বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

নদীর চেয়ে সুন্দর তার মোহনা; পাড়ের কাশফুল : আতিক ফারুক

0

বহুদিন আগের মতো আজ এই নরোম শরতের দিনে ফিরে আসি সেইসব স্মৃতির কাছে যেখানে আজ ছয় বছরের অধিক সময়ের পরও অজস্র কাশফুল ফুটে আছে। যেখানে শুরু হয়েছিল আমার ভাবনার দোলাচল। নদীর পানিতে শেষ বিকেলের আলো-ছায়া আর হিহি হাওয়ার তোড়ে উড়ে আসা গাঙচিলের অজস্র পালক।

সারাদিন কনস্ট্রাকশানের কাজ, পাইলিং মেশিনের শব্দ, হাতুড়ি পেটার ঘটঘট আওয়াজের ভেতর এতসব অস্থিরতা জড়িয়ে থাকে তা কোনোদিন জানা হতো না। যদিও এমনই কোনো কানাগলির ভেতর থেকে ধীরে ধীরে চিন্তার পরিধি ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে এসেছিল আমার। প্রতিদিন বিকেলে নদীপারে আটকে যাওয়া কচুরিপানার সাথে আমার কথা হয়—কত দূরের নদীপথ পেরিয়ে এলো ওরা, এই এখানে এভাবে আবদ্ধ হয়ে যাবে তারা কোনোদিন ভাবেনি। অথচ জীবনের তাৎপর্য তো এমনই—কোথায় কোন লগনে থেমে যাবে তা কেউ জানে না।

শরতের কাশফুল, যার অপর নাম সাচ্চারুম স্পনটানিউম, বহদূরের রোমানিয়া থেকে এসেছিল যে। শরতের গগনশিরীষের ছায়া আমার ভালো লাগে। মাদাগাস্কা থেকে যে গাছ এদেশে এসেছিল দেড়শ বছর আগে, যার অপর নাম। আলবিজিয়া রিচার্ডিয়ানা। পৃথিবীতে যা আছে সবকিছুই রূপান্তরিত!

শরতের কাশফুল, যার অপর নাম সাচ্চারুম স্পনটানিউম, বহদূরের রোমানিয়া থেকে এসেছিল যে। শরতের গগনশিরীষের ছায়া আমার ভালো লাগে। মাদাগাস্কা থেকে যে গাছ এদেশে এসেছিল দেড়শ বছর আগে, যার অপর নাম। আলবিজিয়া রিচার্ডিয়ানা। পৃথিবীতে যা আছে সবকিছুই রূপান্তরিত! সবকিছুই কি দ্বিতল রূপে অন্যকোথাও বাস করে! তাহলে আমার মতোই কেউ না কেউ পৃথিবীর অন্যকোনো দেশে বাস করে। হতে পারে এই কাশফুলের শুভ্রতার ভেতর আমি অন্যভাবে বেঁচে আছি। রোমানিয়া থেকেই যেন কাশফুলের সৌরভে ফুটে আছে আমার প্রাণ।

 

২.
নদীর চেয়ে সুন্দর তার মোহনা যেমন শৈশবের স্মৃতি বলতে নদীপারের সেইসব উপকথা যা শুনেছিলাম মুরুব্বিদের উঠোন-আড্ডায় যখন সন্ধ্যার পর শরতের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় আমাদের বাড়ির উঠোনজুড়ে অদ্ভুত এক আলোছায়ার বিভ্রম তৈরি হতো আর আমরা মায়ের পাশে চুপচাপ বসে থাকতাম যেন মায়ের কোলই আমাদের একমাত্র সম্বল বা মা ছাড়া কখনোই আমরা জানতাম না চাঁদের দেশের বটগাছে একজন বুড়ি বাস করে যার কোনো সন্তান নেই।

এই এতকাল পর আমার মনে হলো নদীপারের মানুষের সাথে আমার যে দীর্ঘ সময়ের সখ্য তা লিখে রাখা প্রয়োজন। আমার এভাবে চোখের সামনে নদী ভাঙনের স্মৃতি। বন্যার পানিতে রাহেলা খালার ভেসে যাওয়া লাল শাড়ির কথা, আমাদের গ্রামে পারাপারের একমাত্র নদীপথ।

 

৩.
কিভাবে যেন শরতের নরম আবহ একটু একটু শীত ডেকে আনে। ইংরেজিতে ‘অটাম’ হলেও আমেরিকায় বলা হয় ‘ফল’। মানে শরৎকাল। এইসব বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে কেবল সেই নদীতীরের কাছেই গিয়ে বসে পড়ি যার ওপাড়ে কাশফুলের শুভ্রতা, সূর্যের আলোয় লাল হলুদ রঙে একটা রংধনুর দৃশ্য ফুটে থাকে সারাটা শরৎ, ভাদ্র-আশ্বিনের সবক’টি বিকেল।

ছয় বছর যাবৎ নদীতীরের পাশে একটা চাকরির সুবাদে থাকা হচ্ছে। এইসব সন্ধ্যার পর কেমন যেন পুরো নদীর রূপ পাল্টে যায়। শান্ত স্রোত, বড়ো বড়ো জাহাজ, ডিঙ্গি নৌকো, কোনো কোনোদিন আমার মন খারাপ। ক’দিন হলো নদী দখল রুখতে সুদীর্ঘ চৌষট্টি কিলোমিটার ওয়াকওয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, গাবতলী থেকে বসিলা পর্যন্ত হয়ে কাজ আবার বন্ধ হয়ে গেল। তবু এটুকু ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে হেঁটে যেতে যেতে কী দারুণ ভালো লাগে! বিকেল হলে বহু মানুষ পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসে, শরৎকালে ওপাড়ের কাশফুলগুলো আপন মানুষের মতো কাছে ডাকে।

 

৪.
মাঝনদী থেকে আজ এক অলৌকিক শহর দেখতে পেলাম আমরা। সন্ধ্যার পরপর কবি পিয়াস মজিদের সাথে গ্রীণসিটির ঘাট থেকে মুলামুলি করে আধঘন্টার জন্য একশ বিশ টাকায় নৌকা ভাড়া করলাম। মাঝনদীতে গিয়ে দূর শহরের আলোর ছটা যখন নদীর পানিতে জ্বলজ্বল করছিল আর বৈঠা বাওয়ার শব্দ কানে বাজছিল—তখন মনে হয়েছিল তুমুল কোলাহলের মাঝেও এমন এক নৈঃশব্দ্য আছে যা অনুভূতিপ্রবণ মানুষের ভাবনার বিস্তৃতি ঘটায়। সিলিকন সিটির পাড় ঘেঁষে ঢাকা উদ্যানের দিকে যাচ্ছি আমরা—কাঁচা ঘাসের মায়াবি ঘ্রাণ শুঁকে পিয়াস ভাই দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে বলে, এই ঘ্রাণ বহুদিন পর খুঁজে পেলাম, মনে হয় হারিয়ে ফেলা স্মৃতির দিন ফিরে এলো। আর আমার মন পড়ে থাকে দূর শহরের আলোকিত দৃশ্যের ভেতর।

আমাদের আধঘন্টা নৈশভ্রমণ শেষে ‘কাবাব-ই আড্ডা’য় এসে খেলাম চিকেন চাপ আর লুচি। তারপর আমার ছোট্টো খানকায় নিয়ে গেলাম কবিকে। আমার খানকা, আমার নিবাস, বহু কবিদের আড্ডাস্থলে পরিণত হচ্ছে। এই-ই তো চেয়েছিলাম—চারপাশে অসংখ্য বই, অসংখ্য ইনডোরপ্লান্ট আর শোবার জন্য একটা খাট, আর একটা জানলা। যা চেয়েছিলাম সেই ছোটোবেলায়, মনে মনে এমন একটা রুমজুড়ে ঘুরে বেড়াতাম, তা এই তারুণ্যে এসে পূর্ণতা পেয়েছে। সেজন্যই বলি, কোনো স্বপ্নই অপূর্ণ থাকে না। শুধু অপেক্ষা এবং ধৈর্য্য ধরলেই তা পাওয়া যায়। যেমন আমি পেয়েছি অনেককিছু, হয়তো অনেক অনাগত সম্ভাবনার দিন।

হুটহাট করেই যা হবার হয়। পরিকল্পনা করে তেমন কিছুই হয় না। আজ হঠাৎ যেমন কবির আগমন, তেমনি আমিও যা ইচ্ছে হয়, তা করে ফেলি। অতশত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা রীতিনীতির সঙ্গে আপস করার সময় নেই। আপসহীন জীবনের কাছেই ছুটে যাচ্ছি আমরা। পিয়াস ভাই দারুণ এক সন্ধ্যা উপঢৌকন দিলেন আমাকে—আমি দিলাম কোঁচড়ভর্তি তামান্না আর অজস্র মুগ্ধতা।

 

৫.
যেকোনো পর্যটন কেন্দ্র মূলত গড়ে ওঠে নদী, সমুদ্র বা পাহাড়ের উপত্যকায়। তাই আমার এখানেও তরতরিয়ে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো কফিশপ, রেস্টুরেন্ট। সপ্তাহে তিন চারদিন ডি-জুসের ফালুদা না খেলে কেমন যেন হাপিত্যেশ লাগে। আশিক ভাই এবং দিশা আপুর হাসিমুখ, খাবারের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। সব মিলিয়ে যে কাউকে মুগ্ধ করবে ডি-জুসের আতিথেয়তা। আরও আছে রিভেরিয়া, যেখান থেকে নদীর ছোটো ছোটো ঢেউ চোখে পড়ে। আমার এই প্রতিদিনের গড়িমসি জীবনের স্থিরতা প্রয়োজন—আর ভালো লাগে না নিঃসঙ্গ যাপন।

বাড়ি যাওয়ার সারাটা পথ শরতের সুন্দর আবহ জড়িয়ে ধরে আমাকে। রোদের তীব্রতা নেই, ততোটা মেঘলাও নয়। সমস্ত ঋতুকে পেছনে ফেলে আমার কেবল শরৎ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

আমাদের গ্রামের পাশে নদীর যে মোহনা বয়ে গেছে, তার নাম বুড়িগঙ্গা। সেই কতকাল আগে আমরা জেনেছিলাম একাত্তরের যুদ্ধে এই নদীতে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, অসংখ্য মানুষের লাশ ভেসে যাচ্ছিল অজানা উদ্দেশ্যে। আবার একই কাশফুল তখনও ফুটেছিল, এই তেপান্তরে কোল ঘেঁষে কত স্মৃতির রাত ফুরিয়ে গেল।

নদীর উপর নীলাকাশ, শেষ রাত্রির পাঁজর খুলে আমাদের কাশবনে ডেকে ওঠে অচিন দেশের পাখি। কচুরিপানার ঝোঁপে বাসা বাঁধে জলচর ডাহুক। আমাদের গ্রামের পাশে নদীর যে মোহনা বয়ে গেছে, তার নাম বুড়িগঙ্গা। সেই কতকাল আগে আমরা জেনেছিলাম একাত্তরের যুদ্ধে এই নদীতে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, অসংখ্য মানুষের লাশ ভেসে যাচ্ছিল অজানা উদ্দেশ্যে। আবার একই কাশফুল তখনও ফুটেছিল, এই তেপান্তরে কোল ঘেঁষে কত স্মৃতির রাত ফুরিয়ে গেল।

 

৬.
নদী যেমন শান্ত স্নিগ্ধ—পাড়ের কাশবনে আরও ভিন্নতরো আবেদন প্রকাশ পায়, তেমনিভাবে কত মানুষকে টেনে নিয়ে গেল। বস্তবন্দি গলাপঁচা লাশ ভেসে ওঠে, সাঁতার না জানা মানুষকে টেনে নিয়ে যায় গভীর তলদেশে। সমস্ত বস্তুরই দুটো রূপের কথা বলেছিলাম সেজন্য।

ও নদী—তুমি কি সমুদ্রের সহোদরা না কাশফুলের প্রেমে পড়া নবীন জলাশয়!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গদ্যকার। ঢাকা সাভারে জন্ম বেড়ে ওঠা এবং পৈতৃক ভিটা। প্রকাশিত বই: ‘এখানে আরেকটু রোদ’ (গদ্য, ২০১৯) , ‘বুনোফুলের দিন’ (গদ্য, ২০২১) , ‘ধুলোপথে হাওয়া’ (গদ্য, ২০২১)। সম্পাদনা করছেন লিটলম্যাগ ‘বেয়ারিং’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।