নিত্যযাত্রী
নিত্যযাত্রী আমি। বড়ো বড়ো দুঃখগুলি খুচরো করে নিই।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া বলতে তো প্রবাদ নয়, আক্ষরিক বর্ষাকাল বুঝি।
হাঁটার কষ্টকে কিছু, ভ্যানরিকশাকে কিছু, ভারতীয় রেলকে কিছু দিয়ে
দেখি তবু অনেকটাই হাতে থেকে যায়। মন ভারী করে। তাই
ফিরতিপথে রোজ আমি ভীষণ ওস্তাদ। নিজেকে দেখাই খেলা।
অবশিষ্ট দুঃখদের মঞ্চে ডেকে অপদস্থ করি।
বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে খুব নিজেকে বোঝাই
বড়ো হতে গেলে কিছু ছোটোখাটো রক্তক্ষয় মেনে নিতে হয়
কথা ফুরিয়ে গেলে
কথা ফুরিয়ে গেলে আর আমি কোনো কাজেই আসি না
যদিও বা রোদ এসে মনোভূমি নাড়িয়ে দিয়েছে
তবুও সতর্কতা ভালো। তাই চইচই করে আমি
অবশিষ্ট কথা সামলে রাখি।
যেখানে যেটুকু মুক্তো, সমুদ্রখাতে কিংবা আত্মকথায়
হামলে পড়ে তুলে নিই। লোকে একটু উল্টোপাল্টা ভাবে
আমি তো জানি না আর ফুরিয়ে যাওয়ার স্বাদ উপাদেয় কি না
শুধু জানি, কোনো কথা না থাকলে কেউ আর খেলতে নেবে না
এইসব পঙ্ক্তিগুলি
সন্ধে নামছে, অথচ মনের আঁচ নিভে আসছে ধীরে
সন্ধে হচ্ছে, অথচ আমাকে কিছু হয়ে উঠতে হবে না যে,
…………………………………….. এ আশ্চর্য নয়?
অতিকথনের ভার পাহাড় হয়েছে আর সন্ধে একটা পাখি,
সরাসরি জীবনের ডালে এসে বসতে পারছে না
তুমিও একটা টিলা আর সচেতনতার ঢালু তোমার গড়ন
হলো না তোমার সঙ্গে বনিবনা আমার কখনো
শুধু কথা কাটাকাটি করে আকাশে রক্ত লেগে গেল
যা বলেছি, বলেছি মিথ্যে, শুধু জাল কেটে বেরোবার আগে
ছটফটে মৌরলার মতো এই পঙ্ক্তিগুলি লিখে রাখতে হবে।
প্রিয় গানের ভেতর দিয়ে
প্রিয় গানের ভেতর দিয়ে আমাদের হৃদয় বদল হয়। স্থায়ী ও অন্তরা’র মধ্যে ঢুকে পড়ে বিবাহপ্রস্তাব। সুর কুণ্ডলীর মধ্যে চিরকাল আমাদের শঙ্খ লেগে থাকে। ধরতাই এর ছায়ায় আমরা রাগী রাগী শৃঙ্গ পার হই। তারপর সম্-এ নেমে পেয়ে যাই শান্তি উপত্যকা। উপত্যকা মানে এক বুগিয়াল, সাতরকম সবুজ। গানেরই ভেতরে এই সংসার পাতা বলে, বুগিয়ালে ছোটো ছোটো ফুল, যেন বা মীড়ের কাজ, শোনো। ঠিক পাখি ভুল পাখি, দ্রুত বা বিলম্বিতে শোনো।
গানের ভেতরে পাতা সংসার, শোনো।
পাঠাবার মতো ডাক
পাঠাবার মতো ডাক পাঠিও আমাকে
যে ডাকে জীবন এসে চিঠি দিয়ে যায়
উঁহু, কোনো কুহু নয়, একটিই কর্কশ কেকা যথেষ্ট হবে
যেন আশরীর চমকে উঠে পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যায়
এই যে সাজিয়ে রাখছি এক ঘরময় আশ্রয়হীনতা
করপুট গলে একটু কী মন বাইরে আসছে দেখে ভাবি সূর্যালোক হলো
প্রকৃত গাছের কিন্তু অন্ধকার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই
এই যে সাজিয়ে রাখছি নিজেকে শো-পিস্ সারা যাতায়াতময়
অথচ রাস্তার কোনো ছুটি নেই ঘরে ফেরা নেই
তোমাকে অন্তিম ভাবি, ইচ্ছেতে রাখো
যেন অন্যভূমি থেকে ফিরে আসে আমার শরিক
আচমকা ময়ূর দেখে ক্যালেন্ডার উলটে পালটে যায়
তেমন ডাকের চিঠি শুনিও শুনিও
আলো দেখার নেশা
১.
ভাবছি টানেল। শেষে নিশ্চয়ই উদ্ভাসিত আলো
আলো মানে আশা। ভেবে নার্ভ যেই আলগা করেছি
অন্ধ ড্রাইভার কালো চশমা খুলে আমাকে দেখাল
২.
তোমাকে দেখাতে চাই হৃদ্পদ্ম কীরকম রক্তে আজ ভেজা
এ কথাটি লিখে ভাবি, এ কেমন কথা !
আমি তো ভেবেছি শুধু হাতের আড়াল করে আলো নিয়ে যাব
৩.
কংসাবতীর তীরে একা একটা ফড়িং নাচছে
তাকে রবীন্দ্রনাথের গানে মার্জনা করো
থাকতে পারোনি, এই দুঃখ ওই দৃশ্যের নির্জনতা মুছিয়ে দিয়েছে
৪.
আমার সমস্ত মন টিলায় দাঁড়ানো এক লোকের সন্তাপ
কখনো সমস্ত নয়, প্রত্যাহারময় আর স্তোকবাক্যে ঘেরা
আমার সমস্ত মন দিগ্বিদিকে পাখিপ্রস্তুতি
৫.
যেন বা অনেকদিন অব্যবহারমাখা চটিজুতো আমি
সদর দরজার সামনে পড়ে থেকে ধুলো আর পাপ জড়ো করি
কখনো বাইরে থাকা ভেতরে যাওয়ার চেয়ে দামী
৬.
চেষ্টা করেছি, তবু একটি ফুলের মতো ফুটে উঠতে পারিনি কখনো
আহত জিপের মতো অনেক খাদের নিচে আমার সে চেষ্টা পড়ে থাকে
আমি ছেড়ে গেছি। তবু, দুটো একটা বনফুল সঙ্গ দেয় তাকে
৭.
আমিও বলিনি আর তুমিও শোনোনি, এই হলো প্রকৃত শূন্যতা
জেন গল্পে এরকম আছে, যেন সহস্র ঘুলঘুলিওলা ঘর
হাওয়া আসে হাওয়া যায়। তুমি আর আমি সেই যুগ যুগ হাওয়া
৮.
গড়িয়ে গিয়েছি অভিপ্রায়ের মতো
যে টিলার দিকে তার শীর্ষে সেই আমিই দাঁড়িয়ে
আছি বহু আগে থেকে। পৌঁছলে জানাব স্বাগত
সন্দেহপ্রসূত
সন্দেহ সন্দেহ শুধু সন্দেহ করে তুমি মেরে ফেলো ওকে
হাড়ের ভেতর পৌঁছে দাও ইয়ার্কিসকল
সঘন বর্ষা হানো। কালো মেঘে আত্মা ছেয়ে যাক
দেখাও যে তুমি আমি আমরা তাহারা সব
…………………….. সন্দেহসূত্র দিয়ে বোনা
হাসিগুলি কথাবার্তাগুলি
কেটে কেটে ভিন্ন ভিন্ন কুঠুরিতে রাখা
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শুধু চাপা ফিসফাস
ফেটে গিয়ে কার্পাস ওড়ে
সুতরাং রোগভোগ, সন্দেহপ্রসূত
হ্যাঁ, ভাই, আপনিও এই সন্দেহপ্রসূত
সকালবেলা
অনেক প্রকার দেখি। ভালো থাকা সোজা মনে হয়
মনের মতোই দেখি। পেখম হয় চোখে
মৃদুমন্দ রান্নায় ভরে উঠছে ঘ্রাণকোরক
শিশিরে ভরে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা
উঠোনসেলাই দেখি। টিপসই দেখি
কারো ভাঙা ঘরে আজ বন্ধকীদ্রব্য ফিরে এলো
কেউ কান্নায় ভালো হয়ে আছে
কেউ কাউকে না বলছে না
আমি একটু ছোটো হয়ে বসি
আমি একটু বাবা হয়ে যাই
গ্রামজীবনের পর
গ্রামজীবনের পর অনন্তকাল ধরে বৃষ্টি পড়ছে
আমার চরিত্রটিতে ঘটে যাচ্ছি আমি
রমণীয় মঞ্চটির স্থানে স্থানে শ্যাওলা, ফার্ন, গুল্ম, লাউলতা
যেন বিস্ময় পেঁচিয়ে ধরছে বালককে
ফুটে উঠেছে বইপত্র, ধীরে; আকর্ষণে ক্লাসরুম, কৌলিন্যপ্রথা
…………. টবের দোপাটি ফুল, যৌনরোম, চায়ের লিকার
স্বল্প ভোরের পর শব্দের আমিষ উঠছে
উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক গ্রস্ততার স্থায়ী ক্ষার, রক্তজালিকায়
পা থেকে খুলে আসছে ক্রিয়াপদ, এমন সময়
অনন্ত বৃষ্টির মধ্যে আমি দেখি
লাল কার্পেট ভেজে; একটি জগৎজোড়া শেক্সপিয়র যায়
অ্যালবাম
স্মৃতিরও অপার এই ছবি ও কাহিনি
জেগে ওঠো ঘুমবিন্দু। যে সাঁতার কাটছে তার
সামনে রাখো অসামান্য টর্চ
নড়ে ওঠো রোমাঞ্চিত ফ্রেম। দু’বালতি জল তোলো
মাথা ঠান্ডা হোক
যে ধ্বস্ত কারবালা জ্বলবে জ্বলবে ভাবছে তাকে
কাদা ও কুয়াশা হেনে নির্বাসিত করো
সব মাটি মাটি হলো। স্মৃতিকে খ্যাপাও
১৯৮৩ সালে জন্ম। ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত কবিতার বই ছয়িটি। ‘যতদূর বৈধ বলি’ (২০০৯), ‘কোনো একটা নাম’ (২০১৩), ‘পতনমনের কুর্সি’ (২০১৬), ‘সন্দেহপ্রসূত কবিতাগুচ্ছ’ (২০১৭), ‘আলো দেখার নেশা’ (২০১৯) এবং ‘রাস্তার কোনো ছুটি নেই’ (২০২০)।