গেরিলা
গোপনে ভাষার দুর্গে ঢুকে পড়ি গেরিলার মতো
মুহর্মুহু আক্রমণে কেঁপে ওঠে দুর্গ-সেনাপতি। তার
খসে পড়ে টুপি, শিরস্ত্রাণ
সৈন্যরা পালায় ভয়ে
অস্ত্র ফেলে ট্রেঞ্চে, পরিখায়;
আর ওই অনেক উঁচুতে
স্তব্ধ-হিম শৈলকপাট থেকে ধীরে
নেমে আসা মাকড়ের জাল
এই দৃশ্য গ্রাসে নেয় পরম কৌতুকে!
ভোলক্যানো
১.
ছিল শান্ত, অচঞ্চল। নাগালের বাইরে সমাহিত।
তবু কেন বনতল অসময়ে কেঁপে উঠল ঝড়ে;
শীতের ভেতর থেকে মাঘশীর্ষে যেন কেউ
ফস্ করে বসন্তের আগুন জ্বালাল। যেন
বহুকাল সুপ্ত থেকে হঠাৎ জেগেছে ভোলক্যানো
২.
ঠাঁই নাই। সামান্য এ-হৃদয়কুঠুরি।
ভুল করে তাতে এসে কে লাগায় মধুর কামড়
৩.
কালো চুলে পাক ধরছে
একে-একে ঝরে পড়ছে সিংহের সুদীপ্র কেশর
৪.
প্রেম এক দুর্ঘটনা। অসময়ে এলে।
লগ্ন পেরিয়ে গেলে কামনার লাবণ্য-পরাগ
অস্থানেই বৃথা ঝরে যায়
৫.
প্রেমাঙ্কুর দিয়ে কে গো শান্ত, নত করতে চায়
রক্তচক্ষু লাল দানবেরে?
শুশ্রূষার বরাভয় কে বিছাতে চায় এই
লাবণ্যসঙ্কাশহীন মনে !
৬.
সরাইখানার নিচে একটু কেশে থেমে আছে গাড়ি;
জীবিতকে নিয়ে যাবে গন্তব্যে ও দূরে; —হয়তোবা
জীবিতের ছদ্মবেশী আরোহীকে অন্য কোনো সরাইখানায়
৭.
‘চেক আউট। চটজলদি। কেননা সময় বড়ো কম!’
৮.
রবীন্দ্রবাবুর গান। টপ্পাঙ্গের।
অসময়ে কেউ গাইছে তোমাকে শোনাতে ।
তোমার দু’কানে তালা।
চোখ ঝাপসা গ্লুকোমায়
চেক আউট।এবার বিদায়
৯.
সীমান্ত ও কাঁটাতার ঝোলাকাঁধে পার হতে হবে
হাসি ও বসন্ত
কী সুন্দর পাখির মতো
হাসি এসে বসে রইল
নানা রকম মেয়েলোকের গালে
পিঁপড়েদের সঙ্গমের হা-শীৎকারকালে
ধূমাবতীর কোল বড়ো, দোলনা দ্যায় পেতে
হাজার লাল বসন্তের আগুনলাগা ডালে
যেই আসুক স্তন পেয়ে
দুধ খেয়ে কোল পেয়ে— শেষে
ডাল ধরে দোল খেয়ে
ঘুমায় শান্তিতে
লা লাল্লা লা
লা লাল্লা লা
আসমানে বিজলিদিন, আসমানে চুপ-জড়িম
হাজার-রঙ ঝাড়বাতিরা জ্বলে
কতো রকম হাসিও তাই
পাখির মতো উড়ে আসছে
পাখির মতো এসে বসছে
নানারকম মেয়েলোকের গালে
মেয়েলোকের গাল ছেড়ে, কোল ছেড়ে
আর কোথায় যাবে?
কোল ছেড়ে যাবেই না?
চোখ এড়ায়, তবু্ও যায়
এক বিঘত, আধ বিঘত দূরে
বাম স্তনের ডাঁশ জড়ুল
বাম স্তনেই ছিল;
পিঁপড়েদের যন্ত্রণায়
ডান স্তনে চুপ করে কখন ঠাঁই নিল?
দিও না যেতে আর কোথাও
আর কারোর কোলে
আদরে-দুধে বাম স্তনেইপাখির মতো ওকে
পেট ভরিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, পোষ মানিয়ে রেখো
পিছল পথ। অনেক দূর। অনেকে এইভাবে
গিয়েছে চলে ফেরেনি, শোকে
আকাশ গেছে ভরে
হ্যামলেট পাঠ
রাত জেগে হ্যামলেট পড়ে
জানালার বাইরে তাকাবো, আর,
না-শোনার মতো বিড়বিড়
আওড়াবো ধীরে:
ডাউট দাউ
দ্য স্টারজ
আর ফায়ার…!
পেঁচা ও বসন্ত
১.
বসন্ত আবলুশরঙ ধাড়ি ইন্দুরের নরম মাংসের লোভ দেখিয়ে
ক্ষুৎকাতর এক পেঁচাকে ঠায় বসিয়ে রাখে রাতের ডালে
২.
বসন্ত পিছলস্বভাবী, বারফট্টাইসর্বস্ব এক ঋতু;
মোক্ষম সময়ে হ’য়ে ওঠে হীন প্রবঞ্চক;
৩.
ছদ্মপ্রেম, ফুল, বাঁশি, বেণুবন আর মৃদু সমীরণ সহযোগে সে আসে;
অহেতু সুরভি-কোমল রঙিন রুমাল নাড়ে
মিহি ফসফরাসে বানানো এক গোল চাকতির ওপর
অলীক রশ্মি ছড়িয়ে বলে: এই নাও ‘জোছনা’
৪.
বেদ্ইুন-তাঁবুতে গোপনে ঢুকেপড়া কুহকিনীর মতো ছলনাময়
ডাবল এজেন্টদের মতো বদমায়েশ এই বসন্ত!
—আলাভোলা ক্ষুধার্ত তরুণ পেঁচাটিকে নিয়ে সে এখন খেলছে!
৫.
একদিকে পেঁচার সৌভাগ্য কামনা করে। অন্যদিকে
ইন্দুরদের আগেভাগেই সাবধান করে দিয়ে বলে:
পেঁচা বসে আছে ডালে। পালাও পালাও!
৬.
শিকারের অনুকূল রাত্রি চায় পেঁচা;
চায় অনুকূল নিশিপরিবেশ;
অথচ কূটচালে পেঁচাকে ঘায়েল করে, অসফল করে
শকুনির মতো ক্রূর দূরে বসে হাসে
৭.
প্রতিটি অপ্রাপ্তি পেঁচার রক্তে উস্কে দ্যায় আগুন
প্রতিটি অচরিতার্থতা তার করোটিতে জন্ম দ্যায় হনন-বারুদ
তার অক্ষিগোলকের ভেতর নিনেভার অগ্নিদহন!
৮.
অপ্রাপ্তির ক্ষোভে পেঁচার ঠোঁট হ’য়ে ওঠে
অবসিডিয়ান নাইফের চেয়েও ধারালো
নখর কাপালিকের খড়্গ, আর
সিমারের নির্মম খঞ্জর
৯.
ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, অবসন্ন ব্যর্থমনোরথ পেঁচা
বারংবার ডেকে উঠছে কর্কশতম স্বরে:
লান্নত! লান্নত্!
লান্নত এই শ্বেতীরোগগ্রস্ত রাত্রিকে!
লান্নত বদমায়েশ বসন্তের প্রতি!
লান্নত বসন্তের ভ্রামরীমিত্রতার প্রতি!
বারফট্টাইসর্বস্ব বসন্তের বিনাশ অত্যাসন্ন!
কূটস্বভাবী, ছলনাময় বসন্তের
বিয়োগান্তক মৃত্যৃর মধ্য দিয়েই সূচিত হবে
গ্রীষ্মের ফিনকিময় লাল কারবালা
আদ্যন্ত মর্সিয়া আর মাতম!!
আদ্যন্ত
লান্নত
লান্নত
লান্নত!!
জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ জানুয়ারি। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার গড়াডোবা ইউনিয়নের সাখড়া গ্রামে। পিতা মুকদম আলী, মা বেগম নূরজাহান (সরু)। দুজনই প্রয়াত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। পেশা সাংবাদিকতা। কৈশোরে নিরুদ্দেশযাত্রা। দীর্ঘ ভবঘুরে জীবন। যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ে। বিশেষত হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে। ঘৃণা করেন বৈষম্য, জাতিবৈর, সকল প্রকারের অন্ধতা। ঘৃণা করেন পৃথিবীকে খণ্ডক্ষুদ্র-করে-দেওয়া সীমান্ত নামের ‘খাটালের বেড়া’। লেখেন মূলত কবিতা। কালেভদ্রে সাহিত্যশিল্প বিষয়ে গদ্যও লেখেন। বিচিত্র বিষয়ে প্রচুর অনুবাদও করেন ইংরেজি থেকে বাংলায় আর বাংলা থেকে ইংরেজিতে।
কবিতাবই: ‘দর্জিঘরে একরাত’, ‘মেগাস্থিনিসের হাসি’, ‘দিওয়ানা জিকির’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘রাত্রি ও বাঘিনী’ ও ‘বসন্তরূপক হাসি’।
অনুবাদগ্রন্থ: ‘কবিতার ট্রান্সট্রোমার’ নোবেলজয়ী সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের বাছাই করা কবিতার অনুবাদ সংকলন। ‘দূরের হাওয়া’ প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ২০০ কবিতার অনুবাদগ্রন্থ।
পুরস্কার ও সম্মাননা: ১. ‘জীবনানন্দ দাশ কবিতাপুরস্কার ২০১৯’ ২. ভারতের পশ্চিমবঙ্গের (কলকাতার) ঐহিক সাহিত্যগোষ্ঠির ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা ২০২০’ ৩. ’নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের জন্য ’বেহুলাবাঙলা বেস্টসেলার বই সম্মাননা ২০১৯’ ৪. রাত্রি ও বাঘিনী কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই-২০২১’ সম্মাননা পুরস্কার।