বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

জীবন যেখানে শ্রেণিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা : লাবণী মণ্ডল

0

‘আমি ধনীদের চেতনা ভারাক্রান্ত করে দেব ভোগান্তি আর গোপন, তিক্ত ব্যথার অশ্রু দিয়ে।’

—রোজা লুক্সেমবার্গ

 

ওয়েন্ডি ফরেস্টের লেখা ‘রোজা লুক্সেমবার্গ: ইন হার ওন টাইম’ বইটি ১৯৮৯ সালে হ্যামিশ হ্যামিল্টন থেকে প্রকাশিত হয়। এটি অনুবাদ করেছেন জি এইচ হাবীব। ‘রোজা লুক্সেমবার্গের জীবন’ শিরোনামে অনূদিত বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। সেখানে রোজার সংগ্রামী জীবনই শুধু নয়, তাঁর জীবনের আরও অনেক দিক উঠে এসেছে। বইটি পড়া শেষে তা নিয়ে লিখতে বসলেও লেখার পরিসর বইয়ের বাইরেও রোজা বৈপ্লবিক চিন্তাকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারে। যার আলোকে পাঠক গ্রন্থটি সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারেন।

সমাজের সর্বত্রই পড়াশুনার চর্চা কমে গেছে। বামপন্থী বা কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এর বাইরে নয়। বিশেষ করে নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনে কার্ল মার্কস, ফ্রেদরিখ এঙ্গেলস, ভ্লাদিমির লেনিন, জোসেফ স্তালিন বা মাও সে-তুঙ— এঁদের ভূমিকা অনন্য। আরও অনেক পুরুষ বিপ্লবী নেতাকে নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে সংখ্যায় তুলনামূলক কম হলেও বিভিন্ন সময়ে যে কয়েকজন নারী বিপ্লবী নেতা সামনে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে আলোচনার পরিসরটা নিতান্তই নগণ্য। রোজা লুক্সেমবার্গ, ক্লারা জেৎকিং বা আলেকজান্দ্রা কোলনতাইয়ের বিপ্লবী জীবন নিয়ে সেভাবে লেখালেখিও হয় না। তাই এমন একজন নারী বিপ্লবীর জীবনী বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

নারীমুক্তি আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট আন্দোলনের চিন্তা করতে গেলে যে কয়েকজন নারী নেতৃত্বের কথা আলোচনায় আসবে, তাদের মধ্যে রোজা লুক্সেমবার্গ অন্যতম। একজন বিপ্লবী, একজন কমিউনিস্ট। পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো এমন সৎসাহস কজনেরই বা থাকে! রোজা লুক্সেমবার্গের মতে, কোনো নারী বা পুরুষ এককভাবে মুক্ত হতে পারে না। বিশ্বের একজন মানুষও যদি মুক্ত না থাকে, তাহলে মানবমুক্তি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। প্রত্যেক মানুষের মুক্তি একে-অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবার এটিও অনস্বীকার্য যে, নারী হাজার হাজার বছর ধরে বন্দি, যখন থেকে শুরু হয়েছিল আদিম সাম্যবাদ ভেঙে ব্যক্তিগত মালিকানা। তাই নারীমুক্তির জন্য ঘরে-বাইরে সর্বত্র পৃথক সংগ্রাম জরুরি।

 

২.
ঊনবিংশ শতাব্দী। ১৮৭১ সালের ৫ মার্চ। ফাল্গুন মাস। কনকনে শীত যায় যায় অবস্থা। হিমেল হাওয়া। এমন এক সাধারণ দিনে পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর জামোস্কে এক ইহুদি পরিবারে জন্ম রোজা লুক্সেমবার্গের। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রোজালিয়া লুক্সেমবার্গ। কিন্তু পরিবারটি ধর্মভীরু ছিল না। বরং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। রোজার মা-বাবা নিজেদের প্রথমে পোল এবং ইউরোপীয় বলে ভাবতেন। ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ভালোবাসতেন।

ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোটো ছিলেন রোজা। শিশুর জন্য পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রোজার মা ছিলেন পড়ুয়া। মায়ের অনুপ্রেরণাই রোজাকে বই পড়তে উৎসাহিত করেছে। তিনি রোজাকে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রোজার বাবা ছিলেন কাঠের ব্যবসায়ী। তবে অন্যান্য ইহুদি পরিবারের চেয়ে তাঁদের স্বচ্ছলতা ছিল। সংকট যখন ঘনীভূত হয়ে আসত, তখন ঘরের জিনিস বন্ধক রাখা লাগত।

রোজা তাঁর জন্ম সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘পেছনে ফেলে আসা জীবন’ অধ্যায়ে বলেন, ‘সত্যি বলতে কী, আমি আসলে জন্মেছিলাম একটা মুরগির ফার্ম দেখাশোনা করার জন্য। কথাটা কিন্তু আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে।’ জীবন সম্পর্কে গভীর ও নির্মোহ বোধ থাকলেই কেবল এমন কথা অকপটে বলা যায়!

Rosa-Luxemburg Cover

রোজা লুক্সেমবার্গের জীবন | লেখক: ওয়েন্ডি ফরেস্ট | অনুবাদ: জি এইচ হাবীব | প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা | প্রকাশক: কথাপ্রকাশ | মূল্য: ৩০০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

মাত্র পাঁচ বছর বয়স। ছোট্ট শিশু। মাত্রই বুঝতে শিখছেন। এ সময় দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন রোজা। এক বছর ধরে শয্যাশায়ী থাকেন। সে অবস্থায় নিজে নিজে লিখতে ও পড়তে শেখেন। রোগটা খুব জটিল, যে জটিলতার কারণে তাঁর শ্রোণীদেশে স্থায়ী ক্ষতি হয়। জীবনের শুরুতেই বড়ো ধাক্কা। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে তাঁর শারীরিক সীমাবদ্ধতা বারবার হেরে গেছে, জয় হয়েছে ইচ্ছাশক্তি, একাগ্রতা ও দৃঢ়তার। তিনি সারা জীবন খুঁড়িয়ে হেঁটেছেন। জীবনের কোনো একদিন তিনি এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেননি; বরং বাস্তবতা মেনে নিয়ে বিপ্লবী রাজনীতিতে প্রবলভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন।

রোজা লুক্সেমবার্গ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিও ট্রটস্কি ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন ছোটোখাটো গড়নের একজন মানুষ; রোগা-পাতলা, শারীরিকভাবে দুর্বল, দেখলে এমনকি রুগ্‌ণ বলে মনে হতো। কিন্তু মুখটা বেশ চমৎকার, আর চোখ দুটো খুব সুন্দর, তা থেকে বুদ্ধিমত্তা বিচ্ছুরিত হতো। স্রেফ তাঁর মনের সাহস আর চরিত্র মাধুরী দিয়ে তিনি যে কাউকে আকৃষ্ট করতে পারতেন… সূক্ষ্ম পার্থক্যবিশিষ্ট বহুমুখী স্বভাবের অধিকারী ছিলেন তিনি। বিপ্লব ও তার সংরাগ, মানুষ ও শিল্প, প্রকৃতি, পাখি এবং বিকাশমান নানান জিনিস—এই সবই তাঁর আত্মার অসংখ্য তারে বেজে উঠতে পারত।’

রোজার এই প্রখর বুদ্ধির কারণেই তিনি মাত্র তেরো বছর বয়সে ওয়ারশ বালিকা বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। তৎকালীন পোল্যান্ড ছিল রুশ জারশাসিত। ওই স্কুলটি ছিল মূলত সম্ভ্রান্ত খ্রিষ্টানদের জন্য। সেখানে পোল্যান্ডের কোনো নাগরিক, তাও আবার ইহুদি কারও পক্ষে পড়ার বিষয়টি ছিল অস্বাভাবিক! শ্রেণিবৈষম্যের পৃথিবীতে রোজাও এর বাইরে ছিলেন না। এমন একটি স্কুলে প্রতিবারই তিনি প্রথম হতেন; কিন্তু সোনার পদক তাঁকে দেওয়া হতো না। যেসব চিত্র রোজাকে আরও বেশি প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী করে তোলে।

মাত্র ষোল বছর বয়স। যে বয়সে নিজের রূপ-লাবণ্য নিয়ে ভাবার কথা, তা করেননি তিনি। ওই বয়সেই সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। শ্রমিকদের পক্ষে কাজ শুরু করেন এবং গোপন বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। সে বয়সেই বিদ্রোহী প্রেরণা পেয়েছিলেন রোজা। জন্মগতভাবে একজন ইহুদি হিসেবে তাঁকেও রুশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য এবং জারের একনায়কতন্ত্রের অধীনে বাস করতে হতো। সে সমাজে বিশেষ করে নারীদের জীবন ছিল বৈষম্যে ভরা। রোজার পরিবার স্বচ্ছল এবং সচেতন থাকার ফলে কিছুটা স্বস্তি মিললেও, রোজার জন্য ছিল এটি অস্বস্তি। বৈষম্যভরা এক পৃথিবীকে বৈষম্য মুক্ত করার দায় নিয়েছিলেন তিনি।

 

৩.
রোজা লুক্সেমবার্গ বেড়ে উঠেছেন বৈষম্যপূর্ণ পরিবেশে। কিন্তু তিনি সেটা মানেননি। সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া প্রথম কয়েকজন শিক্ষার্থীর অন্যতম ছিলেন তিনি। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতাসহ নিজের নানা মতাদর্শের জন্য বেশ কয়েকবারই কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে। মার্কসীয় আদর্শে ধারণের পরও তিনি ছিলেন জার্মানিতে বামপন্থী রাজনীতির কট্টর সমালোচকদের একজন।

‘আমি ধনীদের চেতনা ভারাক্রান্ত করে দেব ভোগান্তি আর গোপন, তিক্ত ব্যথার অশ্রু দিয়ে।’ রোজার এ কথার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয় কতটা বেদনাক্রান্ত পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা। তিনি মনেপ্রাণে ধারণ করতেন, সমাজবিপ্লবী হওয়ার জন্য বিশেষ কোনো বয়স কিংবা আকারের হতে হয় না। মানুষ তাঁর সর্বোচ্চ ইচ্ছাশক্তি দিয়েই জয় করতে পারেন, দূর করতে পারেন সমাজের অসঙ্গতি—অন্যায়—অবিচার। মানুষের সঙ্গে মানুষের এ বৈষম্য রোজাকে পীড়া দিত। তিনি ভাবতেন, মানুষ হয়ে মানুষকে কেন দূরে ঠেলে দেয়, কেনইবা পুঁজির খেলার কাছে মানুষের ভালোবাসা হেরে যায়!

সমাজ পরিবর্তনের মূল তত্ত্বই হলো, গতি—পরিবর্তন—বিকাশ। রোজা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদের পরাজয় ঘটবেই। এর দাপট অস্থায়ী ও ভঙ্গুর। একটু শক্তিশালী নাড়া দিলেই ভেঙে পড়বে মসনদ। গড়ে উঠবে শোষিতের রাজ্য।

 

৪.
রোজা লুক্সেমবার্গের বিখ্যাত উক্তি ছিল ‘সমাজতন্ত্র না হয় বর্বরতা’। এজন্যই কত শত সংগ্রামীর জীবনকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। সকল বিপ্লবেরই মৌলিক প্রশ্ন হলো— রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্ন। লেনিন দেখিয়েছেন যে, সর্বহারা বিপ্লবের মৌলিক প্রশ্ন হলো— সর্বহারা একনায়কত্বের প্রশ্ন। বৈপ্লবিক পন্থায় বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে প্রতিষ্ঠিত এই একনায়কত্ব হলো— একদিকে সর্বহারাশ্রেণি আর অন্যদিকে কৃষক সম্প্রদায় ও অন্যান্য সকল মেহনতি জনগণের মধ্যকার বিশেষ ধরনের মৈত্রী। এটা হলো— অন্যরূপে ও নতুন অবস্থাধীনে শ্রেণিসংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে শোষকশ্রেণিগুলোর প্রতিরোধের বিরুদ্ধে, বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং পুরাতন সমাজের শক্তি ও অভ্যাসের বিরুদ্ধে এক লাগাতার সংগ্রাম— একই সময়ে রক্তাক্ত ও রক্তপাতহীন, হিংসাত্মক ও শান্তিপূর্ণ, সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংগ্রাম। সর্বহারা একনায়কত্ব দ্বারা এবং এইসব ফ্রন্টে দৃঢ়তার সঙ্গে ও লাগাতার সংগ্রামের জন্যে মেহনতি জনগণকে পুরোপুরি সংঘবদ্ধ করা ছাড়া সমাজতন্ত্রের বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়।

১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব লুক্সেমবার্গের জীবনের কেন্দ্রীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। তখন পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জার্মানি এমন একটি দেশ যেখানে বিশ্ব বিপ্লবের উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তিনি তখন বিশ্বাস করেছিলেন যে, এটি রাশিয়ায় আগুন ধরাবে। তিনি ওয়ারশ গিয়েছিলেন, সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন এবং কারারুদ্ধ হন। এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে তাঁর বিপ্লবী গণ-অ্যাকশনের তত্ত্ব উদ্ভূত হয়েছিল, যা তিনি ম্যাসেনস্ট্রিক, পার্টেই অ্যান্ড গেওয়ার্কশাফটেন (১৯০৬; গণ ধর্মঘট, রাজনৈতিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়ন) এ উত্থাপন করেছিলেন। লুক্সেমবার্গ একটি সমাজতান্ত্রিক বিজয় অর্জনের জন্য সর্বহারাশ্রেণির, পশ্চিমা এবং সেইসঙ্গে রুশদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে গণ ধর্মঘটকে সমর্থন করেছিল। গণ ধর্মঘট, ‘উদ্দেশ্যমূলক অবস্থার’ স্বতঃস্ফূর্ত ফলাফল শ্রমিকদের উগ্রপন্থী করবে এবং বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। লেনিনের মতো তিনিও একটি শক্ত পার্টি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন যে, সংগ্রাম থেকে স্বাভাবিকভাবেই সংগঠনের উদ্ভব হবে। এর জন্য তাকে বারবার অর্থোডক্স কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।

 

৫.
‘পেছনে ফেলে আসা জীবন’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে ‘নারীর স্থান থেকে’ পরিচ্ছেদে বলা হয়, ‘রোজাকে যদি আমরা তখনকার নারীদের সাধারণ অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করাই তাহলে একজন পাবলিক ফিগার হিসেবে তাঁর আবির্ভাব আরো বেশি চমকপ্রদ ব’লে মনে হয়। অপেক্ষাকৃত শান্ত একটা জীবন যদি তিনি ওয়ারশ শহরে বেছে নিতেন তাহলে তাঁকে বিয়ে করার একটা প্রবল চাপের মধ্যে পড়তে হতো; একজন নারী এর চাইতে বেশি আর কিছু চাইতে পারে না, এমনটাই আশা করা হতো।’ রোজার বাবা-মা ছিলেন উদারমনা। যে কারণে এসব বিষয়ে তাঁকে বড়ো ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়নি। সে সময় আইন খুব কঠিন ছিল। জারের আমলের পারিবারিক আইন অনুযায়ী নারীর কর্তব্য ছিল ‘পরিবারের কর্তা হিসেবে স্বামীর কথা মেনে চলা, প্রেমময়ী ও শ্রদ্ধাপূর্ণ হওয়া, এবং সবক্ষেত্রে বাধ্যগত হওয়া।’ যা রোজার ব্যক্তিত্ব বা চিন্তার ঠিক বিপরীত। সে সময় নারীর নিজের কোনো টাকা-পয়সা বা সম্পত্তি থাকতে পারত না। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের চাকরি বা ভ্রমণ করা যেত না। বিবাহ বিচ্ছেদের কথা তো ভাবাই অসম্ভব। যে কারণে বিয়ে সম্পর্কটি হয়ে পড়েছিল জুলুম-অত্যাচারের।

কিষাণী নারী প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও খারাপ। ‘পেছনে ফেলে আসা জীবন’ অধ্যায় থেকে—‘কিষাণীদের জন্য গর্ভনিরোধের কোনো বালাই ছিল না এবং যৌন মিলনে রাজী না হওয়ার কোনো অধিকার ছিল না তাদের। গর্ভাবস্থায় কোনো বিরাম ছিল না। পেরেক বা বোতামের হুক ব্যবহার ক’রে মাঝে মধ্যে স্থানীয় কোনো অভিজ্ঞ নারী হয়ত বিপজ্জনক গোপন গর্ভপাত ঘটাতে সাহায্য করতেন। তা না হলে, নারীরা কোনো ধরনের মেডিকেল সাহায্য ছাড়াই সন্তান প্রসব করতেন। বহু নারী মারা যেতেন, শিশুরা মারা যেত আরও বেশি। ছেলে শিশুকে আনন্দের সঙ্গে বরণ ক’রে নেওয়া হতো, মেয়ে শিশুর বেলায় কান্নার রোল পড়ত।’

নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তি পেতে হলে গোড়ায় আঘাত হানতে হবে। হাজার বছর ধরে চলে আসা দৃষ্টিভঙ্গি এত সহজেই দূর করা সম্ভব নয়। মুক্তি বহু দূর। যে দূরের পথে হাঁটতে হবে, হাতে হাত রেখে। সমস্বরে স্লোগান ধ্বনি তুলে। এমনটাই ছিল রোজার চিন্তা।

শুধু বন্দুক দিয়েই পুরো বিশ্ব জয় করা যায় না। এর পেছনে প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ-বেদনা, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জনগণের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি গড়ে না তুলতে পারলে, বিপ্লবের পথ সুদৃঢ় হয় না। যে কারণেই, মননশীল শিল্প–সাহিত্যের প্রতি তিনি দিতেন আলাদা জোর। শিল্প-সাহিত্য দিয়েও যে শত্রুর দুর্গে আঘাত হানা দেওয়া যায়, শত্রুর মসনদকে টলিয়ে দেওয়া যায়, সেটি তিনি ধারণ করতেন।

বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গের মধ্যে রোমান্টিকতা, শিশু মনোভাব ছিল। বিপ্লবী চেতনা এবং রোমান্টিকতাকে সমন্বয় করে, একের পর এক শব্দ গেঁথে, গীতিময়তার মাধুরী মিশিয়ে বক্তৃতা দিয়ে জয় করেছেন শ্রমিকদের মন। আবার একইভাবে শাসকদের প্রশ্নে লৌহকঠিন।

 

৬.
১৯১৬ সালের জুলাই থেকে ১৯১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, রোজা লুক্সেমবার্গকে বার্লিন, রঙ্কি এবং রক্লোতে বন্দি করা হয়েছিল। ১৯১৭ সালে তিনি কারাগার থেকে লেখা নিবন্ধগুলোর মাধ্যমে রাশিয়ায় ফেব্রুয়ারি এবং অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, একই সঙ্গে বলশেভিক একনায়কত্ব নিয়ে সতর্কীকরণ করেছিলেন—তিনি বলেছিলেন, ‘প্রেস ও সমাবেশের অবাধ স্বাধীনতা ছাড়া, মতামতের মুক্ত সংগ্রাম ছাড়া প্রতিটি পাবলিক প্রতিষ্ঠানে জীবনীশক্তি শুকিয়ে যায়—এটি একটি ছদ্ম-জীবনীশক্তিতে পরিণত হয়।’

৯ নভেম্বর ১৯১৮ সালে তিনি কারামুক্ত হন। কার্ল লিবনেখটের সঙ্গে একসঙ্গে তিনি ডাই রোটে ফাহনে সম্পাদনা করেন, ব্যাপক সামাজিক রূপান্তরের জন্য প্রচারণা চালান এবং ১৯১৮-১৯১৯ সালের দিকে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির (কেপিডি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, পৃথিবীর সকল সভ্যতা একইভাবে গড়ে ওঠেনি, বিকশিতও হয়নি। বরং একেক সভ্যতা তার নিজস্ব আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে। আবার কোনো সভ্যতার কবরে অঙ্কুরিত হয়েছে নতুন কোনো সভ্যতার বীজ। তেমনি পুঁজির বিকাশও সব সমাজে একই প্রকারে সাধিত হয়নি। বিশ্বব্যাপী পুঁজির অসম বিকাশ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

সে সময় হাজার হাজার জার্মান শ্রমিক বিদ্রোহের ডাকে সাড়া দেন। ধর্মঘট করেন। সংগ্রামের অগ্রসেনানী রোজা জনতার জোয়ারে কারামুক্ত হলেও জীবন হয়ে পড়ে শঙ্কিত। ১৯১৯ সাল। ১১ জানুয়ারি নাগাদ রোজা-লিবনেখট ও তাদের পার্টির নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান চেষ্টা গুড়িয়ে দিতে তৎকালীন স্বৈরশাসক ব্যাপক নিপীড়ন চালায়। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি বার্লিনে ডানপন্থী মিলিশিয়া বাহিনী ফ্রেইকর্পস রোজা ও লিবনেখটকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালায়। পরে রোজার মাথায় গুলি করে হত্যা করে। এরপর একটি খালে তাঁর মরদেহ ফেলে ফেলে দেওয়া হয়। লেখক, দার্শনিক এবং যুদ্ধবিরোধী বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী রোজা লুক্সেমবার্গের তখন ৪৮ বছর বয়স। লিবনেখটকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর মরদেহ চিড়িয়াখানার বাইরে ফেলে দেওয়া হয়।

 

৭.
মৃত্যুর ১০৪ বছর পরও কেন রোজা লুক্সেমবার্গকে স্মরণ করা হয়; তাঁর চিন্তা-দর্শনকে প্রাসঙ্গিক মনে করা হয় কিংবা প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য জোর দাবি জানানো হয়? কারণ তিনি যত দিন বেঁচেছিলেন, শ্রেণিবৈষম্য-লিঙ্গ অসমতা, শারীরিক-মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মানুষদের সাথে অন্যায্য-আচরণ এবং প্রথাগত রাজনৈতিক মতবাদের বিরোধিতা করে গেছেন। সেসব প্রসঙ্গ আজও একই রকম প্রাসঙ্গিকই রয়ে গেছে।

এখনও তাঁর স্মরণে বার্লিনে র‍্যালি হয়। বিশ্বব্যাপী এখন কট্টর উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে যুদ্ধ ও দারিদ্রের শঙ্কাও। যত সংকট-দুর্দিন ঘনিয়ে আসবে, ততই বিপ্লবী-সংগ্রামী-কমিউনিস্টরা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। যে কারণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নারীমুক্তির চিন্তা ধারণকারীরা রোজার আদর্শ তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, ভোগবাদী সংস্কৃতির আমূল কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে কারণে বারবার ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের জীবনচরিত সচেতন মানুষদের তুলে আনাটা জরুরি।

সমসাময়িক অনুবাদকদের মধ্যে জি এইচ হাবীব অন্যতম। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। তাঁর অনূদিত বইগুলোর মধ্যে—‘গোলাপের নাম’, ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’, ‘সোফির জগৎ’ এবং ‘ইংরেজি ভাষার ইতিহাস’ উল্লেখযোগ্য।

জি এইচ হাবীব অনূদিত ‘রোজা লুক্সেমবার্গের জীবন’ বইটি আকারে ছোটো। মাত্র ৬৮ পৃষ্ঠা। কিন্তু প্রাথমিকভাবে একজন বিপ্লবীর জীবনকে জানতে, তাঁর সম্পর্কে ধারণা পেতে এমন বই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। সমাজ পরিবর্তন করার চিন্তা করতে হলে, ইতিহাসকে জানতে হবে। এই ব্যক্তিদের জীবনপাঠ এরই অংশ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

তাঁর জন্ম টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। সবুজের মাঝে বেড়ে ওঠা এই লেখক ভালোবাসেন প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের গল্প বলতে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রকাশনাশিল্পে। তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে সাহিত্য ও বই আলোচনা এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে থাকেন। ইতিমধ্যে যৌথ সম্পাদনায় তাঁর পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।