প্রথমেই আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি, যদি আপনি জার্নি অব কাঁটা ধারাবাহিক লেখাটি ধারাবাহিকভাবেই পড়ে থাকেন। ধারাবাহিকভাবে যদি আপনার এই লেখা পড়া নাও হয়ে থাকে, যদি দু-এক পর্বও আগে পড়া হয়ে থাকে, তাহলেও আপনাকে স্বাগত জানাই। তবে জার্নি অব কাঁটা ধারাবাহিকভাবে পড়লে পাঠক হিসেবে আপনিও একটি জার্নিতে থাকবেন, এটাই আমার কহতব্য। আর যদি আপনার এ পর্যন্ত প্রকাশিত কোনো পর্বই পড়া না হয়ে থাকে, তাতেও তো আপনাকে স্বাগত জানাতেই হবে। হয়তো আগে পড়েননি, এখন থেকে পড়বেন বা একদিন পড়বেন, সেই জন্যও স্বাগত জানাতে হবে। কিংবা যে কেউ, যদি তাদের ভালো লাগে আমার লেখা পড়তে, আপনার ইচ্ছা হলেই ওয়েবম্যাগ ‘শ্রী’তে ঢুকে এই ধারাবাহিকটি প্রথম পর্ব থেকেই পড়ে নিতে পারেন। দেশে ও বিদেশে থাকা সকল বাঙালি পাঠকের জন্য এই ধারাবাহিক রচনা লিখিত হচ্ছে, নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। এই জার্নি একটি সিনেমা নির্মাণের জার্নি। সিনেমার নাম ‘কাঁটা’। তাই জার্নি অব কাঁটা শুধুমাত্র একটি সময়-ভ্রমণ নয়, এটি একটি সিনেমা হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত। সিনেমার মূল গল্পটার বাইরের যত ইতিকথা, কাঁটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘটে যাওয়া ও ঘটমান যত বাস্তবতার অন্তরঙ্গ-বহিরঙ্গ—সে সব তুলে ধরা হচ্ছে পর্বে পর্বে। প্রতি শুক্রবার একটি করে পর্ব প্রকশিত হয় এবং তা হতে হতেই এই আমরা এসে পড়লাম বিশতম পর্বে। বিশ পর্ব? কেমন করে চলে গেল বিশ পর্ব বা বিশ সপ্তাহ! ওহ সময়, তুমি রিয়েলি ‘সবুজ ডাইনি।’ গ্রিনি উইচ, তুমি কখনোই বয়েসি হও না, তা যতই আমরা সন-তারিখ-ঘড়ি-ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি না কেন! বয়েস হয়ে যায় শুধু আমাদের, মানুষের। মানুষ মরে যায়, সময় মরে না। সময় কি জন্মায় কখনো? নাকি সময়ের কোনো ‘জন্ম হয় না মৃত্যু হয় না’ কেন না সে ‘অন্যরকম হিরের গয়না শরীরে নিয়ে’ জন্মেছে। এই ইনভার্টেড কমার মধ্যে কয়েকটি শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহার করেছি, এটি নীরার প্রেমিক সুনীলের একটি কবিতার অংশ। সময় প্রসঙ্গে মাথায় এসে গেল, আমিও লিখে দিলাম। রণজিৎ দাশ লিখলেন তো, ‘সময়, সবুজ ডাইনি/ পৃথিবীর উপকণ্ঠে থাকো/ নাবিকের হাড় দিয়ে/ সন্ধ্যার উঠোনে তুমি/ ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকো।’ এই কবিতাংশ গান করেছে অর্ণব, ‘ব্ল্যাকআউট’-এ।
সময়ের মাইরে বাপ! কিনারাহীন নদী, সময়? একটা সময় আমি থাকতাম নিউ এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায়। আমার আগে ওই বাসায় থাকত একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। আমার বন্ধুদ্বয়। ওদের মেলামেশায় তৃতীয়জনের আবির্ভাবকালে ওরা উত্তরা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পরে ওই বাসাতে উঠি আমি। সেই ছেলে-মেয়েটির নাম যথাক্রমে নূরুল আলম আতিক ও মাতিয়া বানু শুকু। ওরা উত্তরায় চলে গেল, আমি উঠলাম। ওই বাসাতেই থাকলাম একটানা বারো বছর। তারপর গেলাম শঙ্কর, কয়েক মাস শঙ্করে থেকে চলে গেলাম পুরান ঢাকায়, ফরাসগঞ্জে। ফরাসগঞ্জে কয়েক মাস থাকার পর চলে গেলাম মগবাজার চেয়ারম্যান গলিতে। এবং মগবাজারের বাজার-গেট রেললাইনের গা ঘেঁষা একটি বিল্ডিংয়ে কাঁটার প্রি-প্রোডাকশন ক্যাম্প খোলা হলো। ওটাকে আমরা বলছি কাঁটা ক্যাম্প মগবাজার। রীতিমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অডিশন করে নেওয়া কয়েকশো পাত্রপাত্রীদের নিয়ে মগবাজার ক্যাম্পে পাঁচ মাস থেকে আমরা চলে এসেছি নারিন্দা, ভূতের গলির বাড়িঅলা আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে। এখানে কাঁটার প্রোডাকশন ক্যাম্প। সেটের কাজ ও ২০১৮ সালের বৃষ্টিবাদলা পার করে আমরা পুরোদমে শুটিং শুরু করেছি। কাঁটার শুটিং চলছে। কাঁটা একটি হিউজ প্রোডাকশন এবং পিরিওডিক্যাল ছবি।
রীতিমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অডিশন করে নেওয়া কয়েকশো পাত্রপাত্রীদের নিয়ে মগবাজার ক্যাম্পে পাঁচ মাস থেকে আমরা চলে এসেছি নারিন্দা, ভূতের গলির বাড়িঅলা আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে। এখানে কাঁটার প্রোডাকশন ক্যাম্প। সেটের কাজ ও ২০১৮ সালের বৃষ্টিবাদলা পার করে আমরা পুরোদমে শুটিং শুরু করেছি। কাঁটার শুটিং চলছে। কাঁটা একটি হিউজ প্রোডাকশন এবং পিরিওডিক্যাল ছবি।
নয় মাস আমরা থেকেছি নারিন্দায়। অবশ্যই নয় মাস যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধ আগেও করেছি, পরেও করে যাচ্ছি। যুদ্ধ সর্বত্র চলছে। যুদ্ধ চলছে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে, যুদ্ধ চলছে ভালোবাসার সঙ্গে ভালো না বাসার। যুদ্ধ চলছে তোমার সঙ্গে আমার, তুমি সময়। গ্রিনি উইচ। জানি, আমি বিজিত হবো। তুমি থাকবে, আমি ‘অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ’ নিয়ে কোথায় যে হারাব, জানি না কিছুই। ‘অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ’ একটি কাব্যগ্রন্থের নাম। যে কবি মারা যাওয়ার আগে আরেকটি বইয়ের নাম রেখেছিলেন, শুনলে আপনি হাসতেও পারেন, একেবারে চূড়ান্ত প্রেমিকের উচ্চারণ, যা শুধু একজন কবির পক্ষেই সম্ভব, কী সেই কাব্যের নাম? নাম হচ্ছে, ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব’। ত্রিদিব দস্তিদারের সঙ্গে আমার, মারজুকের একটি ভালো সম্পর্ক ছিল। সে সব তো অন্য গল্প। এখন আমরা আছি কাঁটায়, আছি নারিন্দায়। নারিন্দা থেকে পুনরায় ফিরে আসব মগবাজার চেয়ারম্যান গলির বাসায়। মাস দুয়েকের মধ্যেই মগবাজার থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাব হাতিরঝিল মহানগর প্রোজেক্টে। মহানগরে কয়েকমাস থেকে চলে যাব নর্থ সার্কুলার রোড বা হাতিরপুলের ভূতের গলিতে। দুই মাস সেই বাসায়। তারপর যাব সেন্ট্রাল রোড-সার্কুলার রোড, কিছু দিন পরেই ঢুকে পড়বে করোনা দেবী। করোনা খেয়ে নেবে দুই বছর। করোনার প্রথম বছর পর্যন্ত সার্কুলার রোডের ওই বাসাতে থাকব। তারপর যাব আবার নিউ এলিফ্যান্ট রোড, তবে সেই আগের বাসায় নয়, আগের বাসার কাছেই। যেহেতু আমি একটা অতীতকে তুলে আনছি জার্নি অব কাঁটায়, তাই নারিন্দা থেকে পরে যে জায়গায় আমি থাকলাম, নারিন্দায় থাকা অবস্থায় তো এসব জানতাম না। তাই নারিন্দা থেকে দেখলে ফিউচার টেন্স যা, এখন, এই ২০২৩-এ এলিফ্যান্ট রোডে বসে যখন লিখছি এই লেখা, তখন জার্নি অব কাঁটা একটি পাস্ট টেন্স। একটানা বারো বছর এক বাসায় থাকা আমি এত মালামাল নিয়ে একটা সিরিয়ান শরণার্থী হয়ে গেলাম মনে হয়। ওহ কাঁটা, তুমি যে কী দিলে!
এখনকার এই নিউ এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় ওঠার কয়েক দিন পরেই কাঁটা-জনিত সরকার বাদি মামলায় এক সন্ধ্যায় পুলিশ এলো আমার বাসায়। ওয়ারেন্ট অনুযায়ী আমাকে ধরে নিয়ে গেল নিউমার্কেট থানায়। সারা রাত থানার লকআপে থাকার অভিজ্ঞতা হলো। সে রাতে টেলিভিশন, পত্রিকা বা অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ফেসবুকে সাড়াশব্দ পড়ে গেছে আমার গ্রেফতারের সংবাদ। পরদিন সকালে আমার হাতে হ্যান্ডকাপ দিয়ে ওঠানো হয় পুলিশের পিকাপে, আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুরনো ঢাকার জনসন রোডের কোর্টকাচারিতে, ঢাকার সিএমএম কোর্টে। কোর্টের অপজিটের ‘আজাদ ম্যানশন’ সিনেমা হল, যেখানে কাঁটার শুটিং হয়েছে। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম, হলের সামনে যখন পুলিশের পিকাপ থেকে আমাকে নামানো হচ্ছে হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায়, তখন আমাকে তাঁরা দেখে ফেলতে পারে, ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলাম। রাস্তায় পুলিশ পিকাপে আমি বসে আছি, পিকাপ নীলক্ষেত থেকে রওয়ানা দিলো পুরান ঢাকার উদ্দেশে। সেই পিকাপের সামনে যমুনা টিভির ক্যামেরা, গাড়ি চলছে। পেছনে সময় টিভির ক্যামেরা ও গাড়ি, গাড়ি থেকে সাংবাদিক পুলিশের পিকাপে বসে থাকা অবস্থায় আমার ফুটেজ নিচ্ছে, রাস্তার জ্যামে গাড়ি থেমে গেলে টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক কাছাকাছি এসে আমার সামনে ক্যামেরা অন রেখে কথাবার্তা বলছেন। এ সব আমার জন্য একটা আজগুবি দশা। বুঝতেই পারছি না, কী হচ্ছে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া কি একেই বলে? কোনোভাবেই আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, এসব সত্যি না জাদু? বাংলাদেশ যে জাদুবাস্তবতার আসল দেশ, কলম্বিয়ান মার্কেজ তা কোনোভাবেই জানতেন না। সারা দিন থাকলাম কোর্ট কাস্টডিতে।
রাস্তার জ্যামে গাড়ি থেমে গেলে টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক কাছাকাছি এসে আমার সামনে ক্যামেরা অন রেখে কথাবার্তা বলছেন। এ সব আমার জন্য একটা আজগুবি দশা। বুঝতেই পারছি না, কী হচ্ছে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া কি একেই বলে? কোনোভাবেই আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, এসব সত্যি না জাদু? বাংলাদেশ যে জাদুবাস্তবতার আসল দেশ, কলম্বিয়ান মার্কেজ তা কোনোভাবেই জানতেন না। সারা দিন থাকলাম কোর্ট কাস্টডিতে।
সেখানে বিস্তর আসামী, আমার কলিগ তারা। ২০২১ সালের নবমীর দিন সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে গেল, দশমীর দিন সন্ধ্যায় কোর্ট থেকে সন্ধ্যায় আমাকে জামিন দেওয়া হয় । আমার আইনজীবী ছিলেন প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস। দুই বছর চার মাস চলার পর কোর্টে সেই মামলা নিষ্পত্তি হলো। তারপর পুনরায় আমার মামলার বাদি বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমি কানেকটেড হই। তবে সে সবের ডিটেইল লেখা হবে ধারাবাহিকতার অন্য একটি পর্বে। এখন, এ মুহূর্তে কাঁটার পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এখন ছবি রিলিজের চিন্তা মাথায়, কাঁটাকে দ্রুত মানুষের মুখোমুখি করতে হবে, এরকম চাপ মাথায় রেখেই বকেয়া কাজটুকু এগিয়ে চলছে। কাজ বলতে সাউন্ড-মিউজিক-অ্যানিমেশন, রং বিন্যাস, সাউন্ড মিক্সিং। আর আমার মামলার যিনি আইনজীবী, প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস, তিনি একদা আইনে পড়তেন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন আমি চারুকলায় পড়তাম। বিকেলে বা সন্ধ্যায় হাকিম চত্বর, টিএসসি, চারুকলা, উদ্যান, শাহবাগ, আজিজ মার্কেটে ঘোরাঘুরি করতাম। আমি কবিতা লিখতাম, প্রকাশ’দা লিখতেন ছোটোগল্প। অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর বিচরণও তখন থেকে। তবে কথাসাহিত্যের লোক হলেও প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস বাংলা কবিতার তুমুল পাঠক। শুটিং চলাকালীন একদিন তিনি নারিন্দায় এসেছিলেন, ২০১৮ তে। তখন তো জানা ছিল না পরবর্তী সময় কপাল কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে? আমার মামলায় তিনি ওকালতি করবেন, তাও জানা ছিল না। সরকারি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগে আমাকে গ্রেফতার করা হবে, তাই তো আমার মাথায় ছিল না। পরবর্তী দিনের কথা আগের দিন জানা থাকে না, কারোরই থাকে না, আমারও ছিল না। কদিন আগে, প্রকাশ’দা হঠাৎ ফোন দিলেন। বললেন, কাঁটার খবর কী? সম্ভবত ফেসবুকে জার্নি অব কাঁটা ধারাবাহিকটি দেখেই আমাকে তিনি ফোন করেছেন। এখন ২০২৩। সেপ্টেম্বর শুরু। কিন্তু এই লেখার জার্নি তো এখনো অবস্থান করছে নারিন্দায়, যেখানে শুটিং হয়েছিল কাঁটার। যেখানে আমরা ছিলাম। কয় মাস? নয় মাস।
হঠাৎ রাজীব আশরাফ সিনক্রিয়েট করে চলে গেল গত পরশু, পহেলা সেপ্টেম্বর। ২ ও ৩ তারিখ ফেসবুক শোকে আচ্ছন্ন। কবি, গীতিকার ও নির্মাতা রাজীব আশরাফ। রাজীবের নিজের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছিল সিনক্রিয়েট। ফাইনালি, নিজেই সিনক্রিয়েট করে চলে গেল। রাজীব আর আসবে না। রাজীব মরে গেছে। রাজীবের সঙ্গে আমার ও কাঁটার একটি সম্পর্ক আছে। হয়তো এ সব লেখাই হতো না, যেমন অনেক কিছুই লেখার বাইরে থেকে যাচ্ছে, লিখতে লিখতে যা মনে পড়ে, তাই শুধু লেখা হচ্ছে। সব কিছুই কি আমার মাথায় আছে? না। নেই। আর সব কিছু আমি একা দেখিওনি। লিখব কীভাবে? কিন্তু রাজীব আকস্মিক সিনক্রিয়েট করেই ফেলেছে বলে ওকে নিয়ে লেখা আপন গতিতে নেমে আসছে। লেখা কি পাহাড়ি ঝরনা, আপন গতিতে নামতে থাকে? লেখা কি কখনো মেঘ, ঝরবে ঝরবে ভাব দেখিয়েও ঝরে না কখনো কখনো? কিংবা ঝরেই পড়ে, ঝরঝর মুখরিত বাদল দিনের গান হয়ে ঝরে। লেখা এক অদ্ভুত প্রক্রিয়া। রাজীব লিখত। সেই লেখা কবিতা ও গান। সেই গান বেশির ভাগ গেয়েছে অর্ণব। হোক কলরব—দুই বাংলা কাঁপানো বিখ্যাত একটি গান। ২০০৬ সালে আমি একদিন ‘ব্ল্যাকআউট’-এর স্ক্রিপ্ট নিয়ে গুলশানে সামিরের বাসায় যাই। সামির আহমেদ বন্ধু, ফিল্ম এডিটর। সেদিন সামিরের বাসায় দেখা পাই বন্ধু, কবি ও নির্মাতা আকরাম খানকে। সামির ঘুমোচ্ছিল। সামিরদের প্রোডাকশন হাউস ‘গাঁও প্রোডাকশনস’ তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত। সামিরের বাসাতেই এডিটিং প্যানেল। সামিরের তখনকার স্ত্রী মিতুল, সামির, সামিরের এডিটিং সহকারী মাজহার রনি ও রাজীব আশরাফ—এরাই গাঁওয়ের বাসিন্দা। পরে হয়তো তানভীরও যুক্ত হয়। যুক্ত হয় মামুন। ‘ব্ল্যাকআউট’-এর স্ক্রিপ্ট নিয়ে সামিরের বাসাতেই এক রুমে রাজীবের সঙ্গে বসে গেলাম। রাজীব কিছু দিন চারুকলায় পড়েছিল, আমিও পড়েছি ওখানে, রাজীব কবি, আমিও কবিতা লিখি, খুব জমে গেল। সামির ক্যামেরা ও এডিটিং করেছে ‘ব্ল্যাকআউট’-এর। মিতুল প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিল, অভিনয়ও করেছিল। আর রাজীব ছিল আমার প্রধান সহকারী পরিচালক। এবং ব্ল্যাকআউট-এ রাজীবও অভিনয় করেছে। সেই দিন সারা রাত আমরা ব্ল্যাকআউট-এর স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করি। পরের দিন সারা দিন আলোচনা চলে। আবার রাত আসে। আমি ও রাজীব উঠিনি স্ক্রিপ্ট-আলোচনা থেকে। লিটল বয় কিন্তু লিটল নয়, জাপানের নিউক্লিয়ার বোমা তার প্রমাণ, যেমন, রাজীব আশরাফ। লিরিক লিখত, কারণ, ওর ছন্দের হাত ছিল খুবই দক্ষ। বিষয়-বক্তব্য বহাল রেখেই নিখুঁত অন্ত্যমিল ঘটাতে পারত।
কী তুমুল স্বপ্নের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছিল আমাদের সেই সময়। সেই বয়সেই রাজীব বিবাহিত, জলি ওর বউ, বুয়েটে পড়ত। কিন্তু রাজীবের সঙ্গে সম্পর্ক খুব তলানিতে এসে ঠেকেছিল ওদের এবং সেটা রাজীবের জন্যই। জলি খুব চেয়েছিল সম্পর্কটা ধরে রাখতে, রাজীব হয়তো তা চায়নি। পরে ওদের ডিভোর্স হয়ে গেল। আমার একটি শর্ট ফিল্মে রাজীব আমার ভাগ্নি বর্ষার কো-আর্টিস্ট হিসেবে অভিনয় করল, সাভারের দিকে হেমায়েতপুরের কাশবনে শুটিং হলো। ‘পুতুলবউ’ নামে আমার একটি টেলিভিশন ফিকশনে রাজীব তো প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলই, অভিনয়ও করল। মনে আছে, শুটিংয়ের সেই দিন হঠাৎ খবর পেলাম, বিনয় মজুমদার মারা গেছেন। একটি ইম্প্রোভাইস সিকোয়েন্স বানাই শুটিং করতে করতেই, আজিজ মার্কেটের পাঠক সমাবেশের সামনে। সিকোয়েন্সের ভেতরে দুই তরুণ কথাবার্তা বলাবলি করে, বিনয় মজুমদার মারা গেছেন বলে। কথা হচ্ছে, বিনয় মজুমদার কি ২০০৭ সালের সেই দিনই মারা গেলেন, নাকি বিনয় মারা গেছেন বহু আগে—যখন প্রকাশিত হয় ‘ফিরে এসো চাকা’, যখন প্রকাশিত হয় ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’, বা যখন গায়ত্রী চক্র বলে এক বিদুষীকে নিয়ে স্বরচিত উপকথার আপেলবনে কবি ঘুরে ঘুরে লিখে যাচ্ছিলেন কবিতার পরে কবিতা। কিন্তু গায়ত্রী ফেরেনি, গায়ত্রী ফেরে না, গায়ত্রী আর কোনো দিনই ফিরে আসে না, তবু ফিরে এসো চাকা চাকা চাকা করতে করতে উন্মাদ হয়ে গেলেন কবি। এইসব ইস্যুই তর্কসাপেক্ষে পাগলাটে এক আলোচনায় তুলে আনে দুই বন্ধু, একজন অভিনেতা সেখানে রাজীব আশরাফ, আরেকজন আলতাফ শাহনেওয়াজ। দুই তরুণ কবি। পরে রাজীব গাঁও ছাড়ল। নানান জায়গায় কাজ করছিল টুকটাক। একদিন ফোন করে বলল, ‘আমার প্রোডাকশন হাউস হবে সিনক্রিয়েট। নামটা কেমন টোকন’দা?’ খুব ভালো। সত্যিই আমার এই নামটা ভালো লাগল। একদিন বলল, প্রথম কবিতার বই বের করবে ওর। অর্ণব করবে প্রচ্ছদ আর বইয়ের একটা ভূমিকা যাবে ব্যাক কভারে, সেটা আমাকে লিখতে হবে। হাতে লিখে স্ক্যান করে পাঠাতে হবে, কারণ, আমার হাতের লেখাতেই ছাপা হবে ভূমিকাটা। রাজীব অর্ণবের অনেক গান লিখেছে। আগে অর্ণবের গান লিখেছে বেশি সাহানা ও তওফিক। তওফিক অর্ণবের কলকাতার বন্ধু। রাজীব এমন একটি ছেলে, যাকে দীর্ঘ সময় সহ্য করা কঠিন, কিন্তু ওর প্রতিভাকেও অস্বীকার করা যায় না। সেই সময় আমার নিউ এলিফ্যান্ট রোডের বাসাতে মাঝেমধ্যেই সারা রাত আড্ডা ও কাজের আলাপ চলত রাজীবের সঙ্গে। তারপর পাশাপাশি ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম থেকে উঠেই ফের সেই প্রডাকশন মিটিং।
অনেক বছর বাদে রাজীবকে কাঁটার প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে পেতে ওকে নারিন্দায় ডাকলাম। এত দিনে রাজীব আরও বদলে গেছে। আত্মনিয়ন্ত্রণ আরও হারিয়ে ফেলেছে। রিহ্যাব করেছে কয়েকবার। হাসপাতালে মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে কয়েকবার। জীবনের কিছু স্বপ্ন ওকে ভেঙে গুঁড়িয়েও দিয়েছিল। তার প্রকাশও আমরা দেখেছি। নেশাও ওকে পঙ্গু করে দিচ্ছিল। ওর ছোটো ভাই রিংকুর সঙ্গেও আমার আলাপ ছিল। রিংকুটা ছিল দ্বিতীয় রাজীব, চার বছর আগে আত্মহত্যা করেছে রিংকু। ত্বরিত কর্মতৎপরতা খুব ভালোভাবে সম্পাদন করতে জুড়ি নেই রাজীবের। একটা অর্থনৈতিক চুক্তি মোতাবেক রাজীবকে কাঁটার প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিলাম। কিন্তু নারিন্দায় কাঁটা টিমের কেউ কেউ খুব বেশি অভিযোগ জানাচ্ছিল রাজীবকে নিয়ে। বিশেষ করে আমি যখন মিডফোর্ড হাসপাতালে, তখন প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে নারিন্দায় কাঁটা টিমকে দেখে রাখার দায়িত্ব ছিল ওর। কিন্তু তা হয়নি, যা হয়েছে, তা শুধু ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ। তাই হাসপাতাল থেকে ফিরে, আমাকে বলতেই হলো, ‘রাজীব, তোমাকে নিয়ে অভিযোগ অনেক।’ এরপর হয়তো রাজীবের সঙ্গে আমার সেই আগের সম্পর্কটা আর ফিরে আসেনি। রাজীব চলে গেছে। সেদিন কাঁটা টিম থেকে ফিরে গেছে, আর গত ১ সেপ্টেম্বর দুনিয়া থেকেই চলে গেল। আমার ভাগ্নি বর্ষার সঙ্গে ওর দারুণ বোঝাপড়া ছিল। রাজীবের বেশির ভাগ বন্ধুরাই প্রোডাকশনমুখি, প্রতিভাবান, যেমন, মাজহার রনি, ছোটন, রিপন, জাওয়াদ, অনুপ…। বিনয়কে নিয়ে করা সেই সিকোয়েন্সের মতোই, আজ বলতে পারি, রাজীব কি পহেলা সেপ্টেম্বর মারা গেছে? রাজীব মারা গেছে কবেই, যখন বেঁচেছিল, তখনই। এখন আমরা ওকে ফাইনালি হারিয়ে ফেললাম। কোনো দিন ও আর কাউকে জ্বালাতে আসবে না। ওর অকপট সত্যের ঝাঁঝাল তাপে আর কেউ পুড়বে না। কারণ, আমার ভাইটি, অনুজ বন্ধুটি ‘সিনক্রিয়েট’ করে চলে গেছে, আর আসবে না। ‘রাজীব রাজীব’ বলে কেউ ডাকলেও ও আর সাড়া দেবে না। মিরপুরের এক কবরস্থানে ওর শবদেহ বিলীন হচ্ছে মাটিতে। আমরা পারিনি, মাটি, তুমি কবি রাজীব আশরাফকে ভালোবাসা দিও। ওকে আদর করে খেয়ো।
ব্ল্যাকআউট আনরিলিজড। ৯৭ মিনিটের ব্ল্যাকআউট-এর ক্রেডিট লাইন— ক্যামেরা ও সম্পাদনা সামির আহমেদ, মিউজিক শায়ান চৌধুরী অর্ণব, আর্ট ডিরেশন ও গ্রাফিক্স আব্দুল হালিম চঞ্চল, অ্যানিমেশন চিন্ময় দেবর্ষি, স্টিল রিচার্ড রোজারিও এবং প্রধান সহকারী পরিচালক রাজীব আশরাফ। অভিনয়ে ছিল তানভীর হাসান (পরবর্তীতে একদিন স্বেচ্ছা-প্রয়াণে উধাও), রাহুল আনন্দ, তিনা, সারা, কফিল আহমেদ, ধ্রুব এষ, বর্ষা বিভাবরী, বাপ্পি আশরাফ, বেলায়েত হোসেন, বিমল বাউল, মডেল দাদু, জুয়েনা ফেরদৌস মিতুল প্রমুখ। এ টেল অব টু পালস অফ অ্যা মিস্টিফাইং নাইট—অমীমাংসিত রজনীতে দুই বন্ধুর গল্প, ব্ল্যাকআউট। যৌন অবদমনের গল্প ‘মনে নেই’ বা ব্ল্যাকআউট। ব্ল্যাকআউট আমার চিত্রনাট্য-পরিচালনায় প্রণীত প্রথম ফিকশন। এদেশের বাস্তবতায় ২০০৬ সালে নির্মিত হলেও, কন্টেন্ট এখনো কত সাহসী! নাকি?
কেউ এলেও, কথাবার্তা বলে বুঝেশুনে প্রবেশ করতে দিতে হবে—নির্দেশ ছিল আমার। একদিন গেটের পাহারা ঠেলে একজন বোরকাপরা নারী ঢুকে পড়ে বাড়ির মধ্যে, তার সঙ্গে কয়েকজন পোলাপান। আমি মিটিং করছিলাম টিম নিয়ে। আমার তো রাগ হচ্ছে। গেটের পাহারাদারের ওপর যেমন, বোরকাওয়ালির ওপরেও তেমন। কে এই নারী, যে কিনা গেটম্যানকে ঠেলে-ঠুলেই ভেতরে চলে এলো?
নারিন্দার বাড়িটিতে নিয়মিত ভাড়া দিয়ে গেলেও একসময় বাড়ির মালিক বনানীতে বসে ভাবতে থাকেন—আমরা নামছি না কেন? আমরা কি নাসিরুদ্দিনের বাড়িটা দখল করে নেব? ব্যাপক সন্দেহ দানা বাঁধে তাদের মনে। তারা গেণ্ডারিয়া থানায় নোটিশ করল আমার নামে। পুলিশ এলো। এই থানা থেকেই আমরা থ্রি নট থ্রি, চাইনিজ রাইফেল নিয়েছি শুটিংয়ের জন্য। সেই থানারই পুলিশ এলো সেদিন বাড়িওলার পুলিশ হয়ে। আমাদের নামতে নোটিশ করে দিলো। কিন্তু কাজ তো তখনো কিছু বাকি আছে। আমি কাঁটা টিমকে বলে দিলাম, ‘যত দিন ভাড়াটিয়া হয়ে আছি, তদ্দিন বাড়ি আমাদের। অতএব, বাড়ির মালিকও যদি এরপর এই বাড়িতে আসে, কেউ ঢুকতে দিবা না। বলবা, আমার অনুমতি নেই। চলে যাওয়ার সময় বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়া হবে।’ বাড়ির গেটে আমাদের পক্ষ থেকে পাহারা বসান হলো। কেউ এলেও, কথাবার্তা বলে বুঝেশুনে প্রবেশ করতে দিতে হবে—নির্দেশ ছিল আমার। একদিন গেটের পাহারা ঠেলে একজন বোরকাপরা নারী ঢুকে পড়ে বাড়ির মধ্যে, তার সঙ্গে কয়েকজন পোলাপান। আমি মিটিং করছিলাম টিম নিয়ে। আমার তো রাগ হচ্ছে। গেটের পাহারাদারের ওপর যেমন, বোরকাওয়ালির ওপরেও তেমন। কে এই নারী, যে কিনা গেটম্যানকে ঠেলে-ঠুলেই ভেতরে চলে এলো? মিটিং থেকে ঘুরে তাকালাম। বললাম, ‘কে আপনি?’ সেই বোরকাওয়ালি নেকাব খুলে ফেলল। দেখি, অভিনেত্রী তিশা, তিশাই সেই বোরখাওয়ালি। আমি কিছুটা অবাক। কোনো নোটিশ ছাড়া এরকম করে তিশা আসবে, কেন আসবে, তা আমি জানি না। দু-একটা কথা হলো। কদ্দিন লাগবে কাঁটার শুটিং শেষ করতে, তিশা জানতে চাইল। আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে নেমে তিশা বলল, ‘এই বাড়িতে আগে তো কুয়া দেখিনি!’ কিছু ছবি তুলে চলে গেল তিশা ও ওর সঙ্গে আসা ছেলেরা। বললাম, ‘সরয়ার কেমন আছে?’
‘ভালো। বাসায় আইসেন, সরয়ার তো আপনার কথা বাসায় বলে’—বলে চলে গেল ওরা। এইবার আমি গেটম্যানকে ধমক দিলাম, ‘বলা ছিল, কাঁটা প্রোডাকশনের বাইরের কেউ এ বাড়িতে ঢুকবে না। কী হলো একটু আগে?’ গেটম্যান আমার রাগারাগি দেখে নিজেকে বাঁচাতে চাইল, বলল, ‘আমি তো না করছিলাম উনি কথা বলতে বলতে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছেন।’
‘এরপর আর কেউ যেন এভাবে ঢুকতে না পারে।’ সে সময়, আমাদের শুটিংয়ের সময় অন্যান্য শুটিং পাট্টির লোকেরা খালি লোকেশন দেখতে আসছিল, কাঁটা সেটে কাঁটা টিমের বাইরের কাউকে আমার সহ্য হতো না। কারণ, কেউ এলেই ক্ষতি। হয়তো আমাদের বাগানের একটি ফুল ছিঁড়ে নিল কেউ, সেই ফুল যে একটা কন্টিনিউটির অংশ, সে তো আর জানে না। তাই কাঁটা টিমের বাইরের কাউকে আর অ্যালাউ করা যাচ্ছিল না। নইলে নাসিরুদ্দিনের বাড়ি নিয়ে আমার তো কোনো আদিখ্যেতা নেই। যার বাড়ি, তারই থাকবে, শুটিং শেষ হলে আমরাই চলে যাব।
এর মধ্যেই আমাদের ক্যারেক্টর সেই বিড়াল, শ্রীমতী ডায়না বাচ্চা বিয়োতে উধাও হয়ে গেল কদিন। তাই শুটিং বন্ধ থাকছিল। শুভকে বললাম, একইরকম আরেকটা বিড়াল ম্যানেজ করো। শুটিং বন্ধ থাকা তো বেশি ক্ষতি।’ সেই ক্ষতি বিড়ালপন্থি ক্ষতি। দুই জায়গায় বিড়ালের খোঁজ পাওয়া গেল। এক জায়গা থেকে বিড়াল আনা হলো। সেই বিড়ালের সঙ্গে এসেছে ওর নানি, নানীর বয়স মাত্র বিশ-বাইশ বছর। এরকম তরুণী যেকোনো বিড়ালের নানী হতে পারে, আমি জন্মেও ভাবিনি। তাছাড়া সেই নাতনী বিড়াল একদম আমাদের ক্যারেক্টর বিড়াল ডায়নার সঙ্গে তো পুরোপুরি মেলেও না। এর শরীরে এক জায়গায় কালো আছে, ডায়নার তা নেই। ডায়না শ্বেতাঙ্গিনী। তখন আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে নাতনী বিড়ালকে ছেড়ে দেওয়ামাত্রই শুটিংয়ের লাইট স্ট্যান্ড, ক্যামেরা ও নানাপ্রকারের লোকজন দেখে সে নাসিরুদ্দিনের বাড়ির এক পরিত্যাক্ত স্টোর রুমে গিয়ে এমনভাবে আত্মগোপন করল যে, তার নানী, সেই তরুণী হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করল। বলল, ‘আমি শুটিং করাব না, আমার নাতনীকে ধরে দেন।’ নিজেও মেয়েটি কানতে কানতে তার নাতনী বিড়ালকে ডাকাডাকি শুরু করল। কিন্তু নাতনী তখন ভয়ে চুপসে গেছে। একপর্যায়ে নাতনী ধরা দিলো। নানী মেয়েটা তাকে নিয়ে চলে গেল। আমরা ফের অপেক্ষায় থাকলাম আমাদের ডায়নার, সে বেবি জন্মাইতে গেছে কোনো গলির চিপায় বা পরিত্যাক্ত বিল্ডিংয়ের খোপ-সোপের আড়ালে। আর আমরা পুরো টিম বসে আছি তার অপেক্ষায়। আমাদের মানুষ চরিত্ররা রেডি আছে শিডিউল দিয়ে, কিন্তু বিড়াল চরিত্রটি ঘাপলা করে ফেলেছে। বিড়াল যে কী জিনিস, তখন আমরা হাড়ে হাড়ে না, শিরায় শিরায় টের পাচ্ছি। আমি তো স্ক্রিপ্ট রচনার সময় জানতামই না যে, বিড়াল এত ঘন ঘন বাচ্চা দেয়! তিন সাড়ে তিন মাস পরপরই বাচ্চা দেয় স্ত্রী বিড়াল। আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে আছে মিসেস ডায়না সুন্দরী, সে আমাদের ভোগাচ্ছে। কিংবা সে কাঁটায় অভিনয় করে এক ধরনের স্টারডম উদযাপন করছে।
একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটল তখন। টিম নিয়ে আমি নারিন্দায় আছি, অনেক দিন মগবাজার বাসায় ফেরা হয় না আমার। একদিন মগবাজার বাসার মালিক আমাকে ফোন দিয়ে যেতে বললেন মগবাজার। গেলাম। আমার বাসার দরজার তালা ভাঙা। বাসায় চুরি হয়েছে। বাসায় একটি কাঠের ওয়ার্ডরোবে ছিল ক্যাশ পাঁচ লাখ টাকা। শুধু সেই টাকাটা চুরি হয়ে গেছে। হাতিরঝিল থানা সেই দিনই উদ্বোধন করা হয়েছে। গেলাম মামলা করতে। পুলিশ মামলা নিল না। এমন কি সাধারণ ডায়রিতে চুরির কথাও উল্লেখ করতে দিলো না, লিখতে হলো, হারিয়ে গেছে। এটাই থানা প্রশাসন রিয়েলিটি, অভিজ্ঞতা সূত্রে দেখলাম। আমার বাসায় ওই ড্রয়ারে যে নগদ টাকা আছে, এটা কে জানত? হ্যাঁ, জানত। আমার প্রোডাকশনে কাজ করা কেউ কেউ জানত। চুরিও তাদের কেউ করেছে, কে করেছে আমি জানি, কিন্তু প্রমাণ তো দিতে পারব না। পুলিশ এলো আমার বাসায়। সব কিছু দেখে নোট নিয়ে চলে গেল। আমার যে ক্ষতি হলো শুটিং চলাকালীন নগদ অর্থ চুরি হওয়ায়, সেই ক্ষতি খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল। ভবিষ্যতে এই কেইস আমি যে কোনোভাবেই পুনরায় সক্রিয় করব, ভেবে রেখেছি। কারণ, নারিন্দায় তখন শুটিং ফেলে আমি এতদূর হাতিরঝিল পরপর দুই দিন এসে বুঝলাম, পুলিশের কাছে যাওয়ার সময়টুকুও আমাকে আরও ক্ষতির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। কাজেই, নারিন্দায় ফিরে গেলাম। শুটিং চলছিল, শুটিং অব্যাহত রাখলাম। সামান্য কয়েকটি বাক্যে পাঁচ লাখ টাকা দরজা ভেঙে চুরির কথা লিখলাম বটে এখানে, কিন্তু বিষয়টা এত ঠুনকো ছিল না আমার জন্য। কিন্তু ভেঙে পড়ারও কোনো সুযোগ তো আমার নেই। একটা বিরাট ধাক্কা লাগল। সেই ধাক্কা পার হতে হবে, লোন করতে হলো আমাকে নারিন্দা চ্যাপ্টার শেষ করতে।
বর্ষার পরে শরৎ এলো। শুটিং চলছে কাঁটার। একদিন এক যুবক কাঁটা সেটে ঢুকে খুব হম্বিতম্বি করছিল। জানাল, তার বাসা সূত্রাপুর। অর্থাৎ সে পুরনো ঢাকার নেটিভ। বিষয় কী? যুবক জানাচ্ছে, তার বউদিকে নাকি আমরা আটকে রেখেছি। বউদি কে? নাম লিখব না এখানে। ছেলেটি এসেছে তার বউদির স্বামীর পক্ষ থেকে। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, হ্যাঁ, যে অভিনেত্রীকে সে খুঁজতে এসেছে, তার স্বামীই তাকে পাঠিয়েছে। তাই বলে মাস্তানি? কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা হলো যুবককে, অর্থাৎ ‘ভাই তুমি যাও।’ সে গেল না। এবার কাঁটার সহকারীদের বললাম, ‘ওকে দড়ি দিয়ে বিল্ডিংয়ের পিলারের সঙ্গে বান্ধো। তারপর ওর বাপ-ভাইকে ফোন করো ওর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে। আর গেণ্ডারিয়া থানায় ফোন করো।’ পরে ছেলেটির বাপ এলো, পুলিশ এলো। ওর বাপ মুচলেকা দিয়ে দড়ি খুলে ছেলেকে নিয়ে গেল। কত কী ঘটে একটা বড়ো টিম বাস্তবতায়! যা কোনো দিন ভাবাও হয় না, প্রোডাকশনে হয়তো তাই ঘটতে থাকে অবলীলায়। অবলীলা আবার কে? কে তা আমি জানব কীভাবে?
রোমান কাঁটার সিনেমাটোগ্রাফার, কাঁটা সেটে ফুলটাইমার। দীপন’দা আর্ট ডিরেকশনের দায়িত্বে কাঁটা ক্যাম্পে ফুলটাইমার। তার সহকারী তন্ময় ও শক্তি। তন্ময় ও শক্তি দুজনেই পরাণ চরিত্রে অভিনয় করেছে কাঁটায়। ওরা কাঁটা ক্যাম্পে প্রথমে কিছু দিন ফুলটাইমারই ছিল, পরে একটু আধটু বাসায় যেত। সুবোধ-স্বপ্না যেমন অনেক, পরাণও অনেক। মহল্লাবাসিরা তো জানেই, ‘চুবোদের ছোড বাইয়ের নাম ছবছম পরাণই হয়।’ কাঁটা সেটে কস্টিউম কন্টিনিউটির দায়িত্বে ফুলটাইমার লতা, লতাকে সাপোর্ট দিচ্ছে ফুলটাইমার ঝিনুক ও আয়েশা। প্রপসের জন্য কাজী রাসেল, জ্যানেট অভী সক্রিয় টিমে। রাসেল একটি দৃশ্যে অভিনয় করেছে। ভয়ংকর মজার দৃশ্য। এই দৃশ্য করতে গিয়ে ওকে প্রস্রাব করে দিতে হবে ক্যামেরার সামনে। সকালে শুটিং তাই রাসেল রাত থেকেই প্রস্রাব করা বন্ধ করে দিলো। শুটিংয়ের সময় প্রস্রাব বেরিয়েই যাচ্ছে, আর থামে না, সেই বাস্তবতায় আমরা কী করব? হাসব না শট কাটব? আরও কয়েকজন শিক্ষানবিস হিসেবে সক্রিয় ছিল কাঁটাতে।
শুভ লাইন প্রোডিউসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, কাঁটা সেটে ফুলটাইমার। শিক্ষানবিস হিসেবেই ঢুকে তুরা প্রায় সব সেক্টরেই মেইনটেইন করে যাচ্ছে সেই মগবাজার ক্যাম্প থেকে, যদিও আর্টিস্ট কল ও স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজারের দায়িত্বও ওর মাথায়। কত বড়ো চাপ যে ও নিয়েছে, তা কেউ ভাবতে পারবে না। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা দিয়েছে কাঁটা নির্মাণে। সে সব দিনের কথা যেন রূপকথা হয়ে আছে, হয়তো আমরা রূপকথার ভেতরেই ঢুকে পড়েছিলাম। কৃতিরঞ্জন ফুলটাইমার সহকারী এবং একজন সুবোধ চরিত্রের অভিনেতা, ওর উপর দিয়েও ঝড় বয়ে গেছে। সৌরভ একজন সহকারী পরিচালক এবং ওর বাসা পুরান ঢাকারই আর্সিন গেট। সৌরভের মা শিখা কর্মকার একজন অভিনেত্রী কাঁটার। রাজশাহী বা কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থেকে আসত সোহেল তৌফিক, কাঁটার আরেকজন সুবোধ। আরেকজন সুবোধ অনিমেষ আইচ। আরেকজন সুবোধ শিবু কুমার শীল। ওদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া একজনমের। তৃপ্তি রানী একজন স্বপ্না, আরেকজন স্বপ্না চিন্ময়ী, আরেকজন তিস্তা নদী, আরেকজন পাপড়ি। পাবনা থেকে আসতেন মওলানা মোসলেম উদ্দিন। আর ঢাকা শহর থেকে কয়েকশো নানা পেশার নানারকম মানুষ নিয়েই নির্মিত কাঁটা। সবার অংশগ্রহণেই ছবিটি গড়ে উঠছে। এক বিরাট দজ্ঞযজ্ঞের ঘনঘটা কাঁটা। শহীদুল জহির তো লিখে মুক্তি পেলেন, আমার মুক্তি বা কাঁটা টিমের মুক্তি ছবিটা মুক্তির মাধ্যমেই। বর্তমান বাস্তবতায় যে যেখানেই থাকুক বা অবস্থান করুক, এরাই কাঁটার শরীর, এরাই আমার পার্ট অফ মাই সোল।
যারা এত এত শ্রম-সময়-ভালোবাসা দিলো কাঁটার জন্য, কাঁটাকে একটি ছবি করে তোলার জন্য, তাদের প্রতি কি আমি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? সুব্যবহার করতে পেরেছি সর্বত্র? আমার ব্যক্তিগত আশা-অভিপ্রায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে আমি কি নির্মম হয়ে উঠিনি? আমার সংক্ষুব্ধ মনের বহিঃপ্রকাশ কি আমি ঘটাইনি? বিশেষ করে কাঁটা ব্যাকগ্রাউন্ড টিম মেম্বর, যাদের কাছে অনেক বেশি করে চেয়েছি, তাদেরই কি আমি খিস্তি খেঁউড় বেশি করিনি? করেছি। তাদের কি ভালো লেগেছে সে সব? না। তারা কি আমাকে ক্ষমা করবে? জানি না। আমি কি এখন তাদের প্রতি কোনো সংক্ষোভ পোষণ করে আছি? না। আমি ভালোবেসেছি তাদের, ভবিষ্যতের কোনো দর্শক যাতে কাঁটার কোনো দুর্বলতা ধরে আমাদের বা আমাকে গালি না দেয়, তার জন্য প্রবল-পরাক্রমে আমি রোলার চালিয়েছি। এই বাস্তবতা বুঝে নিতে পারবে এত দিনে, কাঁটা টিমের লোকেরা, আমাকে হয়তো ক্ষমা করে দেবে, এরকম ভাবি। আমার ভাবনা ফলবে, সেই নিশ্চয়তা তো আমি দিতে পারি না। আমি শুধু আমার কনফেস রেখে যেতে পারি। ক্ষমা করতে শিখছি আমিও। ক্ষমা একটা অর্জন করা গুণ। সেই গুণ সহজে আসে না। জীবনের কিছু ক্ষত থেকেই আসে। আমি আমার ক্ষত নিয়ে বসে থাকি নিঃসঙ্গতার চূড়ায়।
পাঁজর খুলে একদিন ক্ষত দেখাব, দেখবে?
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৯
কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।