বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

নির্বাচিত দশ কবিতা : টোকন ঠাকুর

0

পোকা ও প্রজাপতির গল্প


এখনো কবিতা পড়ো মানে তুমি মনে মনে ভাবো
আচমকা এক ফুরফুরে বিকেলে প্রজাপতি সম্মেলন হবে।
সেই সম্মেলনে তুমি স্বাগতিক, তোমার ব্যস্ততা থাকবে।
তুমি ফুলদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে
ঘাসের বক্তব্য শুনতে শুনতে, হয়তো বা ভুলে যাবে—
একজন কবি এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছে,
পোকা থেকে তুমি প্রজাপতি হয়ে কতটা বদলে গেলে?
এখনও কবিতা লেখা হয় মানে সেই লোকটিই কবি—
যে কীনা পোকা হতে পারেনি বলে প্রজাপতি হতে পারছে না


বুদবুদ পর্যায়ের কবিতা


কথা হয়, মীমাংসা হয় না
…….মনে এত ছিটমহল
নিয়তই, মীমাংসার ভান করে, সান্ত্বনাসূচক
বারান্দায় ছুটে আসে সাঁওতালি রাতের মাদল;
ছাদে উঠে গুনে গুনে দেখি
কাছে ও দূরের প্রেক্ষিত, সম্পর্ক, আলো
অন্ধকারে আলো গুনে যাওয়াই ভালো জমকালো
নিজেকে মুঠোয় নিয়ে খেলাটাই খেলা!
খেলা হয়, জয়-পরাজয় মীমাংসা হয় না
…….মনে এত প্রতর্ক প্রহরা
চারিদিকে শুধু শব্দে শব্দে ভরা
কী তুরীয় খরা!
দ্যাখো একটি প্রাণপণ বাক্য হয় না
ফলে, যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে, হচ্ছে না এমন কী তা?

মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কালিদাসের মেঘ
………………………….. রবীন্দ্রনাথের পাখি
কিন্তু ধরাই যাচ্ছে না, কোন ফাঁকে, আড়ালে-আবডালে উড়ে যাচ্ছে
(রোদ-উৎসবে পুড়ে যাচ্ছে দালিচিত্রে গলে যাচ্ছে)
আমার ডানাময় দিন, অমীমাংসিত স্বপ্ন
এমনকি বুদ্বুদ পর্যায়েই, কবিতা


চরম পরিস্থিতি


ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের জন্য আমি কী করতে পারি?

যদি ঘনজঙ্গলে যাই
বাঘিনীর খপ্পরে পড়ি (হায়)
বাঘিনী যদি আমাকে থাবায়, খায়
তখন, দুধ হয়েপৌঁছুতে পারি
মা-বাঘিনীর স্তনের বোঁটায়

বন পর্যটকই একদিন মনোযোগ দেবে
পড়ে থাকা কঙ্কালে, আমার হাড়ে

ওই যে বাঘিনী আসছে
এইবার, যেকোনো মুহূর্তেই, ক্ষুধার্ত বাচ্চারা
জঙ্গলে কবিতা লিখতে আসা আমাকে
খেয়ে ফেলতে পারে


ভূগোল মাস্টার


এই আকাশ আমার পিতা
মাটি আমার মা
আমি তাদের সন্তান, ঐ দিগন্ত

কিন্তু ভূগোলমাস্টার বলছেন—
দিগন্ত একটি ধারণামাত্র


পাতাবাহার


কবিতা লেখামাত্রই আমি সেই কবিতার মা
কয়েকদিন পর, নতুন আরেকটি কবিতা লেখামাত্রই
আমি সেই আগের কবিতার খালা

তারপর আরো কবিতা লেখা হলে অনেক আগের কবিতাকে
……………………………..দূরের আত্মীয় মনে হয়
কবিতা যখন ছাপা হয়, অন্যেরা পাঠ করে
তখন তো সেই আগের কবিতা অনেকটা অচেনা হয়ে পড়ে

আমার পুরোনো কবিতাগুলো পড়তে গেলে মনে হয়
এরা সেই বাল্যবন্ধু, যাদের নামই প্রায় ভুলে গেছি
দেখলেও চিনতে কষ্ট হবে (কাউকে কাউকে তো চিনবই না)

তার মধ্যেও ঠিকই চিনে ফেলব, আমার কোন কবিতাটি খুব জেদি ছিল
কোন কবিতাটি সেই মেয়ে, ক্লাস নাইনে উঠেই যে-বিষ খেয়েছিল প্রেমে
……………………………যে-কখনো দশম শ্রেণিতে উঠবে না আর

হয়তো সেই কামরাঙা কবিতাটির নাম ছিল পাতাবাহার


বাক্যবিস্তার


বাক্য বহো বাক্য বহো বাক্য বহো ধীরে
বাক্য ব্যাকুল জলাঙ্গিনী, আছড়ে পড়ে তীরে।
ফলে, একদিন শুনতেই হল—
…….‘বাক্য বলতে কি বোঝ?’
আমি সাফ জানিয়েছি, বাক্য বলতে খুঁজে পাওয়া
………..এবং নিখোঁজও

বাক্য চাহ বাক্য চাহ বাক্য চাহ পানে
বাক্য মাতাল মধুবন্তী বনজোছনার গানে;
এতে একদিন বুঝতে পারলাম—
কোনও কোনও বাক্য বুদবুদ হয়ে জন্মায়
……. ফেটে যায় এবং মরে যায়
এবং বুদবুদে নিহিত নিগূঢ় বাক্যরাগ
………..বাতাসে মিলিয়ে যায়

বাক্য রহো বাক্য রহো বাক্য রহো ব্রতী
বাক্য লীলার বজ্রাঙ্গনা, বাক্য সরলমতি,
তবু একদিন দেখতেই হল—
বাক্য ক্রমশ জটিল হচ্ছে, জড়িয়ে যাচ্ছে আর
হাসি হাসি মুখগুলি নিভে আসছে…
……..পান করছে এমএ পাশ আঁধার


আত্মচরিত


নিষ্প্রয়োজনে
……….আমি
…………….ছোট নাম লেখাতে গেছি
…………………………..কবির খাতায়
নিজ প্রয়োজনে
………..আমি
………………নক্ষত্রের দেনা
…………………………..নিয়েছি মাথায়
বিষ-প্রয়োজনে
………….আমি
………………সাপ ও বেদেনি
…………………………..চেয়েছি দুটোই

দুহাতে দুধের ছানা, বেপরোয়া মুঠোয় মুঠোয়
সম্পূর্ণ ফুটেও নারী ক্ল্যাসিক্যালি অস্ফুট—

সুতরাং, আজ আমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো—
আমি কি কবি ছিলাম? সাপুড়ে ছিলাম? নাকি ছিলাম যা, তাই?

শিস্-প্রয়োজনে
………….আমি
………………হাওয়া-ধাক্কা দিচ্ছি
…………………………. বসন্ত-জঙ্গলে গাছদেবতার
…………………………. ………………শুকনো পাতায়

কে আমি? বিখ্যাত কেউ? কী ছিলাম? গুরু কেউ? লঘু ঢেউ?
…………….ঝরনার বাথরুমে শাওয়ার ছিলাম?
…………….সুহাসিনীর ড্রেসিং টেবিলে আয়না ছিলাম?
গুপ্তকথা হচ্ছে, আদতে সেই রাক্ষসদের ছেলে,
…………………………. ……… মানুষের ছদ্মবেশে থাকি
যোগ্যতা, নিজের মুখে জোছনারাত অনুবাদ করতে পারি,
…………………….এর বাইরে
………………………….আমি যা ছিলাম, তাই
……………………………………….ছিলাম যা, তাই


জঙ্গলের মধ্যে জাদুঘর


জঙ্গল দেখলেই মনে হয়, ঐ জঙ্গলের একদম ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। অসংখ্য গাছে গাছে ভরা অবিরাম পাতায় পাতায় হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রা আর অগণন পাখিতে পাখিতে নরম পালকে পালকে ডিসপ্লে করা গ্রিনমিউজিয়াম। এই পৃথিবীতে যতগুলো জঙ্গল আছে, প্রায় প্রত্যেকটা জঙ্গলের মধ্যেই একটা করে জাদুঘর আছে

জাদুঘরে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মরচেধরা অনেকদিন আগের একটা বাইসাইকেল। সেই সাইকেলটা কার গো, কার? যথা অপরিণামদর্শী কৌতূহলে, জঙ্গলে প্রবেশ করিয়া যে বালক আর কোনওদিনও ফিরে আসিল না, তার? জংলিপনায় স্নাতকোত্তর আমি, জঙ্গল দেখলেই বুঝতে পারি_ এই জঙ্গলের ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। বাইসাইকেল আছে। বালক-পুরুষ ফিরতে না-পারার জনশ্রুতি আছে।

জনশ্রুতির অধিক রহস্য, সেটাই ধরিত্রী, সেটাই অবলীলা চৌধুরীর লাবণ্য; লাবণ্যের ভেতরে মিশিমিশি আফ্রিকা, ঘনান্ধকার আমাজান_ সাহস করে একবার ঢুকে পড়লেই জাদুঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবার প্রেরণা পাওয়া যাবে। ক্লান্ত সাইকেল গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে এবং সম্ভবত আমার আর কোনওদিনও ফিরে আসা হবে না… হবে না

এ অঞ্চলে এটাই সত্য, জঙ্গলে হারানো পুরুষ শেষপর্যন্ত কিংবদন্তি হয়ে যায়


ভাষা সমস্যা


ভাষার সমস্যা আছে। সব কথা সে প্রকাশে সমর্থ নয়। যতই পণ্ডিতি করি, সান্ধ্যসুর ধরি, ঠিক যেন হলো না—আমার কী বলার ছিল? ‘কী’ বলার মধ্যে আমি কী ভাব বোঝাতে চেয়েও, শেষ পর্যন্ত বাক্য যেন বাগে এল না, বরং বিরাট বিট্রে করে বসল। কুয়োর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া চৈত্র মাসের মহাজোছনা যেন আমি আর তুলে আনতে পারলাম না। এদিকে পরিস্থিতি প্রতিদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে ঝুপঝাপ আঁতাত শুরু করে দিল। কারণ, এই কালপর্বের নাম যুদ্ধক্ষেত্র। আমাকে ক্রলিং করে মাটিতে বুক বাঁধিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভ্রম হচ্ছে, তবে কি আমার বুকপকেটে সে রকম কোনো চিঠি আছে—যার প্রেরক কোনও শহরবাসিনী, প্রহেলিকা চৌধুরী?

কিন্তু ওই যে বললাম, ভাষার সমস্যা! ভাষায় আমি জোছনা দেখাতে পারছি না, সূর্যাস্ত দেখাতে পারছি না, যুদ্ধ দেখাতে পারছি না, রক্ত কতটা লাল দেখাতে পারছি না, বাতাসের বেআদব আচরণ দেখাতে পারছি না! এমনকি আমার মন এখন কতখানি অবাধ্য যে সে আমার ঘরেই থাকে না, প্রতিদিন একই রাস্তায় একই দিকে যায়—মনোগমনের এ বর্ণনা লিখে বোঝানো অসম্ভব! অ্যাবসার্ড!! কারণ, ভাষা শিল্পকে যতটা সমর্থন করে বা শিল্পীকেও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে পারে কিন্তু শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে যেটুকু প্রচ্ছন্ন দূরত্ব, যতটা লৌহবেদনা—ভাষা তা কখনোই স্পর্শ করতে পারে না।

কতটা নির্মম, দুর্ভাগ্যপীড়িত, যদি বলো, এই ভাষাতেই আমাকে লিখে জানাতে হবে সেই প্রচ্ছন্ন দূরত্বের গল্প, লৌহবেদনার ইতিকথা? মন-আনমনা, বাক্য যেন ভাব বুঝল না, বাক্য বিরাট বিট্রে করে বসল। অথচ, কুয়োর মধ্যে চৈত্র মাসের মহাজোছনা গড়াগড়ি যায়…


বসন্তদিন


রহস্যপুর গল্পটা পড়া শেষ হয়নি

আমি সিরিয়াস পাঠক। পড়তে পড়তে পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা এগিয়ে যাই, তাকিয়ে দেখি গল্পের মধ্যে সোনার ঢেঁকি— পাড়ের শব্দও শুনি। ঠিক তক্ষুণি, পর্দাজুড়ে দৃশ্যমান, হাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে দইঅলা বলে একটা চরিত্র, আমি তার পিছু পিছু এগিয়ে যাই কয়েক পৃষ্ঠা, হঠাৎ সামনে পড়ে পোড়ো রাজবাড়ি, রাজবাড়িটা ভাঙা ভাঙা এবং ভৌতিক! ভীতিলুব্ধ সিঁড়িতে একটা প্রজাপতি, আমি প্রজাপতিকে লক্ষ করে উপরে উঠতে থাকি। প্রত্নকোঠার ছাদের কিনারে গিয়ে বলি, ‘প্রজাপতি, তোমার আত্মজীবনী আমি মুখস্থ করতে চাই’, শুনেই ডানাঅলা এই প্রায়পাখিটি উড়ে যায়। এবার আমিও উড়তে থাকি প্রায়পাখিটির সঙ্গে, পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা, বাক্যের পর বাক্য, শব্দের পর শব্দ, প্রয়োজনীয় নৈঃশব্দ; প্রজাপতি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তুমি কি কোনো বংশীবাদক, সুরের ফাঁদে ষড়যন্ত্র করছ? ট্র্যাপ করে পাহাড়ের দিকে টানছ?

রহস্যপুর গল্পের তেইশতম পৃষ্ঠায় সেই হাইডআউট লোকেশন, পাঠক যেখানে অসহায়, দুরু দুরু-সন্ত্রস্ত কিন্তু এগিয়ে যেতে উৎসাহী। প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে মুখোমুখি এক মায়াবী অধ্যায় : আলো হয়ে প্রকাশিত নারী। নারীর সর্বাঙ্গে সদম্ভ আগুন, অহোরাত্র নারীকে পড়তে গিয়েই আগুনে পুড়তে হয় এই নিয়তি নির্ধারিত বলে, মন পুড়ে যায়। পোড়া মন চিকিৎসাধীন, নার্সও দেখতে প্রায়নারী, বেতন-ভাতায়।

আমি রহস্যপুর হাসপাতালে শুয়ে আছি, গল্পের মাঝামাঝি কোনো পৃষ্ঠায়। খুবই জানি, সুস্থ হলেই আবারও সেই ষড়যন্ত্র, প্রজাপতির। হয়তো আমারও খুব ইচ্ছে করবে, তার ডানার খোপের অন্ধকারে রঙ মেখে ঘুমিয়ে থাকি, জাগি। বোঝাই তো যাচ্ছে, এরপর গল্পে একটা খুন এসে যাবে। টিকটিকিরাও জানাচ্ছে, চিরকালই খুনের প্রেরণা নারী। সিরিয়াস পাঠক আমি, হিটলিস্টে আছি, সুতরাং খুন হয়ে যাব— এই ভয়ে অসুস্থ থাকি। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে (জন্মদোষে) নার্স ও নারীর আন্তঃপার্থক্যটুকু ধরার চেষ্টা করছি, পড়ার চেষ্টা করছি আমার পোড়ামন চিকিৎসাধীন।

এদিকে বসন্তদিন

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।