শনিবার, নভেম্বর ২৩

ইয়ো ইয়ো : কৃষ্ণ জলেশ্বর

0

পৃথিবীর সবকিছুই নাকি একটা চক্রে বাঁধা, দূরে ঠেলে দিলেও ফের ফিরে আসে ইয়ো ইয়োর মতো হাতের তালুতে। শুধু খেলতে জানতে হয়। ঠিক মতো ছুঁড়তে জানতে হয়। হতে হয় দক্ষ। দক্ষ হয়ে উঠতে প্রয়োজন প্রচুর অনুশীলন। তার জন্য চাই নিজের একটা ইয়ো ইয়ো, ইচ্ছে মতো।

‘কোকাকোলা না; স্প্রাইট বা ফানটা জমাও তুমি। কোকাকোলার জন্য তোমার লাগবে আটটা, স্প্রাইটের জন্য ছয়টা আর ফানটার জন্য পাঁচটা’— বলেছিল অপলি। সে সময় চলছিল ইয়ো ইয়ো অফার।

আঙুলে সুতো জড়িয়ে ছুড়ে দিতে হয় চাকতিটা। দূরে গিয়ে ফের ঘুরে ঘুরে সুতো গুটিয়ে হাতের মুঠোয় ফিরে আসে। একটি ইয়ো ইয়ো পাওয়ার জন্য অপলির কথামতো ফানটার তিনটা বর্ণ অবধি জমাতে পেরেছিলাম— ‘এফ’, ‘এন’, ’টি’। সাত টাকা দিয়ে ফানটা খাওয়ার টাকা কোথায় পাব! টিফিনের জন্য কোনো কোনো দিন বাবা এক-দুই টাকা দিতেন।

এইসব কোমলপানীয়র ছিপির নিচে একটি করে ইংরেজি বর্ণ ছাপা থাকত। বর্ণ জমিয়ে ব্র্যান্ডের নাম লিখে ফেলতে পারলেই দোকানীর কাছ থেকে বুঝে পাওয়া যেত একটা ইয়ো ইয়ো। জোড়া লাগানো ছোটো গোল দুটি চাকতির মাঝে বাঁধা লম্বা সুতো। আঙুলে সুতো জড়িয়ে ছুড়ে দিতে হয় চাকতিটা। দূরে গিয়ে ফের ঘুরে ঘুরে সুতো গুটিয়ে হাতের মুঠোয় ফিরে আসে। একটি ইয়ো ইয়ো পাওয়ার জন্য অপলির কথামতো ফানটার তিনটা বর্ণ অবধি জমাতে পেরেছিলাম— ‘এফ’, ‘এন’, ’টি’। সাত টাকা দিয়ে ফানটা খাওয়ার টাকা কোথায় পাব! টিফিনের জন্য কোনো কোনো দিন বাবা এক-দুই টাকা দিতেন। সেগুলো জমিয়ে একটা কিনেছিলাম। সেবার বড়ো মামা বেড়াতে এলে তাকে খুব করে ধরে আর একটা ফানটার ছিপি জমেছিল। আর একটা দিয়েছিল অপলি। তার এমনিতে কোকাকোলা পছন্দ। বোধ করি আমার জন্যই সে ফানটা খেয়েছিল।

 

২.
অপলি হচ্ছে অপলি। অপলি সুন্দর। সাত ক্লাসে পড়ত সে। আমিও তখন সাত ক্লাসে। অপলিকে প্রথম যেদিন দেখি তার পরনে ছিল হলুদ শার্ট আর ব্লু জিনস। পায়ে শাদা কেডস। কী যে সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে! অপলির মা নেহা আন্টি, তিনিও সুন্দর। আমাদের কলোনিতে নেহা আন্টির চেয়ে সুন্দর করে কেউ শাড়ি পরতে জানত না। অপলির বাবা থাকত সিঙ্গাপুরে। অপলির ওয়াকম্যান ছিল, বাসায় ছিল ডেক সেট। সেখানে গান বাজত— প্রেমি আশিক আওয়ারা, পাগল মজনু দিবানা। আরও হিন্দি গান বাজত। সব গানের কথা কি আর মনে থাকে! হিন্দি তো আর বুঝতাম না। তবে এই গানটার কথা মনে আছে। এই গানে আমার নাম আছে। আর আছে মজনু ভাইয়ের নাম। মজনু ভাই থাকতেন অপলিদের বাড়ির নিচতলার ফ্লাটে। অপলিদের দোতলা বাড়ি। দোতলায় থাকত অপলিরা। আর আমরা থাকতাম পাশের হাফ বিল্ডিং ঘরে। গ্রামের স্কুলের চেয়ে শহরে পড়াশোনা ভালো বলে বাবা মফস্বল শহরটিতে নিয়ে আসেন আমাদের, মানে মাকে আর আমাকে। বাবা ছিলেন ফুড গোডাউনের কেরানি।

৩.
নেহা আন্টি গুনগুন করে গাইতেন—প্রেমি আশিক আওয়ারা, পাগল মজনু দিবানা…। আমাকে প্রায়ই ডাকতেন। হয়তো তার কাপড় কাচার সাবান লাগত, নয়তো শাকপাতা কিংবা চিনি, এটা সেটা; তিনি ডাকতেন, টাকা দিয়ে বলতেন, যাও, দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসো না! আমিও দৌড়ে যেতাম। আসলে অপেক্ষায় থাকতাম কখন নেহা আন্টি ডাকবেন। তার কাছে ছিল অদ্ভুত মোহনীয় ঘ্রাণ। কোথাও যেতে আসতে মায়ের সাথে দেখা হলে বলতেন, ‘আপনার ছেলের মতো লক্ষ্মী ছেলে আর হয় না। বিনয়ী আর সৎ।’ এই শুনে মা হাসতেন। অপলিও হাসত মিষ্টি করে। আর আমি আরও বিনয়ী ও সৎ হয়ে উঠতে চাইতাম। প্রতি শুক্রবার জুম্মার আগে নেহা আন্টি ডাকতেন। দশ টাকা হাতে দিয়ে বলতেন, ‘মসজিদের দান বাক্সে দিও।’ কত দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি দশ টাকা হাতে নিয়ে— ‘কে দেখছে! দান বাক্সে না ফেলে দশ টাকা দিয়ে দুইটা মিমি চুংগামের প্যাকেট কিনে ফেলা যায়! অথবা বিকেলের শোয়ে রুবেলের ‘সতর্ক শয়তান’ সিনেমায় দেখা যায় কুংফু ক্যারাতি! অথবা, সাত টাকায় দিব্যি একটা ফানটা কিনে ফেলা যায়! তারপর ছিপি জমিয়ে ফানটা লিখে ফেললেই একটা ইয়ো ইয়ো!’ কিন্তু আমার কাছেই আমি হেরেছি কিংবা জিতেছি। মনে ভেসেছে নেহা আন্টির প্রশংসাময় বাক্য, মায়ের আর অপলির হাসি। চাহিদার পাল্লায় একটা ইয়ো ইয়োর চেয়ে ওসবই ভারি হয়ে এসেছিল।

মজনু ভাই তখন ভার্সটিতে ভর্তি হয়ে গেছেন। জেলা শহরে থাকেন। মাঝে মাঝে বাসায় আসেন। তিনি নতুন কত কিছু যে নিয়ে আসেন! একবার নেহা আন্টির জন্য আনলেন তপন চৌধুরীর ফিতা। ডেক সেটে সারাদিন বাজল— ‘পৃথিবীর মতো হৃদয়টাকে আমি কখনো তো ভাগ করিনি আমি।’

 

৪.
মজনু ভাই-ই প্রথম কোকাকোলা খেয়ে খেয়ে কালো রঙের একটি ইয়ো ইয়ো পেয়ে যান। হাতের তালু থেকে হুট করে ছুঁড়ে দেন। সুতা ছেড়ে দৌড়ে পালাতে চায় চাকতিটা; কিন্তু পারে না, ফের সুতা জড়িয়ে হাতের তালুতে ফিরে আসে। মুগ্ধ হয়ে দেখি। মুগ্ধ হয়ে দেখে অপলিও। আর মনে মনে ঈর্ষায় মরে যাই— ইশ্! আমি যদি মজনু ভাই হতাম! মজনু ভাই তখন ভার্সটিতে ভর্তি হয়ে গেছেন। জেলা শহরে থাকেন। মাঝে মাঝে বাসায় আসেন। তিনি নতুন কত কিছু যে নিয়ে আসেন! একবার নেহা আন্টির জন্য আনলেন তপন চৌধুরীর ফিতা। ডেক সেটে সারাদিন বাজল— ‘পৃথিবীর মতো হৃদয়টাকে আমি কখনো তো ভাগ করিনি আমি।’ ছাদে বসে চা খেতে খেতে নেহা আন্টির সাথে কত কিছু নিয়েই যে কথা বলতেন মজনু ভাই। কেন রবি চৌধুরীর চেয়ে তপন চৌধুরী ভালো! কেন আইয়ুব বাচ্চু সেরা গিটারিস্ট! শুভ্র দেব আদতে তোতলা কি না! গান নিয়ে কথা হতো। সিনেমা-নাটক নিয়ে কথা হতো। আমি দূর থেকে আর কিছু করার ছলে সেইসব কথা শুনতাম। দেখতাম অপলি চুপচাপ ওয়াকম্যানে গান শুনত দূরে কোথাও তাকিয়ে থেকে।

 

৫.
ইয়ো ইয়ো দিয়ে কতভাবেই না খেলা দেখাতে পারতেন মজনু ভাই! তার ইয়ো ইয়ো দিয়ে আমিও চেষ্টা করেছি দু’একবার। কিন্তু পারতাম না। কিছুতেই হাতের তালুতে ফিরিয়ে আনা যেত না চাকতিটাকে। মজনু ভাই বলতেন, ‘সবই প্র্যাকটিসের বিষয়, বুঝছিস! এতো সোজা না! সাধনা আর কৌশলে আয়ত্বে আনা শিখতে হয়, তবেই সব তোর হাতে ধরা দেবে। ’

মজনু ভাইকে ভালোবাসতাম। ভাবতাম বড়ো হয়ে মজনু ভাইয়ের মতো হবো। তার ঘর জুড়ে নানা রকম বই, মাসুদ রানা, ফ্যান্টমের কমিকস। কত কত ক্যাসেট! পত্রিকার টারজান কমিকস কেটে কেটে একসাথে বাঁধাই করে বানানো বই ছিল কয়েকটি। বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিট জমানো খাতা। দেয়ালে টানানো বিদেশি ব্যান্ডের গায়কদের ছবি। আলো-ছায়ায় চার মুখ— কুইন। গানস অ্যান্ড রোজেস। আর একটা ছবি ছিল। সুন্দর এক নারী কালো পোশাক পরে তাকিয়ে আছে। মজনু ভাই বলেছিলেন, ওর নাম দিব্যা ভারতী। ভারতের নায়িকা। আত্মহত্যা করেছে। জানার পর থেকেই মেয়েটার চোখের দিকে চোখ পড়তেই মনে কেমন যেন লাগত! মনে হতো— মানুষ কীভাবে নিজে নিজে মরে যেতে পারে! মজনু ভাই বলেছিলেন, ‘মৃত্যু এক অনাবৃত পাথরের নাম, জীবন তা আবৃত করে রাখে’। আসলে বলেন নাই, এটা লেখা ছিল তার একটা খাতার ভেতর। মনে হয় কবিতা-টবিতা লিখতেন। মজনু ভাইয়ের ঘরে ছিল আমার অবাধ যাতায়ত। তার ঘরে বসে বই, কমিকস, খাতা-পত্র, বিভিন্ন পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখার অধিকার ছিল আমার। সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ পরপর তিনি বাসায় আসতেন। তিনি না থাকলে চাচী দরজা খুলে দিতেন। আমি চুপচাপ তার ঘরে বসে কখনো বই পড়তাম, কখনো কমিকস, কিশোর তারকালোক কিংবা চিত্রালী। উল্টেপাল্টে দেখতাম সব।

 

৬.
‘নেহা বলে কোনো শব্দ নেই, শব্দটি নিহা। নিহা শব্দের অর্থ সুন্দর। কেন যে আপনি একটা ভুল নাম ঝুলিয়ে রেখে বেঁচে থাকছেন!’ নেহা আন্টিকে বলছিলেন মজনু ভাই। ‘নেহা-ই ভালো। আমার ভুল নামই সুন্দর।’ হেসে বলছিলেন নেহা আন্টি। আর তখন হয়তো মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছিল। মাথায় কাপড় টেনে নিয়েছিলেন। আর নেহা আন্টির সবুজ শাড়িতে হলুদ ফুলগুলো অদ্ভুত রকম উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল দিন শেষের আলোতে। আযান দিলে পড়তে যেতে হয়। অপলি আর আমি ছাদ থেকে নেমে আসি। অপলি ঘরে চলে যাওয়ার আগে আমার হাতে গুঁজে দেয় একটা ফানটার ছিপি। এ্যা। ‘আর একটা এ্যা হলেই, ফানটা, ইয়ো ইয়ো।’ আমার খুশিতে মন ভরে ওঠে। আমার ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে অপলির সাথে থেকে যাই পুরো সন্ধ্যা। ইচ্ছে করে চিৎকার করি ‘অপলি! অপলি!!’ কিন্তু কিছুই করি না আমি। স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। ‘মা আসছে, যাই!’ বলেই ঘরে চলে যায় অপলি। আর আমি ফিরে গিয়ে একা একা ডুবে যাই সন্ধ্যার বুকে।

‘বাকেরের ফাঁসি হবেই। হুমায়ূন আহমেদকে তো চেনেন না। ওর অনেক বই পড়েছি। সবচেয়ে বড়ো কথা আন্দোলন না হলে ফাঁসি না দিতেও পারত। যেহেতু মানুষ চাচ্ছে ফাঁসি না হোক। তাই হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চয়ই বাকেরের ফাঁসি দেবে।’

৭.
আর এক সন্ধ্যার পর সবাই মিলে আমরা অপলিদের বাসায় টেলিভিশন দেখতে গিয়েছিলাম। সবাই খুব চিন্তিত, সত্যি সত্যি কি বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাবে? আজকেই তো শেষ পর্ব! নেহা আন্টি বলেছিলেন, ‘দেখো ফাঁসি হবে না। এতো আন্দোলন হলো! হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চয়ই মুনার সাথে বাকেরের মিল দেখাবে।’ কিন্তু মজনু ভাই উড়িয়ে দিলেন, ‘বাকেরের ফাঁসি হবেই। হুমায়ূন আহমেদকে তো চেনেন না। ওর অনেক বই পড়েছি। সবচেয়ে বড়ো কথা আন্দোলন না হলে ফাঁসি না দিতেও পারত। যেহেতু মানুষ চাচ্ছে ফাঁসি না হোক। তাই হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চয়ই বাকেরের ফাঁসি দেবে।’ নাটক শুরুর আগেই এমন তর্ক হচ্ছিল। আমরাও ভাবছিলাম সত্য প্রকাশিত হবে। কুত্তাওয়ালি ধরা খেয়ে যাবে। ফাজিল মহিলা! মুনার জন্য মন খারাপ লাগত। আহা! নেহা আন্টির মতো সুন্দর! কিন্তু নাটক শুরু হতে না হতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। মেজাজ খারাপ করে বাইরে বের হয়ে এলাম। বাইরে অন্ধকার, জোনাক পোকারদল। অপলি বলেছিল, ‘আমার মনে হচ্ছিল এমনটা হবে।’ আমরা অন্ধকারে বসে উল্টো করে ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত গুণলাম বহুবার। কিন্তু দশটা বেজে গেলেও বিদ্যুৎ আসেনি। আমরা যার যার ঘরে ফিরে গেলাম। বিদ্যুৎ এলো অনেক পরে। সাড়ে দশটার দিকে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কি হয়ে গেছে! দেখতে পারলাম না। মাকে বলে মজনু ভাইয়ের কাছে গেলাম। মজনু ভাই ঘরে ছিল না। ভেবেছিলাম, মজনু ভাই বোধহয় অপলিদের বাসায়। দোতলায় উঠে সেখানেও পাইনি। নামার সময় মনে হলো, ছাদে নাকি! অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে ছাদে উঠলাম। ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন মজনু ভাই। আমার উপস্থিতিতেই ছুঁড়ে ফেললেন সিগারেট। ইতস্তত কণ্ঠে জানতে চাইলেন ‘কে?’ বললাম, ‘আমি।’

 

৮.
‘ফাঁসি হলেই কি আর না হলেই কি! ধর ফাঁসি হয়নি। তাহলে কী হবে? মুনার সাথে বাকেরের বিয়ে হবে? তুই কি চাস, মুনার সাথে বাকেরের বিয়ে হোক? আর যদি ফাঁসি হয়ে যায়! তবে হোক। মুনাদের জন্য পৃথিবীতে অনেক বাকের থাকে। শোন্, আমরা সমাজকে যেভাবে দেখি। সেটা কাপড়ে মোড়ানো। ভেতরের সমাজটা অন্যরকম।’ এইসব বলছিলেন মজনু ভাই। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। মা বকবেন ভেবে বলেছিলাম, আমি যাই মজনু ভাই।

মজনু ভাই ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘সিগারেট খাই এ কথাটা কাউকে বলিস না।’ বলেছিলাম, ‘আচ্ছা। বলব না।’ আমার দিকে ইয়ো ইয়োটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘শোন, ইয়ো ইয়োটা নিয়ে যা। তোকে দিয়ে দিলাম।’

‘ওটা দিতে হবে না, কাউকে বলব না।’

‘তারপরও নিয়ে যা।’

আমি ইয়ো ইয়োটা নিয়ে দৌড়ে চলে এলাম। মজনু ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠেছিল। এতো ভালো মজনু ভাই! ফিরে এসে মাকে বলেছিলাম, দেখো, মজনু ভাই আমাকে এটা দিয়ে দিয়েছেন। তারপর গভীর রাত পর্যন্ত ইয়ো ইয়ো চালনায় দক্ষ হওয়ার চেষ্টা।

 

৯.
সকালের ঘুম থেকে যখন জাগলাম তখন ঘড়িতে নয়টার কাঁটা ছাড়িয়ে যায়। মা ডেকেছিলেন, ঘুমের জন্য উঠতে পারিনি। ফলত স্কুল কামাই। মায়ের বকাঝকা। বাবা বলেছিলেন, ‘এক আধ দিন স্কুল কামাই করলে কিছু হয় না। বকো না।’ আমি উঠে খেয়ে-দেয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এগারোটার দিকে মা ডেকে বললেন, ‘যা, বকফুলগাছ থেকে কিছু বকফুল পেড়ে নিয়ে আয়। বকফুলের বড়া বানাব।’ অপলিদের বাড়ি লাগোয়া বকফুলগাছ। তার পাশেই একটা বড়ো আমগাছ। অপলি তখন স্কুলে। বকফুল পাড়তে আমগাছে চড়ে বসি। আমগাছে চড়ে দোতলায় অপলিদের জানালায় চোখ পড়ে। আর তখন আমি এক গোপন পৃথিবীর মুখোমুখি হয়ে যাই। আমি চাইছিলাম অদৃশ্য হয়ে যেতে। তাকিয়ে থাকা চোখগুলো যেন আমাকে না দেখে। আমি এ গোপন জানতে চাইনি। এ জানা আমাকে ভারী করে তোলে! এই গোপন আমি কাকে বলব! কার কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করব— এই জ্ঞান মুছে দিয়ে আমাকে মূর্খ করে দাও! আমার এই সত্যের চেয়ে মিথ্যার দিকে দৌড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আমি গাছ থেকে নেমে দৌড়ে পৃথিবীর আর কোথাও চলে গিয়েছিলাম।

আমি উঠে খেয়ে-দেয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এগারোটার দিকে মা ডেকে বললেন, ‘যা, বকফুলগাছ থেকে কিছু বকফুল পেড়ে নিয়ে আয়। বকফুলের বড়া বানাব।’ অপলিদের বাড়ি লাগোয়া বকফুলগাছ। তার পাশেই একটা বড়ো আমগাছ। অপলি তখন স্কুলে।

 

১০.
তারপর আমি বাসায় ফিরিনি সন্ধ্যা অবধি। সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন হাতে ইয়ো ইয়ো। দোতলার বারান্দা থেকে অপলি নেমে এসেছিল। আমি তার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, সে শক্ত চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে। জানতে চাইল, ইয়ো ইয়ো কোথায় পেলে? আমিও কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলাম, মজনু দিয়েছে। দাঁতে দাঁত কামড়ে অপলি বলেছিল ‘মজনু ভাই দিয়েছে! না তুমি চুরি করে নিয়েছ? আরও কী কী যেন নাই ওর ঘরের! তোমার মায়ের কাছে সে বিচার দিয়ে গেছে! সারা কলোনিকে বলে বেড়াচ্ছে তুমি একটা চোর!’ তারপর আমার হাত থেকে ইয়ো ইয়োটা টান দিয়ে নিয়ে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মেরে দৌড়ে তাদের বাড়ির দিকে চলে যায় অপলি। আর ইয়ো ইয়োটা ভেঙে চূরমার হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।

 

১১.
ঘরে ঢুকে দেখি বাবা-মা স্থির হয়ে বসে। আমি মাথা নিচু করে তাদের সামনে। তারা কোনো কথা বলেননি। আমি তাদের চোখের দিকে চোখ রেখেছিলাম। এমন স্থির শীতল চোখ! আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছিল আঙুলে বাঁধা সুতোয় জড়ানো ছুঁড়ে দেওয়া একটা ইয়ো ইয়ো আমার সমস্ত কিছু নিয়ে মহাশূন্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে। নিজেকে তখন ভীষণ শূন্য মনে হচ্ছিল। পৃথিবীতে সেদিন গভীর অন্ধকারে সন্ধ্যা নেমে আসে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম বাংলাদেশে। প্রকাশিত গল্পের বই 'আনোহাবৃক্ষের জ্যামিতি'।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।