মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : পর্ব ২৭

0

এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন লাল ভাই। বিচিত্র তার পোশাক-আশাক, মাথায় ছিল বিচিত্র রকমের ক্যাপ। হাতে থাকত আনকমন লাঠি। ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে ছিলাম আমরা। এই বাড়ির ঠিক পেছনেই বসু বাজার একতা সংঘ, যা কিনা মহল্লার একটি ক্লাব। একতা সংঘের গা ঘেঁষে যে দোতলা বাড়িটা, ওটাই লাল ভাইয়ের বাড়ি। লাল ভাইয়ের নাম ছিল ৩ শব্দে, একটি শব্দ মুসলিম শব্দ, একটি শব্দ সনাতনী, একটি শব্দ খ্রিষ্ট্রীয়। এরকম মানুষ কি সহজে পাওয়া যায়? গত ২১ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে গায়ক ও কাঁটার অভিনেতা সুবোধচন্দ্র দাস মতান্তরে শিবু কুমার শীল ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছে লাল ভাইকে নিয়ে। কারণ, লাল ভাই এর আগের দিন মারা গেছেন। শিবুর পোস্ট থেকে জানলাম, লাল ভাই শিবুর আগ্রহের একজন মানুষ ছিলেন। থাকাটাই স্বাভাবিক। উনি অত্যন্ত বিচিত্র কায়দার মানুষ। ঘর থেকে খুব কম বেরুতেন। শিবু জানাল, উনাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে লিখতেই প্রয়াণ হয়ে গেল লাল ভাইয়ের। লাল ভাইয়ের নামের যে তিনটি ধর্মের তিন শব্দ, শিবুর পোস্ট থেকে যে ছবিটা পেলাম, ওখানে প্রথম শব্দটি কেউ কালি দিয়ে মুছে দিয়েছে। আমরা কাঁটার শুটিংয়ে যখন নারিন্দায় ছিলাম, তখন দেখেছি নেইমপ্লেটে তিন শব্দই। কিন্তু প্রথম শব্দটি ছিল মুসলিম নাম থেকে নেওয়া একটি শব্দ।


p 26. 2

৩৬ ভূতের গলির আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির বৃষ্টিস্নাত রাতের উঠোন | ছবি : শাশ্বত মিত্র


যদিও লাল ভাই হিসেবেই ছিল তাঁর অধিক পরিচিতি। এককালে খেলাধুলা করতেন, বলেছিলেন আমাকে। মুক্তিযুদ্ধের উপরে অনেক ছবি এঁকেছিলেন, দেখিয়েছিলেন। এক ধরনের শিশুর সারল্য দেখেছি তাঁর ভেতরে, আঁকানো ছবিতেও। কয়েকটি কুকুর পুষতেন তিনি। পুষতেন কিছু পাখি। কিছু গাছ ছিল তাঁর বাড়ির ছাদে। একটা মিনি চিড়িয়াখানা ছিল তাঁর বাড়ি। বিচিত্র কায়দার এক সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হতো লাল ভাইয়ের বাড়ির দোতলায়। সেখানে যে কত রকমের জিনিস তিনি সংগ্রহে রেখেছেন, না দেখলে কে আর বিশ্বাস করবে? আমি কিছু জিনিস বাছাই করে ফেললাম কাঁটার প্রপস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। তিনি সানন্দেই দিলেন। একদিন এলেন কাঁটার সেটে। লাল ভাই বাইরে বেরুলেই বসু বাজারের ছোট্ট পোলাপানের দল তাঁর পিছু লাগত। তিনি বিরক্ত হতেন। কিন্তু বাচ্চারা কথা শুনত না। বাচ্চারা কি ভাবত, লোকটা জাদুকর? হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা? আমরা কাঁটার বিহাইন্ড দ্য সিন ক্যামেরায় লাল ভাইয়ের একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। কাঁটা শুটিং করে আসার পর আমিও লাল ভাইকে ভুলে গেছিলাম। হঠাৎ শিবুর ফেসবুক পোস্ট দেখে সব মনে পড়ে গেল। এরকম মানুষকে আমাদের সমাজে সবাই সহজভাবে নিতে পারে না। তাঁর প্রমাণ, বাড়ির নেইমপ্লেট থেকে তাঁর নামের অংশবিশেষ মুছে দেওয়া। বিশেষত এরকম কেউ থাকতে পারে না, যার নামের তিনটি শব্দ তিন ধর্মের! সমস্যা কি? সমস্যা কারো আছে। এই যে সমস্যা, একজন লোকের নামে মুসলিম-হিন্দু-খ্রিষ্টীয় শব্দ থাকার সমস্যা, আমাদের বঙ্গীয় সমাজের সমস্যা এইটা। তাই লাল ভাইকে কিছুটা বেকায়দায় জীবনযাপন করতে হতো হয়তো। তবে তিনি মার্শাল আর্ট জানতেন, কেউ তাকে শারীরিক ভাবে স্পর্শ করবার সাহস দেখাত না। তাঁর আঁকানো চিত্রকলা ছিল অনেকটা স্ক্রৌল পদ্ধতির মতো। ছবির সাবজেক্ট, মুক্তিযুদ্ধ। ছবিতে ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের স্টোরি বলার প্রয়াস। নিজেকে দার্শনিক, কবি, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী নানানভাবে অভিষিক্ত করতেন। ভিজিটিং কার্ড দিলেন, দেখলাম, ওখানে তাঁর অনেক পরিচয়। পর্বের শুরুতেই বলেছি, তিনি বিচিত্র কায়দার মানুষ। একচুয়ালি মহাবিচিত্র শব্দটা লাল ভাইয়ের সঙ্গে যায়। আমার সঙ্গে একটা ভাব-খাতির হয়ে গেল।


p 27. 6

সুবোধ-স্বপ্নার লাশ ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাচ্ছে পরাণচন্দ্র দাস


কিন্তু শুটিংয়ের চাপের কারণেই, খুব একটা সময় দিতে পারিনি তখন তাঁকে। লাল ভাই চলে গেলেন। ঢাকায় এরকম লোক আমরা হয়তো আর পাব না। সবাই তো গড়পড়তা ছা-পোষা মানুষ, প্রায় একই সিলেবাসের মানুষ, গৎবাঁধা মানুষ; লাল ভাই তাঁর থেকে পুরোপুরি আলাদা। আলাদা ধরনের মানুষকে বঙ্গীয় আদিম সমাজ, যা এখনো প্রবহমান এখানে, তারা নিতে পারে না। কারণ কি এই যে, বঙ্গীয় সমাজ চালানো লোকগুলো একেকটা ঢেঁকি। আধুনিক মানুষই হতে পারেনি এখনো। তাই লাল ভাইকে যে কেউ সহজে বুঝতে পারবে না। পারেওনি। লাল ভাইয়ের চাচাত ভাইকে হয়তো অনেকেই চেনেন। তিনি সাংবাদিক-সম্পাদক আবেদ খান। আবেদ খানও অনেক আগে বসু বাজারের ওই বাড়িতেই বসবাস করতেন, পরে জেনেছি।


p 27. 7

রাস্তার মোড়ে বিহারি নাপিত আবদুল আলীর ‘ইয়োর চয়েস সেলুন’ সুবোধচন্দ্র দাস


আমাদের বাড়িটা ছিল কুমার নদের পাড়ে, মধুপুরে। মধুপুর এমন একটা গ্রাম, যার অর্ধেকটা একটা গঞ্জের বাজার। সেই গঞ্জ গাড়াগঞ্জ। কুমার নদের পাড় ঘেঁষে পাকা রাস্তা। রাস্তা এসেছে ঝিনেদা থেকে, রাস্তা গেছে শৈলকূপায়। রাস্তার পরেই ফাঁকা একটু মাঠ, মাঠের পরে বাঁশবাগান। বাঁশবাগানের পরেই সারি সারি বাড়ি। আমাদেরও বাড়ি। আমার বড়ো কাকা মারা যান যখন, তখন আমরা খুব ছোটো। বড়ো কাকার তিন ছেলে। বড়োটা আমার সমবয়সি। আমরা একসঙ্গেই বড়ো হয়েছি। ছোটোকাকা তখনো বিয়ে করেননি। কাজেই ছোটো মা আসেনি তখনো। ছোটোকাকা বাড়িতে তখনকার সিনে পত্রিকা ‘চিত্রালী’ ‘পূর্বাণী’ কিনে এনে ঘরের বাঁশের বেড়ায় পেস্ট করে রাখতেন। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি, খবরাখবর থাকত ‘চিত্রালী’ ‘পূর্বাণী’তে। ছোটোকাকাই আমাকে ও আমার বড়োকাকার ছেলে শিশিরকে জীবনে প্রথম সিনেমা দেখাতে নিয়ে যান ঝিনেদার ‘ছবিঘর’ সিনেমায়। কাজেই আমার জীবনে সিনেমা দেখা ও সিনেমার খবরাখবর জানার ব্যাপারে ছোটোকাকার কাছে আমার ঋণ আছে। এমন কি গাড়াগঞ্জ বাজারে যাত্রাদল আসত তখন, আমার ছোটোকাকা সেই যাত্রা আয়োজনে জড়িত থাকতেন। অথচ কোনো দিন ছোটোকাকার কথা লেখাই হয়নি কোথাও। বড়োকাকা মারা গেলেন সম্ভবত অসুখে। আমরা তখন খুব ছোটো ছিলাম। স্মৃতি খুব পরিষ্কার নেই, ঝাপসাতিঝাপসা ছবির মতো মনে হয় সেই ছোটোবেলাকে। আমার বড়ো মা বিধবা হলেন যখন, তখন তাঁর ছোটো ছোটো তিন ছেলে। এখন বুঝতে পারি, কী কষ্টই না করেছেন আমার বিধবা বড়ো মা ছেলেদের মানুষ করতে। এখন তাঁর ছেলেরা বড়ো হয়েছে, বিয়ে করেছে, ওদেরও বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে। আমার বাবা-মা ও দুই বোন পরে ঝিনেদা শহরে চলে গেল আবাসিকভাবে। সে কারণেই, আমি যখন ঢাকা থেকে ঝিনেদায় যাই কখনো-সখনো, ঝিনেদা শহর থেকে গাড়াগঞ্জ বা মধুপুর আর ফেরা হয় না আগের মতো। তবু অনেক বছর বাদে গত দুই বছর একবার করে গেছি মধুপুর। বড়ো মার বয়স হয়েছিল। অসুখ ছিল। ডায়াবেটিক তাঁকে কাবু করে ফেলছিল ক্রমশ। গত পরশু, ২১ অক্টোবর রাতে বড়ো মা মারা গেছেন। ঝিনেদা থেকে আমার বোন আমাকে প্রথম ফোনে এই খবরটা জানাল। আমি ফোন করলাম বড়ো মার বড়ো ছেলে কণ্ঠশিল্পী ও কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শিশিরকে। আমরা দুই ভাই একসঙ্গেই তো ছোটোকালে সব কিছু করে বেড়াতাম। ভেঙে পড়েছে শিশির।


p 27. 4

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনা অফিসার


বন্ধু দিলিপকে ফোন করলাম। আমার মা ঢাকার বাসায় ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ায় মাকে খবরটা রাতে দিলাম না। কিন্তু সারা রাত আমার ঘুম এলো না। খুব ছোটোবেলাকার স্মৃতি আমাকে জাগিয়ে রাখল। কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ‘আচ্ছা, যখন আমরা মধুপুরের বাড়িতে বড়ো হচ্ছিলাম, তখন কি জানতাম একদিন আমরা কে কোথায় চলে যাব? না। কিছুই জানতাম না। বড়ো মার কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ল। আমার মেজমামা ও ছোটোমামাও মারা গেলেন করোনা আসার আগে ও পরে, আমি যেতে পারিনি হরিণাকুণ্ডুর ভায়নায়, যেখানে একদিন আমার জন্ম হয়েছিল। এভাবেই, একদিন আমাদের বয়স বেড়ে যায়। শিশুরা যুবক হয়, প্রৌঢ় হয়, বৃদ্ধ হয়, মরে যায়। তখন হয়তো নতুন শিশুরা খেলা করে বাড়ির উঠোনে, আমরা যেভাবে খেলতাম। তখন হয়তো নতুন যুবকেরা তাকায় রাস্তায়, দেখতে থাকে, কে আসে, কে যায়? কেউ না কেউ আসে, কেউ না কেউ যায়। এভাবেই প্রবাহিত হয় আমাদের জীবন। একদল প্রজাপতি উড়ে যায়, তারা কোথায় যে উড়ে যায় আমাদের জানা হয় না। আবার একদল প্রজাপতি উড়ে আসে, তারাও উড়ে যায়। প্রজাপতি কোথায় উড়ে যায়? পাখিগুলো কোথায় যায়? কাচপোকা কোথায় যায়? মানুষ কোথায় যায়? আমার মেজোমামা, ছোটোমামা কোথায় এখন? আমার বড়ো মা কোথায় কোথায়? আমি ঢাকা থেকে ঝিনেদায় যাব কিন্তু কোনো দিন আর দেখা পাব না তাদের মুখ! শুধু স্মৃতি-সিন্দুকের ভেতর জমে থাকা তাদের মুখচ্ছবিটা আমি বয়ে বেড়াব। কাঁটা নির্মাণের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জীবনে এইসব এপিটাফ লিখিত হয়ে থাকছে। এর নাম, ব্যথা। চিরস্থায়ী ব্যথা আমার। আমার ভেতর থেকে এরা, ব্যথারা যাবে না কখনো।


p 27. 3

ভোদাই রাজাকাররা দাঁড়িয়ে আছে কান ধরে, যুবতী কুলসুম মজা নেয়


নারিন্দার দিনগুলো নিয়ে কত কথাই তো লিখে যাচ্ছি। রাত নিয়ে লেখা হচ্ছে কম। কেমন ছিল নারিন্দার রাত, ভূতের গলির রাত। কেমন ছিল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে নেমে আসা রাত, রাত্রিগুচ্ছ? দিনেরবেলায় যে টেবিল ঘিরে আমরা বসতাম। রাতের নির্জনে তা দেখতে কেমন? মানুষ থাকলে যে পূর্ণতা, মানুষ ছাড়া তা কতখানি শূন্যতা? শূন্যতা দেখতে কেমন? শূন্যতার সিলেবাস পড়তে পড়তেই তো বয়ে চলা যাপিত আমার দিনলিপি বা নিশিলিপি। আচ্ছা, এমন কি ভাবা যায়, ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনের শূন্যতার ভেতরে আমরা ইনভিজিবলি বসে আছি? আমরা আছি কিন্তু আমাদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। আমরা আমাদের দেখতে পাচ্ছি না! এমন কি ক্যামেরার লেন্স আমাদের ক্যাপচার করতে পারেনি! এ হয় নাকি? ‘ম্যাট্রিক্স’ দেখেছি কত আগে। আমরা কি কাঁটা বানাতে গিয়ে ‘ম্যাট্রিক্স’ এর মধ্যে পড়ে গেছি? না না, এত আধিভৌতিক কিছু নয়। আমরা তো সাইন্স ফিকশন বানাচ্ছি না, বানাচ্ছি সোশ্যাল ফিকশন। ফিকশনের নাম কাঁটা, যে কাঁটা শক্তিশালী ঢের, যে কাঁটা মনোজগতের।

ভূতের গলির মহল্লাবাসিদের অভিজ্ঞতা এরকম যে, ‘ছুবোধের ছুডো বাইয়ের নাম ছবছম পরাণই হয়।’ ভ্যানের উপরে লাশ, সুবোধ-স্বপ্নার লাশ। পরাণ সেই লাশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাচ্ছে। পরাণ একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ভাইয়ের লাশ, বৌদির লাশ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে বটে, কিন্তু কারই বা এটা ভালো লাগে? পুলিশ আছে, মহল্লাবাসী আছে, পরাণ হারিয়েছে দাদা-বউদিকে। কেন হারাল তাদের? এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে কাঁটা ছবিতে।


p 27. 2

বিভ্রান্ত এক পাকি-ফৌজের গুলিতে আকস্মিক দুজন মহল্লাবাসি লুটিয়ে পড়ে


মহল্লার চৌরাস্তার মোড়ে আছে ইয়োর চয়েস সেলুন ঘর। বিহারি নাপিত আবদুল আলীর মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সারাক্ষণ রেডিও বাজে তার সেলুনে। সেলুনের সামনে পেতে রাখা দুইটা কাঠের বেঞ্চে বসে গল্পগুজব করে মহল্লার কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেন। সুবোধ চুল কাটাতে যায়। সুবোধের সেদিন ভয় করে সেলুনের নাপিতের খুরকে। কেন? ছবিতে দেখানো আছে। ১৯৮৯-৯০ সালের সেলুন ঘর। তাই সেলুনের দেওয়ালে সাঁটানো সে সময়ের সিনে পত্রিকা ‘চিত্রালী।’ রাজ্জাক, শাবানা, রোজিনা, ক্রিকেটার ইমরান খানকে দেখা যাচ্ছে। জহির রায়হানের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে লেখা দেখা যাচ্ছে। উপমহাদেশের সিনেমার পত্তনকারী মানিকগঞ্জের হীরালাল সেনকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন আছে চিত্রালীতে।

অন্যদিকে, ঢাকার পাকিস্তানি সেনা অফিসার তার জুনিয়র অফিসারকে ডেকে কিছু একটা নির্দেশ করছেন। সেই নির্দেশ কিসের? ছবিতে দেখা যাবে। ১৯৭১ সালের বাস্তবতা ওটা। কাঁটাতে তিনটি সময়। ১৯৮৯-৯০ একটা সময়। একটা সময় ১৯৭১। আরেকটা সময় ১৯৬৪। ছবিতে বিভিন্ন সময়ের ঘটনাগুলো দর্শকের সামনে উপস্থিত হবে। যেমন, ১৯৭১ সালের কিছু চরিত্র আছে ভূতের গলিতে, তারা রাজাকার। তাড়া এমন ভোদাইগিরি করে যে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সবার সামনে। তখন আলী আকবরের বাড়ির কাজের মেয়ে সাহসী যুবতী কুলসুম তাদের এই কান ধরা দেখে বেশ মজা নেয়। কুলসুমের এই মজা নেয়ার ফলও ভোগ করতে হয়। সেটা কীভাবে? তা এখানে বলা যাবে না। ছবিতে দেখতে পাবেন।


p 27. 10

কাঁটার সিনেমাটোগ্রাফার রোমান হাসতে হাসতে কি দেখাচ্ছে আমাদের?


ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে পাকিস্তানি ফৌজ যেদিন আসে, সেদিন দুজন মহল্লাবাসি হত্যার শিকার হয়। সুবোধের কি হয়? স্বপ্নার কি হয়? সাকুল্যে সেদিন কয়জন মারা যায় ভূতের গলিতে? কেন মারা যায়? কীভাবে মারা যায়? এরকম আরও কত প্রশ্নের উত্তর নিহিত থাকছে কাঁটা ছবিতে। কাজেই, ছবি দেখে উত্তর খুঁজতে হবে।

সনি এফ এক্স ফাইভ ক্যামেরায় শুট করা কাঁটা। এ ছাড়াও সনির একটা ফোর কে রেজিলেশনের হ্যান্ডি ছিল আমাদের কাছে। সেটা দিয়ে অবশ্য বিহাইন্ড দ্য সিন ধরা হয়েছে মূলত। তবে কাঁটার ১ ভাগ শুট করা হয়েছে ওই হ্যান্ডিতেই। বাকি ৯৯ ভাগ সনি এফ এক্স ফাইভ ভার্সনে। কাঁটার সিনেমাটোগ্রাফার তাইজুল ইসলাম রোমান। কী পরিশ্রমই না করেছে রোমান কাঁটার জন্য। রোমান না থাকলে আমার পক্ষে কাঁটা প্রোডাকশন নামিয়ে আনা সম্ভব হতো না, এ আমি বলতেই পারি।


p 23. 11

কুয়া থেকে বালতিতে জল তোলে স্বপ্নারানী দাস


কাঁটাতে ঘুরে ফিরে পাতকুয়ার কাছে ফিরে আসতে হবে আমাদের। কুয়া থেকে জল তুলছে স্বপ্নারানী দাস। মহল্লাবাসি তাদের কৌতূহলের কারণে আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে যখন ঢু মারে, তারাও কুয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়ার চারপাশ ধরে ঘুরণচণ্ডি করে তারা। উড়নচণ্ডি জানা ছিল, ঘুরণচণ্ডি তো জানা ছিল না। জানা ছিল না কিন্তু এইমাত্র শব্দটি এসে ঢুকে গেল জার্নি অব কাঁটাতে। একে বলে বিনির্মিত শব্দ। ডি-কনস্ট্রাক্টিভ ওয়ার্ড। কবিতা লেখার অধিকারে কবিগণ এই কাজ করে আসছে কবিতার ব্যবহারিক জীবনে। তারপর একাডেমি একদিন শব্দটি নেবে, অভিধানে ঢোকাবে। ঢুকুক। ঢোকাক। শূন্যতায় হাওয়া ফুল ফোটাবে, ফুটুক। ফোটাক। এ লেখা যখন লিখছি, আজ নবমী। মন্দির থেকে ভেসে আসছে ঢাক। এরকম এক নবমীর রাতে আমাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সারা রাত থানা হাজতের ফ্লোরে শুয়ে-বসে থাকি। পরদিন দশমী। আমাকে চালান দেওয়া হয় কোর্টে। কোর্ট কাস্টডিতে সারা দিন যায়। সন্ধ্যায় জামিন হয়। ২ বছর ৪-৫ মাস চলে মামলা। জার্নি অব কাঁটার একটি পর্বে সে সব বিস্তারিত লেখার সময় এসে গেছে। লেখা হবে। আপাতত নারিন্দা থেকে ফিরব আমরা। কাঁটার শুটিং নারিন্দায় থাকাকালীন শেষ হয় প্রায় নব্বুই ভাগ। ধারাবাহিকভাবে সে সব লিখে যাচ্ছি জার্নিতে। আবার ধারাবাহিকতা ছিন্ন যে হচ্ছে না, তাও নয়। লিখতে লিখতে লেখা যেদিকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে, আমি লেখার সঙ্গে যাচ্ছি। হয়তো পাঠক বন্ধুরাও সেভাবেই যাচ্ছেন। যাচ্ছেন তো? নাকি যাচ্ছেন না? প্রতিটি মুহূর্ত পার হচ্ছে আর আমরা পার হচ্ছি সময়ের একফুট সাঁকো। কাজেই, স্থির থাকার কোনো সুযোগ নেই। অনেকটা আমরা নদীর ঢেউ, অনেকটা আমরা বাতাসের আনাগোনা করা শিস, কোথাও না কোথাও আমরা যাচ্ছিই অহর্নিশ।


p 23. 12

শাঁখা ভাঙা, সিঁদুর-কৌটা ওল্টানো, অর্থাৎ ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে!


সিঁদুরের কৌটা উলটে সিঁদুরের গুড়ো পড়ে আছে। ভাঙা শাঁখা পড়ে আছে। কেন এসব পড়ে আছে? সেই ‘কেন’র সন্ধানে কাঁটাতে চোখ রাখতে হবে।

কি? কাঁটাতে চোখ রাখতে হবে? কাঁটাতে চোখ রাখা মানে কি? এতে করে চোখ কি ভালো থাকবে? অন্ধ হয়ে যেতে হবে না? অবশ্য এই কাঁটা কন্টক কাঁটা নয়। এই কাঁটা মনোজাগতিক কাঁটা। দেখা যাবে না, দেখানো যাবে না, অনুভব করা যাবে। আমার সঙ্গে একদল মানুষ প্রাণপাত করে খেটেছে সেই অনুভব ভিজ্যুয়াল করতে। এখন পরিশ্রম করছে পোস্ট প্রোডাকশন টিম। সবাই মিলেই আমরা এক অনুভবের দোলা তৈরি করেছি বা করতে সমাপনীর দিকে আছি। ইচ্ছা, নির্মিত এই অনুভবকে আপনার অনুভবের ভেতরে একাকার করে দেওয়া। কতখানি দিতে পারলাম, সেই বিষয়টা আপনিই ভাববেন, বলবেন, যেহেতু আপনি দর্শক, আপনার বিচক্ষণতার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।

পরের পর্বে কি আমরা নারিন্দা থেকে চলে আসব ফের? আমি ফিরব মগবাজারে, অন্যেরা ফিরবে যে যার ঠিকানায়! ভূতের সম্মিলন ভেঙে যাবে! নাকি ভূতের গলিতে আরও এক বা দুই পর্ব থাকতে পারব জার্নি অব কাঁটাতে?


আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৯
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২০
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৬


কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।