লুইস নাস্তিক বিজ্ঞানী। নানারকম আবিষ্কার ও গবেষণার কারণে জগৎ বিখ্যাত। বক্তা হিসেবেও সুপরিচিত। লুইস একটি দেশে যাবে বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তব্য দিতে। এক সঙ্গে দুটি কাজ, বক্তব্য ও ভ্রমণ। লুইস ভ্রমণ করতে ভালোবাসে। ভালোবাসে বিভিন্ন দেশের সংষ্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে। নতুন দেশভ্রমণ নিয়ে লুইস বেশ কয়েকদিন দারুণ উত্তেজিত। উত্তেজনা শিরা-উপশিরায়। বেড়ে গেছে রক্তের সঞ্চালনা। কারণ, অনেকের কাছে শুনেছে উক্ত দেশের মানুষ বেশ অতিথি পরায়ণ। ভোজনপ্রিয়। রন্ধন শিল্পে এদের সুনাম পৃথিবীব্যাপি। রন্ধনটাকে তারা শৈল্পিক পর্যায়ে নিতে পেরেছে। যার বাস্তব উদাহরণ মিয়া এমি। শুধু কি তাই! এরা মায়ের ভাষা রক্ষা করতে জীবনও বিসর্জন দিয়েছে। এমন নজির গোটা পৃথিবীতে নেই। অন্যের অধীনতা মানতে চায় না বলে দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে। সংগ্রাম থেকে আসে স্বাধীনতা। স্বাধীন পতাকা আকাশে উড়ছে। তারা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। এমন স্বাধীন মানুষদের দেখার শখ ও স্বপ্ন কার না হয়?
ভ্রমণের নির্দিষ্ট দিনে বিমানে চড়লেন লুইস। দীর্ঘ জার্নিতে বিরক্তি এবং ক্লান্তির ছাপ থাকে, একঘেয়েমি কাটাতে মোবাইলের মেমোরিতে থাকা ভিডিও গান শোনে; দেখে। পিডিএফ বই পড়ে। এভাবে সময়টা দ্রুত কেটে যায়। নির্ধারিত সময়ে লুইসের বিমান সেই দেশের বিমানবন্দরে গিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু বিমান অবতরণ করতে পারছে না। মিনিট দশেক বিমান আকাশে উড়ছে। লুইস কারণ জানতে চায়। একজন জানায় ল্যান্ড করার পর্যাপ্ত সুযোগ মিলছে না। লুইস নিজেকে বুঝ দেয়, এটা আর এমন কী, পৃথিবীর আরও বড়ো বড়ো বিমান বন্দরেও এমনটা হয়ে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বিমানবন্দরের নাম তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর। বছরে প্রায় নয় কোটি মানুষের যাতায়াত সেখানে। দিনের হিসেবে পঁচিশ হাজার মানুষ ওঠানামা করছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই বিমানবন্দর উদ্বোধন করে দেশটির ৯৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে। সাত হাজার ৬০০ হেক্টর আয়তনের বিমানবন্দরই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো বিমানবন্দর। কখনও কখনও সেখানেও বিমান ল্যান্ড করতে গিয়ে পাঁচ দশ মিনিট দেরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বড়ো বিমানবন্দরগুলোতেও দেরি হয়। তবে, এসব ছাপিয়ে এই বিমানবন্দরের ভেতরর নান্দনিকতা চোখে এক ধরনের আনন্দ দেয়। বৈচিত্র্য রয়েছে, সেগুলো আবার রোলার কোস্টারের মতো বিনোদনে মুগ্ধ করে। যেমন ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্ট প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যস্ততা বেশি। এত ব্যস্ততায় নাভিশ্বাস ওঠার মতো অবস্থা। ভ্রমণপ্রিয় অলস ও আড্ডাবাজদের কাছে এই বন্দর ভালো লাগার কথা না। জুরিখ এয়ারপোর্ট সবচেয়ে সভ্যসুন্দর। মূল শহর থেকে বারো পনেরো কিলোমিটার দূরে। ফলে, ব্যস্ততা থাকে না বললেই চলে। হিথ্রো এয়ারপোর্টের আরেকটা নাম ইউরোপের বন্দর। ইউরোপের বাইরের মানুষরা স্বস্তিতে যাতায়াত করলেও অন্য মহাদেশীয়রা এখানে চরম অস্বস্তিতে ভোগে। ভালো লাগে চুবু সেন্ট্রায়ার নাগয়া। হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দও একটি বন্দর। আরবের সব সুন্দর এখানে স্পষ্ট বিদ্যমান। অবশ্য কারো কারো কাছে তেমনটি মনে নাও হতে পারে। হানেডা বিমানবন্দরে কেউ না গেলে বুঝবে না ওখানকার ভিন্ন রকম পরিবেশ। মুগ্ধ হওয়ার মতো অনেক কিছুই রয়েছে এর ভেতর ও বাইরে। যারা সুন্দরের সন্ধানে থাকে তাদের একবারের জন্যে হলেও সেখানে যাওয়া উচিত। লুইসের কাছে এই বিমানবন্দরটি খারাপ লাগেনি। খারাপ লাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অব্যবস্থাপনা। যা চোখে পড়ার মতো।
প্রায় ত্রিশ মিনিট পর বিমান অবতরণ করে। যাত্রীদের মধ্যে আনন্দের সুবাতাস বইতে থাকে। লুইস জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে টার্মিনালে হাঁটছে। হাঁটলেই টার্মিনাল অতিক্রম করা সম্ভব নয়। কারণ, সবখানে আরোপিত পদ্ধতি। ব্যাগ চেকিংয়ের নামে র্যাগিংটাই বেশি দেয় চেকাররা। এ সময়ে দামি জিনিসটাই ক্ষতির সম্ভবনা থাকে।
টানা জার্নিতে খুবই ক্লান্ত তখন লুইস। গাড়ি নিয়ে দ্রুত হোটেলে ফিরে ফ্রেশ ঘুম দিতে হবে। আজ কোনো কাজ নেই লুইসের। দিনের পুরো সময়টা বিশ্রাম নেবে। ঘুমকে অনেকেই কাজের অংশ ভাবতে নারাজ। মাথামোটাঅলারা ভাবে ঘুম অলস্যতার প্রতীক। অথচ ঘুমের উপকারিতা অনেক। বিজ্ঞান বার বার সেটা প্রমাণ করেছে। এই মুহূর্তে একটা গাড়ি দরকার। বিমানবন্দরে লুইসকে রিসিভ করতে কেউ আসবে না, গাড়িও পাঠাবে না। নির্দিষ্ট সময়ের আগে এলে যা হয়, লুইস ফর্মালের বাইরে গিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে। ভালোবাসে মানুষকে চমকে দিতে। লুইসের আসার কথা ছিল সকাল ৮টায়। বিমানবন্দর থেকে সোজা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। তখন তাদের লোক, গাড়ি, রিসিপশন সার্পোটও থাকত।
লুইস ভাবছে, একটি গাড়ি নিয়ে হোটেলে ফিরব। কিন্তু এখানে যাত্রীর চেয়ে গাড়ি বেশি। রানী মৌমাছিকে ঘিরে থাকে যেভাবে পুরুষ মৌমাছি তেমনিভাবে গাড়ি ঘিরে রেখেছে বিমানবন্দর। বিষয়টি অবাক করার মতো! দিশেহারা মানুষ কখনই সঠিক কাজটি করতে পারে না। অসঠিক কাজটি করে যে গাড়িতে উঠে বসে সেটিতেও এসি নেই। প্রচণ্ড গরম। এসি ছাড়া গাড়িতে বসে থাকা ভারি মুশকিল। দিল্লিতে ৪৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা। পরিবেশে ধূলি আর ধোঁয়া। এমন পরিবেশে মানুষের সুস্থ থাকাটা কঠিন।
সকালের সূর্য উঁকি দিয়েছে। রাস্তায় তখন অনেক গাড়ি। ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়াতে পারছে না। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি বের হতেই সিগন্যাল। ড্রাইভার ভাঙা ইংরেজিতে জানায়, কোনো এক ভিআইপি এয়ারপোর্টে আসছেন। রাষ্ট্রীয় সফরে দেশের বাইরে যাবেন হয়তো। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সময় কাউন্ট ডাউন হচ্ছে দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ করে করে একঘণ্টা। অথচ ভিআইপি আসে না। ট্রাফিক পুলিশ চাইলে সিগন্যাল ছেড়ে দিয়ে রাস্তা ফ্রি করতে পারত। কেন ছাড়ল না, তা ভাবছেন লুইস। ভাবনাটা এরকম হতে পারে, একটা দেশের ভিআইপি যাচ্ছে তা কিছু মানুষকে জানাতে হবে। ভিআইপি দুইপাশে আটক থাকা গাড়ি না দেখলে আবার রাগ করতে পারেন। যখন গাড়ি ছাড়ে তখন রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার লম্বা জ্যাম! এমন ভয়ংকর পরিস্থিতে আমার দীর্ঘশ্বাস কেবল বেড়েই চলছে, এই ভেবে যে, এখানে দ্বিতীয় অপশন নেই। নন এসি গাড়িতে ততক্ষণে লুইসের অবস্থা খারাপ। সব কিছু অসহ্য লাগছে। মাথায় বেজে চলছে স্কুলের ঘণ্টা। কোনো এক অখ্যাত পিয়ন দেদারসে পিটাচ্ছে। লুইস দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে আছে। ড্রাইভার তখন কুমার শানু’র ‘তু মেরি জিন্দেগি হে/ তু মেরি হার খুশি হে/ তুহি পেয়ার/ তুহি চাহাত/ তুহি আশিকি হে…’ গানটি অন করে। বিরক্তির খানিকটা আরও বেড়েছে লুইসের। এক পর্যায়ে স্টপ স্টপ বলে চেচিয়ে উঠল। ড্রাইভার এতটুকু বুঝতে পারল— গান বন্ধ করতে হবে। লুইস মাথা সিটের পেছনে ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইল। ড্রাইভার ভাবছে, জ্যামে গান শোনা তো আমাদের অভ্যাস। বিদেশিরা অনভ্যস্ত কেন! ড্রাইভার এ নিয়ে আর কিছু না ভেবে গাড়ি থেকে বের হয়। রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জিপার খুলে প্রস্রাব করে। লুইস তাকিয়ে দেখছে, আরও বেশি বিস্মিত হচ্ছে!
০২
তখন সকাল আটটা। বেড়ে চলছে রোদের প্রতাপ। আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে ফোন আসে লুইসের কাছে। লুইস জানায়, সে হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রামে যাবে। আয়োজক কমিটি কিছুটা অবাক হয়! এই সময়ে লুইসের এয়ারপোর্টে থাকার কথা! সরকারের প্রতিনিধি পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুইসকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করবে। হাসি মুখে একের পর এক ফুল গ্রহণ করবেন লুইস। ফটো-সাংবাদিকরা ক্লিক ক্লিক ক্লিক ছবি তুলবে। পর দিন পত্রিকায় চার কিংবা ছয় কলামে নিউজ বেরোবে। কেউ কেউ ছবিতে ক্যাপচার হতে ধাক্কাধাক্কি করে কোনোরকমভাবে মুখখানা সামনে ঠেলে দেবে। এইপর সেই ছবি জাতিকে দেখিয়ে গাল ফুলিয়ে শুয়োরের মতো হাসি দেবে। অখ্যাত লোকেরা বিখ্যাত লোকের পাশে ছবি তুলে নিজেকে বিখ্যাত ভেবে আনন্দ পায়।
ফ্রেশ হয়ে আশপাশের পরিবেশ নিজের মতো ঘুরে দেখতে চায় লুইস। দশটা বাজতে দুই ঘণ্টা বাকি। লুইসের বেশ ভালো লাগছে, কাউকে কষ্ট না দিয়ে হোটেলে এসে পৌঁছে। কারণ, নিজের কাজ নিজে করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে লুইস।
গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের দিকে হাঁটছে লুইস। পরিচয় জেনে হোটেলের পক্ষ থেকে সামান্য ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। হোটেল ম্যানেজার বুঝতে পারছেন না এই সময়ে বিজ্ঞানী এখানে কেন! আয়োজক কমিটির লোক কোথায়! বিমানবন্দর থেকে এখানে আসতেই ঘেমে একাকার লুইস। হোটেলবয় দ্রুত তাকে রুমে পৌঁছে দেয়। হোটেলে বিদ্যুৎ নেই। ফ্যান ঘুরছে না। এসিও চলছে না। লুইস অবাক হয়, ফাইভস্টার হোটেলে বিদ্যুৎ নেই! দরজা খুলে দেয়, বাতাস আসছে না। আসবে কি করে, বাতাসের প্রবাহ নেই। হোটেলের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করা হলে তারা জানায়— সাময়িক অসুবিধার জন্যে দুঃখিত। দ্রুতই বিদ্যুৎ চলে আসবে।
বিজ্ঞানী ভাবছেন সমস্যা হতেই পারে— এ আবার এমন কি! ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে তো সমস্যা নেই। হাত, মুখ ও পায়ে পানি ঢাললে কিছুটা ক্লান্তি কমবে। অবাক ব্যাপার, ওয়াশরুমে গিয়ে দেখে পানি নেই! পানি না থাকলে শাওয়ার নেবে কীভাবে! এবার রাগ হয় লুইসের। মানুষ যখন বেশি রাগে তখন মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায় না। লুইস কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রাগে পানির ট্যাপ বার বার ডানে বামে, বামে ডানে ঘোরায়। না, পানি আসে না। বালতিতেও পানি নেই। বাথরুমের লাইনেও পানি নেই। নিজেকে খুবই অসহায় ভাবছে লুইস। এতটা অসহায় নিজেকে আগে কখনোই ভাবেনি। মন খারাপ করে বেরিয়ে আসে। পায়চারি করে রুমের ভেতর। নজর যায় পাশের টেবিলে। একটা পানির বোতল রয়েছে সেখানে। বোতলের শেষ দিকে কিছু পানি আছে। এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। বোতলটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরল। বোতলের মুখ খুলে ঢক ঢক করে গিলতে লাগল। দুই ঢোক গিলতেই শেষ। লুইস ভাবে, এসি ছাড়া থাকা যাবে, ফ্যান ছাড়া থাকা যাবে। ওয়াশ রুমে না গিয়েও কিছু সময় কাটানো সম্ভব। কিন্তু পানি পান ছাড়া থাকা অসম্ভব! এই কোন দেশে এলাম! কোনো সৌজন্যতা নেই। মানুষের জীবনের প্রতি মানুষের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এসব অব্যবস্থাপনার লক্ষণ। হোটেলবয়কে ডাকে লুইস। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেয়। দ্রুত পানির ব্যবস্থা করো। মানুষের প্রতিদিনের রুটিনে সত্তুর ভাগ পানি দরকার। পানি ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। লুইস নতুন করে কিছুই ভাবতে চায় না। চুপচাপ বসে থাকে।
হোটেলবয় পানি নিয়ে আসে। ততক্ষণে প্রোগ্রামে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। নিজেকে আটকিয়ে রাখা সম্ভব হলেও সময়কে আটকানো অসম্ভব। অনুষ্ঠানে যেতে হবে। কথা বলতে হবে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর শরীর জুড়ে ক্লান্তি। উপস্থিত দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে তা লুকানো যাবে না। এক কাপ কফি খেয়ে গেলে কিছুটা ক্লান্তি কমবে। স্বতস্ফূর্তভাবে আলোচনা করা যাবে। ব্যাগে যখন কফি রয়েছে, বোতলে আছে পানি, সুযোগটা কাজে লাগানো যেতেই পারে। পানি গরম করার পাত্রও আছে। অন্তত আয়েশে এক কাপ কফি খেয়ে বের হওয়া যেতে পারে। কনফারেন্স এই হোটেলেই তাই অতিরিক্ত তাড়া নেই। মানুষ আগমনের আনাগোনা বাড়ছে। তড়িঘড়ি আগুন ধরাতে গিয়ে দেখল চুলা জ্বলছে না। গ্যাস নেই। লুইস এবার হতাশা লুকাতে পারল না। রাগে বিস্ময়কর একটা প্রশ্নের বিস্ফোরণ ঘটে তার মস্তিষ্কে। বিজ্ঞানীর চোখে রক্ত জমাট বাঁধে! এই দেশে মানুষ বাস করে কী করে!
০৩
কনফারেন্স রুমে দর্শকের উপস্থিতি বেড়েছে। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসেছেন। অনুষ্ঠানের রিপোর্ট করতে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকরাও এসেছেন। এরই মধ্যে কয়েকজন বক্তা বক্তব্যও রেখেছেন। উপস্থাপক ঘোষণা করছেন, এই মুহূর্তে আমাদের সামনে বিজ্ঞান নিয়ে বক্তব্য রাখবেন, জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও নোবেল লরিয়েট ডেবিড কপার্ট লুইস। লুইস উঠে দাঁড়ালেন। এক-পা দুই-পা করে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ডায়াসের সামনে দাঁড়ান। চুপচাপ এদিকে-সেদিক তাকান। চোখ রাখেন পুরো অডিটোরিয়োমের উপর। ডানে-বামে মাথা নেড়ে মুচকি হাসেন। সর্বডানে সাংবাদিকদের আসন। বামে দেশের বড়ো ও ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামনের আসনগুলোতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বসেছেন। পেছনের সারিতে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষরা সব সময় অসাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাশা করে। বিজ্ঞানী সাধারণ মানুষদের দিকে তাকান। জানতে চান, আপনারা কেমন আছেন? উপস্থিত সবাই চিৎকার করে জবাব দেয়, ভালো। বিজ্ঞানী আরেকবার অডিটোরিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনারা মিথ্যে বলছেন। আপনারা কেউ ভালো নেই। চোখ ও চেহারা সেই সাক্ষ্য স্পষ্ট। আমি নিজেকে দিয়ে বুঝেছি। আপনারা কেউ ভালো নেই। ভালোর সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই তারা ভালো থাকে কীভাবে! তখন অবুঝের মতো বলতে হয় ‘ভালো’। ‘ভালো’ কখনই সর্বোত্তম নয়। এবার বিজ্ঞানী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা কুক্ষিগত কিছু চতুর মানুষের সহযাত্রী। আপনাদের জ্ঞানের পরিধি বাউন্ডারিতে ঘেরা। যদিও জ্ঞান এমন জিনিস যা দেখা যায় না, শোনা যায় না, হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় না, গন্ধ নেয়া যায় না, জিভে স্বাদও নেওয়া সম্ভব নয়। জ্ঞান হৃদয়ের গভীরে লুকানো এক গোপন রহস্য। যখন নিজেকে নিজের থেকে আলাদা করা যায়— তখনই কেবল এর প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে।
একজন সাংবাদিক লুইসকে থামিয়ে বললেন, স্যার বিজ্ঞানের কণা নিয়ে আপনার আজকের আলোচ্য বিষয়। আমরা অধির আগ্রহে শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি। এখানে কয়েকজন রাজনীতিবিদ, জনগণের নির্বাচিত এমপি এমনকি মন্ত্রীও রয়েছেন। দেশ সেরা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগী আছেন। বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্টরা উপস্থিত আছেন আপনার মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্যে। নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের সেরা শিক্ষক ও ছাত্ররা এসেছে অভিজ্ঞতা নিতে। এখন সময় বারোটার অধিক। আপনি মূল বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করলে ভালো হয়।
ইশারায় সাংবাদিককে থামিয়ে দেয় লুইস। প্রত্যাশার চেয়ে নিজের কাজকে গুরুত্ব দেয়া অধিকতর শ্রেয়। আমি হলে, এখানে সময়ের চেয়ে একমিনিটও বেশি থাকতাম না। যে জাতি দুর্ভাগ্যের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না, সে জাতি সৌভাগ্য দেখে পুনরায় ভুল করে। এরা সময় থেকে শিক্ষা নেয় না। ভুল করার চেয়ে সতর্ক হওয়া, দুঃখ এবং অনুতাপের চেয়েও উত্তম। আমি বিজ্ঞান বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেব না। এখানে অন্ধকারের চেয়ে বিজ্ঞানের আলো কম। প্রাইমারি স্কুলে থিসিসের বক্তব্য দিলে রক্তবমি করবে ছাত্ররা। ভাববে পাগলামী। বিজ্ঞানের চেয়ে ভালো হয় আস্তিক ও নাস্তিক প্রসঙ্গে বললে। সেটিই বলব। প্রকৃতি ছাড়া কোনো দিন কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম না। মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। প্রাণীদের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। অথচ, একটা দেশের এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে হোটেল পর্যন্ত যখন এত সমস্যা। অন্যান্য সেক্টরে সেই সমস্যা সহজেই অনুমেয়। এখানে কোনো নেতার নেতৃত্ব নেই। সুশাসন নেই। আইন-আদালত নেই। জবাবদিহিতার বিন্দু-ব্যবস্থা নেই। তারপরও দেশ টিকে আছে। এটা ভারি বিস্ময়কর! ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া এ দেশ টিকতে পারে না। এদেশের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। বিজ্ঞান দিয়ে এমন বিস্ময় বোঝনোও সম্ভব নয়। প্রজ্ঞা দিয়ে অনুভব করে আজ আমি নাস্তিকতা বিসর্জন দিয়েছি।
আজ থেকে ঈশ্বর বিশ্বাসী আমি। এটাই আজকের আলোচ্য বিষয়। বিস্ময়ভরা অসংখ্য চোখ তাকিয়ে আছে লুইসের দিকে।
কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১১ নভেম্বর, ১৯৮৬; চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার বদপুর গ্রাম। হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়েটিভ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। ‘জীবনের ছুটি নেই’ পাণ্ডুলিপির জন্য পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০২০। প্রকাশিত বই : তাড়া খাওয়া মাছের জীবন [কবিতা; শুভ্র প্রকাশ, ২০১৫], বিরুদ্ধ প্রচ্ছদের পেখম [কবিতা; বিভাস প্রকাশন, ২০১৬], এসেছি মিথ্যা বলতে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭]। কিশোর উপন্যাস :বক্সার দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী [ অন্বেষা প্রকাশ, ২০১৯]।