌদ্ধ মঠ দেখিয়ে বলল, ‘ওইখানে যান।’
বৌদ্ধ মঠের কাছে আলো দেখা যাচ্ছিল। আমরা সেখানে গিয়ে একটা স্তূপের পাশে এক বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলাম।
বাখতাশ এবার স্পষ্ট বাংলায় বললেন, ‘ইনি একজন বোধিসত্ত্ব।’
আমি বোধিসত্ত্বকে বললাম, কেন আমরা এসেছি। তাকে আমরা গোরখোদকের কথাও বললাম।
বোধিসত্ত্ব নির্বিকার মুখে পাশের একটা স্তূপের দিকে দেখালেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘একটা কবর খুঁড়ে কী পাওয়া যাবে? অস্থি-পঞ্জর?’
‘কিন্তু আমরা কবরটা দেখতে চাই,’ আমরা বলি।
তিনি স্বগতোক্তির মতো করে বলেন:
আমিও ওই স্তূপের দিকে দেখি।
সাদা জোছনা দেখি,
আলোর ভেতর দেখি সাদা কাঠগোলাপ।
বাতাস বয়ে যায়।
অথচ কারো পায়ের শব্দ নেই।
যিনি নেই
নীরবতার ভেতর তিনি বাক্য হয়ে ওঠেন।
তারা যে পথে যায়,
সে পথেই ফিরে আসে।
যদিও পদচিহ্ন নেই,
কিন্তু যে পথে তোমরা তাদের খোঁজ করো,
তারাই সে পথ।
সেখানে কাঠগোলাপ ঝরে পড়ে
নিঃশব্দের ভেতর।
কাঠগোলাপ বাক্য হয়ে ওঠে
অস্থি-পঞ্জর বাক্য হয়ে ওঠে
সাদা জোছনা বাক্য হয়ে ওঠে।
জন্ম ৮ মার্চ ১৯৭১, সিরাজগঞ্জ। রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ এবং সম্পদনা—সব মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরোর অধিক। ‘আগুন ও ছায়া’ উপন্যাসের জন্য ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২০’ এবং ‘বাংলার দর্শন: প্রাক-উপনিবেশ পর্ব’ বইয়ের জন্য ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২৫’ পুরস্কার পেয়েছেন।