পর্ব-১
এক. এইসব জাদুকর! তারা বাঁ হাত দোলালে হয়ে যায় হ্রদ। ডান হাত দোলালে জাগে সাদা মরাল!
আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য পড়ে উঠতে উঠতে রুশি সেই রূপকথাটিকে মনে পড়ে যায়। খুব মনে পড়ে যেতে থাকে ওই অপরূপ কথা-পরস্তাবটিকে, যার নাম ‘ব্যাঙ রাজকুমারী’।
কেন মনে পড়ে?
আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য-পৃথিবীতে প্রবেশ করার আগে, তাঁর গড়া দুনিয়ার জল ও হাওয়া ও তরু-গুল্ম-জনপদ ও মনুষ্যজীবনের বিবিধ ওঠাপড়ার সাথে বিশদ পরিচয় সম্পন্ন করে নেবার আগে; আমরা ওই রূপকথাটিকে একটু মনে করে নিই যদি, তাহলেই ওই ‘কেন মনে পড়ে’র ধন্দটা মীমাংসিত হয়ে যাবে।
ব্যাঙ রাজকুমারী আদতে এক মনুষ্যকন্যা, রূপময়ী এক রাজনন্দিনী সে। অনেক অনেক দূরের দেশে, একদা এক রাজা রাজত্ব করে চলছিলো। রাজা যতোটা সুশাসক তারও চেয়ে বেশি সে জাদুবিদ্যা পারঙ্গম। দশভুবনের সকলে তাকে ওস্তাদ জাদুওয়ালা বলে ধন্য-ধন্য করে। কিন্তু লোকমুখে অমন জয়ধ্বনি উঠলে কী, রাজার অন্তরে কোনো শান্তি নেই। সেখানে কেবল ধিকির-পিকির ধিকির-পিকির করে করে জ্বলে যেতে থাকে ঈর্ষার আগুন। কে রাজাকে অহর্নিশি অমন দগ্ধে চলে? কোন সে শত্রু? সেই দুশমন অন্য কেউ নয়, সে হচ্ছে রাজার কনিষ্ঠকন্যা ভাসিলিসা। রাজার অন্তরের সকল অশান্তির মূলেই আছে এই কন্যা। সে কিনা বেড়ে উঠতে উঠতে ক্রমে জাদুকর্মে নিজেকে করে তুলেছে তুলনাহীন দক্ষ আর অকল্পনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন। রাজাধিরাজ পিতার চেয়েও সে হয়ে উঠেছে অনেক অনেক শক্তিমান এক জাদুওয়ালা। কন্যার জাদু-সৃজন-যোগ্যতার সাথে পাল্লা দেয়, অমন সামর্থ্যই আর নেই তার বাবার।
কন্যা ভাসিলিসা এই যে এমন গুণী, এই যে এমন চৌকস; তা নিয়ে কিন্তু রাজার অন্তরে কিছুমাত্র গৌরব জাগে না। উলটো কেবল ক্রোধ জাগতে থাকে। বাপের অন্তর কেবলই হিংসায় দাউপাউ করতে থাকে। মেয়ে কিনা তার বাপের চাইতে বেশি শক্তিমান হয়ে উঠবে! এটা সহ্য করা যায়? এটাও বরদাস্ত করতে হবে রাজাকে? কোনোদিন না। কখনোই নয়। ক্রোধে বলকে উঠতে উঠতে শেষে একদিন রাজা করে কী, কন্যাকে কঠিন একটা অভিশাপ দেয়। সেই অভিশাপের চোটে ভাসিলিসা হয়ে যায় ভ্যাটকা কুরূপ একটা ব্যাঙ।
ব্যাঙের জন্য তো আর তখন রাজপ্রাসাদের শুকনো মেঝেতে চরে বেড়ানো খুব একটা স্বস্তিকর ব্যাপার থাকে না। দুঃখ-থ্যাঁতলানো মন নিয়ে কন্যাটি তখন চলে যায় রাজ্যের জলার দিকে। তারপর সেইখানেই বসত করতে থাকে সে।
তবে জলায় যাওয়ার আগে সে জেনে যায়, তার বাবা যেমন অকারণে তাকে অমন ভয়ঙ্কর সাজা দিয়েছে তেমনি ওই দুর্গতি-দুরবস্থা থেকে নিদান পাওয়ার একটা বরও দিয়ে রেখেছে।
কী সেই বর?
বর হলো এই যে, যদি কোনো রাজপুত্র, জলাবাসী ওই কদাকার ব্যাঙটিকে খুশিমনে বিবাহ করে নেয়; তবেই তিন বছর বাদে রাজকন্যা আবার ফিরে পাবে তার মনুষ্যদেহ। তবে অভিশাপ নিয়ে তাকে ব্যাঙ হয়ে তিন-তিনটি বছর অবশ্যই পার করতে হবে, তার আগে কিছুতেই ভাসিলিসার শাপ মুক্তি ঘটবে না। ব্যাঙ-ভাসিলিসা তারপর এই দেশ থেকে সেই দেশ, এই জলাভূমির পর ওই জলাভূমি পেরোতে থাকে। দিনের পর দিন যেতে থাকে, কিন্তু কোথাও সে তার ত্রাতার দেখা পায় না।
যেতে যেতে যেতে শেষে একদিন ভাসিলিসা অনেক দূরের এক রাজ্যে পৌঁছে। সেই রাজ্যের ছোটো যে রাজপুত্রটি, সে ভারি দরদঅলা; কিন্তু সে একান্তই আলাভোলা আর উদাসী-ধাঁচের লোক। পরিস্থিতির চাপে পড়ে ওই ছোটো রাজপুত্র জলায় থাকা কদাকার ব্যাঙটিকে, বিয়ে করে নিজের প্রাসাদে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু ব্যাঙ-বউটাকে নিয়ে তার বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। সকলের উপহাস-টিটকারি তো নিত্যনিরন্তর সয়ে যেতে হয়ই, তার ওপর তার জন্য থাকে অন্য আরেক জাতের যন্ত্রণা সহ্য করার ব্যাপার।
তার যে বাবা, সে রাজা ঠিকই কিন্তু কাজে-অকাজে কেবলই হুলস্থুল বাঁধাতে বড়োই ওস্তাদ সেইজন। তিন রাজপুত্রের নয়া বউদের গুণপনা যাচাইয়ের জন্য রোজ-রোজই রাজার মাথায় নানা ভাবনা-কল্পনা-দুর্বুদ্ধি জাগনা দিয়ে উঠতে থাকে।
রাজা তাই একেকদিন তার তিন-তিনটি পুত্রবধূকেই একেক রকমের জিনিস বানানোর জন্য ফরমাশ দিতে থাকে। ওইসব হুকুম পেয়ে জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম রাজপুত্র কোনো সমস্যা বোধ করে না। কারণ তাদের বউয়েরা হলো মনুষ্যকন্যা। তারা সহজেই শ্বশুরের ফরমাশমাফিক জিনিসপত্র বানিয়ে দিতে পারবে। এবং পারেও।
কিন্তু রাজা যখনই কোনো কিছু বানাবার জন্য ছেলে-বউদের কাছে হুকুম পাঠাতে থাকে তখনই ছোটো রাজপুত্রের মন কুণ্ঠা ও অশান্তিতে ধড়ফড়াতে থাকে। তার সাথে তো কোনো মনুষ্যবালিকার বিবাহ হয়নি, তার বউ নিতান্তই একটা ব্যাঙ। থপথপ করে চলতে থাকা একটা ব্যাঙ মাত্র সে। সে কী করে শ্বশুরের জন্য জাঁকালো কুর্তা সেলাই করবে, কিংবা কীভাবেই-বা রাজার পাতে দেওয়ার মতো সুখাদ্য বানিয়ে দেবে এই ব্যাঙ! কীভাবে সেটা সম্ভব! প্রাসাদের সকলে ছোটো রাজপুত্র আর তার ব্যাঙ বউকে নিয়ে আগের চেয়ে আরো বেশিরকমে হাসাহাসি শুরু করে। আর, ছোটো রাজপুত্রের শরীর-মন হয়ে উঠতে থাকে যাতনা-তড়পানো।
কিন্তু রাজফরমাশ পেয়ে রাজপুত্র যতোই কিনা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠুক, তার ব্যাঙবউকে যেন কোনো হুকুমই কিছুমাত্র কাবু করতে পারে না। কোনোকিছু যেন তার কাছে কঠিন বলে মনেই হয় না। সে ওইসব কাজের হুকুম শোনে; আর রাজপুত্রকে নানামতে স্তোক দিতে থাকে। বলতে থাকে, ‘ভাবনা করো না রাজপুত্র। শুতে যাও, রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে।’
উৎকণ্ঠ রাজপুত্র তখন আর কী করে! সে নিরুপায় বোধ করতে করতে ঘুমে ঢলে পড়ে। তারপর ক্রমে মধ্যরাত আসে। অমন গহন নিরালা রাতেই শুধুমাত্র রাজকন্যা ভাসিলিসা অল্প কিছুক্ষণের জন্য তার ব্যাঙখোলসটি খসিয়ে ফেলার সুযোগ পায়। তখন সেই নিশুতি মধ্যরাতে ভাসিলিসা তার ব্যাঙখোলস খসিয়ে প্রাসাদের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আর সুরে সুরে নিজ খাস ভৃত্যদের ডাক দিতে থাকে। ভৃত্যরা তাদের প্রিয় রাজকন্যার হুকুমমাফিক একেকদিন একেক জিনিস বানিয়ে দেয়। সেসব জিনিসের কতো যে শোভা! কতো যে মনোলোভা হয়ে ওঠে সেগুলো। এমনসব জিনিস যে জগতে খুব সুলভ নয় সেটা রাজা ঠিক বুঝে উঠতে পারে। আর ব্যাঙ-বৌয়ের তারিফে উছলে উঠতে থাকে তার শ্বশুরমশাই।
তারপর একদিন রাজা তিন পুত্রবধূকে রাজসভার ভোজে আসার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠায়। ছোটো রাজপুত্র নিজ বিপন্ন মনখানাকে নিয়ে একাই হাজির হয় সেই ভোজসভায়। এবং নানাজনের হাজারো টিপ্পনী-উপহাসের খোঁচায় ক্লান্ত হতে থাকে।
মধ্যরাতে, ভোজসভার সকলে যখন হুল্লোড়ে অতি মাতোয়ারা, তেমন ঘন রাত্রির কালে প্রাসাদের মূল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ায় একটা রথ। সাত-সাতটা সাদা, তাগড়া-তাজা ঘোড়ায়-টানা সেই রথ থেকে নেমে আসে এমন এক কন্যা, রূপে যে ভরাচাঁদের জ্যোৎস্নার মতো, নাকি ভোররাতের শুকতারার মতো ঝকমকে সেই রূপকুমারী! লোকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকে দেখতে থাকে। দেখে দেখে আশ মিটতেই চায় না কারো। সেই রূপকুমারী শুধু রূপবতীই নয়, তার স্বভাবও কতো যে মনোহর! যেন তৃষ্ণাকালের শান্তিদায়িনী জল, যেন তাপদাহের কালের নম্র-শীতল বৃষ্টি—এমন মধুরা সে। তার স্বভাবের সৌন্দর্যে উপস্থিত সকলের অন্তর জুড়িয়ে যেতে থাকে। সেই সে কন্যাই হলো ছোটো রাজপুত্রের ব্যাঙ-বউ।
ব্যাঙবউ জাদুকরী ভাসিলিসা শুধু তার বাহ্য ও আন্তর সৌন্দর্য দিয়েই রাজসভার সকলকে মুগ্ধ করে না। সে সকলের জন্য আরো আনন্দ আরো মুগ্ধতা আরো আলো আনতে থাকে। সে তার ডান হাত দোলায়; রাজসভার একপাশে জেগে ওঠে দারুণ এক সরোবর—তাতে পদ্মঝাড়। পূর্ণপ্রস্ফুটিত পদ্ম সেখানে। সেই পদ্মরা তাদের সুগন্ধ ও শোভা নিয়ে সকলের সামনে কলখলাতে থাকে।
রাজকন্যা তারপর তার বাম হাতটিকে একটুখানি দুলিয়ে নেয়। পদ্মভরা সরোবরে, অতি সন্তর্পণে ভেসে আসতে থাকে শুভ্র, দৃপ্ত সব রাজহংস। তারা ধীরদেহে ভেসে চলতে থাকে। ভেসে চলে। আগত অতিথিজন বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে যায়। শুধু তাদের চোখ দেখে চলতে থাকে সেই সে সরোবরকে, সেইসব সচল শুভ্রতাকে! দেখে চলতে থাকে সেই অবিশ্বাস্য অতুল্য সুন্দরকে।
আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্যের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জাদুকরী এই ভাসিলিসাকেই কেবল মনে পড়ে যেতে থাকে। যেন অবিকল ভাসিলিসার মতোই এই একজন, এই আহমাদ মোস্তফা কামাল। এক জাদুকর। নবকালের অন্য এক জাদুকর।
ভাসিলিসার মতোই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একা। ভাসিলিসা দাঁড়িয়ে ছিলো মধ্যরাতের রাজসভার মধ্যিখানে; আমাদের এই নব জাদুকর দণ্ডায়মান আরো বড়ো তল্লাটে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কথাসাহিত্যের ভূভাগে; তাঁকে বইতে হচ্ছে ব্যক্তির চির নিঃসঙ্গ থাকার নিয়তির বেদনা, বইতে হচ্ছে তাঁর ভূখণ্ডের অবিরাম পীড়নগ্রস্ত হয়ে ওঠার যাতনা। তাঁকে বয়ে চলতে হচ্ছে তাঁর নিজের এবং তাঁর জনপদবাসীর অমোচনীয় দুর্দশার দুর্বহ ভার। তাঁর সমক্ষে এবং অক্ষির আড়ালে, তাঁর সমকাল ও অনাগতকালের পাঠকসমাজ। তিনি অল্পে অল্পে দুলিয়ে নিচ্ছেন তাঁর হাত; ধীর শ্লথ হাত, আমাদের জন্য। প্রথমে যেন-বা ডান হাত দুলে উঠলো তাঁর, তারপরে বাম বাহু। আর ক্রমে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকলো দুই ভিন্ন দুনিয়ার দুই ভিন্নরকমের বাস্তবতা।
দূরবাসী, মধুময়ী, জাদুকরী ভাসিলিসা তো তার অভ্যাগতদের জন্য গড়ে তোলে নয়ন-চিত্ত-আকুলকর সুন্দরকে। আহমাদ মোস্তফা কামাল, আমাদের কালের এই নব জাদুকর, যিনি নিবিড় মৌন আর একা; তিনি তাঁর পাঠকজনের জন্য কী গড়েন? কথা দিয়ে দিয়ে তিনিও কি অমন সুন্দরকেই গড়েন? কেবলই মন ও দৃষ্টি মুগ্ধকর আলোর হাউই-নকশাই গড়েন কি তিনিও?
নাহ! ভাসিলিসার সেই সুন্দরতা আর মধুরতা তো শুধু রূপকথাতেই সম্ভব। আমাদের এই নব জাদুকর দাঁড়িয়ে ছিলেন বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, তারপর হেঁটে চলেছেন একবিংশ শতকের পথ ধরে ধরে। তাঁর স্বভূমবাসীর মতোই তো তিনিও আছেন রাজনীতি ও রাষ্ট্রসংঘের বহুবিধ বিধান-শৃঙ্খলিত বাস্তবতার রূঢ়তায়। এইখানে জীবন শুধু বিপন্নতা-পীড়িত, কেবলই ত্রাসদংশিত, নিরুদ্ধার দারিদ্র্যগ্রস্ত। এইখানে সব সুন্দর কেবলই ধ্বংসগ্রস্ত হয়। হতে থাকে। ব্যক্তি এইখানে সমষ্টির ভেতরে অবস্থান করেও পরিবারের অন্য সকলের সঙ্গে বাস করেও কেবলই একা হয়ে যেতে থাকে। একা হয়ে যায়। এই সমস্তকিছুর গল্প বলেন তিনি। কুরাজনীতি ও সন্ত্রাসের ছুরি যেভাবে ফালাফালা করে দিচ্ছে তাঁর সমকালের সমষ্টির জীবন ও আশার পৃথিবীকে; তাঁর বয়ান রচনা করে চলেন তিনি। আর রচনা করেন ব্যক্তিজীবনে বন্ধুতার মহিমাকে। এই মনুষ্যজীবনে থাকা নানা সম্পর্কের স্বরূপ ও গাঢ়তার পরিচয় নির্ণয় করাটাও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলেই গণ্য হয়। আমাদের এইটুকু আয়ুষ্কালকে জড়িয়ে থাকে বহুরকমের সম্পর্র্ক। সেই সম্পর্কগুলোর কাছ থেকে পাওয়া গাঢ় তিক্ততা ও তীব্র মধুরতার গল্পও শোনান তিনি।
আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্যের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জাদুকরী এই ভাসিলিসাকেই কেবল মনে পড়ে যেতে থাকে। যেন অবিকল ভাসিলিসার মতোই এই একজন, এই আহমাদ মোস্তফা কামাল। এক জাদুকর। নবকালের অন্য এক জাদুকর।
আমরা দেখতে পেতে থাকি, ওই তো ওই নবকালের জাদুকর ধীরে তুলে ধরছেন তার ডান বাহু! আর এই তো, আমাদের জন্য ফলে উঠছে তাঁর উপন্যাসগুলো। সেখানে আছে এমন নায়কের আখ্যান, বন্ধুতা যার কাছে নিজ অস্তিত্বের সমান মূল্যবান। বন্ধুতার সূর্য থেকে তাপ পায় বলেই এই নায়কের প্রাণ মাথা উঁচোতে পারে আকাশের দিকে। বন্ধুতার জল তার আত্মার তৃষ্ণাই শুধু ঘোচায় না, তাকে বেঁচে থাকার সবটুকু বায়ুপ্রবাহও সরবরাহ করে চলে।
আহমাদ মোস্তফা কামালের যে তিনটি উপন্যাস আমরা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছি : ক. ‘আগন্তুক’ (২০০২), খ. ‘অন্ধ জাদুকর’ (২০০৯), গ. ‘জলের অক্ষরে লেখা’ (২০২৪) —এইখানে, এইসব কারুকর্মে, তিনি ডান হাত দুলিয়ে দিয়ে যেমন ওই এক বিমর্ষ নায়কের গল্পকথা আমাদের সামনে এনে দিয়েছেন, তেমনি একই সাথে তিনি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলেছেন মনুষ্যসম্পর্কের বিবিধ আঁকবাঁক, গলিঘুঁজি, নৈকট্য-অনৈকট্য, সুখ-অসুখ, বেদনা-নিঃসঙ্গতা; পরস্পরের কাছে যাওয়ার আকুলতা, অথচ একে অন্যের চির অ-নিকট হয়ে থাকার নিয়তিকে। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন বন্ধুতার মধুর বিষ ও তিক্ত অমৃতের কথা। যে-বন্ধুতার ওম আমাদের আত্মা অহর্নিশি পেয়ে থাকে, আমাদের কিশোবেলায়; পেয়ে থাকে আমাদের প্রথম তারুণ্যের কালে। যেই ওম আমাদের বক্ষস্পন্দনের সাথে মিশে না-থাকলে আমাদের কেবলই বেড়ে উঠতে হতো বিকলমতি অসম্পূর্ণ দ্বিপদ হয়ে; সেই বন্ধুতার অমল রৌদ্রের গন্ধ ও বর্ণ ও ঝাঁজের গল্প বলে চলেছেন তাঁর আখ্যানে আখ্যানে।
আমরা আবার নতুন করে বোধ করে উঠতে থাকি, এই যে জীবন আমাদের, একে যে আমরা শেষপর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটি সম্ভব হয় নানা সম্পর্কের কাছ থেকে আমরা জ্বালানি পাই বলেই। আমাদের সম্পর্কগুলো অমূল্য অশেষ জ্বালানি হয়ে আমাদের চালিত করতে থাকে, গতিসুধা দিয়ে ভরিয়ে রাখতে থাকে। এই সম্পর্কগুলোই আদতে সত্যকার পঞ্চভূত, আমাদের ব্যক্তিঅস্তিত্বের জন্য। এই সম্পর্কগুলোই আমাদের প্রাণসত্তার জন্য হয়ে দাঁড়ায় মাটি জল বায়ু অগ্নি ও আকাশ। এই সত্য বা এই বোধ-উপলব্ধিকে তিনি, আহমাদ মোস্তফা কামাল, তাঁর উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আমাদের ভেতরে জাগিয়ে তুলতে থাকেন।
আহমাদ মোস্তফা কামালের সম্পর্কবিষয়ক বয়ানগুলো আমাদের অন্তরাত্মার অসাড়-দশাটাকে খুব নাড়া দিতে থাকে। আমরা সাড়া বোধ করতে থাকি। আমরা নিঃস্ব হয়ে ওঠার ব্যথাটাকে পেতে থাকি। খুব পেতে থাকি। ব্যথা পেতে পেতে আমাদের মনে পড়ে যেতে থাকে, আমরা পরিণত বয়সে আছি বটে এখন, কিন্তু আছি অথর্ব তবদা-খাওয়া এক অসাড় জীবনে।
ধীরে আমাদের মনে পড়তে থাকে, আমাদের বয়স্ক হয়ে উঠতে থাকা জীবন থেকে কীভাবে যেন ক্রমে লুপ্ত হয়ে গেছে মায়াবী, বন্ধুতা-ফলের সকল সুঘ্রাণ। আমাদের মনে পড়ে যেতে থাকে, আমাদের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলোর কথা। হারিয়ে-ফেলা সম্পর্কগুলোর পক্ব রৌদ্রাভাকে মনে পড়ে যেতে থাকে। দিনগত আয়ু ক্ষয় করে যেতে যেতে আত্মার জন্য অপরিহার্য সেই বায়ু ও জল-সরসতা ও আশ্রয়কে আমরা কখন যে হারিয়ে ফেলি, সেটাও আমরা একসময় আর বুঝে উঠতে পারি না। শুধু যাপন করতে থাকি সচল এক প্রাণহীনের জীবন।
আহমাদ মোস্তফা কামালের সম্পর্কবিষয়ক বয়ানগুলো আমাদের অন্তরাত্মার অসাড়-দশাটাকে খুব নাড়া দিতে থাকে। আমরা সাড়া বোধ করতে থাকি। আমরা নিঃস্ব হয়ে ওঠার ব্যথাটাকে পেতে থাকি। খুব পেতে থাকি। ব্যথা পেতে পেতে আমাদের মনে পড়ে যেতে থাকে, আমরা পরিণত বয়সে আছি বটে এখন, কিন্তু আছি অথর্ব তবদা-খাওয়া এক অসাড় জীবনে। এমন জীবন কি চেয়েছিলাম আমরা? ভোর-রৌদ্রময় কিশোরবেলায় এমন পরিণত-ক্ষয়গ্রস্ততাকেই কি চেয়েছিলাম নাকি? আমরা দীর্ঘশ্বাসে ফেঁড়ে যেতে থাকি। তখন তেতো গ্লানি ও নিঃস্বতার ভোঁতা এক ছুরি আমাদের থেঁতলে চলতে থাকে। আহমাদ মোস্তফা কামালের উপন্যাসেরা আমাদের সামনে এইসব গূঢ় বেদনা-জিজ্ঞাসাকে জাগুন্তি দিতে থাকে। আমাদের স্বস্তিকে হরণ করে নিতে থাকে।
এটা তো গেলো এই জাদুকরের ডান বাহু দুলিয়ে তোলার ফল।
তিনি যখন তাঁর বাম হাত নাড়েন, তখন কী ঘটে?
তিনি যখন তুলে আনতে থাকেন তাঁর বাম বাহুটিকে, তখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এক রাষ্ট্র-সন্ত্রাস ছিন্নভিন্ন দেশের সমস্তটা সমাজের ক্লেদ-ক্লিন্ন-বিপন্ন-ধুঁকন্ত-ঘা-থকথকে বাস্তব প্রতিবেশটি। এইখানে তখন শুধু ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের আলো-মেঘই আর প্রধান রূপে দৃশ্যমান হয় না। তখন স্পষ্ট হয়ে আসে এক বিশেষ সময়ের এক ভূভাগের রূপ। তখন উঠে আসতে থাকে সেই ভূখণ্ডে বসতকারী সাদামাটা, সাধারণ লোকসকলের জীবনের আদত অবস্থাটার পরিচয়। উদ্ঘাটিত হতে থাকে সামান্য মনুষ্যজনের বেদনা-পতন-নিরুপায়তা আর পরাজয়ক্লিষ্টতার রূপ। আহমাদ মোস্তফা কামালের সমকাল, রাষ্ট্র-রাজনীতি-হিংস্রতা-শৃঙ্খলিত সমকাল; এইবার এসে দাঁড়ায় আমাদের অক্ষির সামনে। সমাজসত্য, মনুষ্যজীবনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবকিতাব, আশা ও দুরাশা, সুখী হবার স্বপ্ন দেখার শক্তি ও সেই শক্তির বিপুল বিনষ্টি, এই সবকিছু—সমস্ত কিছুই, বিদ্যুৎঝিলিক দিয়ে দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকে আমাদের দৃষ্টির দিগন্তে দিগন্তে। তাঁর ক. ‘ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য’ (২০০৭), খ. ‘অশ্রু ও রক্তপাতের গল্প’ (২০১১), গ. ‘বড়োদের গল্প যেমন হয়’ (২০২০) গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো এই বাস্তবতাকেই অতি তন্নতন্নরকমে উপস্থাপন করে চলে।
আমরা বলতে পারি, নিঃসঙ্গ নায়কের একাকী এক জীবন-অভিযান আর মনুষ্যসম্পর্ক-বিষয়ক আঁধারি-খোঁয়ারির রূপকেই প্রধানত স্পষ্ট করে তোলেন তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোতে। আর, তাঁর সমকালের তাঁর নিজস্ব ভূখণ্ডের লোকজীবনের বিপন্নতা-নৈরাশ্য, তাদের অবিরাম পর্যুদস্ত হয়ে যেতে থাকা আশা ও সম্ভাবনা বিনষ্টির কাহিনি তিনি উপস্থাপন করেন তাঁর ছোটোগল্পে।
দুই. সুস্থিত নগরবাসী, অথচ আদ্যোপান্ত বহিরিস্থিত
আগন্তুক, অন্ধ জাদুকর এবং জলের অক্ষরে লেখা উপন্যাস-তিনটি হচ্ছে যথাক্রমে অঞ্জন হায়দার চৌধুরী, কায়সার আহমেদ আদিত্য এবং ঋভু পারভেজ মাহমুদের আখ্যান। আহমাদ মোস্তফা কামালের এই উপন্যাসগুলো সমকালীন নাগরিকজীবনের প্রেক্ষাপটেই রচিত। এই যে তিন নায়ক, তারা একান্তই নগরবাসী এবং উচ্চশিক্ষিত। তারা আছে তাদের তারুণ্যের মধ্যাহ্নে। কর্মজীবনে বেশ থিতু এই তিনজনই গভীররকম পরিবারলগ্ন। কম বা বেশি যেমনই হোক, নিকটজনদের মধ্যেই তাদের জীবন যাপিত হয়। তাদের কোনো কোনোজন কর্মক্ষেত্রে অতি সফল, সংসারে তাদের সম্পন্নতা অঢেল। কেউ কেউ অতোটা সচ্ছলতাকে পায়নি এখনো, কিন্তু তাদের কারো কারো আছে সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠার প্রগাঢ় সাধ ও বাসনা।
তাদের জীবনে চাকুরির ব্যতিব্যস্ততা আছে। রোজকার কর্মভারে বেশ অনেকটা হাবড়া-জাবড়া হয়ে যাওয়া দিন, আর কর্মশেষের সন্ধ্যা ও রাত আছে। একটি নির্দিষ্ট ঠিকানায় থাকা গৃহে দিনশেষে তাদের ফিরে আসার তাগাদা ও দায়ও আছে। সেই গৃহে বয়স্ক প্রিয়জনের অচিকিৎস্য ব্যাধির যন্ত্রণাভার নিঃশব্দে, নিরুপায় সহ্য করে চলার মহাচাপ আছে। প্রায় সবগুলো সংসারকেই কোনো-না-কোনোভাবে প্রিয় কোনোজনের অকালমৃত্যুর দগদগে ঘায়ের যন্ত্রণা সহ্য করে চলতে হয়ই। অপঘাতে অকালমৃত স্বজনের জন্য কঠিন ব্যথা পেতে থাকে এদের সত্তা। অচিকিৎস্য-ব্যাধিগ্রস্ত নিকটজনের জন্য বেদনায় দগ্ধাতে থাকে তাদের প্রাণ। তারা প্রত্যেকেই এমত বিষাক্ততা দিয়ে ঘেরাও হয়ে থাকে আর ক্রমে নীরক্ত নিরুদ্যম আর স্তব্ধ-হিম হয়ে উঠতে থাকে তাদের ভেতর-বাহির।
এই নায়কদের প্রত্যেকেরই ঘরে-সংসারে অথবা অতি নিকটেই আছে তাদের অতি আপনজনেরা। আছে মা অথবা বোন অথবা ভাবী অথবা বন্ধুপত্নী অথবা বান্ধবী অথবা স্ত্রী অথবা অতি বিশ্বস্ত সেবক অনুচর; তাদের কারো কারো সাথে কখনো কখনো তাদের খানিকটা ভুল-বোঝাবুঝি বা অভিমানজনিত দূরত্ব আসে বটে, কিন্তু তাতে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের মমতা ও দরদের মাত্রাটা কিছুমাত্র কমে না। এই যে নারীগণ, তারা প্রত্যেকেই সুধাময়ী, গভীর দরদবতী। তারা এই নায়কদের গভীরভাবে আগলে রাখে। তাদের দেখভাল, যত্ন-সেবা করে চলে অক্লান্ত চিত্তে। কিন্তু তাও, এই সকলজনের ভেতরে থেকেও; এই অঞ্জন বা কায়সার বা ঋভু ‘নিজের স্বভাব দোষে’ ‘একা’ হয়ে যেতে থাকে। তাদের নির্বন্ধই হচ্ছে কোথাও কারো সাথেই খাপ-না-খাওয়াতে পারা। তাদের নিয়তিই হচ্ছে, ‘জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা-কওয়া’ হৃদয়ের ভার একা-একলা বয়ে বয়ে চলা, আর ‘বিষাদ-হিম’ হয়ে উঠতে থাকা। আর শ্লথ-মন্থর-নিরুদ্যম-মূক পায়ে জীবনের পথে পথে হেঁটে হেঁটে চলা।
ওই তিন নায়কের বাহ্যসত্তাটি সাংসারিক ও সামাজিক নানা অন্যায় ও কুবিধিরীতিগুলোর পাশে অবস্থান করে চুপমুখে, একান্তই শব্দহীনভাবে। আমরা দেখতে পাই, সামাজিক বা পারিবারিক বা রাজনীতিক দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে সক্রিয়, সাংঘর্ষিক, ক্রোধ-বিস্ফারিত হয়ে ওঠে না তারা কেউই। কিন্তু অন্তরের ভেতরে তারা ঘৃণায় পুড়তে থাকে। তীব্ররকমে পুড়ে যেতে থাকে। প্রকাশ্যে কোথাও কোনো বিরাগ বা বিরক্তির ঝনাৎকার জাগায় না তারা বটে; কিন্তু সকল অন্যায্যতার বিরুদ্ধে ঘৃণায় বিবমিষায় তারা প্রত্যেকেই অন্তরে অন্তরে হয়ে যেতে থাকে অতি করুণরকমের বিমর্ষ একজন। হয়ে ওঠে তারা নিরলম্ব উন্মূল। তারা থাকে অতি বহিরিস্থিত, অতি অনিকেত একজন হয়ে। একা, অতি একা তারা প্রত্যেকেই।
আহমাদ মোস্তফা কামালের এই তিনটি উপন্যাসের পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে করতে, আমরা বোধ করতে থাকি যে, যেন একই মহানিঃসঙ্গ একজনের ইতিকথাই তিন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ও তিনটি ভিন্ন গল্পে ও শিরোনামে বিধৃত করেছেন এই কথাকার। যেন-বা আগন্তুক উপন্যাসে যে-নায়ক এসেছে অঞ্জন নাম নিয়ে, সে-ই আরেকটু ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে এসে দাঁড়িয়েছে কায়সার নামে, অন্ধ জাদুকর উপাখ্যানে।
আহমাদ মোস্তফা কামালের এই তিনটি উপন্যাসের পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে করতে, আমরা বোধ করতে থাকি যে, যেন একই মহানিঃসঙ্গ একজনের ইতিকথাই তিন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ও তিনটি ভিন্ন গল্পে ও শিরোনামে বিধৃত করেছেন এই কথাকার। যেন-বা আগন্তুক উপন্যাসে যে-নায়ক এসেছে অঞ্জন নাম নিয়ে, সে-ই আরেকটু ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে এসে দাঁড়িয়েছে কায়সার নামে, অন্ধ জাদুকর উপাখ্যানে। তখন সে হয়ে উঠেছে আরেকটু ঋদ্ধ আরেকটু পরিণত আরেকটু সঘন একাকিত্বময়।
যখন সে কায়সার, তখন সে অঞ্জনের চেয়ে আরেকটু বেশি স্বপ্নময়, আরেকটু বেশি বিপন্ন, আরো একটু বেশি ব্যথা ও নৈঃশব্দ্যের ভার তাকে বইতে হচ্ছে। আরো একটু বেশি গভীর তার অন্তরের ক্ষত ও যাতনা। অঞ্জনের চেয়ে আরো ঢের বেশি একা সে, তুমুল একা। এবং মৌন।
তারপর অনেকটা পথ পেরিয়ে সে-ই যখন ঋভু বা পারভেজ মাহমুদ হয়ে দেখা দেয় তখন আমরা তার মধ্যে পাই, একই সাথে পাই সন্তের নির্লিপ্তি, ঔদাস্য ও মৌনতা; আবার সেসবের সাথেই পাই তার ‘তরুণ গরুড়সম কী বিপুল’ জীবনতৃষ্ণা বা সম্ভোগবাঞ্ছা। সফল সে এখন, বহুভাবে পরিপূর্ণ তার অস্তিত্ব; বহুরকমে পরিতুষ্ট তার জীবন। সচ্ছলতা আছে বেশ, শরীরী তৃষ্ণার ঘন নিবৃত্তিও থাকে তার। কিন্তু ওই পরিতুষ্টির পরেও, সকল বাঞ্ছা নিবৃত্তির পরেও এই জীবনের গভীরে স্থায়ীরকমে বসত করে চলে শূন্যতা, নিঃসঙ্গতাবোধ।
এই জীবন বহন করে চলে মোচন-অসম্ভব এক হাহাকারের ভার। একাকিত্ব থাকে চিরকালের দোসর হয়ে, ছায়ার মতোই, এখনও তার ভরভরন্ত জীবনের পাশেই। প্রাণতম বন্ধু অংশু যেমন ঋভুকে উষ্ণতা দিয়ে আবৃত রাখার জন্য সদা ব্যগ্র থাকে তেমনি অন্তর্গত হিম-হাহাকার ও নিঃসঙ্গতার বোধও ঋভুকে জড়িয়ে থাকে কঠিন বেষ্টনে। চির সহচর হয়ে কদমে কদমে তার পাশেই থাকে। যেন অঞ্জন ও কায়সারের সকল বেদনা-দুর্বহ বিষাদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এই ঋভু-মোহনায়, তাই এইখানে তার বিমর্ষতা এতো তেজি এতো জ্যান্ত।
আহমাদ মোস্তফা কামালের এই উপন্যাস-তিনটিকে এক বহিরিস্থিত নিঃসঙ্গ নায়কেরই ধারাবাহিক আখ্যান বলে গণ্য করতে পারি আমরা।
লেখকের ছবি : শরৎ চৌধুরী
বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।
আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!