একজন নির্মোহ ও নিরেট প্রগতিশীল মানুষের এমন নীরবে চলে যাওয়া খুবই বেদনা ও বিষাদের। কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমের জীবনাচরণ আর দশজন কবির মতন নয় বলেই আজ তাঁকে ঘিরে শোক, শ্রদ্ধা ও স্মৃতি স্মরণের জন্য আমাদের এতো আকুলতা। তাঁকে ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগেই তিনি চলে গেলেন। আমাদের অপরাধী করে গেলেন চিরজীবনের জন্য।
এতো কিসের তাড়া ছিল কবির? কী এমন অবহেলা করেছি আমরা? কবি মাহমুদুল হাছান মাছুম আমাদের কারও ভাই, বন্ধু কিংবা পিতাসম। মানুষটি কোনোকিছু না বলেই চলে গেলেন পরপার নামক এক অজানা পাড়ে। যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেন না। এই না আসাটাই আবশ্যিক সত্য। তবুও তাঁর এই চলে যাওয়াকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে— ভেতর থেকে ভাষাহীন কোনো এক অপরাধী সত্তা ডুকরে কেঁদে উঠছে।
কেউই মাছুম ভাইকে ভুলতে পারছি না— ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি এতই প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন— যাকে দেখলে কখনোই মনে হতো না তাঁর বয়স ষাট বা তার অধিক। বয়স দিয়ে তাঁকে কখনো মাপা যায়নি। বয়সের সকল গাম্ভীর্যতাকে পাশ কাঁটিয়ে মাছুম ভাই আমাদের সাথে কথা বলতেন, হাসতেন, গাইতেন ও আনন্দ করতেন। লোভ-লালসা-হিংসা-বিদ্বেষ তার মধ্যে ছিঁটেফোঁটাটুকুও ছিল না
মাছুম ভাই ব্যক্তিগতভাবে আমার বন্ধু ও পিতাতুল্য ছিলেন। মাত্র তিন বছরের পরিচয়কে মনে হচ্ছে তিন যুগের মতন। আজ সেই তিন যুগের বোঝাপড়ার ভার বহন করতে হচ্ছে। আমরা কেউই মাছুম ভাইকে ভুলতে পারছি না— ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি এতই প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন— যাকে দেখলে কখনোই মনে হতো না তাঁর বয়স ষাট বা তার অধিক। বয়স দিয়ে তাঁকে কখনো মাপা যায়নি। বয়সের সকল গাম্ভীর্যতাকে পাশ কাঁটিয়ে মাছুম ভাই আমাদের সাথে কথা বলতেন, হাসতেন, গাইতেন ও আনন্দ করতেন। লোভ-লালসা-হিংসা-বিদ্বেষ তার মধ্যে ছিঁটেফোঁটাটুকুও ছিল না। এতো নির্মোহ ও আন্তরিক জীবনকে একজন কবি ছাড়া আর কে ধারণ করতে পারে? কে পারে বন্ধু হয়েও পিতার মতো স্নেহ করতে? তা একজন মানুষই পারতেন, তিনি মাছুম ভাই— আমাদের কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম।
মাছুম ভাই পাহাড় বড্ড ভালোবাসতেন। তার মনের ভেতর যে দেশটি আছে পাহাড়বেষ্টিত সবুজাভ এক অরণ্য। তিনি একাই সেখানে বিচরণ করেন। নগরের যত কোলাহল, যত অসভ্যতা সবকিছুকে পাশ কাঁটিয়ে তিনি চলতেন একটি সহজ পাহাড়ের মতন। মাছুম ভাই চলে যাওয়ার আগের দিনও তিনি পাহাড়ে ছিলেন। নিজের জীবনকে পাহাড়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন। আজ পাহাড়ের বুকেও আদিবাসীদের ক্রন্দনরোল ধ্বনিত হচ্ছে। তিনি পাহাড়ের সহজ ও সজীবতাকে আগলে ধরেছেন নিজের কবিতায় ও বুকে। তিনি জুমখেতের অঙ্কুরিত বীজ কুড়িয়ে পকেটে রেখে দিতেন, যাতে পরবর্তী মৌসুমে সেই বীজ ছিটিয়ে দিতে পারেন জুমের মুক্ত খামারে। সেভাবে তাঁকেও শত শত আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা হৃদয়ের জুমখেতে ফলন্ত বীজের মতো জায়গা দিয়েছেন। কবির কবিতায়ও সেই আভাস পাওয়া যায়—
‘আশার বীজ কুড়িয়ে পকেটে রাখি
আর মৌসুমি পরিবর্তনের ভেতরে ছিটিয়ে দেই—
মুক্ত খামারে, কিছু বীজ খেয়ে যায় অনাহারী পাখি
অবশিষ্ট বীজ অঙ্কুরিত হয় মৌসুমি খেয়ালে।
বৃষ্টিপাত আর মাটির সঙ্গমে
বজ্রপাতের সকল বিপর্যয় কাটিয়ে
খোলস ফেটে বেরিয়ে আসে কচি অঙ্কুর
আমার চোখে স্বপ্ন হাসে—
বৈরী দুপুরের আগুনে ঘাম ভাসে
ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে আশার জাদু-বৃক্ষ।’
অপ্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ, ‘ঔপনিবেশিক অন্ধকার’।
কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমকে হারিয়ে যতটা শোকাগ্রস্ত তাঁর পরিবারের সঙ্গী, কন্যা ও স্বজনরা, তেমনই শোকের ছায়ায় ছেয়ে গেছে পাহাড় ও সমতলের শত্রু, বন্ধু, ভাই ও ভক্তকূলের হৃদয়। মাছুম ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনামাত্র আমার মতো হয়তো কেউই স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেননি। ৬ সেপ্টেম্বর খুব ভোরে খবর পেলাম মাছুম ভাই আর নেই। তখনই কান্নায় ভেঙে পড়ি। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। মাছুম ভাই আপনি কবে এতো কাছের মানুষ হলেন বুঝতেই পারিনি! আপনার চলে যাওয়া এত বেদনার হবে ভাবতে পারিনি। জীবনে চলার পথে আমাদের সকলকেই চলে যেতে হবে— কিন্তু এভাবে কেউ চলে যায়? এরকম বিনা নোটিশে?
গভীর শূন্যতা তৈরি করে গেলেন কবি, সেই শূন্যতা বুকে নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আপনি নিজেই চেয়েছিলেন তৈরি হোক শূন্যতা। একজন কবি নাকি ঈশ্বরের সমান শক্তি নিয়ে জন্মায়। কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমও কবিতায় সেই চিন্তা নিয়ে জন্মেছেন। যাকে মুছে ফেলা যাবে না— যার বিনাশ নেই। কবি তাঁর অপ্রকাশিত কবিতার বই ‘শ্মশানগামী জোছনা’য় বলছেন—
‘শূন্যতা সৃষ্টি হোক!
অপরিসীম শূন্যতার বিস্তারে
বাতাসে প্রবাহিত হোক
নির্জনতার নরম প্রাচুর্য।
পাতারা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকুক
খড়খড়ে মাটির রুগ্ন পাঁজরে
সরীসৃপ বুকে হেঁটে পেরিয়ে যাক
সমস্ত মধ্যবর্তী দুপুরের আগুন।
ফিজা ছেড়ে উড়ে গেছে
যাবতীয় পাখিদের গোত্র—
শিকারির ডান জুলফি বেয়ে
নেমে যাচ্ছে— এক ফোটা নিঃসঙ্গ ঘাম
আর নির্যাতিত উপকন্ঠে শ্মশানের উপক্রম।
আগুনের জলসা বসেছে—
রাজ্য পুড়ে উজাড় হয়ে গেলেও
রাজা-মন্ত্রী-শান্ত্রীদের ফোয়ারায় ঝরবে
নির্জলা সাম্রাজ্যবাদী মদের নির্যাস—
আমাদের অবহেলিত প্রশ্বাসের প্রতি
ঈশ্বরেরও কোনো বিশ্বাস নেই।’
কবিতার ভাষায় তিনি এনেছেন নৈসর্গিক ভিন্নতা। পাহাড়ের মতো জেগে আছে তাঁর কবিতার ভাবনা। কবির কবিতা পাঠ করলেই অনুভব করা যায় ট্রেনে চড়ার মতো একটি আবহ— সমান্তরাল লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ভাবনা। প্রেম, বিরহ, রাষ্ট্র, চিন্তা ও দর্শনের সকল অলিগলি দিয়ে চলেছে তাঁর কবিতার ট্রেনটি। মাঝে মাঝে নিজের চিন্তাকেও প্রশ্ন করছেন, অবজ্ঞা করছেন ও থুথু দিয়েছেন নিজের অপারগতাকে।
মাহমুদুল হাসান মাছুম আপাদমস্তক কবি ছিলেন, ছিলেন পাড় আড্ডাবাজও। আড্ডা তাঁর অক্সিজেন, কবিতা তাঁর খাদ্য। না হলে একটি মানুষ কীভাবে প্রতিদিন নিয়ম করে ঢাকা শহরের অসহ্য ৩-৪ ঘন্টার জ্যাম ঠেলে প্রতিদিন শাহবাগ, টিএসসি ও কনকর্ডে ছুটে আসে! মাছুম ভাই আর নিয়ম করে দুপুরে খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে ফোন দিবেন না, বলবেন না, ‘রানা, আমি খেয়ে বের হলাম। তুই থাকিস আলাপ আছে।’
মাহমুদুল হাসান মাছুম আপাদমস্তক কবি ছিলেন, ছিলেন পাড় আড্ডাবাজও। আড্ডা তাঁর অক্সিজেন, কবিতা তাঁর খাদ্য। না হলে একটি মানুষ কীভাবে প্রতিদিন নিয়ম করে ঢাকা শহরের অসহ্য ৩-৪ ঘন্টার জ্যাম ঠেলে প্রতিদিন শাহবাগ, টিএসসি ও কনকর্ডে ছুটে আসে! মাছুম ভাই আর নিয়ম করে দুপুরে খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে ফোন দিবেন না, বলবেন না, ‘রানা, আমি খেয়ে বের হলাম। তুই থাকিস আলাপ আছে।’ কবি আর কোনো কথা বলবেন না।
কবি যেদিন আমাকে দুটো পাণ্ডুলিপি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সেদিন বলছিলেন, ‘রানা, এই দুটো বই আমার শেষ বই।’ আমি এই কথা কোনোরকম কানে তুলিনি। কথাটা এতোটা সত্য হয়ে দাঁড়াবে ভাবিনি। তিনি ইউনিকোডে লিখতেন, কনভার্ট করে প্রুফ দেখার জন্য একটা প্রিন্ট দিয়ে দিলাম। যথারীতি তিন দিন পর লাল কলম দিয়ে দাগানো প্রুফ কপি এনে আমাকে দিলেন। বললেন, ‘বেশি ভুল নেই, কনভার্টের কারণে কিছু মাত্রা ও কিছু শব্দ ভেঙে গেছে।’ তারপর দুই দিন সময় নিয়ে প্রুফ দেখে তাকে জানালাম। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ ভাইয়ের কাছ থেকে ভূমিকা নেওয়ার জন্য যথারীতি তিনি আমার কাছ থেকে আবার প্রিন্ট নিলেন এবং সেলিম মোরশেদ ভাইয়ের কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনি চলে গেলেন। আর কিছু দিন সময় দেওয়ার অবসর তাঁর ছিল না। অবসর আর হবেও না। এই পৃথিবীতে আর সময় নেই তাঁর জন্য। নিজেকে কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে আড়ালে চলে গেলেন। কবি বেঁচে আছেন তাঁর কবিতায়—
‘আমরা যারা বেঁচে আছি!
তাদের ভেতরের কোনো কোনো অংশ মরে গেছে
নয়তো বা অসার হয়ে রয়েছে বোধের গ্রন্থি
ঢাকতে ঢাকতে আমরা একেবারে নগ্ন হয়ে যাচ্ছি।’
এখন মাছুম ভাই আমার পাশে বসে কথা বলছেন না, কিন্তু তাঁর গুছিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি দুটো আমার সাথে কথা বলছে প্রতিনিয়ত। লাল কলমে কাটা প্রুফগুলো হাতে নিয়ে দেখছি। কি সংশোধন করেছেন, কি যোগ-বিয়োগ করেছেন শব্দের শরীরে। প্রুফগুলো তিনি দেখে দেওয়ার আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘কোনো চাপ নিস না, যতো সময় লাগে নে। জীবনের কোনো তাড়া নেই।’ মাছুম ভাই ঠিক বলেছিলেন জীবনের কোনো তাড়া নেই, নেই খুব বেশি চাপ নেওয়ার।
মাছুম ভাই ছিলেন এক সশরীরি শব্দের প্রতিমূর্তি, নিজেকে ভাঙতেন-গড়তেন কাব্যিক স্রোতের ধারায়। তাঁর জীবনের শেষ কথা ছিল ‘ভালোবাসা’। ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো পথ নেই— পথ এই একটাই। আজ কবিকে হারিয়ে আমরা যে বেদনার নদীতে ভাসছি— সেই বেদনার নদীর পাড়ে দাড়িয়ে মাছুম ভাই হয়তো জীবনানন্দের ভাষায় বলছেন—
‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।’
লেখক ও প্রকাশক।