কবি দেবদাস আচার্যের ‘দেবদাসের জীবনপ্রভাত’ পড়া শেষ হলো। ব্যক্তিগত গদ্য কত বিচিত্র হতে পারে এই বইটি তার উদাহরণ। অরুণেষ ঘোষের ‘র্যাঁবো ও রামকৃষ্ণ’ও ব্যক্তিগত গদ্য। তবে সেখানে ছিল র্যাঁবো ও রামকৃষ্ণকে খোঁজার প্রাণান্ত চেষ্টা। জীবনকে ছেনে ছেনে ওইটুকুকে আলাদা করবার তাগিদ। কিন্তু দেবদাস আচার্যের এই বইটি একেবারে আলাদা। অনেকটা দেবদাসের আত্মজীবনী। বলা ভালো, শৈশব ও কৈশোরলিপি। সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে, তাঁর বর্ণনাশৈলি। দেবদাস আচার্য তাঁর শৈশবকে, শৈশবের গ্রামকে এতো নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন যে পাঠ করতে গিয়ে আপনার কখনও কখনও মনে হতে পারে এ জীবনটি আপনারই শৈশবের। বিশেষত যারা শেষ-আশি বা নব্বইয়ের শুরুতে গ্রামে বেড়ে উঠেছেন।
বইটির ভূমিকায় মনীন্দ্র গুপ্তর বয়ানে জানা যায়, একদা ‘পরমা’ নামে তিনি একটি কাগজ করতেন। গুপ্তবাবুর তখন একবার মনে হয়েছিলো, ‘সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টির পক্ষে তাঁর ছেলেবেলার গুরুত্ব অপরিসীম। কবির ছোটোবেলাকে জানলে পাঠকের পক্ষে তাঁর কবিতার জট ছাড়ানো সহজ হয়।’ তখন তিনি ‘পরমা’র প্রতি সংখ্যায় একজন কবি বা শিল্পীর শৈশবকথা প্রকাশের কথা চিন্তা করেন। প্রথমে অরুণ মিত্র (তাঁর লেখাটা ঠিক ‘শৈশবকথা’র বদলে অন্যমাত্রার হওয়ায় পরমায় তা আর প্রকাশ হয়নি।), পরবর্তীতে শিল্পী জীবনকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছোটোবেলার কাহিনি চিত্রসহ। এর পর মনীন্দ্র গুপ্ত নির্বাচন করেন দেবদাস আচার্যকে। এরপর নির্মল হালদার এবং তারই ধারাবাহিকতায় মনীন্দ্র গুপ্ত লিখে ফেলেন তাঁর বহুপঠিত ‘অক্ষয় মালবেরি’র প্রথম পর্ব।
দেবদাস আচার্যের জন্ম ১৯৪২ সালের ৩ জুলাই। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার বন্ডবিল গ্রামে। পাঁচ ভাই দুই বোন। ভাই-বোনদের মধ্যে আচার্যই বড়ো। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হন আচার্য পরিবার। বসত গড়েন ভারতের কৃষ্ণনগরে।
এই পর্যন্ত তাঁর ২৩টি কাব্যগ্রন্থ ও ৪টি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছে পঞ্চাশেরও বেশি সম্মাননা ও পুরস্কার। ২০১২ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডমি’ পুরস্কার।
[এখানে ব্যবহৃত লেখকের প্রতিকৃতিটি নেওয়া হয়েছে বাংলা কবিতার ব্লগজিন ‘বাক্’ থেকে। প্রতিকৃতিটি অঙ্কন করেছেন বিশিষ্ট শিল্পী শ্রী দেবোজ্জ্বল মজুমদার। তাঁদের সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ ও ঋণী।]
একটি গ্রন্থের সূচনা কোথায় কীভাবে হয় তা জানার জন্য এই ভূমিকাটির গুরুত্ব অপরিসীম।
দেবদাসের দেখার দৃষ্টি সরল। সহজতাই তাঁর লেখার প্রাণ। তাঁর গদ্যের অন্যতম শক্তি হলো পাঠককে সম্মোহন করা। গ্রামের সহজ সরল মানুষ, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে এক হাঁটু ধুলোরাঙা পায়ে হেঁটে চলেছেন মাজা বেঁকে যাওয়া এক বদ্যিবুড়ি। তার কাঁধের ঝুলিতে সালসার শিশি, কন্টিকারীর বড়ির কৌটা, আরও কত কিছু! আর সেই বুড়ির সঙ্গে হেঁটে চলেছেন আপনি। হ্যাঁ, আপনি। গাবগাছ, কামরাঙাগাছ, সবুজ ক্ষেতের পাশ দিয়ে গাঁয়ের শান্ত, নীরব পথে। হেঁটে চলেছেন দেশভাগের করুণ ইতিহাসের বোঝা মাথায় নিয়ে।
এই যে দেবদাসের সঙ্গে সেই বদ্যিবুড়ির পেছন পেছন আপনিও যাত্রা শুরু করে দিলেন অজান্তেই, এটাই হয়তো এই গ্রন্থের চূড়ান্ত উৎকর্ষতা।
জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।