নিষাদগৃহ
পুরুষ নিষাদ এক তুমি তার উজ্জ্বল শিকার
তোমার পৃথিবী দেখ চারদিকে ঘিরেছে শিকারী
চিত্রল হরিণী তুমি খোঁজ একা জলের বিহার
শ্যামল ঘাসের ফাঁদে রাত্রি তার ঢালে চন্দ্রতাড়ি
মাতাল ঋত্বিক করে হোমাগ্নিতে যজ্ঞ আয়োজন
তোমার পূজোর ছলে সব তার সাজানো তূণীর
জলের গভীর ঢেউ, খুঁজে দেখ মরীচিকা মন
আদর কোথায়? শুধু বিষে ভরা মিথ্যে বাহুনীড়
শিকারে পড়েছ ধরা, মায়াজালে পেলে কারাগার
মানুষ হলে না তুমি রাতভর রতির উদ্যান
পুত্রবতী কন্যা হয়ে জন্ম দিলে উত্তরাধিকার
তুমি শুধু সেবাদাসী তৃষ্ণাযামে গভীর ওলান
সোনার তোরঙ্গ তুমি মেলে দিলে যা কিছু তোমার
পেলে তুমি অন্নজল খুঁদকুড়ো হৃদয়-প্রহার!
জেলেনী
শহুরে জেলেনী আজ আষাঢ়স্য সপ্তম দিবসে
অধীর হয়েছে, ছড়াতেছে তার কোমল গভীর জাল
কামিজ উঠেছে ভিজে, বুনোজলের ঘায়ে কম্পিত কটেজে
ভিজে যাচ্ছে তার আহা কি মধুর নিঃশব্দ জলমহাল
কুম্ভকার কোনোদিন জানে নাই মাটির কলস
জল ধরে রেখে জ্বলে কিভাবে বর্ষায়, কিভাবে মৎস্যকন্যা
জলের জংশন খোঁজে জলাবদ্ধ পুরুষ শহরে
মেঘের গম্ভীর খামে চিঠি এল উপুর্যপুরি বন্যার
বর্ষব্যাপী বিরহের তন্তুতে বুনে রাখা সর্বগ্রাসী জাল
ভালোটি বাসবে বলে প্রস্তুত, অনিদ্রিত সমস্ত ট্রলার
উন্মাদ মেঘ ও মল্লার, তৈরি আছে দাঁত ও চোয়াল
চুম্বনের জন্য আর আঁশবটি দেখাবে স্বরূপ তাহার
জেলেনি জ্বালেনি দীপ, নির্জন মন্দিরে রাত্রি আষাঢ়স্য
শহুরে জেলেনী খুঁজিতেছে ঝড়-জলে তার পুরুষ-মৎস্য!
জন্তু
তোমার জন্তুকে বলো, আচমকা এভাবে সে যেন দাঁত না বসায়
ওটা কতদিন পর এভাবে ছিঁড়ল প্রেইরীর ঘাস?
বিদ্যুতের লতাজালভর্তি অবগুণ্ঠিত ঝরোকা,
তাদের সময় দিতে বলো উন্মীলনের, ক্ষতচিহ্ন পেতে
এইতো সাজানো ফল উন্মোচিত, একা
সে কি নিতে পারবে সৌরচুল্লীতে জন্মানো ধাতুমঞ্জরী,
শূন্যে তোলা দু’পা, প্রাচীন মহেঞ্জোদারো অথবা হরপ্পা
খুঁড়ে বের করে আনো চাঁদ, ধারালো চোয়ালে
তোমার জন্তু কি যেতে পারে অতটা পাতালে,
যখানে তৃষ্ণার্ত চিতা উন্মুক্ত করেছে বুক?
তোমার জন্তুকে বলো খুবলে রক্তাক্ত করবার আগে
আরো একটু ধ্যানী হতে,
এমন গতি ও তাড়নায় ভয় পায় আধবোজা ছোট সে ঝিনুক!
শিকারী আঙুলগুচ্ছ
পুরুষ কখনো নয় উপশম, বেদনানাশক
প্রেমের চুল্লীতে পুড়ে, ভিজে আছ বিষে
আঙুলের ধূর্ত মুদ্রা ক্ষতমুখে ঢেলেছে আরক
মিথ্যা নদীগুলি অর্ঘ্যরে মোহর নিয়ে আসে
নির্বোধ বাগান, তাকে দ্রুত ঘিরেছে মারীচ
সোনার কুঠার তুমি রক্তজমা গর্ভে নিয়েছিলে
লুব্ধক হৃদয় নিয়ে বসে আছ ভ্রূণ পাহারায়
সুন্দরের ধ্বংসস্তুপে, প্রেমের কঙ্কাল গিলে
তোমার কুসুম প্রেরণাহীন মুকুল থেকে ঝরে গেছে
আত্মাহুতির আভায়, মৃত্যুতৃষ্ণার জঠরে
তুমি একমুখি হেঁটে গেছ প্রেমে একনিষ্ঠ থেকে
অন্ধ ডানাদের আকাশ ছিল না হাহাকার চূর্ণ ঘরে
তোমার অহল্যা নাভিকুণ্ডে চিতা, স্পর্শকাতরতা
কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে আর ততদিনে জেনে গেছ
মুছে দিতে কান্নাদাগ, ধাত্রীহীন ক্ষত, সে চণ্ডাল
পুরুষ-আঙুল নয় হিরন্ময় মায়াবী রুমাল!
প্রেমিক ও কুকুরেরা
প্রেমিক পোষার চেয়ে শূন্যতা পোষাই ভাল
অথবা কুকুর; এই বলে ঘন মরীচিকায় চলে গেছে মন
তার আঁশটে লতায় কীটের কামড় নিয়ে
বিধ্বস্ত বাগানে ফুল ফোটানোর নামে
প্রেমিক উপড়ে নেয় শেকড় দুগ্ধভারানত বৃক্ষের,
ভাষাহীন প্রেমের পুরুত বৃক্ষের বাকলে এঁকে দেয়
ক্ষুধা ও কাতর অগ্নি, আঠা ও লালায়
প্রণয়ের অবশেষগুলো কুড়াতে কুড়াতে ঘুম আসে
বয়স্ক টিলার গলগলে রক্তের ভেতর পুঁতে রাখি কান্না
ছেঁড়া মাংসতন্তু, উড়াই পালক নৃশংস বাতাসে
প্রাচীন সাঁজোয়া নিয়ে প্রেমিকের সদম্ভ জাহাজ
এসে ফিরে যায়, জ্বালামুখ থেকে তুলে অভ্র ও আকরিক
শুধু শূন্যতাই অন্ধকুকুর, প্রভুভক্ত, পায়ে পায়ে ঘোরে
আর কুকুরেরা পদলেহনের পর কুণ্ডলি পাকিয়ে বসে থাকে
অনুগত যন্ত্রণার মতো নিঃস্ব বাগানের পাহারায়!
ঘৃণাকুসুম
ভাসিয়ে দিয়েছি ঘৃণাকুসুম, নদী তাকে নিয়ে
কালো, থকথকে আর ভারী
তোমার কুকুরগুলো বসে আছে পাহারায়
তাদের লালায় ভিজে যাচ্ছে বাড়ি
ভাবি আজ, তোমার ভেতরে যে কুকুর
তার লালাসিক্ত জিভ আমি কি চুম্বন করিনি?
ফিকে নীল জোছনায় শ্মশানের খুলির ভেতর
বৃষ্টিজমা আয়নায় মুখ দেখে চলে গেছে প্রেত
তুমি তো তখনও খুঁজছিলে প্রেতযোনি
তোমার ভেতরে যে লালসারা লেজ নাড়ে
গড়িয়ে পড়তে দিই মহাবিশ্বের একটি মধুর ফাটলে
রাক্ষসের ক্ষুধা নিয়ে তবু তোর যৌনঅপরাধগুলো
বাড়ে উত্তরোত্তর, দানবাকারে
প্রেমভিক্ষু আমি তাই কাগজের নৌকো ভরে
ঘৃণাকুসুম ভাসিয়ে বসে আছি নদীর কিনারে!
পুরুষের প্রেম
মিথ্যার মেশিন থেকে ক্লান্তিহীন গড়িয়ে পড়ছে
পুরুষ, তোমার প্রেম, ট্যাঙ্ক খালি আর পূর্ণ হচ্ছে
মিথ্যাশ্রমে পুন পুন নির্মাণ করছ দেবীমূর্তি
উৎফুল্ল ইঞ্জিনের বুক, ধকধক, ঘর্ঘর কাঁপছে
প্রস্তরে গড়ছ তক্ষশীলা, লীলাজল কি মধুর প্রবাহিত
অলিভবর্ণ নাইটি পরেছে যে বৃক্ষ, তার নিরব সংগীতও
না জেনেই তুমি চালান করেছ তোমার কুঠার
সকল রন্ধ্রেই তার ঢেলে দিলে বর্জ্য, ক্ষার
তোমার জন্তুটি ঋজু, শিখিয়েছ চুম্বনের আগে
নমিত কুর্ণিশ, জানে বিষকুম্ভ উদয়াস্তরাগে
কীভাবে হানতে হয় উন্মুখ পরাগে, দৈববশে
প্রেমে পড়ি, মেশিনের কলকব্জা আমাকে আবেশে
ধরে রাখে, গিলে ফেলে, অতঃপর রেতপাত
আমি চোখ বুঁজে তখনও নিতে থাকি মিথ্যের প্রপাত!
প্রবেশ
আমি মন দিয়ে ঢুকি আর তোমরা শরীর
কি বিপুল সাইরেন বেজে ওঠে মাথার ভেতর
যখন সংকেত আসে রক্তে, হৃদয়সঙ্গমে বাজে
নিস্তব্ধতার কোমল পিয়ানো, মনেরও অর্গাজম লাগে
যেসব রাত্রিতে আমি নিধুবনে দেখি রক্তবর্ণ ফুল
ফুটেছে পিপাসাদীর্ণ করে একরত্তি ঘাসের ভেতর
খুলে রাখি আঙরাখা, ধাতব পেয়ালা ভরে রাখি
অলীক দ্রাক্ষার রসে, যদি পেয়ে যোই চুম্বনযোগ্য হৃদয
তাহলে হৃদয় চুম্বন শেষে আঁকশিতে গাঁথি ঠোঁট
রাগমোচনের আগে মন সাঁতরায় ঝর্ণাজলে
একটা প্যাঁচানো সিঁড়ির সহস্র ধাপে
পা ফেলে উঠতে চাই হৃদয়ের চূড়ান্ত মহলে
তোমরা শরীর চাও, আমি চাই শরীরের মিউজিক, অরণ্যদুপুর
তোমরা সুচের মতো ঢোক, আর আমি সুর!
মাতা ও প্রেমিকা
আমার পুরুষ, সিংহদরজায় তার অশ্ব রয়েছে দাঁড়ানো
আর সে বিজিত শিকারীর বেশে দাঁড়াল চুম্বকটিলায়
উদ্যত কিরিচ নিয়ে, আমার দু’বৃন্তে তার অবনত মুখ
চুষে নেয় পৃথিবীর প্রথম পিপাসাজল, মৃণালের রস,
অলীক আরক শৈশবের, একদা যা দিয়েছিল মাতৃস্তন
মা’র ঘ্রাণ খুঁজে খুঁজে এসেছে সে কুহকমহলে,
জানুতলে বসে, চায় নাভিমূলের নিচে একটু শরণ
ক্রমশ প্যাঁচানো সিঁড়ি, হা মুখ, গোলাপি ফাঁদ ভয় জাগানিয়া
গুল্ম আর সবুজ উদ্ভিদ নেড়েচেড়ে বাড়ে সাহস তাহার
অমি দিই পথ কুরুক্ষেত্রে, আমি খুলি অনন্ত তোরণ, দিই বর
আমার পুরুষ, মধু সংগ্রাহক, জাগরূক, ধীরে ধীরে
ভ্রমণের যোগ্য হয়ে ওঠে তার শিরদাঁড়া ও কোমর
স্নেহাশিস নিয়ে দেখি তার উজ্জ্বল ঘর্মাক্ত মুখ প্রেমের শিখায়
এক অঙ্গে এত রূপ, হয়ে উঠি অপরূপ মাতা ও প্রেমিকা!
উজ্জ্বল ছুরিকা
বাঁকা ছুরির মতো আমি নিঝুম পড়ে থাকি। ঝকঝকে সোনালি বাট, একা একা ভোতা হতে থাকি আর আমাকে জড়িয়ে বাড়তে থাকে লালচে মরিচা। মরিচা ধরা সমস্ত আগুন মুড়ে রাখি ভূর্জপত্রে। পুষি বজ্র, বিদ্যুৎ, আর অপেক্ষা করি হিংস্র হায়েনার মতো, একটা তুলতুলে পুরুষহৃদয়ের। শিকারের গন্ধ পাওয়ামাত্র আমার ম্লান ধাতু জেগে ওঠে। খনার মেয়ে বলে জিভ কেটে ফেলেছ বহুবার, কর্তিত করেছ আমার হস্ত পদ স্কন্ধ, কবন্ধ হয়ে তোমাদের পদতলে বিছিয়ে দিয়েছি শেষ জীবন্ত কোষখানি। তবু তোমাদের প্রস্তরে কোনো জলপ্রপাত জাগেনি। আমার মাংস ঝলসে চলেছে তোমাদের বনভোজন। আমি আজ ধবংস থেকে জন্মপ্রাপ্ত উজ্জ্বল ছুরিকা, রক্তপিপাসু, কর্তনলিপ্সায় উন্মাদ।
তোমরা কি তবু এ ছুরিতে রাখবে তোমাদের হাত?
শেলী নাজের জন্ম ১১ মার্চ হবিগঞ্জে। পাহাড়বেষ্টিত, সমুদ্রবিধৌত চট্টগ্রামেই কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের উজ্জ্বল দিনগুলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর।পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর বর্তমানে তিনি মেলবোর্নের সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন। তার গবেষণার মূল বিষয় বাংলাদেশে পুরুষতন্ত্র এবং যৌননির্যাতন ও বাণিজ্যিকায়নের শিকার কন্যাশিশুর মানসিক সাস্থ্য। পেশাগত জীবনে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত। তার কবিতার বই ৯ টি। প্রথম কবিতার বই ‘নক্ষত্র খচিত ডানায় উড্ডীন হারেমের বাঁদি’ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। পরবর্তীতে ‘বিষাদ ফুঁড়ে জন্মেছি বিদ্যুতলতা (ম্যাগনাম ওপাস ২০০৬)’, ‘শেকলে সমুদ্র বাজে’ (অনন্যা ২০০৭), ‘মমি ও মাধুরী’ (ম্যাগনাম ওপাস ২০০৯), ‘চর্যার অবাধ্য হরিণী’ (পাঠসূত্র ২০০৯), ‘সব চাবি মিথ্যে বলে’ (ম্যাগনাম ওপাস ২০১১), ‘সূচের ওপর হাঁটি’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন ২০১৩), ‘পুরুষসমগ্র’ (অ্যার্ডন পাবলিকেশন্স ২০১৫) এবং ‘কাটা জিভের গান’ (বাতিঘর, ২০২০) নামে আরও একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার নারীর আত্মপরিচয় নির্ণয়ের যুদ্ধযন্ত্রণা, নারীবাদ, পুরুষতন্ত্রের বিপরীত স্রোতে ভাসবার সাহস আর সমাজবাস্তবতার দ্বান্দ্বিক বোধ তার কবিতার প্রধান বিষয়।