আব্বাস কিয়ারোস্তামি সত্তরের দশকে ইরানের চলচ্চিত্রজগতে শুরু হওয়া নবতরঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানে দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী নির্মাতা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। এছাড়া চলচ্চিত্রের ভাষা নির্মাণে বিশ্বজুড়ে তাঁর প্রভাব লক্ষণীয়, বিশেষ করে তরুণ বা উঠতি চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে। ২২ জুন তিনি তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে ৪ জুলাই প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৭৬ বছর বয়সে। কিয়ারোস্তামি তাঁর প্রথম ছবি ‘দ্য রিপোর্ট’ নির্মাণ করেন ১৯৭৭ সালে। ইরানি বিপ্লবের পর সে দেশের অনেক চলচ্চিত্রকারের মতো দেশ ছেড়ে না গিয়ে তিনি একের পর এক নির্মাণ করেন ৪০টিরও বেশি সিনেমা। ১৯৯৭ সালে তাঁর ‘টেস্ট অব চেরি’ সিনেমাটি কান ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পাম ডি’ওর জিতে নেয়। ফরাসি সাংবাদিক বেনোয়া পায়োঁ’র নেওয়া এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয় কান ফেস্টিভ্যালের ওয়েবসাইট, ২০১৪ সালের মে মাসে। শ্রী-র পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন রাফসান গালিব।
প্রশ্ন : তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কেমন ছিলেন আপনি সে সময়টায়?
কিয়ারোস্তামি : আজকের দিনে এসে আমি একটা কথা বলতে চাই যে, সে সময় অন্যান্য তরুণ ফিল্ম ডিরেক্টরদের মতোই আমি একজন সাধারণ তরুণ ফিল্ম ডিরেক্টর ছিলাম। আমার ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা ছিল না। আমি এটাকে জীবিকার পথ হিসেবে ভাবিনি। আমি চারুকলায় পড়েছিলাম, কিন্তু একজন চারুশিল্পী হইনি শেষ পর্যন্ত। তবে একসময় আমার মনে হলো সিনেমাই সেই মাধ্যম, যেটায় আমি নিজেকে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারব।
প্রশ্ন : ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
কিয়ারোস্তামি : খুব কঠিন ছিল। ভাগ্য ভালো, এটা বড়ো ধরনের সাফল্য এনে দিল এবং বেশ স্বীকৃতি পেল। আমি এটা বোঝাতে চাইছি না যে, তখনই আমি চলচ্চিত্রকার হয়ে গেলাম। আমি যদি বিশ্বাস করতাম এখানেই শেষ, তাহলে আমি আর সিনেমা বানাতে পারতাম না। আমি আরও ফিল্ম বানালাম এবং আরও। যখন আমার প্রথম ফিচারফিল্মটি বানালাম, তখন নিজেকে বললাম, চলচ্চিত্রকার হিসেবেই নিজেকে ভাবা উচিত, এটাই আমার কাজ। প্রথম ফিল্ম থেকেই আমি দুই ধরনের দর্শক লক্ষ করতে থাকলাম, দর্শকদের একটা গোষ্ঠী আমার ফিল্ম ভালোবাসত আর তাদের বড়ো অংশটা আমার কাজ ভালোবাসত না। এটাএখন পর্যন্ত সত্য।
প্রশ্ন : প্রথম সিনেমায় সাফল্য পেতে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা চাই?
কিয়ারোস্তামি : আমার প্রথম ফিল্ম সাফল্য পায়, একটি উৎসবে স্বীকৃতি পায় এবং সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়। তবে আজ অতীত পর্যালোচনা করে বলি, আমি মনে করি না একটা ফিল্ম পুরস্কার জিতলেই সেটা ভালো ফিল্ম। একইভাবে মনে করি না একটি ভালো ফিল্ম বিশাল দর্শকগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করবে অথবা সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা পাবে। এসব মাপকাঠি সাফল্য ধরে রাখার বিষয় বটে, তবে ভালো ফিল্ম শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের বিবেচনায় আমাদের কাছে বিশেষ মূল্য পাবে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ত্রিশ বছর পর আমরা বিচার করতে পারি—একটা ফিল্ম টিকে থাকবে কি না, এমনকি জানতে পারি, সেটা এখনো টিকে আছে কি না, নাকি হারিয়ে গেছে।
প্রশ্ন : একজন চলচ্চিত্রকারের ক্যারিয়ারে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কী রকম গুরুত্বপূর্ণ?
কিয়ারোস্তামি : খুব গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এগুলো ডিরেক্টরকে সাহসী হতে ও হাত পাকাতে সুযোগ করে দেয়। ডিরেক্টরের চরিত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে তার বানানো সব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ফিচারফিল্মে প্রযোজক খোঁজা এবং অর্থের যে অপরিহার্যতা সেই অনিশ্চিয়তা থাকে। থাকে দর্শকের রুচির বিষয়ও। কোনো ডিরেক্টরই এসব এড়িয়ে যেতে পারে না। সে দিক দিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা একেবারেই ব্যক্তিগত। এগিয়ে যেতে, নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্যের জায়গাটা আগে নেওয়া উচিত এবং সেটাই হবে ডিরেক্টরের প্রথম ফিল্ম।
প্রশ্ন : ইরানি চলচ্চিত্রের কথা বলুন। আপনি কি মনে করেন এটা এখন শক্তিশালী অবস্থানে আছে?
কিয়ারোস্তামি : ইরানি চলচ্চিত্রে দুই ধরনের ব্যাপার আছে। একদিকে আছে রাষ্ট্রীয় সিনেমা; যেগুলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আর্থিক সহযোগিতায় হচ্ছে। ইরানে এরকম অনেক চলচ্চিত্রকার আছেন যারা রাষ্ট্রকে খুশি করতে বা রাষ্ট্রের জন্যই কাজ করেন। আমি তাদের নিকট থেকে বেশি কিছু আশা করি না কারণ তাঁরা শুধু ইরানেই নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছেন। তাঁদের ফিল্ম অতিমাত্রায় আঞ্চলিক ও নির্দিষ্ট ভোক্তা শ্রেণীর জন্য। অন্যদিকে এক ধরনের স্বাধীন চলচ্চিত্রও হচ্ছে, যেটা আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। অপরিচিত অনেক চলচ্চিত্রকার উঠে আসছে একদম সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চল থেকে। তারা বেশ উন্নতমানের ফিল্ম দিচ্ছে আমাদের। আমার আশার বাস্তব রূপ দেখতে পারছি এসব মানুষের মধ্যে।
প্রশ্ন : ইরানি নিউ ওয়েবের পরবর্তী অবস্থা কী, যার সাথে আপনি জড়িত ছিলেন?
কিয়ারোস্তামি : এই প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। তাদের মধ্যে কেউ বলতে পারবে কেন তাঁরা এইটা অব্যাহত রাখছে। নিউ ওয়েব কখনোই ভাঙার নয়। এইসব চলচ্চিত্রকার— যারা নিজ থেকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উঠে আসছে তাদের উদ্দেশ্য করে বলব তাঁরা যেন নতুন কিছু করতে থাকে অবিরত।
প্রশ্ন : এখনো কী আশা করেন সিনেমা থেকে?
কিয়ারোস্তামি : আমি কোনো কিছু আশা করি না। আশা ধারণ করে তরুণ প্রজন্ম। আশা বাদ দিয়ে আমি কাজ করে যাচ্ছি। তারপরও আজকে যা সিনেমা থেকে আশা করছি— তা হয়তো এমন কিছু যে, যখন আমি রাতে ঘুমিয়ে পড়ছি তখনও আমি একটা নতুন ইমেজ কল্পনা করে যাচ্ছি। ঠিক একজন জেলের মতো যে জাল ছোঁড়ার পর থেকেই সর্বদা আশায় থাকে মাছ ধরার।
লেখালিখি করেন। একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত আছেন৷