রিমা দাসের জন্ম ১৯৮২ সালে ছায়গাঁও, আসাম, ভারত। তিনি একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা যিনি তাঁর চলচ্চিত্র, ‘ভিলেজ রকস্টার্স’ (২০১৭) এর জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বেশ কয়েকটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন। ২০১৮ সালে ভারতের হয়ে তাঁর রচিত, পরিচালিত, সম্পাদিত ও প্রযোজিত এ চলচ্চিত্রটি সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার এর জন্য প্রতিযোগিতা করে। ভারতের অন্যান্য ২৮টি চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া ছবিটি অস্কার বিবেচনার জন্য জমা দেওয়া প্রথম অসমীয়া চলচ্চিত্র। এছাড়াও তিনি নির্মান করেছেন ‘ম্যান উইথ দ্য বাইনোকুলারস’, ‘ভিলেজ রকস্টার’ ও ‘বুলবুল ক্যান সিং’ এর মতো চলচ্চিত্র। ২০১৮ সালে, জিকিউ ইন্ডিয়া রিমা দাসকে ২০১৮ এর ৫০ জন প্রভাবশালী তরুণ ভারতীয়দের একজন হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
চলচ্চিত্র বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘সিনেস্তান’ এ ২০২০ সালে প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন শ্রীরাম ইয়েংগার। শ্রী-র জন্য সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন রিসান আহমেদ। ভূমিকাও রিসানের।
ভনিতা, ভূমিকা কিংবা শিবের গীত
অভিনেত্রী হওয়ার জন্য এসেছিলেন মুম্বাইতে। কিন্তু মাতৃভাষা অসমীয়া ছেড়ে টান টান হিন্দি কিংবা ইংরেজি কোনোটাই আয়ত্তে আনতে পারেননি। কাজের সুযোগ খুব একটা হয়নি তাই। ডিপ্রেশন কাটাতে হাঁটতে শুরু করলেন বিশ্ব সিনেমার অলিতে গলিতে। সত্যজিৎ রায়, গদার, তারকোভস্কি, মাজিদ মাজিদি, ওয়াং কার ওয়াইদের মতো মাস্টারদের সিনেমার মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলেন একটু স্বস্তি। সিনেমা দেখতে দেখতেই বুঝলেন অভিনয়ের বাইরেও সিনেমা থেকে নেওয়া কিংবা সিনেমাকে দেওয়ার আরও হাজারটা পথ খোলা আছে।
ওই সময় নিজের সোনার গয়না বিক্রি করে একটা ক্যামেরা কিনলেন। আমি জানি না, রিমা দাস জানতেন কি না এই ক্যামেরাই বদলে দিবে তার পথের বাঁক। কখনো ফিল্ম স্কুলে না যাওয়া, কারো সহকারী হিসেবে কাজ না করা রিমা দাস শুধু জানতেন তিনি কি বলতে চান, কিভাবে বলতে চান। ওইটুকু জানাকে সম্বল করে ছোট্ট একটা দল নিয়ে তিনি বানানো শুরু করলেন তার প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘অন্তর্দৃষ্টি’ কিংবা ‘Man with a binocular’. এই সিনেমা বানাতে গিয়েই শিখলেন কিভাবে বলতে হয় লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন। কিছুদিন পরে কোথাও একটা খটকা অনুভব করলেন তিনি, কোনো কোনো অভিনেতা কিংবা সহকারীর চোখে একটা সন্দেহ, ভাবলেন হয়তো তিনিই কনফিডেন্ট না তাই এমন হচ্ছে। মুম্বাই থেকে নিয়ে আসা, মনের ভেতরে পুষতে থাকা সেই রাগ বাড়তে লাগল।
তখন গ্রামের একটা অনুষ্ঠানে একদল ছেলেমেয়েকে দেখলেন থার্মোকল দিয়ে বানানো মেকি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গান গাইছে। রিমা দাস বিশ্বাস করেন আমাদের যাত্রার সাথে এই মহাবিশ্বেরও একটা যোগাযোগ আছে। এই গল্পের এই পর্যায়ে এসে আমারও তাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। নাহয় সব বাঁধা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনকে উপভোগ করতে চাওয়া এক নারীর সামনে, একদল শিশুর সব না-পাওয়া ভুলে গিয়ে জীবনকে উপভোগ করা শুধু কাকতাল তো হতে পারে না। কিংবা এমনও হতে পারে, আমরাই আমাদের সকল না-পাওয়া মহাবিশ্বের সাথে জুড়ে দেই, আমাদের না-পাওয়ার হাহাকারই আমাদের অবিচ্ছিন্ন করে তোলে জগতের এই অনিঃশেষ যাত্রার সাথে। রিমা দাসও তাই অবিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি।
ওই আনকোরা শিশুদের দল, কলেজ পড়ুয়া কাজিন মল্লিকা দাস আর গয়না বিক্রি করে কেনা সেই ক্যামেরা হাতে তিনি নেমে পরলেন এক কাব্যিক যাত্রায়। যেই যাত্রা চলে প্রায় চার বছর। রিমা দাস তার এই যাত্রার নাম দিয়েছেন ‘ভিলেজ রকস্টার’। আপনার যদি রিমা দাসের এই গল্পটুকু জানা থাকে, তাহলে রিমা দাস আর ‘ভিলেজ রকস্টার’ এর ১০ বছর বয়সী ধুনুকে আলাদা করা হয়তো সম্ভব হবে না আপনার পক্ষে। কখনো ওই চার নম্বর দেয়ালটা ভেঙে রিমা দাস ঢুকে পরেন ধুনুর চরিত্রে কখনোবা ধুনু এসে নাড়ায় গল্পের কলকাঠি।
মেক্সিকান বংশোদ্ভূত হলিউডি পরিচালক রবার্ট রদ্রিগেজের একটা বই আছে ‘রেবেল উইথাউট আ ক্রু’ নামে। এই বইতে রদ্রিগেজ তার ২৩ বছর বয়সে মাত্র ৭ হাজার ডলার আর সাথে একটা মাত্র বন্ধু নিয়া কিভাবে একটা পূর্নদৈর্ঘ্য অ্যাকশান সিনেমা বানিয়েছিলেন সেই কথা বলেন। এই ৭ হাজার ডলার জোগাড়ের জন্য রদ্রিগেজ একটা মেডিসিনের ট্রায়ালে গিনিপিগ হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। পরে এই সিনেমা কলম্বিয়া পিকচার্স ডিস্ট্রিবিউট করে এবং প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করে। বছর তিনেক আগে যখন এই বইটা পড়ি, এত বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে গিয়েছিলাম যে এক রাতেই এক ফিচার ফিল্ম বানানোর পরিকল্পনা করে ফেলেছিলাম। তো এই শিবের গীত গাওয়ার উদ্দেশ্য একটা কথাই বলা যে রিমা দাসকেও আমি রেবেল বলতে চাই।
‘ভিলেজ রকস্টার’ বানানোর এই চার বছরকালীন সময়ে তিনি কোনো প্রযোজকের চৌকাঠ মাড়াননি। নিজের গল্পের স্বাধীনতা কিংবা নিজের শেখার স্বাধীনতা তিনি অন্য কারো হাতে বর্গা দিতে চাননি। তাই নানারকম ছুটা কাজ করে আর পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে ধার দেনা করে এই চার বছর তিনি সংসার চালিয়েছেন, শ্যুটিং এর খরচা জোগান দিয়েছেন।
রিমা দাসের সিনেমায় আমি একটা জার্নি খুব জোরদার অনুভব করি তা সে ‘ভিলেজ রকস্টার’-ই হোক কিংবা ‘বুলবুল ক্যান সিং’। একই গ্রামের বাউন্ডারির মধ্যেই দুইটি সিনেমার গল্প, তাও যেন কোথায় থেকে কোথায় চলে যাওয়া যায়।
এই জার্নি রিমা দাসেরও। তাই তো তিনি আসামের ওই গ্রাম থেকে ভারতের হয়ে অস্কারে যান। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। সবচেয়ে বড়ো কথা তিনি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন।
অনুপ্রাণিত করেন এই যে, সিনেমা এইভাবেও বানানো যায়।
সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন : ২০১৮ সালে প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণ করার পর এবার (২০২০) জুরি সদস্য হিসেবে বার্লিনালে ফেরা। এই যাত্রাটা নিশ্চয়ই অসাধারণ ছিল।
রিমা দাস : অবশ্যই, এটা একটা অসাধারণ যাত্রা। আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ডিজিটাল বিপ্লবকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই যার কারণে কিছু জিনিস পরিবর্তন হয়েছে। যার ফলে আমার মতো নির্মাতারা ছবি বানাতে পারছেন।
আমার জন্য বার্লিন সবসময়ই রোমাঞ্চকর। দুই বছর আগে এই শব্দটাই (বার্লিন) আমার জন্য মন্ত্রমুগ্ধকর ছিল। এমনকি গতবছরও সেখানে আমরা ‘বুলবুল ক্যান সিং’ এর ইউরোপিয়ান প্রিমিয়ার করেছি। একে তো বার্লিনে প্রথমবারের মতো স্ক্রিনিং শেষে দর্শকদের সাথে কথা বলা তার উপর অ্যাওয়ার্ড ফাংশন, বড়ো বড়ো নির্মাতাদের সাথে এক টেবিলে বসা। তাই হঠাৎ করে তারা যখন আমাকে জুরি সদস্য হওয়ার আহ্বান জানায়, আমার মনে হয় এখানে দায়িত্ব থেকে সম্মান ও ভালোবাসা বেশি। ভারতে আমি ও আমার অন্যান্য সহপরিচালকরা যা করছি তা ইতোমধ্যে চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করেছে। আমরা নতুন নতুন গল্প নিয়ে আসছি।
প্রশ্ন : OTT প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থান আপনার এই বিজয়গাথারই অংশ। ‘ভিলেজ রকস্টার’ এবং ‘বুলবুল ক্যন সিং’ দুটোই নেটফ্লিক্স দেখাচ্ছে। এই পরিবর্তন সম্পর্কে আপনার কী মত?
রিমা দাস : আগে দর্শকের কাছে পৌঁছানো আমাদের জন্য এক দীর্ঘ সংগ্রামের বিষয় ছিল। OTT প্ল্যাটফর্মগুলো এই ঘরানার সিনেমাগুলো অনেক লোকজনের দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনি প্রায়ই বলেন যে, আপনি সিনেমা দেখে সিনেমা শিখেছেন। আমার মনে হয়, ঠিক তেমনি একটা নতুন প্রজন্মের স্বাধীন নির্মাতারা হয়তো OTT প্ল্যাটফর্মে আপনার সিনেমা দেখে শিখছেন।
রিমা দাস : হ্যাঁ, একটা নতুন প্রজন্ম যে অনুপ্রাণিত হচ্ছে তা আমি দেখতে পাই। অন্যান্য নির্মাতাদের কথা বলতে পারি না, তবে লোকজন আমাকে মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া, অন্যান্য মাধ্যমে লিখতে থাকে। অধিকাংশই অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে। আগে OTT প্ল্যাটফর্মগুলো বড়ো বড়ো বলিউড সিনেমাগুলো বাছাই করত। এখন তারা বুঝতে পারছেন যে আমাদের দর্শককে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হিসেবে নেওয়া উচিত না। তারা এখন কন্টেন্ট সমৃদ্ধ সিনেমা খুঁজছেন। এটা শুধুমাত্র ভারতীয় সিনেমা জন্য নয়। দর্শকরা এখন অন্যান্য দেশের সিনেমা দেখছেন, ওয়ার্ল্ড সিনেমা দেখছেন, তারা এখন নতুন কন্টেন্ট চায়।
এমনকি স্টুডিওগুলোও বুঝতে পারছে দর্শকরা এখন নতুন কন্টেন্ট খুঁজছেন। এটা আমাদের একটা আত্মবিশ্বাসের জোগান দেয়। আগে স্বাধীন সিনেমাগুলোকে ‘আর্ট-ফিল্ম’ নামে একটা বক্সের মধ্যে আটকে রাখা হতো। বলা হতো এইধরনের সিনেমার দর্শক নেই। ওই বক্সটা এখন ভাঙতে শুরু করেছে।
প্রশ্ন : এখন, তাহলে একটা দর্শকশ্রেণি তৈরি আছে। আপনার শুধু প্রয়োজন সঠিক কন্টেন্টের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করা।
রিমা দাস : ঠিক তাই। আমার ক্ষেত্রে, আমি যখন ‘ভিলেজ রকস্টার’ বানাই, বিশেষ করে ‘ভিলেজ রকস্টারের’ ক্ষেত্রেই, কারণ ‘বুলবুল ক্যান সিং’ এর সময় আমি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতাম, একে তো ‘ভিলেজ রকস্টার’ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছাড়া, তার উপর নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভ। আমি ভেবেছিলাম হয়তো শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক দর্শকরাই সিনেমাটা গ্রহণ করবেন। এটা একটা অসাধারণ বিষয় ছিল যে শুধুমাত্র সমালোচক বা ফেস্টিভ্যালের দর্শকরা না বরং সাধারণ দর্শকেরাও সিনেমাটা পছন্দ করেছিলেন। এটা আমাকে অবাকই করেছে। আমি এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
আমি এটা বলব না যে, আমাদের দর্শকরা এখন তৈরি বরং আমি বলব যেই এক্সেসটা এখন তাদের আছে সেটা আগে ছিল না।
যখন ‘বুলবুল ক্যান সিং’ আসাম এবং ভারতের অন্যান্য অংশে মুক্তি পেল, লোকজন, ছোটো ছোটো স্কুল-কলেজের বাচ্চারা আমাকে লিখতে শুরু করল। আমি তাদের কাছ থেকে শিখেছি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী খুবই ইন্টারেস্টিং। তারা অনেক অনেক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমাটি দেখেছেন। সেই ক্ষেত্রে বলতে গেলে আমিই দর্শকদের কাছ থেকে শিখছি।
প্রশ্ন : এই যে স্বীকৃতি, এটা নির্মাতা হিসেবে এবং ব্যক্তি হিসেবে আপনার মধ্যে কি ধরনের পরিবর্তন এনেছে?
রিমা দাস : পরিবর্তন? খুব বেশি না। এখনো নতুন সিনেমা শুরু করার সময় আমার ভয় লাগে। পরিবর্তন বলতে আমি একটা কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম, আমি জানতাম না এটা কীভাবে কাজ করবে। এখন আমি দেখছি এটা কাজ করে, যার ফলে এখন কোনো নিয়ম ভাঙার ক্ষেত্রে আমি একটা আত্মবিশ্বাস পাই।
আমি ফিল্ম স্কুল থেকে আসি নাই, খুব বেশি কিছু জানিও না। আমি যখন ‘ভিলেজ রকস্টার’ এবং ‘বুলবুল ক্যান সিং’ এর সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করছিলাম, আমার টেকনিক্যাল জ্ঞানও ছিল না। যার ফলে, কোনটা ভুল কোনটা সঠিক তা নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করত। সেই ভয়টা এখন চলে গেছে। সোজাকথায় আমি এখন বিশ্বাস করি সিনেমা একটা শিল্প মাধ্যম এবং দর্শকের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আপনি এটাকে ব্যবহার করতে পারেন। আমি আমার গল্পগুলো বলতে চাই, যেটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পরিচালক হিসেবেও আমি পরিবর্ধিত হচ্ছি। আমার ক্রাফট এবং শিল্প দক্ষতাও পরিবর্ধিত হচ্ছে। কিন্তু যখন লোকজন আপনার কাজ পছন্দ করে এবং সমর্থন দেয় তখন আপনি এক ধরনের শান্তি অনুভব করবেন যা আরও বেশি কাজ করতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন : আপনি সিনেমা নির্মাণের নিয়মকানুন না-জানা সম্পর্কে বললেন কিন্তু এই না-জানাই কি ‘ভিলেজ রকস্টার ’এবং ‘বুলবুল ক্যান সিং’ তৈরি করে নাই?
রিমা দাস : হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আমি মোটামুটি আমার চরিত্রদের গতি-প্রকৃতি, দৃশ্যের মেজাজ অনুযায়ী যাচ্ছিলাম। কিভাবে যেন এটা হয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমাঝে আমার মনে হয় আমার মধ্যে একটা সহজাত গুণ আছে। আমি সৌভাগ্যবান। এই বিষয়টি মাঝেমাঝে আমাকে অবাকও করে। টরোন্টোতে আমি যখন ভিলেজ রকস্টার প্রথমবারের মতো দেখলাম, আমার মনে হলো, ‘ওহ, এই সিনেমাটা যে বানিয়েছেন সে কি আমিই?’
যদি আপনি আপনার চরিত্র এবং গল্পের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারেন, তখনই জাদু শুরু হয়। আপনি যদি ‘বুলবুল ক্যান সিং’ দেখে থাকেন, আমার অনেকগুলা প্রিয় দৃশ্যই পরিকল্পিত ছিল না।
সিনেমার শেষ দৃশ্যের রংধনুটা কাকতালীয়। আমি শুধু পরিকল্পনা করেছিলাম যে তারা নদী তীরে যাবে। কিন্তু আমি একটা রংধনু দেখলাম এবং চারপাশে প্রচুর বাতাস। আবহাওয়াটা পরিবর্তিত হচ্ছিল, ঐ সময় আমি শ্যুট করছিলাম আবার ডায়লগও লিখছিলাম। এটা একটা জাদুর মতো ছিল যা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
একটা রংধনু তো আপনি প্ল্যান করতে পারবেন না। এটা ভিএফএক্সও ছিল না। এমনকি আমি সচেতনও ছিলাম না। আজকাল আমি মুম্বাইতে থাকি, এখানে আপনি কালেভদ্রে হয়তো একটা রংধনু দেখবেন। কিন্তু ওইদিন রংধনুটা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমার মনে হয় এটা আকাশের একটা রং কিংবা মহাবিশ্বের সাথে একটা সংযোগ ছিল। এটা জাস্ট ঘটে গিয়েছিল। আপনাকে চারপাশটা মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করতে হবে। আমার মূল সমস্যা ছিল সিনেমাটা একটা চূড়ায় শেষ করা। ওটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি একটা গতানুগতিক সমাপ্তি চাচ্ছিলাম না।
‘ভিলেজ রকস্টারের’ ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছিল। আমি মা আর মেয়েকে (সিনেমার চরিত্র) নিয়ে নদীর পাড়ে গেলাম। কোনো কথা নেই বার্তা নেই, বাচ্চাগুলো নদীতে ঝাপ দিল। ওইটাই আমাকে পুরো সমাপ্তিটা তৈরি করতে সাহায্য করেছে। আমি ভাবছিলাম, ‘এইটাই সে পয়েন্ট যেখানে আমি সিনেমাটা শেষ করতে পারি।’
আপনার নিজের গল্প এবং প্রকৃতির সাথে একটা অকৃত্রিম যোগাযোগ থাকতে হবে।
প্রশ্ন : গতানুগতিক প্রশিক্ষণ কিংবা নির্মান সম্পর্কিত বোঝাপড়া এইটা পরিবর্তন কিংবা প্রভাবিত করতে পারত?
রিমা দাস : হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়। তাহলে আমি হয়তো অন্যকিছুর কথা ভাবতাম— একটা ভয় কাজ করত। কিন্তু যেহেতু আমার খুব বেশি জানাশোনা ছিল না, তাই আমি যা ভাবছিলাম তা করার স্বাধীনতা আমার ছিল। আমি কোনো নিয়ম মানছিলাম না। যদিও সিনেমাটা শুরু করার আগে আমি বিখ্যাত ও সমকালীন নির্মাতাদের প্রচুর সিনেমা দেখেছিলাম। কিন্তু যখন আপনি আপনার নিজের সিনেমাটা বানাবেন, কিভাবে যেন সবকিছুই ভুলে যাবেন।
যদি আমি একটা ফিল্ম স্কুল থেকে আসতাম, হয়তোবা আমি আরও সতর্ক এবং সচেতন হয়ে যেতাম। আমি যখন আমার ফিল্ম স্কুলের বন্ধুদের সাথে আলাপ করি, তারা প্রায়ই বলে, ‘তুমি এই দৃশ্যটা ওইটার মতো করে শ্যুট করেছো, আমি হয়তো ওইভাবে ভাবতাম না।’ জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে আমি তাই বানিয়েছি, যা আমি অনুভব করেছি (যেটা আসলে হওয়া উচিত)।
প্রশ্ন : সম্প্রতি আপনি জিয়া ঝাঙ্কে এবং অন্যান্যদের সাথে ব্রিকস এন্থোলজির জন্য একটা শর্টফিল্ম তৈরি করেছেন, সেটা কেমন গেল?
রিমা দাস : বলতে পারেন এটা আমার প্রথম কাজ, যার পারিশ্রমিক আছে। লোকজন যখন আপনাকে এপ্রোচ করে তখন অবশ্যই আপনার মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করবে। সময় একটা বাধা ছিল এবং কাজটাও চ্যালেঞ্জিং ছিল। একটা ছোটো টিম নিয়ে আমি আমার প্রথম সিনেমা (অন্তর্দৃষ্টি) বানিয়েছিলাম। ‘ভিলেজ রকস্টার’ এবং ‘বুলবুল ক্যান সিং’য়ের ক্ষেত্রে আমার কোনো টিম ছিল না। যে কারণে ক্রু নিয়ে কাজ করায় আমার মধ্যে একটা ভয় কাজ করত। তার উপর, আমি এই দুইটা সিনেমা (ভিলেজ রকস্টার ও বুলবুল) খুবই ছোটো ক্যামেরা সেটাপ নিয়ে করেছিলাম। এই শর্টফিল্মটা, আমরা শ্যুট করেছি অ্যালেক্সা, প্রচুর লাইট আর একটা ঠিকঠাক টিম নিয়ে। আমি যখন এই প্রজেক্টটা পেলাম, আমি কিছুটা সন্দিগ্ধ ছিলাম। কিন্তু এটা ভালোই হয়েছে, এখন আমি টিম নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
প্রশ্ন : আপনি যখন আপনার প্রথম সিনেমা বানান আপনি তখন একজন অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলেন, এখনও কি ওই স্বপ্নটার পরিচর্যা করেন?
রিমা দাস : আমি জানি না। সত্যি কথা বলতে, আপনি যদি নিজেকে একজন নির্মাতা হিসেবে বিবেচনা করেন, তাহলে আপনাকে প্রতিনিয়ত গল্প নিয়েই ভাবতে হবে। অভিনেত্রী হিসেবে, আমার নিজেকে আরও বেশি সময় দিতে হবে। আপনাকে নিজের জন্য বেশি সময় উৎসর্গ করতে হবে। আবার নির্মাতা হিসেবে আপনার দুনিয়াটা পুরোপুরি ভিন্ন। দেখা যাক কি হয়! অভিনয় আমার প্রথম ভালোবাসা। নিকট ভবিষ্যতে আমি হয়তো অভিনয় করতে ভালোবাসব, কিন্তু সেটা বড়োজোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। কোনো কিছু সৃষ্টি করা এখন আমাকে আরও বেশি পরিতৃপ্ত করে।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, কিন্তু তিগমাংশু ঢুলিয়া, অনুরাগ ক্যাশ্যাপ এমনকি মার্টিন স্করসেজিও অভিনয় করছেন। সুতরাং একটা সম্ভাবনা তো আছেই। হয়তোবা আপনার নিজের সিনেমাতেই?
রিমা দাস : সত্যি বলতে এটা সম্ভব। দেখেন, গত এক দশক ধরে আমি মুম্বাইতে থাকি। আসাম থেকে আসায়, ভাষা না জানায়, আমার একধরনের ফোবিয়া হয়ে গিয়েছিল। হয়তো আমার অবচেতন মনের কোথাও সেটা রয়ে গিয়েছে। আমার সেটা ভাঙতে হবে। যদি আমি আমার জন্য সময় বের করতে পারি এবং কোনো সমমনা পরিচালকের সাথে কাজ করার সম্ভাবনা তৈরি হয় তাহলে হয়তোবা অভিনয়টা করতেও পারি। কিন্তু আমার পক্ষে ওইভাবে গেলাম আর অভিনয় করলাম সেটা সম্ভব না। ওই ফোবিয়াটা এখনো আছে। ওটা ভাঙার জন্য আমার কিছুটা সময় দরকার।
আমার অন্তর্গত ভোগান্তির কারণ আমার জন্য এটা পুরোপুরি একটা ভিন্ন দুনিয়া ছিল।
প্রশ্ন : আমরা দর্শকের বোধের পরিবর্তন নিয়ে কথা বললাম, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ভেতরেও একধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। একটা সিনেমাকে আর্ট ফিল্ম বলে দেওয়া কিংবা একজন অভিনেতাকে আর্ট ফিল্মের অভিনেতা বলে দেওয়া। আবার হিন্দি সিনেমার একজন অভিনেতাকে নির্দিষ্ট রকম দেখতে হবে, সে একটা নির্দিষ্ট ঘরানার অভিনয় করবে এইধরনের চিন্তাভাবনাও প্রচলিত আছে। আপনি কি এসব জায়গায় কোনো পরিবর্তন দেখতে পান?
রিমা দাস : অবশ্যই পরিবর্তন দেখতে পাই, কিন্তু সে পরিবর্তনটা অনেক বড়ো সেটা বলব না। কিছু লোক এই বিভাজনটা ভাঙতে দেবেন না। এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি এবং এর সাথে ব্যবসায়িক উন্নতি জড়িত। যতদিন পর্যন্ত আমাদের একটা স্টুডিও ব্যাকাআপ হবে না ততদিন ওই লোকগুলো এটাকে ভাঙতে দেবেন না।
স্বাধীন সিনেমাগুলো দূর্বল মার্কেটিং এবং প্রমোশনের জন্য ভোগে। একটা শাহরুখ খান কিংবা অক্ষয় কুমারের সিনেমার মুক্তির আগেই একটা বিশাল ফ্যান ফলোয়িং থাকে। স্বাধীন সিনেমাগুলো অত বড়ো দর্শক শ্রেণির কাছে পৌঁছাবে না। এটা শুধুমাত্র ভিজিবিলিটির মাধ্যমেই সম্ভব।
কিছু কিছু প্রযোজক সেই দায়িত্বটা নেন। অন্যথায় আমাদের দৌড় ওই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম না হয় কোনোমতে সিনেমাটা মুক্তি দেওয়া।
প্রশ্ন : সম্প্রতি বেশ কিছু বছর ধরে, উত্তরাঞ্চলের পরিচালকদের থেকে দুর্দান্ত সব গল্প আর ন্যারেটিভ স্টাইল আসছে। এই অঞ্চলের তার নিজস্ব একটা ফ্লেভার আছে, গল্পের একটা ভাণ্ডার আছে। আপনার নতুন নতুন আইডিয়ার এটাও কি একটা উৎস?
রিমা দাস : হ্যাঁ, কারণ এই অঞ্চলটা তুলনামূলকভাবে কম আবিষ্কৃত হয়েছে। সংস্কৃতি, ভাষা কিংবা সুন্দর সুন্দর সম্প্রদায় সবক্ষেত্রেই আমাদের প্রচুর ভিন্নতা আছে। আমাদের প্রচুর গল্প আছে। নাগাল্যান্ডের এখন নিজস্ব চলচ্চিত্র উৎসব আছে। এমনকি শিলং, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুরেরও চলচ্চিত্র উৎসব আছে। আসামের ক্ষেত্রে, ‘ভিলেজ রকস্টারের’ পর অনেক বছর বাদে লোকজন সিনেমা হলে এসেছে।
একই সাথে আপনি যদি উত্তরাঞ্চলের দিকে তাকান, আমরা কিন্তু সিনেমায় খুব বেশি ইনভেস্ট করছি না। এগুলো সবই স্বল্প-বাজেটের সিনেমা। কিন্তু আমি গল্প বলার একটা তাড়না দেখতে পাই। আসামের প্রচুর নির্মাতা গল্প বলতে চায়। এটা চমৎকার।
প্রশ্ন : সিনেমায় টাকা ঢালার পেছনে এই যে অনীহা এর কি কোনো কারণ আছে?
রিমা দাস : আমাদের খুবই কমসংখ্যক সিনেমা হল আছে যেখানে হাতেগোনা কয়েকটা প্রদর্শনী হয়। শুধুমাত্র গুয়াহাটি আর তিন-চারটা শহরে সিনেমা হল আছে। আমাদের এখানে কোনো মাল্টিপ্লেক্স নেই।
এতকিছুর পরেও এখানে রত্নাকর নামে একটা কমার্শিয়াল সিনেমা বক্সফিসে আট কোটি রুপির ব্যবসা করেছে। এখানে আরও অনেক জটিল রাজনীতি জড়িত। ধীরে ধীরে এটা কমছে, কিন্তু এখনো অনেক কিছুই ঘটছে।
এই অঞ্চলটা অনেক বড়ো। কিছু কিছু প্র্যাকটিক্যাল ইস্যুও আছে। কিন্তু লোকজন অনেক সাপোর্টিভ। সিনেমা এবং সাহিত্য নিয়ে কথা বলা আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই আছে। গত দুই তিন বছরে, একটা বড়ো পরিবর্তন হচ্ছে। লোকজন এই পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। এইটা ইন্টারেস্টিং।
প্রশ্ন : আমরা নিশ্চয়ই এই ধরনের পরিবর্তন আরও বেশি করে চাইব। আমাদের সাথে কথা বলার জন্য ধন্যবাদ।
রিমা দাস : ধন্যবাদ।
শিক্ষার্থী ও চলচ্চিত্রকর্মী। নিজের গল্প বলার স্বপ্ন দেখেন।