ইরানের গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে এই লেখাটি ‘গ্রাফিন ডট কমে’ প্রকাশিত হয় ২৯শে মার্চ, ২০২০ তারিখে। ইরানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ইরানের সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইনকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা জানার চমৎকার এক মাধ্যম হতে পারে এ লেখাটি। গণমাধ্যমগুলোতে কট্টরপন্থী ইরানের যে চিত্র দেখা যায় সেটি বাদেও ইরানের এক অসম্ভব বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক রূপের কথা উঠে এসেছে এই লেখায়। ইরানের গ্রাফিক ডিজাইনের হালহকিকত বুঝতে সহায়ক গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাটি শ্রী-র জন্য অনুবাদ করেছেন আলী রেজা পিয়াল।
কিছুদিন আগে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে কিছু লেখা বের করেছিলাম। লেখাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশের গ্রাফিক ডিজাইন সম্পর্কে একটু জ্ঞান আহরণ করা, দেশীয় সংস্কৃতি কিভাবে গ্রাফিক ডিজাইনকে প্রভাবিত করে সেসব জানা। এছাড়া যে দেশে যাচ্ছি সে দেশের সহকর্মীদের সাথে দেখা হবে, সে দেশের গ্রাফিক ডিজাইনের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যাবে সেসবের লোভ তো ছিলই। বৈশ্বিকীকরণের প্রভাবে আমাদের এই পেশাটার বিশ্বব্যাপী কি অবস্থা সেটা দেখারও খানিকটা ইচ্ছা ছিল আমাদের।
প্রথম লেখাটি তুরস্কের গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে হলেও এবার চোখ বন্ধ করতেই আমাদের সামনের ভেসে ওঠে ইরানের কথা। আলাদীনের দৈত্য যেমন কুপি থেকে মুক্ত হয়েই চমৎকারের পর চমৎকার সাধন করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল, ইরানের শিল্পের মাধুর্য্যও তেমন।
ইরানের কথা শুরু করার আগে অবশ্য আমাদের সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক উত্তেজনার কথাটাও একটু মাথায় রাখতে হবে। আমেরিকা আর ইরান দুই দেশের আকাশেই যুদ্ধের মেঘ দেখা যাচ্ছে। তাই আমরা যাচ্ছি অন্য এক ইরানের সাথে পরিচিত হতে। যে ইরান শিল্প দিয়ে তৈরি আর নকশা দিয়ে সাজানো তার সংস্কৃতি আর ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে।
ইরানের সাধারণ জনগণ যারা করোনাভাইরাসের এই সময়ে দুঃখ দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এই লেখাটা পড়ে যদি আপনারা গর্বিত বোধ করেন বা আপনাদের মধ্যে সামান্যতম আশার আলোও জেগে ওঠে তাহলে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করব। ইরানের পথে পথে ঘুরে তার গ্রাফিক ডিজাইনের সাথে পরিচিত হয়ে আমরা যে আনন্দ পেয়েছি তার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। সেই সকল ডিজাইনারদেরকেও ধন্যবাদ যারা কল্পনার সীমানাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রতিভার সাহায্যে অসীমের দিকে ছুটছেন।
পেছনের গল্পটা না জেনে ইরানের একজন ডিজাইনার বা শিল্পীর কাজকে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। কারণ ঐতিহাসিকভাবেই ইরান শিল্পের দিক থেকে অনেক এগিয়ে।
পেছনের গল্পটা না জেনে ইরানের একজন ডিজাইনার বা শিল্পীর কাজকে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। কারণ ঐতিহাসিকভাবেই ইরান শিল্পের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। একদম প্রথম থেকে বলতে গেলে শুরু করতে হয় পার্সিয়ান সাম্রাজ্য থেকে। সেই সাম্রাজ্য অনেক সংস্কৃতি, অনেক সভ্যতার মিশেলে পরিণত হয়েছে আজকের ইরান। শিল্পের দিক থেকে ভাবলে বিশ্বে ইরানের একটা স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। অনেকে ইরানকে আরব দেশগুলোর অংশ ভাবলেও এটা সত্যি নয়। সাংস্কৃতিক দিক থেকে বরং ভারতের সাথে ইরানের সম্পর্ক বেশি।
প্রত্নতাত্ত্বিক সময় থেকে বিশ্বকে নিজেদের শিল্প দিয়ে প্রভাবিত করার ইতিহাস আছে ইরানের। ৬০ এর দশকে পশ্চিমাদের জন্য ইরান পুরোপুরি উম্মুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৭৯ এর ইসলামিক বিদ্রোহের সময়টাতে ইরানকে বেশ একটা অন্ধকার সময় পার করতে হয়। বর্তমান সময়েও গণমাধ্যমে ইরানকে যেভাবেই দেখানো হোক না কেন শিল্প, সাহিত্য চর্চার জন্য ইরান বিশ্বে এক বিশেষ অবস্থান দখল করে আছে।
তাই ইরানের বর্তমান গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে কথা বলার আগে একটু এর অতীত থেকে ঢু মেরে আসা যাক।
৩০০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য
যুদ্ধ, বিগ্রহ, সভ্যতার উত্থান পতন এসব মিলিয়ে পারস্য আর ইরানের ইতিহাস ১০০১ আরব্য রজনীর গল্পের মতোই চমকপ্রদ। সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মিশেল এর মধ্যে দিয়ে যাওয়ায় ইরান শৈল্পিক দিক থেকে বিশ্বে অদ্বিতীয়। এতবছর ধরে এই শিল্পগুলো তাদের গুনগত মান আর বৈচিত্র্যের জন্য এখনো টিকে আছে এবং আমাদের বর্তমান শিল্পের বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করছে। চিত্রকর্ম, কবিতা, সিরামিকস, খোদাই, ট্যাপেস্ট্রি এসবই ইরানিয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯৫০ এর শেষের দিকে তেহরান এর একটি পত্রিকায় ছাপানো এক লেখায় ইরানের ঐতিহ্য এবং তার প্রভাবের অহম লক্ষ্য করা যায়। ‘ইউরোপের রোমান ভাস্কররা যে সাসানিয়ান বাস-রিলিফ থেকে অণুপ্রাণিত হয়েছিলেন এই সত্য ঐতিহাসিকরা আর উপেক্ষা করতে পারবেন না। চীনা শিল্পীরাও আমাদের ইন্টারলেসিং এবং আলংকারিক কাজগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আমাদের মিনিয়েচারসগুলো বিশ্বকে রং এবং লাইন সম্পর্কে শিখিয়েছে। বিশ্বের পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত শিল্পের যে স্রোত আমরা তাদেরকে মিশিয়ে মোহনায় এনে ফেলেছি।’
আখেমেনীয় সাম্রাজ্যকে ধরা যায় প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো এবং পারস্যের প্রথম বড়ো সাম্রাজ্য। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের প্রভাব গ্রীস, মিশর থেকে শুরু করে চীন, ভারতের আনাচে কানাচে পর্যন্ত ছড়িয়ে পরেছিল। আলেকজান্ডার দি গ্রেট এর সময়ে এই সাম্রাজ্য ভেংগে গেলেও পরবর্তীতে সাসানিদ সাম্রাজ্যের সময়কালে (২২০ খ্রিষ্টাব্দ) এর ব্যপ্তি আবার বাড়তে থাকে। এই সাম্রাজ্যের খ্যাতি এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব এতই বেশি ছিল যে পার্শ্ববর্তী সভ্যতা যেমন রোম এবং বাইজেন্টিয়ান, পশ্চিম ইউরোপ, আফ্রিকা, চীন এবং ভারতের শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য সবকিছুকেই এর ছাপ লক্ষ্য করা যায়।
আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে নিয়ে একটু কথা বলা যাক। ধরা যাক আমরা খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আছি। আলেকজান্ডার ভাবছেন গ্রীসের সাথে পূর্বের সভ্যতাগুলোর মিলন ঘটালে তার স্বপ্নের হেলেনিস্টিক সভ্যতা তৈরি হবে। রাজনীতি এবং সমাজে শিল্পের প্রভাব শুরু হয় তাকে দিয়ে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে তার প্রতিকৃতি অঙ্কন দিয়ে। এতবড়ো সাম্রাজ্য যা ঘোড়ায় চড়ে অতিক্রম করতেও কয়েক সপ্তাহ লেগে যায় সেই সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে আলেকজান্ডার সাহায্য নিলেন তার সাম্রাজ্যের শিল্পীদের। প্রচুর পরিমাণে অর্থ দিয়ে শিল্পীদের বললেন তার ফ্রেস্কো, ভাস্কর্য বানানোর জন্য। নিজের প্রতিমূর্তির পেছনে পয়সা খরচ করা প্রথম রাজা তিনি। তাই শারিরীকভাবে অনুপস্থিত থেকেও জনগণের মনে এভাবেই জায়গা ধরে রেখেছিলেন আলেকজান্ডার। এর আগে ভাস্কর্য, মূর্তি বানানো হতো শুধুমাত্র দেবতাদের। নিজের এই সর্বশক্তিমান অবতার তৈরির মাধ্যমেই আলেকজান্ডার দেবতাদের কাছাকাছি পৌঁছে যান এবং শাসন করতে থাকেন তার বিশাল সাম্রাজ্য। ‘পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং’-এর পাঠ তাই কারো থেকে যদি নিতেই হয় তাহলে তা আলেকজান্ডার থেকে নেওয়াই ভালো।
শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আলেক্সান্ডারের প্রতিকৃতিগুলো আজও রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত। অনেকেই তা দেখতে প্যারিসের সিনেট গ্যলারিতে ভীড় করেন। কারণ এই ছবিগুলো আলেক্সান্ডারের ক্ষমতার প্রতীক। পশ্চিমা ঐতিহ্যের যে বাহ্যিক সৌন্দর্য্য তার একটা বড়ো অংশই এসেছে আলেক্সান্ডারের কারণে।
পূর্ব আর পশ্চিমকে একত্রিত করার যে স্বপ্ন আলেক্সান্ডারের ছিল তা তার মৃত্যর কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই শেষ হয়ে যায় এবং মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে সাসানিদ সাম্রাজ্যের। আর এই সাম্রাজ্যই ইরানের পারস্য সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখে। তবে আলেকজান্ডারকে এখনো ইরানে একজন নায়ক হিসেবেই দেখা হয় এবং তার সাম্রাজ্যবাদী চেহারাটা বিশেষ বিবেচনায় আসে না।
পূর্ব আর পশ্চিমকে একত্রিত করার যে স্বপ্ন আলেক্সান্ডারের ছিল তা তার মৃত্যর কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই শেষ হয়ে যায় এবং মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে সাসানিদ সাম্রাজ্যের। আর এই সাম্রাজ্যই ইরানের পারস্য সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখে। তবে আলেকজান্ডারকে এখনো ইরানে একজন নায়ক হিসেবেই দেখা হয় এবং তার সাম্রাজ্যবাদী চেহারাটা বিশেষ বিবেচনায় আসে না। ২৩ শতাব্দী পরে এসে এটা বলাই যায়, আলেক্সান্ডারের মতো অনেকে পেরেছিলেন পশ্চিম আর পূর্বের সভ্যতাগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে। সেই সেতুবন্ধনগুলো টিকে থাকুক আমরা সেই প্রত্যাশা করি।
অক্ষরের সৌন্দর্য্য
লেখার ধরণ বা অক্ষরের মধ্যে সবসময় কিছু দৃষ্টিনন্দন ব্যপার থাকতে হয়। নবী মুহম্মদ এর ওপর কোরানের বাণী নাজিল হওয়ার পরে অনেক কিছুই লিখে লিখে মুখস্ত করতে হতো। ইরানি গবেষক এবং গ্রাফিক ডিজাইনার সিনা ফাকুর ব্যপারটাকে ব্যখ্যা করেন এভাবে ‘আট থেকে আঠারো শতাব্দীতে, মানে যখন প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কার হয়নি তখন যে পরিমাণ হাতে লেখা বই বের হয়েছে তার সংখ্যা অগণিত। বর্তমানে ইরানের লাইব্রেরিতে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এরকম প্রায় ত্রিশ লক্ষ বই সংরক্ষিত আছে।’
কোরানের ওপর ভিত্তি করে ইসলাম ধর্মে যেসব চরিত্রগুলো আছে তাদেরকে নিয়ে অনেক মিনিয়েচারস তৈরি হয়েছে। ধীরে ধীরে অবশ্য ধর্মগ্রন্থে এসবের উপস্থাপনা বন্ধ হয়ে যায় এবং কোরানের শব্দগুলোই একধরণের অলংকারে পরিণত হয়। উদ্ভাসন, রং এবং ক্যালিগ্রাফি করে স্বর্ণ আর কালির সাহায্যে এই পবিত্র শব্দগুলো তখন লেখা হতো। ক্যালিগ্রাফি এখনো ইসলামের চারুকলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ইরানি গ্রাফিক ডিজাইনে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
নিচে ১৬১৬ সালে ফেরদৌসির কিছু ক্যালিগ্রাফির ছবি দেওয়া হলো। এগুলা নেওয়া হয়েছে শাহনামা থেকে। ১৩০০ থেকে ১৫০০ শতাব্দীর মধ্যে কোরান শরীফের ব্যবহৃত কিছু ক্যালিগ্রাফির ছবিও আপনারা নিচে দেখতে পাবেন।
সেই ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আজও হস্তলিপি বিভিন্ন ভংগিতে লেখা হয় এবং এটা তাদের গ্রাফিক ডিজাইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যান্য দেশে যেখানে চিত্রের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া হয় সেখানে ইরানে হস্তলিপি মাঝে মাঝে চিত্র বা ছবির থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অক্ষরগুলোই হয়ে ওঠে এক একটা চিত্র। এই জিনিসটাকে বিবেচনা না করলে ইরানি গ্রাফিক ডিজাইন বুঝতে আমাদের একটু অসুবিধা হবে।
নিচে ইরানি ডিজাইনার এবং ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট পারাশতু ফারুহারের ক্যালিগ্রাফি কাজের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো। ১৯৬২ তে তার জন্ম। ১৯৯১ এ সরকার এর সমালোচনা করার কারণে তার বাবা মাকে খুন করা হয় এবং এরপর থেকে তিনি জার্মানিতে বসবাস করা শুরু করেন। তবে তিনি এখনো নিজের কাজ দিয়ে ইরান সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছেন এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন।
এই সিরিজের ড্রয়িংগুলোতে ফারুহার ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণির নাম লেখেন। আমরা যখন এই ছবি দেখি তখন কি লেখাটাকে দেখব নাকি ছবিটা দেখব এমন এক অদ্ভুত অষ্পষ্টতা তৈরি হয়। এতবছর জার্মানীতে থাকার পরেও তার জার্মান সহকর্মীরা যখন তাকে ‘ইরানি’ বলে ডাকেন তখন নিজের অস্তিত নিয়ে তার ভেতরে যে অস্পষ্টতা তৈরি হয় সেটাই তার কাজগুলোতে ফুটে উঠে। তার ড্রয়িংগুলোর নমনীয়তা এবং বাহ্যিক প্রদর্শন ইরানি এবং জার্মান সংস্কৃতির মধ্যে একধরণের যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করে। সাধারণ অনূভূতি যেখানে প্রকাশ করা কঠিন সেখানে তার ড্রয়িংগুলো ছবি ও লেখার মাধ্যমে অপ্রকাশিত অনূভূতিগুলো প্রকাশের কাজ করে।
শেষ ছবিটি হিন্দুদের মতে সবচেয়ে পবিত্র প্রাণি গাভীর ওপরে কিছু অর্থহীন আরবী শব্দ। যে দুটি ধর্ম ভারতকে ভেতর থেকে বারবার ভেংগে ফেলছে সেটার প্রতীক এই ছবি।
টাইপোগ্রাফি এবং মুদ্রণ
ক্যালিগ্রাফির যান্ত্রিক ভাই মানে আরবি টাইপোগ্রাফি ইরানে আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। পশ্চিমে টাইপোগ্রাফি আগে বিস্তার লাভ করে কারণ ল্যাটিন ভাষায় অক্ষর শুধু একটা ইউনিট মাত্র। এর আলাদা করে কোনো অর্থ নেই এবং সেই অক্ষর দিয়ে যে শব্দ বানানো হয় তা একটা থেকে আরেকটা আলাদা। কিন্তু আরবি আর ফারসি ভাষার ক্ষেত্রে শব্দ লেখার ওপর ভিত্তি করে এর অর্থ পরিবর্তন হয়।
ক্যালিগ্রাফির যান্ত্রিক ভাই মানে আরবি টাইপোগ্রাফি ইরানে আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। পশ্চিমে টাইপোগ্রাফি আগে বিস্তার লাভ করে কারণ ল্যাটিন ভাষায় অক্ষর শুধু একটা ইউনিট মাত্র। এর আলাদা করে কোনো অর্থ নেই এবং সেই অক্ষর দিয়ে যে শব্দ বানানো হয় তা একটা থেকে আরেকটা আলাদা। কিন্তু আরবি আর ফারসি ভাষার ক্ষেত্রে শব্দ লেখার ওপর ভিত্তি করে এর অর্থ পরিবর্তন হয়।
এখানে বলে রাখা ভালো ফারসি ভাষা আরবী অক্ষর দিয়ে লেখা হলেও এটা আরবী ভাষা নয়। আরবী ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা পারসি ভাষাভাষি লোকের সংখ্যার প্রায় তিনগুণ। ইরান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইরাকে সাধারণত ফারসি ভাষা ব্যবহৃত হয়। ফারসি ভাষার একসময় নিজস্ব অক্ষর ছিল কিন্তু ১৮ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফারসি কথাটার উৎপত্তি পারস্য থেকে কিন্তু আরবীতে যেহেতু ‘প’ অক্ষরটি নেই তাই এটিকে পারসি না লিখে ফারসি লেখা হয়।
ইরান অনেক আগে থেকেই মুদ্রণের কাজে লিথোগ্রাফি ব্যবহার করে আসছে। এমনকি জ্ঞান বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা লিথোগ্রাফিকে প্রাধান্য দেয়। ইরানের টাইপোগ্রাফিকে অক্ষরবৃত্তিকভাবে সাজানোর চেষ্টা প্রথম করেন রেজা আবেদিনি।
প্রথম লিথোগ্রাফিক মুদ্রণ যন্ত্রটি আমেরিকাতে ব্যবহার শুরু হওয়ার মাত্র দু’বছর পরেই এই প্রযুক্তি ইরানে পৌঁছায় ১৮২১ সালে। একটা পাথরের ওপর অঙ্কন করে এই মাধ্যমে শিল্পীরা কোনোরকম সীমাবদ্ধতা ছাড়াই মোটিফ, ক্যালিগ্রাফি এবং ক্যারিকেচার করতে পারতেন তুলনামূলক কম খরচে। লিথোগ্রাফি ব্যবহার করে প্রথম বই ছাপাতে অবশ্য আরও ১১ বছর লেগে যায়। ওইসময়ে বৈশ্বিকীকরণ এবং আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে অনেক ইউরোপীয় বই অনূদিত হয়ে প্রকাশ হয়েছিল লিথোগ্রাফির মাধ্যমে। পরবর্তীতে সংবাদপত্রগুলোও মুদ্রনের কাজে লিথোগ্রাফি ব্যবহার করা শুরু করে।
প্রথম দিককার গ্রাফিক ডিজাইনাররা
সমসাময়িক গ্রাফিক ডিজাইনের শুরু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তেহরানে। ১৯৪১ এ তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় তাদের চারুকলা বিভাগে গ্রাফিক ডিজাইনের জন্য আলাদাভাবে কোর্স চালু করে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে প্যারিসের ন্যাশনাল স্কুল অফ ফাইন আর্টস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটা আলংকারিক বিভাগ তৈরি করে। চারু ও কারুকলার যাবতীয় জিনিস এখানে শেখানো হয়। মরতেজা মমায়েজ, রেজা আবেদিনিদের মতো ইরানের অন্য শিক্ষার্থীদেরও গ্রাফিক ডিজাইন শেখার আগে চারুকলার কিছু পাঠ দিয়ে শুরু করতে হয়।
৬০ এর দশকে মরতেজা মমায়েজ এবং তার সমসাময়িক শিল্পীরাই (গিটি নভিন, ফারশিদ মেশগালি, ঘবাদ শিবা) ইরানের গ্রাফিক ডিজাইনারদের প্রথম প্রজন্ম।
অত্যন্ত সমৃদ্ধ পাশ্চাত্য ধাঁচে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরেও তারা বিজ্ঞাপনের ঝকমকে দুনিয়া আর অর্থের হাতছানিকে উপেক্ষা করে নিজস্ব ভিজুয়্যাল স্টাইল তৈরিতে মনোযোগ দেন। যদিও সে সময়ে তাদের কাজের বেশিরভাগ গ্রাহকই ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে নকল করে কিছু একটা বানিয়ে দিলেই খুশি হয়ে যেত।
অত্যন্ত সমৃদ্ধ পাশ্চাত্য ধাঁচে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরেও তারা বিজ্ঞাপনের ঝকমকে দুনিয়া আর অর্থের হাতছানিকে উপেক্ষা করে নিজস্ব ভিজুয়্যাল স্টাইল তৈরিতে মনোযোগ দেন। যদিও সে সময়ে তাদের কাজের বেশিরভাগ গ্রাহকই ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে নকল করে কিছু একটা বানিয়ে দিলেই খুশি হয়ে যেত। কিন্তু পশ্চিমের ব্যপারে পর্যাপ্ত কৌতূহল থাকায় এবং প্রযুক্তির কারণে পশ্চিমে গ্রাফিক ডিজাইনে যে জোয়ার এসেছে তা লক্ষ্য করে তারা চেষ্টা করেন সংস্কৃতির সাথে মানুষের যে দূরত্ব সেই সমস্যার একটা ভিজুয়্যাল সমাধান দিতে। সেই সময়ে ‘কানুন’ এর মতো অনেক প্রগতিশীল ম্যাগাজিন শিশুদের বই এবং এনিমেটেড ছায়াছবির জন্য উৎসবের আয়োজন করে এবং শাহ সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে অর্থ সাহায্যও দেওয়া হয়।
ওইসময়ে এই ডিজাইনাররা সত্যিকার অর্থেই পথিকৃত ছিলেন। তারা নিজস্ব শৈলীতে ডিজাইন করে সেই ডিজাইন লোকদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন ডিজাইন শুধুমাত্র বাহ্যিক উপস্থাপন নয় এর মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ অর্থ নিহিত থাকে। ভাগ্যক্রমে ইরানিরা এবং তাদের কাজের গ্রাহকরা শিল্প-সাহিত্যের বেশ সমঝদার ছিলেন এবং গ্রাফিক ডিজাইনকে আলাদা একটা শিল্প হিসেবেই ভাবতেন। প্রথম গ্রাফিক ডিজাইন প্রদর্শনী হয় তেহরানে ১৯৬৪ সালে এবং এরপরে দ্বিবার্ষিক এশিয়ান আর্ট উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ইরানের রাজধানীতে ১৯৭৮ সালে।
মমেয়াজ ৫০ এর দিকে ইরানে পড়াশোনা এবং কাজকর্ম চালিয়ে গেলেও ৭০ এর শুরুতে প্যারিসে যান আর্টস ডেকো স্কুলে প্রশিক্ষণ নিতে। এরপর তিনি তেহরানে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অনেক গ্রাফিক ডিজাইন প্রদর্শনী, উৎসবের তত্ত্বাবধান করেন। তার প্যারিসে কাটানো সময়, নিজের দেশের সংস্কৃতি এবং পোলিশ প্রচ্ছদশিল্প থেক অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আঞ্চলিক গ্রাফিক ডিজাইনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে অদ্বিতীয় ভূমিকা রাখেন। মমেয়াজ ইরানের প্রথম নাগরিক হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল গ্রাফিক এলায়েন্সের সদস্য হন।
গ্রাফিক ডিজাইনের মতো দুনিয়া, যেটা মূলত পুরোটাই পুরুষ অধ্যুষিত সেখানে গিটি নভিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ে চাকরি পেয়েও এই মহিলা চাকরি ছেড়ে দেন; কারণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালকের মতে সেক্রেটারির কাজ বাদে অন্য কোনো কাজ তাকে দিয়ে হবে না। পরবর্তীতে নিউ ওয়েভ ফিল্মমেকার হাজির দারিয়ুশ তাকে ফিল্ম বিভাগে চাকরি দেন এবং সেখানে তিনি তেহরানের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবের ভিজুয়্যাল ডিজাইন করেন।
তাই বলা যায় ইরানের সংস্কৃতি ও শিল্পের বিকাশে নারীদের ভূমিকা অস্বীকার্য। প্রথম দিকে তারা বুনন, তাঁতশিল্পের মতো ঘরোয়া শিল্পে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া শিল্পী ও ডিজাইনারদের অর্ধেকই নারী।
তারা বের হয়ে শুধু গ্রাফিক ডিজাইনার হচ্ছেন, ডিজাইন শেখাচ্ছেন এমনই না। বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন এবং আর্ট গ্যলারি চালাচ্ছেন। এই নারীদের মধ্যেই বিশেষ করে বলতে গেলে বলতে হয় হোমা ডেলভারে, জয়নাব ইজাদার, মাশা ঘোলেনজাদের কথা। তাদের কিছু কাজ নিচে দেখতে পাবেন।
ইসলামিক বিপ্লব এবং শিল্পের সেন্সরশিপ
কিন্তু ১৯৭৯ এ সব পরিবর্তন হয়ে যায়। ইসলামী বিপ্লবের ফলে শাহ পদচ্যুত হন এবং এরপরে কট্টরপন্থি ইসলামের শাসন শুরু হয়। ইসলামের মূল মতাদর্শের বিরোধী হওয়ায় যাবতীয় শিল্পের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মার্জান সাতরাপীর পার্সোপলিস পড়লে এব্যপারটা কিছুটা বোঝা যাবে। নাইকি, মাইকেল জ্যাকসন, পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক আছে এমন সবকিছুই নিষিদ্ধ করা হয়। নভিনের মতো শিল্পীরা দেশ ছেড়ে পালানো শুরু করেন। দুবছর পরে অবশ্য শাসক ফারাহ পেহলাভি গাগেনহেইম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সমসাময়িক শিল্পগুলো সংরক্ষণ করে একটি জাদুঘর তৈরি করেন। এই জাদুঘরের নাম দেওয়া হয় তেহরান মিউজিয়াম অফ কন্টেম্পোরারি আর্টস। ইউরোপ, আমেরিকা বাদ দিলে বিশ্বের অন্যান্য জাদুঘরের তুলনায় এটাতেই সবচেয়ে বেশি সমসাময়িক শিল্প সংরক্ষিত আছে।
এই জাদুঘরের বেইসমেন্টে বিশ বছরের বেশি সময় ধরে অ্যান্ড্রি ওয়ারহল, হেনরী মুর, সালভাদর দালি, মার্ক শাগাল, লিক্টেনস্টাইন, রাউজেনবার্গদের শিল্পকর্ম আটকা পরে ছিল কারণ এগুলোকে ইসলাম বিরোধী শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা হত। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ এ প্রথম এই শিল্পকর্মগুলোর জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। ইরানের বর্তমান সরকার এসব ব্যপারে আরেকটু সহনশীল হলেও বেশিরভাগ সময় এগুলো বেইসমেন্টের অন্ধকারেই পরে থাকে।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে
বিপ্লবের সময়টাতে শিল্পীরা যে যেখানেই ছিলেন সেখান থেকেই নিজেদের মতো করে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং অনেকেই ১৯৯০ এর দিকে দেশে ফিরে আসেন। মরতেজা মমায়েজ এর মতো কয়েকজন বিপ্লব এবং পরবর্তীতে ইরান ইরাক যুদ্ধের মধ্যেও দেশে থেকেই নিজেদের সৃজনশীল কাজকর্ম অব্যাহত রাখেন।
বিপ্লবের সময়টাতে শিল্পীরা যে যেখানেই ছিলেন সেখান থেকেই নিজেদের মতো করে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং অনেকেই ১৯৯০ এর দিকে দেশে ফিরে আসেন। মরতেজা মমায়েজ এর মতো কয়েকজন বিপ্লব এবং পরবর্তীতে ইরান ইরাক যুদ্ধের মধ্যেও দেশে থেকেই নিজেদের সৃজনশীল কাজকর্ম অব্যাহত রাখেন।
এই প্রসংগে বলে রাখা ভালো, একজন ডিজাইনারারের কাজই হচ্ছে সমস্যার নিখুঁত সমাধান খুজে বের করা। সেই সমস্যা তার কাজের সাধারণ গ্রাহক তৈরি করুক অথবা সরকার। হাজারো বাধানিষেধ পাশ কাটিয়ে ডিজাইনাররা সে সময়ে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে শিল্পকে বেছে নেন। বিপ্লব এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৯০-২০০০ সালের মধ্যে ইরানে নতুন প্রজন্মের গ্রাফিক ডিজাইনাররা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকেন। যারা নিজের দেশের সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক শিল্প সৃষ্টিতে মনোযোগ দেন।
এই প্রজন্মের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম রেজা আবেদিনি। তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন এবং তার তত্বাবধানেই ইরানের তৃতীয় প্রজন্মের গ্রাফিক ডিজাইনাররা বেড়ে উঠেছে।
গ্রাফিক ডিজাইনের যেসব সাফল্য ইরান পেয়েছে তার বেশিরভাগই সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। প্রথম গ্রাফিক ডিজাইনাররা সংস্কৃতি বাদে অন্য কিছুতে তেমন আগ্রহও দেখাননি কখনো।
ইরানিয়ান গ্রাফিক ডিজাইনের পুনরুত্থান
ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক শক্তিশালী এবং নতুন শিল্পীরা সেই ঐতিহ্যের শক্তিকে ধীরে ধীরে আধুনিকায়নের চেষ্টা করছেন। গ্রাফিক ডিজাইনার বেহরুজ হারিরি বলেন ‘ইরানের ডিজাইনারদের সৌভাগ্য যে তারা এমন এক সভ্যতায় জন্ম নিয়েছে যার বয়স ৩০০০ বছর। তাই সংস্কৃতি থেকে তাদের অনুপ্রাণিত হওয়ার সুযোগ অনেক। কিন্তু মাঝে মাঝে এই সংস্কৃতি আবার তাদের সৃজনশীলতাকে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। কারণ এত এত ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রভাব এড়িয়ে নতুন কিছু তৈরি করাটা একটু কঠিন।’ তাই সঠিক পদ্ধতিতে সামনের দিকে এগোনোটাই আজকের দিনে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা।
ইন্টারনেটের উন্নতির ফলে ইরানিয়ান গ্রাফিক ডিজাইনাররা বিশ্বের সকলের সাথে নিজেদের চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলেই গনমাধ্যমে ইরানের যে চিত্র দেখানো হয় তার পাশাপাশি সৃজনশীল, কৌতূহলী, সাংস্কৃতিক এবং বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ এক ইরানকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের। নতুন ডিজাইনার যারা ইসলামিক বিপ্লবের পরে জন্মেছে তাদের মধ্যে অনেকে ফারসি ঐতিহ্য অনুযায়ী কাজ করতে পছন্দ করে। আবার অনেকেই বৈশ্বিকীকরণের ফলে পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে কাজ করা শুরু করেছে। তবে তাদেরকে পুরনো প্রজন্ম এখনো নিজেদের সাংস্কৃতিক শেকড়ের সাথে যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখতে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে।
ইন্টারনেটের উন্নতির ফলে ইরানিয়ান গ্রাফিক ডিজাইনাররা বিশ্বের সকলের সাথে নিজেদের চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলেই গনমাধ্যমে ইরানের যে চিত্র দেখানো হয় তার পাশাপাশি সৃজনশীল, কৌতূহলী, সাংস্কৃতিক এবং বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ এক ইরানকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের।
ইরানের সকল বিখ্যাত গ্রাফিক ডিজাইনারকে নিয়ে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। তাই আমরা ইরানের তিনজন নারী গ্রাফিক ডিজাইনারকে নিয়ে কথা বলব।
হোমা ডেলবারে, রেজা আবেদিনির ছাত্রী। তিনি ইরানেই বসবাস করেন এবং বেশিরভাগ সময় আঞ্চলিক প্রজেক্টে কাজ করলেও ইউরোপ, আমেরিকাতেও তার কাজের গ্রাহকের সংখ্যা অনেক। তার কাজ আন্তর্জাতিক মহলে বেশ কয়েকবার প্রদর্শিত হয়েছে এবং কাজের জন্য অনেক পুরস্কারও জিতেছেন তিনি।
স্টুডিও কারাগ এর প্রতিষ্ঠাতা আরিয়া কাসাই, রেজা আবেদিনির সাথে মিলে আজাদ গ্যালারির পাক্ষিক প্রদর্শনীর জন্য বেশ কিছু পোস্টার তৈরি করেন। তার এই কাজ ইরানের সাধারণ মানুষ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে গ্রাফিক ডিজাইন ছড়িয়ে দিতে অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করে। মধ্যপ্রাচ্যে পোস্টার ডিজাইনের উন্নয়নে তার কাজের প্রভাব অনস্বীকার্য এবং এই কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক ডিজাইনার আন্তর্জাতিক মহলেও ভালো সুনাম অর্জন করেছে।
জয়নাব ইজাদায়ার, রেজা আবেদিনির গ্রাফিক ডিজাইন স্টুডিওতে কাজ করতেন। নিচের পোস্টারগুলো একটি উৎসবের জন্য তিনি ২০০৭ সালে তৈরি করেন।
তিনি বর্তমানে একজন পোশাক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন এবং ২০১৭ সালে তিনি ‘vvorkvvorkvvork’ নামে আমেরিকাতে একটি পোশাক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। পোশাকের সমসাময়িক দর্শনের সাথে নিজ দেশের সংস্কৃতি থেকে পাওয়া প্রাকৃতিক রঞ্জনবিদ্যা এবং ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করে তিনি নতুন একধাঁচের পোশাক তৈরি করছেন।
মেহেদি সাইদি উঠতি সম্ভাবনাময় গ্রাফিক ডিজাইনারদের একজন যদিও তিনি আমেরিকা থেকেই মূলত কাজ করেন। টাইপোগ্রাফিতে কিভাবে ক্যালিগ্রাফির মূলনীতিগুলো ব্যবহার করা যায় সেটি তৈরিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পার্সিয়ান অক্ষরগুলোর জুমরফিজম নিয়েও তিনি কাজ করছেন। এই ব্যপারে ‘মেলোডি অফ লেটারস’ নামে তার খুব সুন্দর একটি কোর্সও আছে।
আরও শত শত গ্রাফিক ডিজাইনারের নাম চাইলে বলা যাবে। কিন্তু লেখাটা ইতিমধ্যেই বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। আমরা অনুরোধ করব আপনারা যেন সিনা ফাকুর, স্টুডিও মেল্লি, মাসুদ মরগান, স্টুডিও মেটাফোর, মোজতাবা আদিবি, স্টুডিও তেহরান, স্টুডিও খারাগ এদের কাজ অবশ্যই খুঁজে বের করে দেখেন।
প্রতিভাবানরা বেরিয়ে আসুক
যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এত এত নিষেধাজ্ঞার ভিড়ে ইরানের গ্রাফিক ডিজাইন বা শিল্প থেকে বিশেষ কিছু আশা করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু এটাও সত্যি যে শিল্প আসলে প্রতিবাদের একটা মাধ্যম। শিল্প শুধু অভিব্যাক্তি নয়, এটা একটা দায়িত্ব। ইরানের সেন্সরশিপ তাদের শিল্পকে ভাঙতে পারলেও মচকাতে পারেনি। আলাদীনের দৈত্য যেমন কুপির বিধিনিষেধের মধ্যে থেকেই চমৎকার সাধন করে তেমনি ইরানের প্রতিভাবান শিল্পীরাও এত বিধিনিষেধের মধ্যেও নিজেদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শিল্পের খাতিরে। তাই এত রাজনীতি আর যুদ্ধের মধ্যেও ইরান ক্রমাগত প্রতিভার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এবং এদেরকে নিয়েই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে।
তেহরানে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত অনেক গ্যালারি আছে এবং সেখানকার শিল্প সংস্কৃতিও এখনো ভালোই শক্তিশালী। যদিও এর উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো সাহায্য, পৃষ্ঠপোষক বা সংগঠন নেই তারপরও ডিজাইনাররা এই অনিশ্চিত অর্থনীতিতে একজন আরেকজনকে নিজেদের প্রতিভা দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছেন। বর্তমান দুঃসময় কাটিয়ে ইরানের গ্রাফিক ডিজাইন আবার চারিদিকে ছড়িয়ে পরবে এবং শেষপর্যন্ত প্রতিভা এবং শিল্পের জয় হবে এতটুকুই আমাদের প্রার্থনা।
প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু আগ্রহ এবং প্যাশন সিনেমাকে কেন্দ্র করে। সিনেমা নির্মাতা হবার উদ্দেশ্যে সে একাধিক শর্টফিল্ম তৈরি করেছে। সিনেমা নির্মানের পাশাপাশি লেখালেখিতে আগ্রহী। প্রকাশিত অনুবাদের বই রিচার্ড ফাইনম্যানের লেখা ‘সিক্স ইজি পিসেস’।