প্রায়ই মনে হয় আচমকা এসে কেউ পেটের ডান পাশে একটা চাকু ঢুকিয়ে দেবে।
প্রায় আট-দশ বছর ধরে এই আতঙ্কটা আমাকে তাড়া করছে। বহুবার, নানান উছিলায় এটাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করি। ভুলে যাইও। আবার কিভাবে কিভাবে যেন ফিরে আসে।
এটার শুরু হয়েছিল গোপাল কবিরাজের সাথে দেখা হবার পর থেকে। ছোটোপিশির বাড়িতে সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে দেখেই তার মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। অনেকটা সময় চোখ বন্ধ করে চুপ থাকার পর, উৎকণ্ঠার ছাপ চোখে-মুখে ফুটিয়ে তুলে পিশিকে বলেছিলেন, ‘এডো কেডো? কি হয় তোমার? আহারে! অর তো বড়ো ফাড়া আছে জীবনে! পুলিশি ঝামেলা আছে। তাছাড়া অপঘাতে রক্তপাতের সম্ভাবনা স্পষ্ট।’ আরেকটু রহস্য ছড়িয়ে, মাথা নাড়তে নাড়তে একা একাই বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘যেভাবে প্যাঁচ দিয়া ধরছে, কপালে খুবই খারাপি আছে।’
‘কী প্যাঁচ দিয়া ধরছে কাকা?’— ভূতগ্রস্থের মতো আতঙ্কে চোখ-মুখ অন্ধকার করে জিজ্ঞেস করেছিলেন পিশি।
গোপাল কবিরাজ একটু সময় নিয়ে লম্বা করে শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘মিয়া মানুষ।’
‘কী প্যাঁচ দিয়া ধরছে কাকা?’— ভূতগ্রস্থের মতো আতঙ্কে চোখ-মুখ অন্ধকার করে জিজ্ঞেস করেছিলেন পিশি।
গোপাল কবিরাজ একটু সময় নিয়ে লম্বা করে শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘মিয়া মানুষ।’
সেই রাতেই পিশি কাঁদতে কাঁদতে মাকে ফোন করে। ‘তোমার ছলেক বাঁচাইবার চাইলে কালই চইলা আসো বৌদি! অক আর মনে হয় আমরা বাঁচাইতে পারমু না।’
মায়ের আতঙ্ক আর উদ্বেগ কেমন ছিল তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম পরেরদিন দুপুরে মা যখন পিশির বাড়িতে এসে পৌঁছান। শাড়ি এলোমেলো, চুল আচড়ানো নাই, সিঁদুরও ঠিকঠাক পড়া হয় নাই। এক অজানা আতঙ্কে ঝড়ের বেগে যেন ছুটে এসেছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, কাঁদতে কাঁদতে গোপাল কবিরাজের কাছে আঁচল পেতে আমাকে ভিক্ষা চেয়েছিলেন মা।
গোপাল কবিরাজ মাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘চিন্তা কইরো না বউমা। আমি যহন আছি তহন আর চিন্তা নাই। এমন কাম কইরা দিমু, বাপ বাপ কইরা পলাইবো।’
মাকে যতই বলি, এইগুলা ভুয়া কথা। এই বিজ্ঞানের যুগে তুমি এখনও এইগুলা বিশ্বাস করো! একটা ভণ্ড লোক! ধুন-ফুন কইয়া তোমাগোর কাছ থিকা টাকা হাতানোর ধান্দা করতেছে! তোমরা কিন্তু কিছুতেই ওই লোকের ফাঁদে পা দিও না!
কে শোনে কার কথা!
আমি যতই বলি মা ততই আমাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘বাড়ির বাইরে থাকোস বাবা, কখন কী হয় তার কোনো ঠিক আছে? কিসের থিকা কী হয়া যাইবো! আর ক, কোন ছেড়ির সাথে কী করছোস! কেডো প্যাঁচ দিয়া ধরছে?’
এই আগুনে আমার পিশি এগিয়ে এসে আরেকটু ঘি ঢেলে দেয়—
‘সারাদিন মোবাইলে ঘুতুর ঘুতুর করে কার সাথে জানি কথা কয় বউদি! তোমার ব্যাটা ঠিক নাই। গোপাল কাকা আসছে, তার কাছ থিকা কিছু কইরা দেও। নাইলে রক্ষা নাই।’
আমার কোনো কথাকে তারা বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে গোপাল কবিরাজের কাছে গিয়ে বসে। কী কী সব আলাপ চলতে থাকে ঘরের ভেতর। আমার মেজাজ এইসব দেখে পুরো তিরিক্ষি হয়ে যায়। কিন্তু মা আর পিশির আচরণে, কান্নাকাটিতে ততক্ষণে আমার ভেতরেও একটা ভয়ের গোপন স্রোত বইতে শুরু করে। তারা ঘর থেকে বের হলে আমি গিয়ে বসি। মনের মধ্যে যাই থাকুক, বাইরে কঠোর ভাব নিয়ে একটু কঠিন কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলেন কী জানেন।’
গোপাল কবিরাজ, আমার কথায় বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলো বলে মনে হলো না। বরং আরও বেশি গম্ভীর আর রহস্যময় হয়ে উঠলেন। তার সেই কোটরে যাওয়া চোখ, চাপা ভাঙা গাল আর হাড় জিরজিরে কালো চেহারায় একটা ভীতিকর রূপ ফুটিয়ে তুলে নেভি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন। মনে মনে কী যেন হিসেব করে চলেছেন; ছক কাটছেন। শেষে লম্বা করে একমুখ ধোঁয়া ছুঁড়ে বললেন, ‘তোমার পেছনে তো আইজ থিকা না দাদু, মেলাদিন ধইরা লাইগা আছে সে। সহজে ছাইড়বো না। এ যে-সে জিনিস না!’
মেজাজ আরো তিরিক্ষি হলেও তার রহস্যময় আচরণ, বলার ভঙ্গি কিংবা নিজের দুর্বলতাগুলো ততক্ষণে আমার মনের উপরিতলে উঠে আসায় গলা নরম করে বললাম, ‘কেডা দাদু?’
যেন শিকার ধরা শেষ। চাপা একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে পরিবেশটাকে আরো গভীর আর ঘন করে বললেন, ‘দাদু, তোমরা শিক্ষিত ছলপল এইসব তো বিশ্বাস করো না। মিষ্টির শিরা থাকলে তো পিঁপড়া ধরবোই।’
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ থেকে আবার শুরু করেন : ‘তোমার গায়ে এমন একটো জিনিস আছে যে তোমার পিছে মিয়ামানুষ আঠার মতো লাইগাই থাইকপো।’
আমার গলা প্রায় শুকিয়ে আসে। কথাও আর বের হতে চায় না। তার বলা কথাগুলো ততক্ষণে আমার একটু একটু বিশ্বাসও হতে শুরু করেছে। কিন্তু শেষের বাক্যটা শোনার পর ভয় ও কৌতুহল একইসাথে চরমে পৌঁছায়। আরও আরও কথা শোনার জন্য চুপ করে থাকি। এদিকে অনবরত পকেটে ফোন ভাইব্রেট করে যাচ্ছে। ভোঁত ভোঁত শব্দ করে কেঁপে উঠছে পকেটের ভেতর। গোপাল কবিরাজ কিছু বুঝতে পারলেন কি না বোঝা গেলো না। নিজে নিজেই বলতে থাকলেন, ‘এই ফোনই তো সব শ্যাষ কইরা দিলো!’
তুমুল আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় সংকুচিত হতে হতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শরীরে কী আছে দাদু?’
তিনি চুপ করে থাকেন। কি কি যেন বিড়বিড় করেন। যেন হাওয়ার ভেতর থেকে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করছেন।
“প্যাঁচায়া ধরা জিনিসের নামের প্রথম অক্ষর ‘র’।” — বলেই আবার কোথায় যেন হারিয়ে যান।
অথচ এই রুমিই চরমতম দুঃসময়ে আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। ভালোবেসে একটু একটু করে সারিয়ে তুলেছিল। মনের ভেতর থেকে ঘন কুয়াশা দূর করতে করতে বলেছিল— ‘আলোপাখি, তুই একটা আদর আদর; আমার সকালবেলার ঘুম। মরে গেলে আমার কবরে তুই শিমুল ফুল হয়ে জড়িয়ে থাকিস।’
‘র? মানে, রুমি?’ —আমি মনে মনে মেলাতে থাকি। আতঙ্কে পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে আসে। রুমির সাথে কাটানো নানান ঘটনা একে একে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পুরো শরীরে ঘাম ছুটে যায়। বলে কী!
আমার সন্দেহের তীর তখন পুরো রুমির দিকে। ওর প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পাগলামীকে মনে হতে থাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যেন আমাকে গ্রাস করার জন্য সবই ওর সাজানো নাটক। সে যেন কোনো অশুভ শক্তির এজেন্ট।
অথচ এই রুমিই চরমতম দুঃসময়ে আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। ভালোবেসে একটু একটু করে সারিয়ে তুলেছিল। মনের ভেতর থেকে ঘন কুয়াশা দূর করতে করতে বলেছিল— ‘আলোপাখি, তুই একটা আদর আদর; আমার সকালবেলার ঘুম। মরে গেলে আমার কবরে তুই শিমুল ফুল হয়ে জড়িয়ে থাকিস।’
মাথার চুল ঠিক করে দিতে দিতে অবাক বিস্ময়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, ‘তুই যে একটা সত্যি সত্যি পাগল তা কি তুই জানিস?’
উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘আমার কিছু জানার দরকার নাই। আমি তোর পাগল হয়ে সারাজীবন তোরই থেকে যেতে চাই রু!’
সে হেসেছিল। সেই হাসির অর্থ আমি করতে পারি নাই।
সেদিন উত্তর আকাশ থেকে একঝাঁক পাখি উড়ে গিয়েছিলো দক্ষিণ আকাশে। আমাদের তুলসীতলার পাশে কয়েকটি গাঁদাফুলের গাছে ঝেঁপে ফুল এসেছিল। আর মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসছিল।
রুমি প্রায়ই বলত, ‘এই শহরটা এখন তোর। বুক ফুলিয়ে চলবি। বাকি সব আমি দেখব।’
মাঝে মাঝেই আদুরে ব্ল্যাকমেইল করত। বিভিন্ন অকেশনে গিফট কিনে ফোন করত, ‘মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি আয়। নইলে খবর আছে।’ আমি জানতাম, না গেলে সত্যিই ও খবর করে ছাড়বে। চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে দেখা করে আসতাম।
ওকে আমি ভয় পেতাম ওর বেপরোয়া স্বভাবের কারণে। ওর ভালোবাসার তীব্রতম আবেগের কারণে। নইলে রঞ্জু ভাইয়ের মতো ডাকু লোকের ঘরে থেকেও কেউ কাউকে ভালোবাসার সাহস পায়! গোপনে আগলে রাখতে পারে!
রুমির সাথে যখন আমার পরিচয় হয় রঞ্জু ভাই তখন জেলে। কী এক দলীয় ষড়যন্ত্রের শিকার। এইসব ঘটনা জেনেছিলাম অনেক পরে। আসলে আমাদের মাঝে গল্প হতো টগর ফুলের। কোনো পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে পরস্পরকে হারিয়ে ফেলে উদভ্রান্তের মতো দুজনই দুজনকে খুঁজতে থাকা বিরহের। এছাড়া কোনো কোনো বৃষ্টির রাতে আদিম বন্যতায় অকস্মাৎ পরস্পরের রাক্ষস হয়ে উঠলে ও আহ্লাদ করে আমাকে ডাকত ডাকু; পরাণডাকু। বলত, ‘তোকে ছাড়া কী হবে বল তো ডাকাত!’
আমাদের ভোর হয়ে যেত।
রঞ্জু ভাই বা ওর পরিবার নিয়ে রুমিকে সেভাবে কোনোদিনও তেমন ভাবতে দেখি নাই। তার প্রসঙ্গ প্রায় আসতোই না আমাদের মাঝে। যেন ওর জীবনে রঞ্জু বলে কেউ আসেই নাই কোনোদিন। যেন আমিই ওর একমাত্র জীবন। শুধু একদিন দেখেছিলাম খুব বিষণ্ণতা নিয়ে নীরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। যেন তার সাত আসমান জুড়ে কেবলই থৈ থৈ শূন্যতা। যেন নিরুপায় গন্তব্যহীনতার দিকে ছুটে চলেছে এক বিপন্ন ডাহুক। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
তারপর থেকে আমরা আর কেউ কাউকে কোনোদিন না বলি নাই।
সেই থেকে আমাদের গোপন পৃথিবীতে রোদ ও বৃষ্টিপাতের গল্প পালাক্রমে বাড়তে থাকে। সুযোগ পেলেই আমরা পরস্পরের টগর ফুল হয়ে সেই রোদ ও বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। ভিজে যেতে থাকি।
গোপাল কবিরাজই এইসব উত্তুঙ্গ আনন্দের মাঝে নিরানন্দের বিষ ঢুকিয়ে দেয়। তার বলা কথার সাথে আমার দুইয়ে দুইয়ে চার মিলতে থাকে। অপঘাতে রক্তপাতের সম্ভাবনার কথায় দ্বিতীয়টি আর ভাবতে হয় নাই। সোজা রুমির ঘরের দেয়ালে টাঙানো রঞ্জু ভাইয়ের মুখটা মনে পড়েছিল। ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গিয়েছিল।
কিছুক্ষণ পরে মাকে ডেকে তার হাতে একটা আকিক পাথর আর রূপার তাবিজ তুলে দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘ছয়মাস পরে কোনো শনিবার দেইখা বাড়িতে একবার শনি পূজা কইরো বউমা।’
আর আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলেছিলেন, ‘মিয়া মানুষ থিকা সাবধানে থাইকো দাদু। হরিণের নিজের মাংসই তার শত্রু। তোমার গোপনাঙ্গের তিলের মতো।’
চূড়ান্ত বিস্ময়ের এটুকুই বোধহয় বাকি ছিল। হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম তার এই কথায়। মানুষের গোপন আর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় লোকটা জানে কী করে!
সম্মোহিতের মতো এর পরে তার সব কথা বিশ্বাস করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায়ই ছিল না। নিজে নিজেই বলছিলেন, ‘পেটের ডান পাশে আঘাতের সম্ভাবনা স্পষ্ট। আগামী ছয় মাস খুবই খারাপ সময়।’
সেই ছয় মাস, আজও, আমার জীবনে আর শেষ হলো না।
২.
বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াই। আকাশটা ঝকঝকে নীল। নিত্যদিনের মতো অসংখ্য মানুষ ছুটে চলছে এদিক-সেদিক। কারো চোখের দিকে আমি আর তাকাতে পারছি না। প্রতিটি মানুষকে আমার এক-একজন ছদ্মবেশী রঞ্জু ভাই মনে হতে থাকে। যেন আচমকা এসে চাকু চালিয়ে দেবে পেটের ডান পাশে।
পকেটে রুমির ফোন বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে।
জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।