আপস্টেট নিউইয়র্কের ছোট্ট শহর সিরাকিউস; প্রায় দেড় দশক আগে তুষারঝড়-খ্যাত হাড়-কাঁপানো শীতের এই শহরটায় আমি ছিলাম প্রায় এক বছরের মতো। মার্কিন সরকারের ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলাম ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্সট্রাক্টর হিসেবে। আমার কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা পড়ানো। এর পাশাপাশি প্রোগ্রামটির আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিভাগের কারিকুলামের প্রায় যে কোনো কোর্স, যেগুলোর কোন pre-requisite নেই, নেওয়ার স্বাধীনতাও ছিল।
তো সেবার উইন্টার সেমিস্টারে নানা ধরনের কোর্স ঘেঁটে শেষমেশ ফিকশান রাইটিংয়ের একটা কোর্স নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোর্সটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের আওতাভুক্ত। নিয়ম-অনুযায়ী কোর্সে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে কোর্স প্রফেসরকে ই-মেইল করলাম। তিনি আমাকে তিন দিন পরের এক সন্ধ্যায় শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে কোণের একটা কফিশপে আসতে বললেন। অর্থাৎ আমার সাথে কথা বলার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে তিনি আমাকে কোর্সটাতে নেবেন কি না।
তথাস্তু।
সেদিন দুপুর থেকেই অনবরত তুষার পড়ছে; ঘোলাটে আকাশ আর হাড়ের ভেতর চিনচিনে ব্যথা তৈরি করা শোঁ শোঁ বাতাসে বের হওয়ার কথা ভাবতেই অবশ লাগছে। কিন্তু যেতে হবে কারণ আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের কোর্স করব।
এরকম আবহাওয়ায় সাধারণত বাস-পাতাল-ট্রেন সবই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে আসে। সেটা মাথায় রেখেই চল্লিশ মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিতে দুই ঘন্টা আগেই বের হয়ে পড়লাম। কিছুটা বাসে, কিছুটা পাতাল রেলে আবার কিছুটা হেঁটে কাঁপতে কাঁপতে এসে পৌঁছালাম নির্ধারিত কফিশপটায়। কফিশপের লোহার সিঁড়িটার দুইপাশে প্রায় সাড়ে তিন ফিট তুষার জমে আছে; আশপাশের সবকিছুও ছেয়ে আছে নাতিশুভ্র তুষার-কুঁচিতে। কফিশপের সামনে রাখা তিনটা গাড়ির ছাদ, ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনের ইয়ার্ড, সামনের পার্কিং লট।
তুষার-বুট পরা পায়ে মোটামুটি ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকে জানালার পাশের একটা ছোট্ট গোল টেবিলের দখল নেওয়ার আগে অর্ডার করলাম এক কাপ ধোঁয়া-ওঠা কফি। কাউন্টারের মেয়েটা হাসিমুখে বলল— ‘ইউর কফি উইল বি রেডি ইন সিক্স মিনিটস।’
তুষার-বুট পরা পায়ে মোটামুটি ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকে জানালার পাশের একটা ছোট্ট গোল টেবিলের দখল নেওয়ার আগে অর্ডার করলাম এক কাপ ধোঁয়া-ওঠা কফি। কাউন্টারের মেয়েটা হাসিমুখে বলল— ‘ইউর কফি উইল বি রেডি ইন সিক্স মিনিটস।’
এই সময়টায় কাস্টমার কম। কফিশপের মাঝামাঝি একটা টেবিলে ফেডোরা হ্যাট আর জিন্স পরা সত্তোরোর্ধ এক বুড়ো বসে কফি খাচ্ছে আর কোনায় জবরজং মাদুলি ঝোলানো এক স্বর্ণকেশী জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পাতাল রেলের শেষ স্টপে মেয়েটাকে মানুষের কাছে পয়সা চাইতে দেখেছিলাম।
কফিতে প্রথম চুমুকটা দিতেই একটা বেশ চনমনে স্বস্তি অনুভব করলাম। তবে একই সাথে এতক্ষণ শীতে কুঁকড়ি মেরে থাকা ভেতরের দলা-পাকানো টেনশনটা একটু উত্তাপ পেয়ে নড়েচড়ে উঠল। ফিকশান কোর্সের প্রফেসর আমাকে নেবেন তো তার কোর্সটাতে? না নেওয়ার কারণগুলো মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে ঘড়িতে দেখলাম প্রায় পৌনে পাঁচটা বেজে গেছে। শীতের এই সংক্ষিপ্ত দিনে আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই সূর্য ডুবে যাবে।
প্রফেসর আমাকে সময় দিয়েছেন সাড়ে পাঁচটায়। এতক্ষণ কী করব? ভাবতে ভাবতে আমার নোটবুকটা বের করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলাম। মনে মনে ভাবলাম ফিকশনের কোর্সটায় চান্স পেলে এই নোটবুকেই প্রথম গল্পের প্রথম ড্রাফট লিখব। যদিও নোটবুকের সব লেখা বাংলায় তবে এটাকে আধাআধি ভাগ করে দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজিতে লেখা যেতেই পারে। নোটবুক খুলে প্রথম পৃষ্ঠার একটা অর্ধসমাপ্ত লেখা পড়তে শুরু করলাম।
হঠাৎ বাম পাশ থেকে চিকন গলায় লোকাল অ্যামেরিকান অ্যাকসেন্টে কে যেন বলল—
‘আর ইউ এ রাইটার?’
তাকিয়ে দেখি কালো টি-শার্ট আর কালো বেসবল ক্যাপ পরা একটা মেয়ে, নিশ্চয়ই এখানকার ওয়েটার। মেয়েটা ঝুঁকে আমার নোটবুকের লেখাটার প্রথম ‘ব’-টার দিকে ইঙ্গিত করে বলল—
‘আই ডোন্ট নো হোয়াট ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ দিস বাট দিস লেটার লুকস লাইক এ পিৎসা স্লাইস।’
আমি হাসলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি মেয়েটা আমার জন্য চমৎকার একটা পিৎসা স্লাইস নিয়ে হাজির।
আমি বললাম যে আমি তো এটা অর্ডার করিনি। সে বাঁ দিকে মাথাটা ঝাঁকিয়ে একটা ঝকঝকে হাসি দিয়ে বলল— ‘দিস ইজ এ রাইটার’স ক্যাফে। হোয়েন এ রাইটার কামস হিয়ার ফর দ্য ফার্স্ট টাইম, আ স্লাইস অফ পিৎসা ইজ ফ্রি। দিস ইজ আওয়ার ওয়ে অফ ওয়েলকামিং হিম ইন্টু আওয়ার রাইটার্স কমিউনিটি।’
আমি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রফেসরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
কফিশপটা আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে থাকে। আমি প্রচ্ছন্ন হলুদাভ আলোর মধ্যে বসে হাবিজাবি ভাবতে থাকি। ছাদের স্পিকার থেকে একটা কান্ট্রি মিউজিকের সুর ভেসে আসছে। সুরটা একই সাথে করুণ, আবার কেমন দূরবর্তী আলোর মতো আশা-জাগানিয়া।
আমার মনে হলো প্রকৃতি কিছু কিছু জিনিস নিজের হাতে রেখে দেয় কখনো কখনো চমক দেখাবে বলে। যেমন সুর, যেমন আলো।
খুব যত্ন করে রেওয়াজ করে মঞ্চে ওঠা শিল্পীর গলায় যে সুর ধরা দেয় না, কোনো নিশুতি রাতে কুয়াশা আর অন্ধকারের যুগলবন্দির মধ্যে সে সুর ঝিকিয়ে ওঠে মদ্যপ কোনো রেওয়াজবিহীন শিল্পীর গলায়। এই যেমন দূরদেশের এই অচেনা সুরটা।
আবার যেমন এই নিরালা শীতসন্ধ্যায় সারা দিনের ঘোর ব্যস্ত থেকে আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে থাকা কফিশপটার কাউন্টারটপের ওপাশের আলোটুকুর কথাই ধরা যাক। ওয়েটার মেয়েটা এখন অন্ধকারমুখে, কী জানি ম্যানেজারের ধমক খেয়েছে কি না, অ্যামেরিকানো বা লাতে বা ক্যাপুচিনো বানাচ্ছে। ওর মাথার ওপরের বাল্ব থেকে আসা হলুদ আলোটা যেন অচেনা কোনো ম্যাজিক লন্ঠনের আলোর মতোই ওকে ধারণ করে আছে।
আমার মনে হলো আলোটা যখন হয়ে উঠছিল— তখন জানালার ওপাশে শীতের সন্ধ্যাটা একটা পাখির মতোই নেমে এসেছিল। সারা দিন অচেনা থেকে সন্ধ্যার মুখে মুখে আবার চেনামুখ হয়ে ওঠা পাখিটা আস্ত একটা দিনকে যে ঢেকে দিচ্ছিল নিজের বিশাল কালো পাখা দুটির ছায়ায়…
তখন এই একটু আগে সবচেয়ে কোনার টেবিলের ফেডোরা হ্যাট পরা সত্তোরোর্ধ আমুদে বুড়োটা এইমাত্র পাওয়া গরম কফির কাপটাতে চামড়া-রঙের একটা ওয়ান টাইম কাঠি নাড়ছিল…
তখন কফিশপের ভেতরে আশ্রয় নেওয়া বুড়িয়ে যাওয়া চেহারার মাঝবয়েসি হোমলেস মেয়েটা শেষ মুহূর্তের কিছু রোজগারের আশায় কফিশপের বাইরে দাঁড়িয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া কাস্টমারদের উদ্দেশ করে তার খালি কাগজের কাপে জমা পড়া পয়সাগুলো ঝিনিক ঝিনিক শব্দ তুলে নাড়ছিল…
তখন আমি একটা ওভেনফ্রেশ পিৎসাতে কামড় বসিয়ে ভেতরের মেল্টেড চিজটুকুকে আমার গোঁফে লেপ্টে যেতে দিচ্ছিলাম…
ঠিক ওই সময়টায়ই প্রকৃতির বন্ধমুঠি থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য ছাড়া পেয়ে আলোটা স্থির হয়ে বসল অ্যামেরিকানো বা লাতে বা ক্যাপুচিনো বানাতে থাকা মেয়েটার মাথার ওপর।
কখনো আহমেদ কোম্পানির অরেঞ্জ জেলি মাখানো স্কুলের বেঞ্চের আকারের লম্বা টোস্ট, কখনো বা সামনের আব্দুল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে আনা ধোঁয়া-ওঠা তেল-চুপচুপ মোগলাই পরোটা।
অথচ এই আলো আমার আজকের দেখা না। ঠিক এই আলোটাই আসতো আমাদের মালিবাগের ছোট্ট বাসাটায়। আব্বা, আম্মা, ছোটোবোন আর আমি যখন আমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট করা বেতের চেয়ারগুলোতে বসে আমাদের বিকালের চা খেতাম—কন্ডেন্সড মিল্ক আর সাদা চিনির গাঢ় লিকারের চা; সাথে কখনো সরিষা তেলমাখা মুড়ি-চানাচুর, কখনো সদ্য বাজারে আসা ডিম ফেটে ছড়িয়ে দেওয়া ফুজি ইন্সট্যান্ট নুডুলস, কখনো আহমেদ কোম্পানির অরেঞ্জ জেলি মাখানো স্কুলের বেঞ্চের আকারের লম্বা টোস্ট, কখনো বা সামনের আব্দুল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে আনা ধোঁয়া-ওঠা তেল-চুপচুপ মোগলাই পরোটা। ছোটোবোনটা তখন সদ্য প্রেমে পড়েছে; ল্যান্ডফোনে রিং বাজলেই দৌড়ে গিয়ে ধরে বলত—
‘হ্যালো স্লামালিকুম! কে বলছেন?’
আম্মার তখনো ডায়বেটিস ধরা পড়েনি, আব্বার স্ট্রোক করতে তখনো বহুবছর বাকি আর আমি ইন্টারমিডিয়েটে সায়েন্স না পেয়ে কমার্স পড়া কিন্তু দর্শনশাস্ত্র ও কবিতায় মজে থাকা ভাবুক কিশোর। যে শুক্রবারের সকালের অধিবেশনে দেখানো ‘গার্ল ফ্রম টুমরো’র আলানার প্রেমে পড়ত প্রতিবার।
আমার ভাবনার ঘোর ছিঁড়ে গেল একটা এসএমএস এর টুং শব্দে। আমার প্রফেসর লিখেছেন—
‘সরি, আজকে খারাপ আবহাওয়ার কারণে আমি আসতে পারছি না। আমি পরে আরেকদিন দেখা করব তোমার সাথে।’
জন্ম ঢাকায়। বর্তমানে কানাডা-প্রবাসী। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশায় শিক্ষক। পড়েছেন ও পড়িয়েছেন ঢাকা, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি ও টরন্টোতে। অনুবাদক ও ছোটোগল্পকার। লেখা প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা, দিল্লী ও ম্যানচেস্টার থেকে। ছোটোগল্পের বই ‘হ্যাঁ অথবা না-এর গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯-এ।