সুন্দরবনের গল্প-১
সুন্দরবনের গল্প ভিজে আছে লবণাক্ত ঘ্রাণে
জীববৈচিত্র্যের ছবি মাঝেমাঝে কেঁপে ওঠে ত্রাসে;
এত যে বিচিত্রপ্রাণ— বহুদ্বন্দ্বপ্রশাসিত প্রাণে,
যত তৃণজীবী প্রাণ— তাদের শোণিত মাখা ঘাসে।
জলে দাঁত, থলে থাবা, উপরন্তু বরুণের ভয়
বিড়ম্বিত একতায়— বনতন্ত্র, সীমানাবিভাগ;
শোণিতের স্বাদ তবু ডেকে আনে প্রাণের প্রলয়
ছায়াহরিণের ছায়া ফলো করে ডোরাকাটা দাগ।
ঘুমভক্ত লোকালয়— উপার্জিত রাখালান্ত পাপ;
সেই ডাক নেই, তাই হাটেবাটে ভীতিকর ছাপ।
সুন্দরবনের গল্প-২
ঈসা খাঁর ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি গাছ
সম্মুখে জলেশের ঊচ্ছ্বাসের চোখ— লোনা আস্ফালন,
পশ্চাতে লোকালয়; সবুজ আড়ালে থেকে তলে তলে
গোড়া কাটে মীরজাফর-জগতশেঠ হাত। তাই দেখে
ক্লাইভের চোখ হয়ে হাসে স্ফীতি আর লবণের লোভ।
সুন্দরবনের সুরসভায়
সুন্দরবনের শ্যামা গায় শোনো সহজিয়া গান
অর্পণগাছিয়া জলে বেজে ওঠে সুরের সঙ্গম
রয়েল বেঙ্গল বাঘ সেই সুরে পেতে আছে কান
সুরের সভায় এক তন্দ্রাচ্ছন্ন মোগলে আজম!
ভাটির দেশের মাঝি সেই সুরে পেয়ে ভাটিয়ালি
নৌকার বাদাম খুলে মাঝপথে মজে সুখটানে
বাওয়ালী দ্বিধাগ্রস্ত আর কেন বন করা খালি!
এতদিন বুঝিনি তো সহজিয়া সংগীতের মানে!
মাওয়ালী ভাবে বুঝি মউচাক ছুঁয়েছে সে গলা
কুহু ভাবে তার সুর সঙ্গোপনে কে করেছে চুরি!
শতবর্ষী বটবৃক্ষ সেই গানে অন্তরে উতলা
মাটির কোমরে বাঁধে মায়াময় ঠাকুরের ঝুরি।
বনের প্রতিটি ঘরে সেই সুর বেঁধে নেয় বাসা
আকাশ-মাটির মাঝে বেড়ে যায় দিগন্তের টান;
তিনটি শেয়াল শুধু বুকে নিয়ে অসূয়া-পিপাসা
সে গানের বৈরিতায় বনে বনে ছড়ায় দুর্নাম।
শেয়ালের সিংহরোগ
ভাগের তো শেষ নেই— সুন্দরবন পাঠ করে জানা গেল—
বিভক্তিই জীববৈচিত্র্যের মৌল দুর্বলতা। বাওয়ালীদেরও
আগে একথা জেনেছিল শেওড়াপাড়ার ভাগ্নে— শেয়াল।
দলেবলে ভারী হওয়ায় সিংহ নয়—সেদিন বাঘই রাজা বলে
সাব্যস্ত হলে মামার লেজ ঘেঁষে লাফিয়ে উঠেছিল শেয়াল:
হুক্কা-হুয়া হুক্কা-হুয়া! কিন্তু যমদূত কবেই-বা সম্মোহিত ছিলেন!
ফলে তো সিংহকে বহাল রেখে হারিয়ে যান বাঘ-মামাজি; আহা
বাঘ-মামা! অথচ আশ্চর্য এই যে বাঘের মৃত্যুতে শেয়াল নয়,
শোকাগ্রস্ত হয়ে ওঠেন সিংহ; ইষ্টদেবের নাম জপেই কেটে যায়
তার বৃক্ষময় দিন, বৃক্ষময় রাত। ফলে এতে আর আশ্চর্য
হওয়ার কি আছে যে শূন্য সিংহাসন নিয়ে তার কোনো মাথা
ব্যথা নেই! এই ফাঁকে রাজাসনের জন্য কাতর হয়ে উঠেছে
শেয়াল; আর সিংহকে শালবনে কোণঠাসা করে বাঘ-মামার
মধ্যপদলোপী কর্মধারা সমাস অর্থাৎ কিনা সিংহাসন দখলের
কৌশলটা আগাগোড়াই জানা ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাগ্নেধনের।
আর শেয়ালভক্তের কি অভাব ছাগলাকীর্ণ এই ঘাসের তল্লাটে!
অতএব শুরু হয়ে গেছে হুক্কা-হুয়া! বৃদ্ধসিংহ না হয় শুয়েই রইলো
ঝরাপাতার গালিচায়; আর হাতিরা তো বরাবরই নির্বিকার; কিন্তু
এই শুনে কি হাইস্যা দিবে না পুরোনো ঢাকার টমি মিয়ার ঘোড়া?
জঙ্গলায়ন
দ্যাখো—এক থাবার নগ্ন সাফল্যে উজ্জীবিত আরো
এক থাবা; উভয় ক্ষেত্রেই থাবাগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার
আর তাদের আঘাতে স্বভূমে সমুলে উৎপাটিত
বাতাসের সংগীত শুনে বেড়ে ওঠা দুই ভূগোলের
সংখ্যালঘু বৃক্ষরাজি যারা দিয়ে এসেছে ফল ও ছায়া,
শোভা ও অম্লজান, দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ।
কী দোষ তাদের? হায়, তাদের র্পূব-প্রজন্ম নাকি পড়শি
ভূগোলের আমবাগান ছিল অপ্রমাণিত কোনো এক কালে!
অতএব তাদের শাখায় থাবা, সমূহ শেকড়ে দাঁত!
মানুষ নেকড়ে হলে বৃহত্তম গণতন্ত্রও জঙ্গল হয়ে ওঠে।
কবি ও গবেষক। জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩। প্রকাশিত গ্রন্থ : ২৫টি। কবিতার বই : ২০টি; ছড়ার বই ৩টি; প্রবন্ধের বই ১টি; এবং গবেষণা গ্রন্থ: ১টি। কয়েকটি উল্লখযোগ্য বই : ‘মহানন্দা এক সোনালি নদী নাম’, ‘কুয়াশার বর্ণমালা’, ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’, ‘জোছনার রাত বেদনার বেহালা’, ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’, ‘হিজলের সার্বিকট হাউস’, ‘নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব’।