দুদিন ধরে মনে হচ্ছে, আমি একটা খুন করব।
একটা ছুরি আমার মুঠোয় ধরা, মেড ইন নেপাল। জিনিসটা কুকরি নামে পরিচিত, দেখতে অনেকটা ভোজালির মতো। তবে ভোজালির এত ওজন নেই। আমার হাতের কুকরিটার ওজন হাফ কেজির বেশি হবে। সূর্যের আলো ঠিকরে উঠছে ৯ ইঞ্চি ব্লেডে। মহিষের শিংয়ে বানানো হাতল। তার ওপর ইস্পাতের ফলা, মাঝ বরাবর সামান্য বাঁকানো। ব্লেডের নিচে যে জায়গাটা হাতলের সাথে এসে মিশেছে সেখানে একটা ঘোড়ার মাথাওয়ালা স্পাইক, দেখতে ত্রিভুজের মতো। এ রকম ধারালো জিনিসে হাত দিলেই গা শিরশির করে ওঠে। বুকের মধ্যে শিহরণ জাগে। গুর্খাদের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র হিসেবে খ্যাতি আছে এর।
জানালা গলে সকালের নরম আলো এসে রুমে ঢুকছে। আমি মুখ দিয়ে ভাপ ছাড়লাম। ধোঁয়ার মতো বের হলো। ছেলেবেলায় এই খেলা আমার খুব প্রিয় ছিল। এখন আমার বয়স সাতাশ বছর। তবু শীতকালে এই খেলাটা আমি খেলি। মুখের ভাপে গামছা দিয়ে ছুরিটা একবার মুছে নিলাম। ব্লেডের চকচকে ভাবটা আরও বাড়ল। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। খুন করার ইচ্ছেটা তীব্র হলো আমার।
যারা আমার হাতে খুন হতে পারে তাদের একটা সম্ভাব্য লিস্ট আমি মনে মনে তৈরি করেছি। এখন পর্যন্ত সে-ই লিস্টে আছে দুটো নাম। মেথড অব এলিমিনেশনে দুজনের যেকোনো একজনকে হয়তো আমি বাদ দেব। বাকি জন খুন হবে আমার হাতে।
যারা আমার হাতে খুন হতে পারে তাদের একটা সম্ভাব্য লিস্ট আমি মনে মনে তৈরি করেছি। এখন পর্যন্ত সে-ই লিস্টে আছে দুটো নাম। মেথড অব এলিমিনেশনে দুজনের যেকোনো একজনকে হয়তো আমি বাদ দেব। বাকি জন খুন হবে আমার হাতে। আবার দুজনকেও খুন করতে পারি। একটা খুনের যে সাজা দুটোরও সে-ই একই সাজা হওয়ার কথা।
অবশ্য খুন করে ধরা পড়লে তবেই না শাস্তির ব্যাপারটা আসবে। আমি ডিটেকটিভ উপন্যাসের পোকা। তিন গোয়েন্দা থেকে শার্লক হোমস কিছুই বাদ দিইনি। সব কটা কেসেই দেখা যায়, খুনি প্রায় নির্ভুলভাবে খুনটা করেছে। গোয়েন্দা-পুলিশ শত চেষ্টা করেও আসল খুনির নাগাল পাচ্ছে না। শুধু একেবারে শেষে গিয়ে সামান্য একটা ভুলের জন্য খুনি ধরা পড়ে যায়। গোয়েন্দা গল্প পড়তে পড়তে সে-ই ছোট ভুলগুলো আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। সে ধরনের ভুল আমি করব না, এটুকু কনফিডেন্স নিজের ওপর আছে।
অনুতাপের একটা ব্যাপার অবশ্য থেকেই যায়। খুন করলাম, ধরা পড়লাম না। কিন্তু বিশ্রী একটা অনুশোচনা আমাকে পেয়ে বসল! তখন? বুকের মধ্যে ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস জমা রেখে বেঁচে থাকতে হবে। সেটুকু ঝুঁকি না নিয়ে আমার উপায় নেই।
আমার জীবনটা চুরি হয়ে গেছে। অন্য আর দশটা ২৭ বছরের যুবকের মতোই হওয়ার কথা ছিল আমার জীবন, তিনভাগে ভাগ করা—শৈশব, কৈশোর আর যৌবন। দুজন লোক মিলে এগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে।
এর মধ্যে প্রথম চোর হলো বিধান সরকার। তিনি আমার শৈশব আর কৈশোর নষ্ট করেছেন। সম্পর্কে তিনি আমার বাবা। সমস্যা হচ্ছে, তাকে খুন করতে চাইলে প্রথমে জানতে হবে, লোকটা এখন কোথায় থাকে? কী করে? আমি নিশ্চিতভাবে তার সম্পর্কে কিছু জানি না। আবছাভাবে জানি, তিনি সিলেটের দিকে আছেন। তবে সেটা সত্য না-ও হতে পারে। এত দিন পর্যন্ত তার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। এখন মনে হচ্ছে, খোঁজ রাখা দরকার ছিল।
বাবাকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি আমার নেই। আমি যখন অনেক ছোট, ঝিনাইদহ শহরে থাকতাম আমরা। আমরা মানে আমি, বাবা আর মা। ও হ্যাঁ, আর একজন ছিল। আমার ছোট বোন। এক বছর বয়স ছিল তার। আমরা আদর করে ডাকতাম বুচি।
বাবার কথা ভাবলে অস্পষ্ট কিছু দৃশ্য তৈরি হয় আমার মাথার মধ্যে। তার মধ্যে একটা দৃশ্য হলো, সকালবেলা তিনি বাড়ির উঠোনে বসে আছেন। মুখে জলের ছিটা দিয়ে সাবানের ফেনা ঘষছেন। দাড়ি কামাবেন। এ সময় ঠোঁট দুটো গোল করে শিস বাজাতেন।
বাবার কথা ভাবলে অস্পষ্ট কিছু দৃশ্য তৈরি হয় আমার মাথার মধ্যে। তার মধ্যে একটা দৃশ্য হলো, সকালবেলা তিনি বাড়ির উঠোনে বসে আছেন। মুখে জলের ছিটা দিয়ে সাবানের ফেনা ঘষছেন। দাড়ি কামাবেন। এ সময় ঠোঁট দুটো গোল করে শিস বাজাতেন। তার চেহারা ছিল সিনেমার নায়কদের মতো। লম্বা-চওড়া লোক। গায়ের রংও ফরসা। মজা করে কথা বলতেন। চুল সব সময় পরিপাটি করে আঁচড়ানো থাকত।
বিজ্ঞানের সূত্রমতে, বাবার থেকে ২৩টা ক্রোমোজম আমার পাবার কথা ছিল। একটাও পাইনি। আমি বেঁটেখাটো মানুষ, হাইট মেরেকেটে পাঁচ ফিট দুই-আড়াই ইঞ্চি হতে পারে। গায়ের রং কালো, পোড়া বেগুনভাজির মতো। দশজনের মধ্যে দাঁড়ালে আমার দিকেই সবার শেষে চোখ পড়বে। কথাবার্তায় ছিরিছাঁদ নেই। মিনমিনে করে গলা দিয়ে স্বর বের হয়। কেবল মায়ের দেওয়া ২৩টা ক্রোমোজমে ভর করে নিদারুণভাবে আমি এই পৃথিবীতে টিকে আছি।
বাবা ছিলেন মোটর মেকানিক। নিজের একটা গ্যারেজ ছিল ঝিনাইদহ শহরে। যেকোনো মোটরসাইকেল বা গাড়ি তিনি ঠিক করে দিতে পারতেন চোখের নিমেষে। আয়রোজগারও ভালো ছিল। দুহাতে টাকা খরচ করতেন। আমোদ, ফুর্তি করতে খুব ভালোবাসতেন। নেশা-ভাং করার অভ্যাস তার ছিল না। এমনকি বিড়ি-সিগারেটও খেতে দেখিনি কখনো। এত দিলখোলা লোকটা আমার সাথে কথাবার্তা খুব একটা বলতেন না। মাঝেমধ্যে শুধু গম্ভীর গলায় বলতেন, ইংরেজিটা ভালো করে পড়িস। ইংরেজিটাই আসল।
আমি তখন মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। সন্ধ্যাবেলা ৬০ পাওয়ারের বাল্বের হলুদ আলোয় বসে বসে মুখস্থ করি—এ ফর অ্যাপল, বি ফর বল, সি ফর ক্যাট। জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম, বাবা বাড়িতে ফিরছেন। কোনো দিন তাকে খালি হাতে ফিরতে দেখিনি। খেলনা পুতুল বা বেলুন কিছু একটা তার হাতে থাকত। তিনি সেটা বুচির হাতে তুলে দিতেন। আমি পড়ার টেবিলে বসে বসে দেখতাম। বুচিকে বাবা খুব ভালোবাসতেন। সবাই বলত, সে পুরোপুরি বাবার চেহারা পেয়েছে। টুকটুকে চেহারা, গাল দুটো ফোলা ফোলা। দেখলেই কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে হতো। আমি আর বুচি যে একই মায়ের পেটের ভাই-বোন বিশ্বাস করা শক্ত ছিল। সেই বয়সেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমার ছোট্ট বোনটা জিতে গেছে।
বুচি মাত্র দুদিনের জ্বরে ধড়ফড় করে হেরে গেল। তার বয়স তখন দেড় বছর। প্রথম দিন সে সারা দিন খুকখুক করে কাশল। রাতে আকাশ-পাতাল জ্বর এলো। বাবা গিয়ে বেলায়েত ডাক্তারকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে বললেন, সিজন চেঞ্জের জন্য এ রকম হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে।
কিছুই ঠিক হলো না। পরদিন সন্ধ্যায় বুচি চলে গেল আমাদের ছেড়ে। সে-ই থেকে আমার বাবা বিধান সরকার একেবারে চুপ মেরে গেলেন। খুব প্রয়োজন না হলে কথা বলতেন না। ভোরে দাড়ি কামাবার সময় শিস দিয়ে সুর তোলা বন্ধ হয়ে গেল। রাতে দেরি করে বাড়ি ফিরতেন। তার আরও একটা রোগ হলো সে সময়। অদৃশ্য হওয়ার রোগ। মাঝেমধ্যেই গায়েব হয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম এক-দুই দিনের জন্য। মা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতেন না।
ধীরে ধীরে তার গায়েব থাকার সময়টা বাড়তে লাগল। সংসার থেকে পুরোপুরি মন উঠে গিয়েছিল বাবার। আমার বয়স যখন সাত বছর তিনি চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অদৃশ্য হওয়ার আগে তিনি গোপনে তার গ্যারেজটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল বেশ চালু একটা গ্যারেজ। বিক্রি করে অনেকগুলো টাকা হাতে পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। সেই টাকা নিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন। তারপরও প্রায় তিন মাস আমার মা অপেক্ষা করেছিলেন বাবার ফিরে আসার। একসময় আর না পেরে মা তার বাবার বাড়িতে খবর পাঠালেন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, মায়ের হাত ধরে আমি ঝিনাইদহ থেকে বাসে উঠেছিলাম। আমাদের সাথে ছিল ছোট-বড় অনেকগুলো ব্যাগ। মেজমামা আমাদের নিতে এসেছিলেন।
মামাতো ভাই-বোনেরা মই বেয়ে উঠে সে-ই বাসা থেকে পাখির বাচ্চা পেড়ে আনত। এটা ছিল তাদের এক নির্মম খেলা। এই খেলায় তারা আমাকে কখনো সাথে নেয়নি। কেউ মিশতে চাইত না আমার সাথে। আমি ছিলাম এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।
বাসে করে আমরা বোয়ালমারী চলে এলাম। সেখানে আমার মামাদের বাসা। একতলা একটা সাদা রঙের বিল্ডিং। পুরোনো দিনের অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। বাড়িজুড়ে ছিল বিশাল বিশাল সব জানালা আর ভেন্টিলেটর। ভেন্টিলেটরে খড় দিয়ে চড়ুই পাখি বাসা বানিয়েছিল। শয়ে শয়ে চড়ুই সারা দিন কিচিরমিচির করত। মামাতো ভাই-বোনেরা মই বেয়ে উঠে সে-ই বাসা থেকে পাখির বাচ্চা পেড়ে আনত। এটা ছিল তাদের এক নির্মম খেলা। এই খেলায় তারা আমাকে কখনো সাথে নেয়নি। কেউ মিশতে চাইত না আমার সাথে। আমি ছিলাম এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।
লোকে বলাবলি করত, আমার বাবা ইন্ডিয়া চলে গেছে। সেখানে তার অন্য একটা সংসার আছে। সেই সংসারে বউ আছে আর একটা ছেলে। সেই ছেলে আমার মতো ভুইত্যা কালা না, গায়ের রং দুধের মতো সাদা। তারা কোত্থেকে এসব তথ্য পেয়েছিল আমি জানতাম না। স্কুলে বন্ধুরা আমাকে টিজ করত, দু-একজন স্যার পর্যন্ত আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত।
আমার সময় কাটত না। স্কুলে কোনো বন্ধুবান্ধব জোটাতে পারিনি। মাকেও আমার অসহ্য লাগত। আমি আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলাম বইয়ের কাছে। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিটা ছিল বড়। মফস্বলের কোনো স্কুলে এ রকম লাইব্রেরি থাকতে পারে ভাবা যায় না। আমি প্রতিদিন একটা করে বই বাসায় নিয়ে আসতাম। মুখ গুঁজে সেই বই পড়তাম। চারপাশের জগৎটাকে অস্বীকার করে নিজের একটা পৃথিবী বানিয়ে সেই পৃথিবীতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।
যে বছর আমি ক্লাস নাইনে উঠলাম, আমার এক মেসো খবর নিয়ে এলেন, বাবাকে নাকি দেখা গেছে। জাফলং বর্ডারের কাছে। বিশ্বস্ত সূত্রে তিনি খবর পেয়েছেন, সেখানে একটা ছোট গ্যারেজ দিয়েছেন। আমতা আমতা করে মেসো আরও বললেন, সেখানে আমার বাবা আর একটা বিয়ে করেছেন।
এই কথা শুনে বড়মামা মহা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, ফাইজলামি নাকি? যা খুশি তাই করবে? রেণুরে ছাইড়া আর একটা বিয়া করবে? কইলেই হইল? কেস করে দেব। মাদারচোতরে আমি জেলের ভাত খাওয়াব। রেণু তুই চল, আইজই আমরা জাফলং যাব।
মা বুকে পাথর বেঁধে বলেছিলেন, না।
সেই না আর হ্যাঁ হয়নি। তিন মামা মিলে অনেক বোঝালেন। কিন্তু আমার মা এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন, যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না। কেস-ফেস করে কিছু হয় না।
আমার শৈশব ও কৈশোর—দুটোই চুরি হয়ে গিয়েছিল। জুন মাসের যে দুপুরে আমি আর আমার মা ঝিনাইদহ টু বোয়ালমারী বাসে উঠেছিলাম—সেই দুপুরেই।
বাবাকে ক্ষমা করা কি আমার পক্ষে সম্ভব?
এইচএসসি পাস করার পর আমি ঢাকায় চলে আসি। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই। আমার ছোটমামা মেসে থাকতেন। তার সাথে এসে উঠি। সেই মেসে এখন আমার আট বছর পার হয়ে গেছে। মামা বছর তিনেক হলো বিয়েশাদি করে রামপুরা বনশ্রী চলে গেছেন। আমার কোথাও যাওয়া হয়নি।
মেসে আমি একা এক রুমে থাকি। কাঁটাবনে একটা সরু গলির মধ্যে এই মেস। নোনাধরা পুরোনো একটা বিল্ডিংয়ের চারতলায় আমার রুম। মা মারা গেছেন চার বছর হলো। যখন তিনি বেঁচে ছিলেন মাঝেমধ্যে বোয়ালমারী যেতে হতো, এখন আর কোনো পিছুটান নেই।
আমার গা থেকে নাকি বোঁটকা গন্ধ বের হয়। অনেকেই বলে। কোনো ব্যাপারে সব লোক একসঙ্গে একমত হয়ে গেলে সেটা মিথ্যা না হবার সম্ভাবনাই বেশি। আসলেই হয়তো আমার গা থেকে বোঁটকা গন্ধ বের হয়। আমি টের পাই না। তবে এই ব্যাপারে কোনো রিস্কে যাওয়া যায় না। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে লাক্স সাবান দিয়ে গা ডলে ডলে স্নান করি।
আমার গা থেকে নাকি বোঁটকা গন্ধ বের হয়। অনেকেই বলে। কোনো ব্যাপারে সব লোক একসঙ্গে একমত হয়ে গেলে সেটা মিথ্যা না হবার সম্ভাবনাই বেশি। আসলেই হয়তো আমার গা থেকে বোঁটকা গন্ধ বের হয়। আমি টের পাই না। তবে এই ব্যাপারে কোনো রিস্কে যাওয়া যায় না। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে লাক্স সাবান দিয়ে গা ডলে ডলে স্নান করি। এমনকি শীতের দিনেও। না হলে মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করে।
চুলায় স্নানের জল গরম হচ্ছে। আমি অপেক্ষা করছি। আমি ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলাম। চুলায় জল চাপানোর পর ১৫ মিনিট কেটে গেছে। রান্নাঘরে গিয়ে বালতিতে সেই জল ঢেলে নতুন করে চায়ের জন্য জল তুলে দিলাম। স্নান সেরে চা খেয়ে রাস্তায় নামলাম। ঘড়িতে তখন ১০টা বেজে ৩৫ মিনিট। মোড়ের দোকানে গিয়ে বুড়ো দোকানিকে বললাম, ৫টা গোল্ডলিফ।
পাড়ার এই দোকান থেকে আমি প্রতিদিন সিগারেট কিনি। বের হওয়ার সময় ৫টা আর ফেরার সময় ৫টা। সেই হিসেবে অ্যাভারেজে ৩০০ সিগারেট কেনা হয় মাসে। বুড়োর বান্ধা কাস্টমার আমি। আমাকে তার বেশ খাতির করার কথা। অথচ ব্যাটা আমাকে পাত্তাই দেয় না! পাত্তা দেওয়ার মতো মানুষও আমি অবশ্য না। মুদি দোকানদার কেন, কেউই আমাকে পাত্তা দেয় না।
আমাকে দাঁড়া করিয়ে রেখে বুড়োটা অন্য এক লোকের কাছে প্রথমে সয়াবিন তেল বিক্রি করল। আয়েশ করে লুঙ্গির ওপর দিয়ে পাছা চুলকাল কিছুক্ষণ। তারপর সিগারেটের প্যাকেটে হাত বাড়াল। এর মধ্যেই মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা এসে ভ্যানিলা আইসক্রিম চাইতেই সে সিগারেট ফেলে ছুটে গেল মহিলার কাছে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আইসক্রিম কেনার পর মহিলার মনে পড়ল ময়দা কেনার কথা। বুড়ো ময়দার প্যাকেটে হাত দিতেই আমি গলা ভারী করে বললাম, কী ব্যাপার! আপনি আমার সিগারেট দেবেন, নাকি দেবেন না? অন্য দোকানে যাব?
গলার স্বর শুনে নিজেই চমকে উঠলাম। মিনমিনে আওয়াজটা আর নেই। বদলে গেছে। নিজের কাছেই অন্যরকম শোনাল সে স্বর।
আমার কোমরে কুকরিটা গোঁজা। এ রকম জিনিস সাথে থাকলে গলায় জোর আসে। আমি মৃদু চাপ দিয়ে জিনিসটার অস্তিত্ব একবার অনুভব করলাম। চামড়ার খাপে মোড়ানো ছুরিটা। সাইজে বেশ বড় বলে প্যান্টের পকেটে আঁটে না। শার্টের নিচে গুঁজে রেখেছি। শার্টটা সামান্য ফুলে আছে। ওপরে একটা ডেনিম জ্যাকেট চাপানো বলে বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। কেউ আন্দাজই করতে পারবে না কোমরে এ রকম ধারালো অস্ত্র নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি।
শাহবাগ পর্যন্ত একটা রিকশা ঠিক করলাম। অন্যদিন রিকশাওয়ালার সাথে মিনমিন করে দর-কষাকষি করি। সে ২৫ টাকা বললে আমি মুখ বাঁকিয়ে বলি, ১৫ টাকা। ২০-এর ওপরে কোনোভাবেই উঠি না। আজ সে রকম কিছু করলাম না। একটা রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল গলির মুখে। লাফ দিয়ে উঠে বললাম, শাহবাগ।
আমি যাব এডিটিং প্যানেলে। প্যানেলটা বারিধারা ডিওএইচএসে। সেখানে আমাদের ফিল্মের এডিটিং শুরু হবে আজ। এর আগে টানা দুমাস শুটিং করেছি।
সোহিনী কথাচিত্রের ব্যানারে তৈরি হচ্ছে ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম ‘উদ্বাস্তু’। আশুতোষ রানা সেই সিনেমার পরিচালক। আমি চার বছর ধরে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছি। আমি ছাড়া আরও তিনজন এডি আছে রানা ভাইয়ের টিমে।
ফিল্ম মেকিংয়ের সাথে আমার জড়িয়ে পড়ার ইতিহাসটা প্যাথেটিক ধরনের। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমার জীবনে কিছু পরিবর্তন আসে। দু-চারটা বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। বাইরের পৃথিবীর আলো আমার চোখে এসে পড়ে। আমি তখন লোভে পড়ে গেলাম। মানুষের সাথে মেশার লোভ। এর আগে সামান্য প্রশ্রয়ও পাইনি কখনো বন্ধুদের কাছ থেকে।
ঢাকা শহরে নতুন যে ছেলেদের সাথে আমি মিশতাম, তারা আমার ইতিহাস জানত না। আমার বাবা যে মাকে ছেড়ে চলে গেছে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার চেহারাও অত গুরুত্বপূর্ণ নয় তাদের কাছে। তাদের কাছে আমি ছিলাম ঠিক তাদের মতোই আর একজন সাধারণ মানুষ।
সেকেন্ড ইয়ারে পড়া অবস্থায় দুই বন্ধু যখন বলল তারা একটা ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশনের কোর্সে ভর্তি হবে, আমি শুধু তাদের সাথে সময় কাটানোর লোভেই সে-ই কোর্স এনরোল করে ফেললাম। ছোটবেলা থেকেই একা একা থাকতাম বলে আমার চিন্তাভাবনা ছিল একটু আলাদা রকমের। সবাই যেভাবে ভাবত তার চেয়ে আমার ভাবনার ধরনটা ছিল আলাদা, বেশ উইয়ার্ড। প্রচুর বই তত দিনে পড়া হয়ে গেছে। নিজে নিজে স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। সেই ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে আমি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফার্স্ট হয়ে গেলাম।
এরপর আমার মাথায় ফিল্ম মেকার হবার ভূত চেপে বসে। সেই ভূত আজও নামেনি। দু-একটা ভূত মাথায় না থাকলে বেঁচে থাকা কঠিন। আশুতোষ রানার ফোর্থ এডি হিসেবে যখন কাজ শুরু করেছিলাম, ভেবেছিলাম একদিন নিজেই ডিরেকশন দেব। রানা ভাইও সে রকম আশ্বাস দিয়েছিলেন। এখন বুঝি, সেগুলো ছিল টোপ। মুলা ঝুলিয়ে গাধার মতো খাটানো।
আশুতোষ রানা বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির ফিল্ম মেকার। বাইরের পৃথিবীর কাছে শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র। নারীঘটিত কোনো কেলেঙ্কারির সাথে তার নাম নেই। মিডিয়ার সবাই তাকে দেবতা বলে মানে। তবে এটা ওপরে ওপরে। আমি তার সাথে খুব ভালো করে মিশেছি বলে জানি, সে একটা জোঁকের মতো। রক্ত শুষে খায়। চার বছর ধরে একটু একটু করে আমাকে শুষে নিচ্ছে।
আমার সাথে তার চুক্তিটা হচ্ছে দিন হিসেবে। আমি যে কদিন শুটিং করব সে আমাকে পার ডে দেড় হাজার টাকা হিসাবে দেবে। শুটিং ছাড়া যদি এডিটিংয়ে বসতে হয়, বা লোকেশন হান্টিং বা প্রপস ম্যানেজমেন্টের কাজ করতে হয়, তাহলে সেদিনের রেমুনারেশন হিসেবে পাব সাড়ে সাত শ টাকা। নেহায়েত দিনমজুর টাইপের চুক্তি। রাত-দিন এক করে অমানুষিক পরিশ্রমে পেটেভাতে থাকা।
আমার সাথে তার চুক্তিটা হচ্ছে দিন হিসেবে। আমি যে কদিন শুটিং করব সে আমাকে পার ডে দেড় হাজার টাকা হিসাবে দেবে। শুটিং ছাড়া যদি এডিটিংয়ে বসতে হয়, বা লোকেশন হান্টিং বা প্রপস ম্যানেজমেন্টের কাজ করতে হয়, তাহলে সেদিনের রেমুনারেশন হিসেবে পাব সাড়ে সাত শ টাকা। নেহায়েত দিনমজুর টাইপের চুক্তি। রাত-দিন এক করে অমানুষিক পরিশ্রমে পেটেভাতে থাকা। এই অল্প কটা টাকাও সে বাকি রাখে। বেশ ভালো অঙ্কের রেমুনারেশন বাকি পড়ে আছে আমার।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের কাজটা হচ্ছে থ্যাংকসলেস জব। যা কিছু কৃতিত্ব তার পুরোটাই ডিরেক্টর আর প্রডিউসার নিয়ে নেয়। প্রেস আর মিডিয়ার ফোকাসে তারা থাকে। আর ভুলগুলো এডি আর প্রোডাকশন ম্যানেজারের ঘাড়ে এসে পড়ে। পান থেকে চুন খসলে গালি শুনতে হয়। এত কিছুর পর যদি টাকাপয়সা ঠিকভাবে পাওয়া না যায়, তাহলে আমার সান্ত্বনাটা কী?
আমার সব স্বপ্ন চুরি হয়ে গেছে। কখন চুরি হলো বুঝতেও পারিনি। গাধার মতো কাজ করি আমি এখন। আমার মূল কাজ হচ্ছে প্রপস ম্যানেজমেন্ট। স্ক্রিপ্ট পড়ে কোন দৃশ্যে কী কী জিনিস লাগবে সেগুলো গুছিয়ে রাখা। এবং শুটিংয়ের সময় সেটে সেই জিনিসগুলো ঠিকভাবে হাজির করা। এখন যে ছবিটা আমরা করছি, সেটা পিরিয়ড ড্রামা। ’৪৭-এর দেশভাগের সময়টাকে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে সিনেমায়। তাই এখানে প্রপস এবং কস্টিউম খুব গুরুত্বপূর্ণ।
গুলশান ডিসিসি মার্কেটে বেশ কিছু অ্যান্টিক শপ আছে। তার মধ্যে একটা হলো এ. আর. সন্স। সেখানে সিনেমার শুটিংয়ের জন্য পুরোনো দিনের জিনিসপত্র ভাড়া পাওয়া যায়। কিছু টাকা ডিপোজিট রেখে শর্ত সাপেক্ষে এসব জিনিস নিতে হয়। একটা পুরোনো আমলের গ্রামোফোন, রেডিও, কয়েকটা হ্যাজাক বাতি, কাঁসার প্লেট-গ্লাস, একটা জাহাজি বাইনোকুলার আর আমার কোমরে গোঁজা নেপালি কুকরি বাবদ মোট ৩০ হাজার টাকা ডেপোজিট রেখেছিলাম। শুটিং শেষ হয়েছে গত মঙ্গলবার। সব জিনিস ফিরিয়ে দিলেও কুকরিটা আর ফেরত দেওয়া হয়নি।
এ রকম হয়। শুটিং শেষে অনেক জিনিসপত্রের হিসাব মেলে না। কিছু জিনিস স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে যায়। খুব দামি কিছু না হলে সেগুলো নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কুকরিটার দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর সিনেমার বাজেট এক কোটি ৪০ লাখ। প্রায় দেড় কোটি টাকা বাজেটের সিনেমায় সাড়ে তিন হাজার টাকার একটা জিনিস খোয়া যেতেই পারে। কারও চোখে পড়বে না।
আমি কুকরিটা মেরে দিয়েছি। আরও সহজভাবে বললে চুরি করেছি।
সাধারণত মানুষ প্রয়োজনে চুরি করে। কোনো কিছু তার নেই, অথচ জিনিসটা না পেলে চলবে না—তখন জিনিসটা সে সিম্পলি মেরে দেয়। আমার ছুরি দিয়ে কোনো প্রয়োজন ছিল না। ২৭ বছরের জীবনে কারও গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, ঝগড়া পর্যন্ত করিনি আমি। ছুরি, বন্দুকের প্রয়োজন পড়েনি। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি চুরি করিনি। জিনিসটা দেখতে সুন্দর— এটাই ছিল একমাত্র কারণ।
কিন্তু চুরি করার পর থেকে মনে হচ্ছে, আমার একটা প্রয়োজন তৈরি হয়েছে। ছুরিটা ব্যবহার করা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
গত দুদিন আমার কোনো কাজ ছিল না। টানা দেড় মাস শুটিংয়ের ধকল গেছে। একটানা পরিশ্রমে শরীরটা প্রায় বসে গিয়েছিল আমার। একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু শুয়েবসে দিন কাটানোর একটা অসুবিধা হচ্ছে, এ সময় মানুষ একা থাকে। আর একা থাকলেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। নিজের সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা আমি বুঝতে পেরেছি, দেয়ালে পিঠ ঠেকে আছে আমার। ঘুরে দাঁড়াতে হবে এখন। একটা খুন না করলেই নয়।
শাহবাগ মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, মোবাইলটা বাজল। স্ক্রিনে দেখলাম আশুতোষ রানার নাম। রিসিভ করে বললাম, হ্যালো।
ওপাশ থেকে খসখসে গলা শোনা গেল, তুমি কোথায়?
আসতেছি।
আসতেছি মানে কী? কোথায় তুমি এখন?
বাসে।
বাসটা মঙ্গল গ্রহে চলতেছে? নাকি পৃথিবীর মাটিতে? যদি পৃথিবীর মাটিতে হয়, তাহলে সেটা এখন কোথায়?
শাহবাগ।
শাহবাগ!
আমি চুপ করে রইলাম।
ওপাশ থেকে বলল, শাহবাগ থেকে ডিওএইচএস আসতে কতক্ষণ লাগবে আইডিয়া আছে?
শুক্রবার আজ, বললাম আমি, বেশি সময় লাগার কথা না।
তোমার কয়টায় আসার কথা ছিল অয়ন?
নয়টায়।
এখন কয়টা বাজে?
সোয়া এগারোটা।
শিফটটা ৯টা থেকে শুরু হয়। প্রত্যেকটা সেকেন্ডের টাকা গুনতে হয়। এডিটর আইসা বইসা আছে। তুমি যদি টাইমলি আসতে না পারো, আমাকে বলতা। আমি সোহেলকে বলতাম প্যানেলে বসতে।
আসতেছি।
বালের আলাপ করবা না আমার সাথে। আসতেছি মানে কী? সারা রাত মদ-গাঁজা খেয়ে পড়ে ছিলা নাকি?
আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম। হারামিটা ভালো করেই জানে আমি মদ-গাঁজা খাই না। তারপরও এই কথা বলবে। দিনের পর দিন আমি সকাল ৯টায় গিয়ে বসে থেকেছি। এডিটর ১১টার আগে একদিনও আসে না। শুক্রবার হলে নামাজের পরে আসে। তাই ইচ্ছে করেই আমি দেরি করে যাই। আমি কোমরে হাত দিয়ে কুকরিটাকে একবার স্পর্শ করলাম। সাথে সাথে মনের মধ্যে কোত্থেকে একটা শক্তি চলে এলো। বললাম, বালের আলাপ আমি করি? না আপনে করেন?
ভয়ংকর এক জেদ আমাকে পেয়ে বসেছে ততক্ষণে। আমার যৌবনের স্বপ্ন চুরি করার অপরাধে আশুতোষ রানাকে আমি খুন করব। করতেই হবে।
ওপাশ থেকে দীর্ঘক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। আমি জানি, এই কথা বলার পর আমি আশুতোষ রানার টিম থেকে বাদ পড়ে যাব। কিন্তু ভয়ংকর এক জেদ আমাকে পেয়ে বসেছে ততক্ষণে। আমার যৌবনের স্বপ্ন চুরি করার অপরাধে আশুতোষ রানাকে আমি খুন করব। করতেই হবে। অনেক ক্ষমা করেছি জীবনে। আর না।
অনেকক্ষণ পর বাজখাঁই গলায় রানা ভাই বলল, তোমার সমস্যা কী অয়ন? আর ইউ আউট অব ইয়োর মাইন্ড? মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগুয়েজ।
মাদারচোত, আমি চিৎকার করে উঠলাম, তুই তোর ল্যাংগুয়েজ ঠিক কর। এডিটিংয়ে বসা আমার দায়িত্ব? আমার কন্টাক্ট শুটিং পর্যন্ত। এডিটে বসার কথা রাজীবের। সে অসুস্থ বলে আমি কাজটা করে দিতে রাজি হইছি।
অয়ন, তোমাকে আসতে হবে না। আমার সাথে আর কখনো কন্টাক্ট করবা না। বাই।
শোন, তোর সাথে কন্টাক্ট করার কোনো ইচ্ছা আমার নাই। তোর কাছে আমার যে আড়াই লাখ টাকা পাওনা আছে সে-ই টাকাটা দিয়ে দে। তারপর তোর মুখের মধ্যে আমি মুতে দেব। সাউয়া একটা তুই!
ওপাশ থেকে আশুতোষ রানা লাইন কেটে দিল। আমি ঠোঁট কামড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কোমরে গোঁজা ৯ ইঞ্চি ফলার বাঁকানো ছুরি। বুকে প্রতিশোধের নেশা।
এখন আমি কোথায় যাব? জাফলং—যেখানে বিধান সরকার বউ-বাচ্চা নিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছে? নাকি ডিওএইচএস—যেখানে আশুতোষ রানা বসে বসে রাগে গজরাচ্ছে? কোনো একটা জায়গায় যেতে হবে আমাকে।
জীবনভর ছুটেছি। কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারিনি। বা গন্তব্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা কি আমার ছিল? যারা নিজেদের গন্তব্য জানে না, তারাও পথ চলে। যাত্রাপথের আনন্দ উপভোগ করে। আমি তা-ও পারিনি। পেরেছি কেবল শরীরের ভারটুকু টানতে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটা জায়গায় বন্দি। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, ঘুরে ফিরে সেখানেই ফিরে আসছি। বৃত্তের মাঝে আটকা পড়ে গেছি।
কিন্তু আর কত? এবার আমাকে বৃত্ত ভাঙতে হবে। এখন, এই মুহূর্ত থেকে আমি একজন রূপান্তরিত মানুষ, বুকে মত্ত হাতির বল, কোমরে গোঁজা নেপালি কুকরি।
এবার আমি জেতার চেষ্টা করব। একবারের জন্য হলেও করব।
আলভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ কৌশলে স্নাতক। পেশাগত জীবনে যন্ত্রপাতির খটমট বিষয়ে না গিয়ে বেছে নিয়েছেন অডিও ভিজুয়াল ফিকশন নির্মাণ। টেলিভিশন মিডিয়ার জন্য নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন। সিনেমার বড় পর্দায়ও অভিষেক হয়েছে। লেখালেখি তার নেশা। নিজের নাটক, সিনেমার জন্য গল্প, চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে তার লেখার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। আলভী আহমেদ হারুকি মুরাকামির তিনটি উপন্যাস অনুবাদ করেছেন—’নরওয়েজিয়ান উড’, ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ এবং ‘পিনবল, ১৯৭৩’। বইগুলো বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে, মুরাকামির গল্প সংকলন, ‘কনফেশনস অব আ সিনেগাওয়া মাংকি’। প্যারালাল ইউনিভার্সের ওপর তার প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘জীবন অপেরা’ ২০২১-এ প্রকাশিত হয়েছে। ১১ জন নিঃসঙ্গ মানুষকে নিয়ে লেখা ‘ব্লাইন্ড স্পট’ তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। ইংরেজিতে লেখা তার পেপারব্যাক গল্পগ্রন্থ ‘ঢাকা ড্রিমস’ অ্যামাজনে ফিকশন বেস্ট সেলার ক্যাটাগরিতে শীর্ষে ছিল তিন সপ্তাহ।