বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২

চন্দ্রবিন্দু থেকে সন্ধিক্ষণ : নুরেন দূর্দানী

0

‘এইটা তোমার গান
তুমি লোডশেডিংয়ে চাঁদের আলোর সর
তুমি জ্বরের শেষে সূর্য ধোয়া ঘর’

এইটা তোমার গান | চন্দ্রবিন্দু

 

পহেলা মে, হিস্ট্রিতে দেখা মিলল পরপর বেশ কয়েক বছর আমার জ্বরমুখী সকাল উজ্জ্বল। আমার টেবিলের ধুলোপড়া বই, কেউ একটু এসে গুছিয়ে দেবে। উঁহু, এখানে গুছিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। এই বছর নিয়মটা ভেঙেছে। শুধু শব্দ কেটে কেটে ভাবনায় থাকছি। অসুখও তো কখনো-সখনো সুন্দর, যদি পাশে কেউ একজন থাকত কপালে জলপট্টি দিত, গায়ে হাত দিয়ে বলে ফেলত ‘ইসস, এতো তাপ, যেন নামছেই না।’ এলোমেলো আমাকে গুছিয়ে দিত কাপড়ের ভাঁজে, এনে দিত চিকেন স্যুপ অথবা লাল রঙের ডালিম, কিছুটা বিট লবণ মাখিয়ে মাল্টা খেতে দিলেও মন্দ হতো না। কারণ শিরায়-শিরায় ভিটামিন সি-এর প্রয়োজনীয়তা আছে। আচমকা এই ভাবনাগুলো সুখী করে তোলে নিজেকে। এখন এই মুহূর্তে একটা আয়োজন যদি ‘জীবন’ হয়, তবে সেখানে দিনগুলো হুবহু একই থাকে শুধু ব্যতিক্রম হতে থাকে সম্ভাবনা। আমি কি তোমার কথা ভাবছি, না কি তুমি আমার কথা ভাবছ। গাছের পাতায় শব্দ হচ্ছে, তোমার কি ছন্দপতনের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থেকে মাছের সাথে আনমনে গল্প করতে। তাকিয়ে দেখতে, কতো সবুজ ছেয়ে আছে পুরোটা পাড় জুড়ে। কী, মনের ভুলে চিন্তাঘুমে আটকে গেলে?

আমি পাতা আঁকলে গাছ হয়ে যায় তখন কেবল নিজেকে দেখতে পাই নিঃসঙ্গ। কখনো কোনো আর্ট স্কুলের বেঞ্চিতে বসে পাখি আঁকা শিখিনি। যতবার ছবি এঁকেছি ততবার জল হয়ে গেছে আকাশ আর সেখানে ভেসে বেড়াত ডানাওয়ালা মাছ। তাদের পেখম ছিল বোঞ্জেস-ব্লু। তারা রোদ্দুর ভালোবাসতো তাই পৌঁছাতে চাইত সূর্যদেবের কাছে, জল-আকাশে উড়ে উড়ে তারা চলে যেত।

আমরা বোহেমিয়ান হতে চেয়েছি। সত্যি আমরা ছুটছি, আর আমাদের ঘিরে ছুটছে যারা। এই বৃত্তের ভেতরও কিছু মানুষ থাকে এমন, বন্ধুত্বহীন-প্রেমহীন আর কাব্যহীন। তাই বলে কেউ তো আর একলা হাঁটছি বলা যাচ্ছে না। কাউকে ভালোবাসছি না, স্পষ্ট হচ্ছে না। এভাবেও গাইতে ভালো লাগে;

 

‘আয়না ভরা দিন রূপ সায়রের জল
আলগা ছুটির রোদ রক্ত ঝলোমল
তোমায় দিলাম…
এই খাতার ভাজে গাছের পাতার নাম’

এইটা তোমার গান | চন্দ্রবিন্দু

 

আমি পাতা আঁকলে গাছ হয়ে যায় তখন কেবল নিজেকে দেখতে পাই নিঃসঙ্গ। কখনো কোনো আর্ট স্কুলের বেঞ্চিতে বসে পাখি আঁকা শিখিনি। যতবার ছবি এঁকেছি ততবার জল হয়ে গেছে আকাশ আর সেখানে ভেসে বেড়াত ডানাওয়ালা মাছ। তাদের পেখম ছিল বোঞ্জেস-ব্লু। তারা রোদ্দুর ভালোবাসতো তাই পৌঁছাতে চাইত সূর্যদেবের কাছে, জল-আকাশে উড়ে উড়ে তারা চলে যেত। তাদের উড়ে যাওয়া দেখে আমার ভীষণ আনন্দ হতো আবার কিছুটা দুঃখও। সহজ-সরল আলাপকালে কথাগুলো ডুব দিত, খুঁজে ফিরতাম আমাকে। নিখোঁজ আমি আনমনে অদ্ভুত জাদুকরকে ডেকে যেতাম, যে মেঘের বাড়িতে আমার জন্য ঝুড়ি ভর্তি ফুল সাজিয়ে রাখত। আমরা দুজনায় কান পেতে শুনে নিতাম নীলাদ্রির আলাপন। তাদের নতুন ভুবনে জেগে উঠত গ্যালাক্সি নাইট, তারাদের ছুটোছুটি আর শিশুতোষ কৌতুহল। মোহের ভেতর শুধু ছোট্টোটি চুম্বন, চোখ মেললেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেত অদ্ভুত জাদুকর। কতবার ডেকে যাই তারে, ততবারই উৎসবের শেষ দৃশ্যে রামধনু উঁকি দিয়ে নিভে যায়। অশ্রুধারা গড়িয়ে যায়, মিশে যায় সেই নদে যেখানে তোমার আমার বুকের ভেতর শব্দ ধারণ করে। কান পেতে শুনতে থাকি তোমার-আমার বুকের শব্দ; পাড় ভেঙে যায় ওই ধারে। শুধু হাহাকারের শব্দ ভেসে আসে আর আহাজারি, মুহূর্তে পৃথিবীতে বসতহীন-নিঃস্ব হয়ে গেল যারা, ভাসিয়ে নিয়ে গেল শেষটুকুন। তবুও কিছু দুঃখ ঘিরে থাকুক অনেকটা এমন;

 

‘এইটা তোমার গান
তুমি নরম ঠোঁটে স্বেচ্ছা ব্যথার নীল
তুমি অন্য মনে একলা পাখির ঝিল’

এইটা তোমার গান | চন্দ্রবিন্দু

 

কাছাকাছি আমরা পৌঁছাতে পারি না। তবুও মনে হয় আমাকে ভেবে লিখে ফেলা কোনো গীতিকবির গান। প্রেম হয়েছিল কি আমাদের? তুমি ঘাসের উপর পা গুটিয়ে বসে আছ। সবাই তোমাকে ঘিরে বসে আছে, জানতে চায় হিস্ট্রিক্যাল অ্যালগরিদম। তুমি এতো জ্ঞানী হয়ে উঠলে কবে আমি ভেবে যাচ্ছিলাম। অবশ্য সেটা তোমার বিন্যস্ত জ্ঞানের ধারা, যাতে তুমি পারদর্শী। সেই তুমি হাত দিয়ে ইশারা করলে, আমাকে বসতে বললে। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, তুমি পরিচয় করিয়ে দিলে এই শহরে তোমার চেনামুখ, যারা আমার কাছে পরিচয় পর্বের পরও অচেনাই থেকে গেল। আমিও নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে, বসে থাকা তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কি ভেবে উঠে দাঁড়ালে, সবার কাছ থেকে বিদায় নিলে। আর আমাকে আহ্বান করলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সন্ধ্যা নামিয়ে দিতে। আমিও চুপচাপ তোমার কথায় সায় দিলাম। এরপর একটা রিকশায় বসে পড়লাম দুজন; যথেষ্ট চুপচাপ ছিলাম আমি আর তুমি গাইতে থাকলে গান। নিষ্প্রাণ নগরীতে কিসের টানে যেন প্রাণ ফিরতে শুরু করল। চাঁদের আলোয় স্নান করতে থাকলাম আমরা। হঠাৎ গান থামিয়ে আমাকে বললে কবিতা শোনাতে, গানের সুরে ভাসতে ভাসতে আমি ‘কবিতা’ শব্দ শুনে কিছুটা হোচট খেলাম। তুমি আমার হাত সেই প্রথম ধরে ফেললে। বলে উঠলে; ‘কাব্য হয়ে উঠবে তখনই যদি তুমি নরম কোমলপ্রাণের পরশ বুলিয়ে দিতে পারো’ আর ঠিক তখনই আমাকে বিষণ্ন-সুন্দর ঘিরে সুর বসাল প্রকৃতি। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আরও ইতস্তত হয়ে পড়লাম। অন্ধকারের ভেতর ডুবতে শুরু করলাম, কবিতা আর বলা হয়ে উঠল না। বাকিটা পথ মোহের স্তুপের অন্য রূপ, আমাকে দেখতে পাচ্ছ না তুমি। কেন জানি মনে হলো যাপনে বস্তুগত দূরত্ব নেই। দৃশ্যমান হলে যত্নে থাকে। সেখানে আলসেমি কেবল মান্য, দৃশ্যমান জেনেই অবহেলা। ছাড়তে চায় না কেউ…

 

‘এই মায়ার পশম হাত দেওয়ার আরাম’

 

তবুও কোন মায়া? কিসের টানে সেজে ওঠে প্রকৃতি?

ঝড় হচ্ছে না। বৃষ্টিও আসে না। সন্ধ্যা হলেই বাতাসের শব্দ। সকাল হলেই ভলিউম বাড়ায় রোদ। আজকাল কোথাও কোনো ছুটি নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু দৃশ্য ধরা দেয়; লাল সেডে সাদা মিশেলে লেখা থাকে ‘আজ নগদ, কাল বাকী’ ধার নেই টং ঘরে। ফুটপাত ফাঁকা। বাস আসছে, ঝুলছে না কেউ। কোলাহলের ভেতর নগরজীবন যেন আজ অন্য রকম। ঘাম গায়ে মেখে গেলে, মুছে ফেলছি টিস্যুতে চেপে চেপে। আর দৃষ্টিতে গল্প জমে যাচ্ছে উলটো যানের পথে দাঁড়ানোর অনুমতি পেতে। নীল পোশাকের কনস্টেবলের মুঠোতে দশ-বিশেক ভাংগতি রুমালের আড়ালে পকেট পূর্ণ হলো। দেশটা বড্ড অনিয়মের না কি মানুষ্য সমাজটাই এমন বিশৃঙ্খল? বাতাসের দোলায় আপনা-আপনি ঝরে গেল সাদাফুল। বাস স্টপজে দাঁড়িয়ে চায়ের স্টলে শব্দ হচ্ছে; বুদবুদে ফুটছে লিকার। রোদ্দুরের শহরে বৃষ্টির ছাঁট, এভাবেই চলছে যেমন;

 

‘ওই আঁচল ঘেরা বৃষ্টি ছাঁটের ঘ্রাণ
রেখে মেঘের শিশু গিয়েছে ভাসান’

 

আজ আকাশটা খুব সুন্দর। কেমন হলদে হয়ে গেছে দালানগুলো। রশ্মির আলো-খেলা। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। আজ কী দিবস; শহরে কোনো দিবস এলেই শিল্প এলাকার অফিসপাড়া ফাঁকা হয়ে যায়। আমি যেখানে কাজ করি, সেখানের হাউজে আজ মানুষ কম বলেই সেন্ট্রাল এসি শীতের কাঁপুনি দিয়ে যায়। এক অর্থে তিনশ পয়ষট্টি দিন আমার অফিসের দেয়ালে লেগে থাকে শীতকাল। ডেস্কের ব্রাউন খামের কাজগুলো নিয়ে বসতে হবে। স্ট্যাম্প-কালি আর কলমের ভেতর সাদা পাতাগুলো কেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জীবনের হালখাতাও হয়তো এমন। জগতের ভেতর লালিত-পালিত হচ্ছে দিবস সম্ভার। কখনো পাখি হতে ইচ্ছে করেনি, শুধু ভাসতে চেয়েছি। অবশ্য বোহেমিয়ান সবাই হতে পারে না। এই জীবনে বোবা গাছ হতে চেয়েছি।

আমি যেখানে কাজ করি, সেখানের হাউজে আজ মানুষ কম বলেই সেন্ট্রাল এসি শীতের কাঁপুনি দিয়ে যায়। এক অর্থে তিনশ পয়ষট্টি দিন আমার অফিসের দেয়ালে লেগে থাকে শীতকাল। ডেস্কের ব্রাউন খামের কাজগুলো নিয়ে বসতে হবে।

এইটুকুনের বেশি কি আর চাইতে পারি? চোখের কোণে জমে যায় জল কিছুটা ইতস্তত হয়ে পড়ি আজকাল। কতশত সংবাদ জমা হচ্ছে, কতগুলোর কথাই বা মনে থাকে। মানুষ একাকী নয়, শুধু মগ্ন হয়ে থাকে সাউন্ডস অবজেক্টের ভেতর। মন্দ কী, কেউ না কেউ তো ব্যস্ত পাহাড়সম। কোথায় যেন পড়েছিলাম; ‘হৃদয় মেলে দিতে হয় যদি পেতে চাই নিজেকে, আর তখন হাওয়ায় ভেসে যায় এক আলৌকিক চুম্বক। যে আত্মাকে নিয়ে যায় বহুদূর, যেখানে সেই মানুষটি পৌঁছাতে চায়। সকল ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে সে যেন হৃদয় দিয়ে এগিয়ে চলে সম্মুখ পথে।

এই পথটুকু যেতেই ছায়াকর্তা বললেন; ‘তোর সময়গুলো জঞ্জালপূর্ণ, থামবি এইবার?’

থামছি, হৃদয় কে সচল রেখে, মাঝে মধ্যে থামতেও যে জানতে হয়। সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। হেঁয়ালি করে কাউকে ভালোবেসো না, প্রিয়! আর এই দেখো-দেখো, একটু ফুঁ দিয়ে দেই? উড়িয়ে দেই উইশ পাপড়ি; তোমার জীবনে আসুক আনন্দ। সারা দিন মন শ্যামল মাটির গন্ধে জেগে থাকুক। গানের ভুবনে ডুবে গিয়ে মাছরাঙা কী তুলে দিলো তোমায়? কোন অনুতাপের পর মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় জানো কী? আবারও বলছি হেঁয়ালি করে কাউকে ভালোবেসো না, প্রিয়। শুধু গোটা অক্ষরে জেনে রেখো— পিছুটানের দরজায় কড়া কেউ না নাড়লেও, কেবল শব্দহীন ঈশ্বর জানেন খেলাঘরে শিশুর আহ্বান… স্রোতের ভেতর থেমে যাওয়া সুর…

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১২ অক্টোবর, ঢাকায়। শৈশব-কৈশোর বেড়ে ওঠা শহরে। কবিতা, গল্প, মুক্তগদ্য ইত্যাদি লেখেন। লেখালেখির শুরু স্কুল জীবনে। তারপর ব্লগ, বিভিন্ন ছোটোকাগজ ও পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। লেখকের প্রথম বই ‘ঘুমপত্র’ (অনুপ্রাণন, ২০১৮)। কর্মজীবনের এক অংশ কাটিয়েছেন বেসরকারি রেডিওতে প্রযোজক ও উপস্থাপক হিসেবে। ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।