কৃষ্ণচণ্ডী
কাকভোরে কাঁসরের ঢং ঢং শব্দ মন্দির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে যখন বাইরে ছাপিয়ে পড়ে, ‘জয় তারা’, ‘জয় তারা’ রব ওঠে। সেবাইত পঞ্চপ্রদীপের আলো তারাশিলার দিকে ঘোরাতে থাকেন। মায়ের ভক্তরা জোড়হাতে নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে আছেন। ভোরের মৃদুমন্দ টাটকা বাতাসের মতো তাঁদের নতুনকার হৃদয়ের বাসনা মাকে জানাচ্ছেন। ভৈরবী নাটমন্দিরের একধারে বসে আছেন। সমাহিত স্তব ভাবমূর্তি। তারাশিলার মতো ওঁর গায়ের রং। কালো চকচকে দেহ থেকে জ্যোতি বের হচ্ছে। ভক্তদের মনে প্রার্থনারই তর তর ভাব। মঙ্গলআরতি শেষ হলো। সকলে ভূমিষ্ঠ হয়ে মাকে প্রণাম করছেন। ভৈরবীর প্রণাম নেই। তিনি নির্বাণ দশাপ্রান্তির ভেতর যেন রয়েছেন। আমার চোখ টানল আরও। নাটমন্দির ফাঁকা হতে আমি তাঁর কাছে গিয়ে বসলাম। ভোরবেলাকার নীরব মায়ের এলাকা তখন কোলাহলে মুখরিত হতে থাকল। ভৈরবী শিলাময়ী মূর্তির দিকে ফিরে তাকিয়ে তাঁর ধ্যানভঙ্গ করলেন। কথা বললেন না কোনো। শালুলালের একটা বোঁচকা খুললেন তিনি। পুরোনো একখানা বই বের করে পড়তে লাগলেন,
কৃষ্ণেণারাধিকা চণ্ডী কৃষ্ণচণ্ডী সুসিদ্ধিদা।
কৃষ্ণনামধরাদেবী সর্ব্বতন্ত্রেষু গোপিতা।।
শ্রীকৃষ্ণের আরাধিতা কৃষ্ণচণ্ডী সুদিদ্ধিদা। তিনি কৃষ্ণনামধারিণী। সর্বতন্ত্রে তিনি অত্যন্ত গুপ্তা।
কৃষ্ণচণ্ডীর কথা আমি প্রথম যে শুনলাম, তাও নয়। একবার এক তান্ত্রিক-বৈষ্ণবের কুঠিয়ায় রাত কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি সেদিন শ্রীকৃষ্ণের তান্ত্রিকমতে পুজো করছিলেন। সেদিন ছিল জন্মাষ্টমীব্রত। তাঁর কুঠিয়ায় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধিকা নেই। আছেন কৃষ্ণ-রুক্মিণী। পুজোয় তিনি পাত্রস্থাপন করে ভোগ দিয়েছিলেন মৎস্য ও কারণ।
বললেন, আমার গুরুদেব মহিষ বলি দিতেন। মহিষের মাংস রান্না করতেন মা— গুরু জিরে, আদাবাটা দিয়ে। আমাদের সে পাট আর নেই। এখানে মৎস্যভোগ হয়। তবে মাংস-মৎস্যের ভোগ শ্রীকৃষ্ণের জন্য নয়, দেওয়া হয় রুক্মিণী দেবীর উদ্দেশে।
বললাম, এর কারণ কী, বাবা?
তান্ত্রিক-বৈষ্ণব রসিকলাল গোঁসাই বললেন, রুক্মিণী দেবীকে আমরা মহালক্ষীস্বরূপা মনে করি। তিনি মদ্য-মাংস-মৎস্যপ্রিয়া। ভগবান মৎস্য অবতার কী শুধু পৃথিবীকে বাঁচাতে নিয়েছিলেন নাকি, তাঁর স্ত্রী রুক্মিণী মৎস্যপ্রিয়া ছিলেন তো। রুক্মিণী দেবী দ্বাপর যুগে মাছ খেতে চেয়েছিলেন। ভগবান এর পর মৎস্য অবতার নিয়েছিলেন, যাতে তাঁকে খেয়ে রুক্মিণী দেবী সন্তুষ্ট হন।
এমন কাহিনি-কথিকাগুলো বৈষ্ণবতন্ত্রের পুথি-পাতরার ভেতর পাওয়া যায়। বক্তব্যগুলোর মধ্যে দ্বার্থক সব মানে আছে। সবই অন্তরঙ্গ সাধনধারার। সহজ বিষয়াদি নয়। তেমনই এক পুথি দেখেছিলাম একবার মিলনগড়ের বৈষ্ণব আখড়ায়।
যাওয়া মাত্র গোঁসাই ঠাকুর খাইয়েছিলেন বেলপানার শরবত। গরম দিন। চৈত্ররোদে পানা খেয়ে শরীরে শীতলতা আসছে। আখড়ার পাতকুয়ো থেকে তোলা জলে পানা করলেন মা-গোঁসাই। কুয়োর ধারে একখানা বুড়ো বেলের গাছ। মা-গোঁসাই বলেন শ্রীফল। সন্ধ্যায় বেলে গুড়-জড়ানো মোরোব্বা মিলেছিল প্রসাদ হিসেবে।
গোঁসাই ঠাকুর বললেন, রাধারানি মহাবিদ্যা যে। আখড়ায় আমরা রাধারানির যন্ত্রপুজো করি।
বললাম, কিন্তু গোঁসাই, তন্ত্রে যে রাধার পুজোর কোনো স্বতন্ত্র ক্রম নেই! গৌতমতন্ত্রে, ক্রমদীপিকায় শ্রীকৃষ্ণের পাত্রস্থাপন করে পূজাবিধির উল্লেখ পেয়েছিলাম।
গোঁসাই দোক্তা-ভরা গালে কথা বলতে থাকলেন। বললেন, দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণের পুজো তন্ত্রোক্ত। বৈষ্ণব-তান্ত্রিকেরা তাঁর পুজো যে করেন, বাবা। আমার গুরুদেব করতেন সেই পুজো। বলি হতো। তিনি বলতেন, রাজাধিরাজ শ্রীকৃষ্ণ তো রাজসিক। তাই দ্বারকাধীশের পুজোতে মৎস্য-মাংস-কারণাদির বাহার। তবে সবই যে বাহ্যিক বাহার। আন্তর তন্ত্রের প্রক্রিয়াদির ভেতর এসব তো দেহকাজ, বাবা।
বললাম, কীরকম গো গোঁসাই?
মিলনগড়ের গোঁসাই বললেন, মাংস তো জিহ্বা, রসনা। বাক্য ভরা রসনার অংশ। রসনা সকলের প্রিয়। কথাতে তাই লাগাম নাই রে, বাবা। সাধকেরা বাক্ সংযম করবেন এটাই মাংস সাধকের কাজ—
মাশব্দাসনা জ্ঞেয় তদংশান রসনা প্রিয়ান।
সদা যো ভক্ষয়েদ্দেবি স এব মাংস সাধক।।
ব্রহ্মরন্ধ্রে কুণ্ডলিনীশক্তি, রাধার হলাদিনী উঠলে সুধা ঝরে যে। ওই তো মদ্য। দেহের ভেতর গঙ্গা নাড়ি আর যমুনা নাড়ির ফাঁকে রজঃ ও তমোগুণের দু’খানা মাছ চড়ে বেড়াচ্ছে। সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সত্ত্বগুণী হতে পারাই তো রে মৎস্য ভক্ষণ। এইসব গুপ্ত আধার রে বাবা, বৈষ্ণব-তান্ত্রিক তরিকার। কৃষ্ণচণ্ডী পুথি জোগাড় কর্ গিয়ে। বৈষ্ণবদেহতন্ত্রের তরিকা বুঝে যাবি।
জোগাড় করতে পারিনি তো এতকাল। আজ সকালবেলা ভৈরবী মা কৃষ্ণচণ্ডী পড়ছেন। এ পুথি করায়ত্ত করতেই হবে। আমি ভৈরবী সাধিকার ধারে লেপ্টে বসে রইলাম।
কৃষ্ণচণ্ডীর পাঠ চলছে।
মায়ের কারণ
আনন্দময়ী ভৈরবীর কুঠিয়ায় মায়ের ভোগে খেয়েছিলাম আতপের মোটা অন্ন। ভৈরবী রাঢ় বাংলার মানুষ। এখানকার পুরনো মানুষেরা খোসা সমেত কলাই ডাল পছন্দ করেন। ডাঁটার ঝাল রাঁধেন সর্ষে-পোস্ত দিয়ে। ভৈরবী বলেন ডেটো খাড়ার চড়চড়ি। মায়ের ভোগে খোসা না ছাড়ানো কালো রংচঙে কলাই ডালের সঙ্গে ডাঁটার ঝাল মুখে তুলতে তুলতে ভৈরবী আমার জিজ্ঞাসার সেই ভোগ পর্ব নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। ধু ধু জমির উপর একখানা খোলা চারচালায় মায়ের মূর্তি ইঁটের বেদিতে প্রতিষ্ঠিত। এর পেছনে শান বাঁধানো দাওয়ার কিছুটা দরমার বেড়া দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ খোলা মুলি বাঁশের দরজার ওপর চটের বস্তা দেওয়া। যাতে মায়ের চারচালা থেকে ঘরের ভেতরে চোখ না পড়ে। ঘরের ভেতর মড়ার চ্যাটা, মড়ার মালসা— তান্ত্রিকদের শ্লিষ্ট ভাষার নরকপাল আর খুলিকঙ্কাল রয়েছে। ভৈরবী বলেন মড়ার মাথা। মাথাতে করে মায়ের কারণভোগ দেন আনন্দময়ী ভৈরবী।
মকারের অধিকারও কেবলমাত্র অভিষিক্তের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পাত্রস্থাপন করে মাকে কারণ প্রদান করলেই কী হয়, বাবা! কারণাদি শোধন করে নিবেদন করতে হয়। আজকাল সকলেই মাকে কারণ দেন। শাস্ত্রবাক্যের ঊর্ধ্বে চলে যান তাঁরা সব। এ ঠিক না। গুরু নিজে অভিষিক্ত নন অথচ তাঁর শিষ্য মাকে কারণ নিবেদন করছেন, পঞ্চমকারে বসে পড়ছেন। মড়ার মাথাতে মাকে কারণ নিবেদন করে কী বলবে তাঁরা?
ভৈরবী বললেন, অভিষিক্তের কারণ প্রদান তন্ত্রে একেবারেই নিষিদ্ধ। মকারের অধিকারও কেবলমাত্র অভিষিক্তের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পাত্রস্থাপন করে মাকে কারণ প্রদান করলেই কী হয়, বাবা! কারণাদি শোধন করে নিবেদন করতে হয়। আজকাল সকলেই মাকে কারণ দেন। শাস্ত্রবাক্যের ঊর্ধ্বে চলে যান তাঁরা সব। এ ঠিক না। গুরু নিজে অভিষিক্ত নন অথচ তাঁর শিষ্য মাকে কারণ নিবেদন করছেন, পঞ্চমকারে বসে পড়ছেন। মড়ার মাথাতে মাকে কারণ নিবেদন করে কী বলবে তাঁরা? আনন্দ ভৈরব আনন্দ ভৈরবী মন্ত্রের উপদেশ না পেলে মায়ের পূজাদির কারণ শোধন হবেই বা কী করে? সব কিছু সবাই তো আর মাকে নিবেদন করতে পারেন না। পুরনো কারণ মাকে দেওয়ার রীতি যে, বাবা।
বললাম, চরণসংহিতার ভেতর এ তথ্যাদি পেয়েছিলাম যে মা। নতুন মদ গুরুপাকের। ত্রিদোষের উত্তেজনা ধরা আছে ওর ভেতর।
ভৈরবী মৃদু হেসে বললেন, দোকানের কেনা কারণ তো কারিগর ধরে বানানো। কারিগরের দেহাদির তমোময় দশা আর রজোগুণের স্পর্শাদি ওইসব কারণাদিতে লেগে থাকে, বাবা। তা খেলে দেহাধার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আমার গুরুদেব স্পর্শশক্তিকে খুব মানতেন যে। তাই আমাদেরও মানাগোনা আছে।
বললাম, স্পর্শশক্তি কী মা?
কোনো কোনো স্পর্শাদি আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনে খুব প্রতিকূল হয়, বাবা। কোন ব্যক্তিতে কোন প্রকার গুণাদি আছে তা কী তুমি জানো? কার স্পর্শে উপকার হবে, কার স্পর্শে অপকার হবে তা নিরূপণ করা শক্ত কাজ হলেও আমরা বুঝতে পারি এসব দীর্ঘ গুরুসঙ্গে কাটিয়ে।
ভৈরবী বললেন, কোনো কোনো স্পর্শাদি আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনে খুব প্রতিকূল হয়, বাবা। কোন ব্যক্তিতে কোন প্রকার গুণাদি আছে তা কী তুমি জানো? কার স্পর্শে উপকার হবে, কার স্পর্শে অপকার হবে তা নিরূপণ করা শক্ত কাজ হলেও আমরা বুঝতে পারি এসব দীর্ঘ গুরুসঙ্গে কাটিয়ে। তমোগুণসম্পন্ন দেহাদি চিনবার নানান প্রণালী আছে যে, বাবা। আমরা নির্ধারণ করতে পারি। এদের সংস্পর্শে আসলে আধ্যাত্মিক উন্নতি আটকে যায়। এদের দেওয়া আহারাদি পর্যন্ত গ্রহণ করা উচিৎ নয়। কারণের কারবারিরা তমোগুণী। এদের তৈরি কারণ তন্ত্রের মকারে লাগে না যে। পুরনো তান্ত্রিকেরা পুরনো কারণ মাকে নিবেদন করে গ্রহণ করেন। আমাদের গুরু পরম্পরাতে সেই রীতি বর্তমান। আমার মা-গুরুর কাছে বহু পুরাতন মধু ভরা মাটির একখানা জালা ছিল। সে জালা আজও বর্তমান। আমাদের জিম্বায় আছে। পুরনো মধুর সঙ্গে মেড়াশৃঙ্গী গাছের ছাল তুলে ক্বাথ করে মিশিয়ে ওতে পিপুল গুঁড়া আর লঙ্কা গুঁড়া মিলিয়ে মকার সাধনের কারণ তৈরি করি আমরা। সেই কারণও শোধনাদির পর মাকে নিবেদন করা হয় মরার মাথায় করে।
বললাম, চরক সংহিতাতেই পড়েছিলাম তো মা, পুরনো মদ দেহের রসাদিবাহী নাড়িকে শোধন করে অগ্ন্যুদ্দীপক, লঘুপাক, রোচক, প্রীতিকর, বলবর্ধক করে তোলে। পুরোনো মদে শরীরস্থ বীর্যের পুষ্টি বেড়ে যায়। সেজন্যই সত্ত্বগুণাধারীরা পুরনো মদ উপযুক্ত মাত্রাতে খেলে দেহে অমৃতের ধারা নেমে আসে।
মা বললেন, বৈদ্যক শাস্ত্রাদির সবখানেই কারণের প্রশংসা আছে যে, বাবা। তবে সবই ঘরে বানানো কারণাদি। কারবারির কারণাদিতে দেহ উত্তেজক হয় খালি। ওই কারণাদি দেহের বল বিধান করতে পারে না। পুরানা তান্ত্রিকেরা সেসব এড়িয়ে চলেন। এ আমাদের গুরুঘরের শিক্ষা।
আমি তখন মোটা আতপের অন্ন ভেঙে ঘুষো মাছের টক দিয়ে মাখছি। গরস তুলতে যাব। ওরই ভেতর মা মড়ার মাথায় দেওয়া প্রসাদি কারণ আমার পাতের উপর ঢেলে দিয়ে গেলেন। আঠালো, থকথকে কারণ দিয়ে বেশ খানিকটা জড়িয়ে নিলাম ফের মোটা আতপের অন্ন। জানি না আমার শরীর পুরনো মদ পেয়ে বলবর্ধক হবে কিনা!
বৈদ্যক শাস্ত্রাদির জ্ঞান পেয়েই বোধহয় ভৈরবী ওর ডেরা ছেড়ে আসার আগে আমাকে একটা বোতলে বেশ খানিকটা কারণ দিয়ে বলেছিলেন, নিয়ে যাও, বাবা। সন্ধ্যায় মায়ের নাম করেটরে, ধ্যানজপের পর একটু একটু পান করো।
আনন্দময়ী মায়ের বানানো মকার সাধনার কারণের বোতলখানা আজও আমার বইয়ের দেরাজে রয়েছে মায়ের স্মৃতি হিসেবে। খাওয়া আর হয়নি। কাষ্ঠগড়া থেকে ফেরার দিন তিনেক পর খবর পেলাম ভৈরবী মা দেহ রেখেছেন। মা চলে গেছেন। কাষ্ঠগড়া আশ্রমে মায়ের সমাধি রয়েছে আর রয়েছে আমার কাছে মায়ের দেওয়া কারণ। পুরোনো মদ। চরক সংহিতার পাতা—
প্রায়শোঽভিনবং মদ্যং গুরুদোষ সমীরণম্।
স্রোতস্রাং শোধনং জীণং দীপনং লঘুরোচনম্।।
হর্ষণং প্রীননং বর্ণ্যং, ভয়শোশ্রমাপহম্।
প্রাগলভীর্য্যপ্রতিভা তুষ্টি পুষ্টি বলপ্রদং।।
সাত্ত্বিকৈর্বিধিবৎ যুক্ত্যা পীতং স্যাৎ অমৃতং যথা।।
কাঁচা আমিষ
কামেশ্বরে পুজো দিয়ে নামছি তখন। সঙ্গে রয়েছেন নির্মলানন্দ ভৈরব ঠাকুর। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গুয়াহাটি শহরের কাছে নীলাচল পাহাড়ের ওপর কামাখ্যাপীঠ। ভারতের একান্ন মহাপীঠের অন্যতম পীঠ কামাখ্যা অসমের কামরূপ জেলায় অবস্থিত। জপমালা ভৈরবীর বলা পীঠকথা তখনও কানে বাজছে। আমরা কামেশ্বরের দক্ষিণে ছিন্নমস্তায় চলেছি। দেবী এখানে গুপ্তদুর্গা-ছিন্নমস্তা নামে পরিচিতা। নীলাচল পাহাড়ে পাঁচটি শিবের মন্দির রয়েছে— কামেশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, কোটিলিঙ্গ, অঘোর ও আম্রাতকেশ্বর। কামাখ্যা তন্ত্রপীঠ। তন্ত্রের আরাধ্যা দশমহাবিদ্যার দেবী মাতঙ্গী ও কমলা ছাড়া বাকি দেবীদের এক একটি মন্দির আছে নীলাচল পাহাড়ে। বিভিন্ন মনস্কামনা পূরণের জন্য তান্ত্রিকের সব শিষ্যভক্তদের এখানে এনে পুজো করান। তান্ত্রিকী হোম-ক্রিয়াদি সমাপন করেন।
জগৎপালক পিতা বিষ্ণুদেব সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে দিলেন। যে সকল স্থানে সতীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পড়েছিল, সেসব স্থানই পরে মহাপীঠ হয়ে উঠল। সতীদেহের মহামুদ্রা, যোনিঅঙ্গ পড়েছিল নীলাচল পাহাড়ে। কামাখ্যাবিদ্যার সারবত্তা বুঝতে হবে। শুধু এখানে এসে পুজো-হোম-ক্রিয়াদিতে কিছু হবে না গো।
জপমালা ভৈরবী বললেন, দক্ষযজ্ঞে স্বামীর নিন্দা শুনে সতীনারীর প্রাণ গেলে শিব স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়কাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়লেন। শিবতাণ্ডবে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে পর্যন্ত কম্পন হতে থাকল। দেবতারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। জগৎপালক পিতা বিষ্ণুদেব সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে দিলেন। যে সকল স্থানে সতীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পড়েছিল, সেসব স্থানই পরে মহাপীঠ হয়ে উঠল। সতীদেহের মহামুদ্রা, যোনিঅঙ্গ পড়েছিল নীলাচল পাহাড়ে। কামাখ্যাবিদ্যার সারবত্তা বুঝতে হবে। শুধু এখানে এসে পুজো-হোম-ক্রিয়াদিতে কিছু হবে না গো।
বললাম, কী সেই সারবত্তা মা?
ভৈরবী বললেন, দেহ আমাদের ছাঁকনি গো। দেহে আছে লোভ-মোহ, অষ্টপাশ। সব ছাঁকতে হবে। কুণ্ডলিনীযোগে দেহের কাম-কামনা সব্বার আগে তুলে নিতে হয় গো। কাম থাকে দেহাদির বাহিরে। বহিরিন্দ্রিয়ের কামাদি কুণ্ডলিনীযোগে ছাঁকতে ছাঁকতে অন্তরিন্দ্রিয়ের যোগ-সাজুশে প্রেমে পরিগণিত হয়। এই হলো কামাখ্যাবিদ্যা। বিদ্যায় দেহাদির নানান সব মুদ্রাভঙ্গিমা আছে। গুপ্তমহামুদ্রার ব্যবহার চলে কামাখ্যাবিদ্যা সাধনে। ভৈরব ঠাকুর মহামুদ্রা খুলে ভৈরবী ঠাকুরানির মহামুদ্রাতে স্থাপন করতে থাকেন। নির্দিষ্ট তিথিযোগ আছে। নক্ষত্রাদির গতাগতি দেখে দুই দেহের বহিরস্থ কামকে ছাঁকতে ছাঁকতে অন্তরঙ্গ প্রেমের দশাতে এনে তোলা কামাখ্যাবিদ্যা।
ভৈরব বললেন, আদ্যাশক্তি রাজ্ঞী। রাজমহিষী, রানি। তন্ত্রের ভৈরবী সাধিকাও আদ্যার শক্তিধারী। তিনি রাজ্ঞী, রাজমহিষী, রানি হয়ে আকাশে নিয়ন্ত্রীধারায় গতিশীলা। এর গুহ্য মানে আছে রে, বাপ। আকাশে বিস্তারিতা অর্থাৎ দেহে ব্যাপ্ত কামকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন। দেহে যখন মহামায়ার আবির্ভাব ঘটে তখন সাধক সেখানে মাংসকে আস্বাদন করেন। দেহরূপ কাঁচা মাংসভক্ষিণী। জ্ঞানখড়্গ দিয়ে দেহাদির কাম-ক্রোধ-লোভ-ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রাকে কেটে ফেলে পশ্বাচারের আস্বাদনকে বলা হয় মাংস ভক্ষণ।
বললাম, ঠাকুর কী দেবী কেশাইখাতির কথা বলছেন? তিনি কাঁচা মাংসভক্ষিণী বলে এই নামে প্রসিদ্ধা।
ঠাকুর বললেন, ঠিক জায়গায় ধরেছ গো এইবার। কাঁচা মাংস। কাঁচা আমিষ। তন্ত্রোক্ত পুজোয় বামাচারীরা পঞ্চমকারযোগে যখন বলি প্রদান করেন সেখানে কাঁচা আমিষে ভোগ দেওয়া হয়। অতিগুহ্য কাঁচা আমিষের বলিপূজাদি। বিশেষ তন্ত্রক্ষেত্রে প্রশস্ত। মহাপীঠে কাঁচা আমিষের ভোগ চলে। দেবীর সামনে বলির পশুর রুধির মাংস কেবল নিবেদন করা চলে।
বললাম, ঠাকুর একে কি রহস্য বলির কাঁচা আমিষ ভোগ বলে?
ভৈরব বললেন, হ্যাঁ। তবে পশু বলি আর রহস্য বলি আলাদা যে, বাপ। দেবীর সম্মুখে বলিষ্ঠ পশুর মাংস রান্না করে পরে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। পশু বলির রান্না ভোগ শোধন করতে হয় না। কিন্তু রহস্য বলিতে রুধির মাংস দেবীকে নিবেদন করবার সময় শোধন করতে হবে। মৃত নরের মাংসও শ্মশানকালী, বামাকালী, দক্ষিণাকালীর রহস্য পুজোতে দেওয়া হয়। নিবেদনাদির রহস্য পুজো তন্ত্রের বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকল্পাদির ব্যাপার। অত্যন্ত গুপ্তভাবে এসব ক্রিয়াবিদ্যাদি করা হয়। রহস্য পুজোর মাংস আলাদা ভাবে সংগ্রহ করতে হয়।
ভৈরবী বললেন, দেহ আমাদের ছাঁকনি গো। দেহে আছে লোভ-মোহ, অষ্টপাশ। সব ছাঁকতে হবে। কুণ্ডলিনীযোগে দেহের কাম-কামনা সব্বার আগে তুলে নিতে হয় গো। কাম থাকে দেহাদির বাহিরে। বহিরিন্দ্রিয়ের কামাদি কুণ্ডলিনীযোগে ছাঁকতে ছাঁকতে অন্তরিন্দ্রিয়ের যোগ-সাজুশে প্রেমে পরিগণিত হয়। এই হল কামাখ্যাবিদ্যা।
কাঁচা আমিষের শোল বলি দেখেছিলাম একবার আড়ংঘাটা শ্মশানে। মুক্তানন্দ ভৈরবী মা চিতার ওপর শোল মাছ বলি দিয়ে শ্মশানকালীকে কাঁচা আমিষাদি ভোগ সাজিয়ে দিলেন। কাঁচা আমিষের ভোগ মানে রান্না করা কিংবা ঝলসানো কিছু নয়, সদ্য কাটা মাংস, মাছ দেবীর সম্মুখে নিবেদন করা হয়। পরে সেগুলো রান্না করে প্রসাদ পাওয়ার নিয়ম।
ছিন্নমস্তায় নেমে এলাম আমরা। সকালে গিয়েছিলাম ভুবনেশ্বরী। কামাখ্যা মন্দির ছাড়া অন্য সাতটি মন্দিরের অন্যতম ভুবনেশ্বরী। নীলাচল পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ভুবনেশ্বরী মায়ের মন্দির। কামাখ্যা হলেন দশমহাবিদ্যার ষোড়শীর রূপ নীলাচল পাহাড়ে। কালী, তারা, ষোড়শী-কামাখ্যা, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা-গুপ্তদুর্গা, বগলা। দশমহাবিদ্যার এই আট দেবী রয়েছেন এখানে। ছিন্নমস্তায় সন্ধ্যা নেমেছে। কিছু পর মায়ের আরতি শুরু হবে।
নির্মলানন্দ ভৈরব ঠাকুর বললেন, নবদ্বীপের কালীসাধক পর্যন্ত কামাখ্যা এসেছিলেন। এটা জানো তো?
বললাম, এর তথ্যাদি?
ঠাকুর বললেন, কামরূপের রাজা গদাধর সিংহের পর সিংহাসন পান রুদ্র সিংহ। তিনি শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার বাসনায় নবদ্বীপ থেকে আগমবাগীশ মশাইকে আনিয়ে ছিন্নমস্তায় দীক্ষা নিয়েছিলেন।
ভৈরব ঠাকুরের কথা শুনে আমি ইতিহাসে চোখ রাখি। করতোয়া নদী পর্যন্ত অহোম রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর জন্য রুদ্র সিংহ বড়সড় সেনাবাহিনী বানালেন। যুদ্ধ করা হলো না। যুদ্ধের আগে মারা গেলেন রাজা রুদ্র সিংহ। তিনি তান্ত্রিক, বিদ্যোৎসাহী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি ছিলেন— ভৈরব ঠাকুরের কথাতে আমার মনে পড়ে গেল!
ভৈরব গুপ্তদুর্গা ছিন্নমস্তাতে প্রণাম করছেন। মায়ের স্তোত্রপাঠে নীলাচল পাহাড় গমগম করছে যেন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। জপমালা ভৈরবীর হাতে পূজার থালি। নির্মলানন্দ ভৈরব ছিন্নমস্তা মায়ের পূজাদি সারছেন। গোটা নীলাচল পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকের আওয়াজ। আওয়াজ ছিন্নমস্তা মায়ের মাথার মতন মন্ত্র কেটে বের হচ্ছে যেন! রুধির ধারা উঠছে। রুধির হলো রক্ত-মাথা। সাধনায় মস্তিকের কাজ সবচেয়ে বেশি। ওখানে সহস্রার। দেবীর কাঁচা আমিষের ভোগে রুধির মাংস দেওয়ার গুহ্য অর্থ হলো, নিজের সমস্ত সহস্রার অনুভূতিকে মায়ের কাছে নিবেদন করে দেওয়া।
নির্মলানন্দ ভৈরব বললেন, সাধক দেহে থাকে ভোক্তা ও ভোগ্য রূপ। ছিন্নমস্তা মায়ের দিকে তাকাও তো, বাপ। কী দেখতে পাচ্ছ?
বললাম, মা নিজের রক্ত রুধির নিজে পান করছেন।
ঠাকুর বললেন, তার মানে হলো রে বাপ, দেহের ভেতর ভোক্তা আছে, ভোগ্য আছে, কিন্তু ভোগ না হলে সব বৃথা। সাধন রসাতলে। ভোগ মানে শরীর। শরীরজগৎ পালনের জন্য ভোগ। না হলে কুণ্ডলিনী জাগবে কীরূপে? ছিন্নমস্তা মা সব সময় সেই জাগরণ নিয়ে বসে আছেন। দ্যাখ ভালো করে, বাপ।
আমি দেখছি মায়ের ত্রিরুধির।
ঠাকুর বলছেন, ওই ত্রিধাশক্তি। তিনটি ধারার রক্তস্রোতের ফিনকি। মা ভোক্তা, মা ভোজন-পানাদি করছেন, মা ভোগ করছেন আর ভোক্তার যাবতীয় সুখ-দুখাদি অনুভব করছেন। শরীরে ত্রিরুধির দিয়ে রক্তের ফিনকি ওঠে। সাধক ওকে পান করে ত্রিধাশক্তি লাভ করতে থাকেন। এই হলো গিয়ে ছিন্নমস্তা মায়ের সাধনধারা।
ভৈরব ঠাকুর মায়ের বীজমন্ত্র বলে চলেছেন পরম নিবিষ্টতায়। আমি দেখতে পাচ্ছি মন্ত্রবীজ হাওয়া কেটে কেটে ছড়িয়ে পড়ছে ঠাকুরের বলা ছিন্নমস্তা মায়ের ত্রিরুধির ধারায়!
শ্রীং হ্রীং ক্লীং
ঐং বজ্র বৈরোচনীয়ে
হুং হুং ফট্ স্বাহা…
কবি, প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতি গবেষক।
কলকাতা।