রেললাইন
পরিত্যক্ত রেললাইন ধরে লোকটা ৩০ বছর ধরে হাঁটছে।
ধূসর ট্রেনে করে তার নামে একটা নীল রঙের প্যাকেট আসার কথা; প্রতিরক্ষার চেয়েও গোপন, ঘুমন্ত কোনো তথ্যাস্ত্র তার হাতের ছোঁয়ায় জেগে উঠবে, কাকজ্যোৎস্নায়, ওই সামনের প্রত্ন-স্টেশনে।
লোকটা অপেক্ষা করতে করতে হাঁটে অথবা হাঁটতে হাঁটতে অপেক্ষা করে।
একদিন ডিপার্টমেন্টের লোকজন এসে লাইনটা তুলে নিয়ে যায়; স্টেশন ঝেড়েমুছে কারখানা বানানোর কাজ শুরু হলে কিছু কাক বিভ্রান্ত হয়ে জ্যোৎস্নায় এলোপাথাড়ি উড়তে শুরু করে।
তবে লাইনছাড়া ট্রেন কী করে আসবে?
এই চিন্তা করতে করতে লোকটা একদিন নিজেই রেললাইন হয়ে যায়।
বিপ্রতীপ
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না। সব ফেক। আমার পুরোটাই মুখোশ।’ আমি শেষবার বলেছিলাম তোমাকে। তুমি কাঁদলে, ঘৃণায় থুথু ছিটালে।
তারপর নতুন সংসার গুছিয়ে নিলে।
একদিন তুমি তোমার ব্যালকনিতে বেশ কিছু অর্কিড এনে ঝুলিয়ে দিলে।
আমি রোজ ওই ব্যালকনির নিচের সড়ক ধরে সাইকেল চালিয়ে যাই। আর যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, অর্কিডগুলোর বেগুনি আভা ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
আর রোজ ঘরে ফিরে আয়নায় নিজেকে দেখি। আমার মুখমণ্ডল থেকে একটু একটু করে ঝরে যাচ্ছে জীবনের বিভা। আমি ক্রমশ ধূসর হচ্ছি।
ওই একটুখানি মিথ্যা তোমাকে দিয়েছে জীবন। আমাকে দিয়েছে তুমুল ধূসরতা। যদিও আমি কোনো দিন মহাপুরুষ ছিলাম না, ময়ূরাক্ষী।
গোপন আগুন
গণেশ মাঝি মৃত্যুশয্যায়। বয়সের তো গাছপাথর নেই, বার্ধক্যজনিত পীড়া আর কী। কথা বন্ধ হয়ে গেছে, হাত-পা নড়ে না। সেই লোক মাঝরাতে হঠাৎ ‘কুলসুম’ ‘কুলসুম’ বলে চিৎকার করে ওঠে।
ছেলেরা, বৌমারা, নাতিপুতিরা কেউ কোনো কূলকিনারা পায় না। কুলসুম নামের কারো সাথে এ পরিবারের কোনো সংশ্রব আবিষ্কারে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।
তারা এ-ও জানে না, মাঝি চিৎকার করার আগে বাড়ির পাশের নদী, যা আজ মৃত, যেখানে দালানকোঠা উঠেছে, সেখান থেকে বৈঠার ছপছপ শব্দ শুনেছে।
৪৯ বছর আগের ঘটনা। ওরা জানার কথা না। ওরা তো দূরে থাক, দেশেরই জন্ম হয়নি তখন।
যুদ্ধের কাল। ভরা বর্ষার পয়মন্ত নদী। এক দুপুরে পাকবাহিনীর কিছু সদস্য তালুকদারপাড়ার কুলসুমকে গণেশ মাঝির নৌকায় করে ওপারের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারপর সন্ধ্যার মুখে তারই নৌকায় ফেরত পাঠায়।
একটা ছেঁড়াখোড়া রক্তাক্ত দেহ। নৌকার পাটাতনে প্রায় নির্জীব। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। একবার ওপারে নিয়ে যেতে পারলে, ভাবে মাঝি, সুনীল ডাক্তার ধন্বন্তরী, বাঁচিয়েও ফেলতে পারে। বিদ্যুতবেগে বৈঠা চলে।
মাঝনদীতে পুরো সন্ধ্যা। ফিকে অন্ধকারে পাটাতনের উপর একদলা গাঢ় অন্ধকার। হঠাৎ নড়ে ওঠে দলাটা। ভেতর থেকে বাঘের চোখের মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে একজোড়া আগুনের বল। তারপর বল দুটো লাফিয়ে পড়ে নদীর জলে। হারিয়ে যায় অতলে।
৪৯ বছর ধরে আগুনের বল দুটো মাঝির বুকের দুপাশে গোপনে জ্বলেছে।
কোথাও কোনো ইতিহাসের চিহ্ন না রেখে শেষরাতে তারা চূড়ান্তভাবে নিভে যায়।
অ্যাসাইনমেন্ট
‘হ্যালো। ঈশ্বর বলছেন?’
‘জি।’
‘আমি দেবী কলাবতী।’
‘ওহ্, বলো দেবী। তোমার এসাইনমেন্টের কতদূর?’
‘শুরুই করতে পারিনি। আমাকে প্রত্যাহার করুন প্রভু।’
‘কেন?’
‘দুঃখিত প্রভু, আমাদের চিন্তা যেখানে শেষ হয়, মানুষের চিন্তা সেখান থেকে শুরু হয়।’
ঈশ্বর স্তম্ভিত। তিনি কলাদেবীকে ১০০০ বছর আগে মানবজাতির মধ্যে কলাবিদ্যার উত্তোরণ ঘটানোর জন্য বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে মর্তে পাঠিয়েছিলেন।
থুতুসূত্র
প্রতিদিন বেশ কয়েকবার ভিখারিনীর সামনে দিয়ে ঝকঝকে অডি গাড়িটা যাওয়া-আসা করে। প্রতিবার ভিখারিনী থুঃ করে থুতু ছিটায়। কোনোবারই তার থুতু ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার নাগাল পায় না। ফুটপাতেই বিলীন হয়ে যায়। ১৫ বছর ধরে চলছে এই ড্রামা।
আজ সকালে যখন গাড়িটা গিয়েছিল, একই সূত্রে থুতু ছিটিয়েছিল সে।
এখন বিকেল। গাড়িটা ফিরছে। সে জিহ্বা নাড়িয়ে গ্ল্যান্ডগুলো থেকে থুতু জড়ো করার চেষ্টা করে। শুকনো, খাঁ খাঁ গ্ল্যান্ড। একবিন্দু থুতুও পাওয়া যায় না। শুকিয়ে যাচ্ছে জিব, গলা, বুক।
চিনচিন করে ব্যাথাটা বুক থেকে গলা পর্যন্ত আসতেই মনে হয় আগুন ধরে গেছে শ্বাসনালীতে। পৃথিবীটা দুলছে। বসা অবস্থা থেকে পড়ে যাচ্ছে ভিখারিনী। এই সময় তার ১৪ বছর বয়সী ছেলে দেবদূতের মতো এসে তাকে ধরে ফেলে।
‘কী হৈছে তোমার, আম্মা?’
‘আল্লার ডাক আইছে, বাপ।’ দৃষ্টি ঘোলাটে হতে শুরু করেছে তার।
ছেলেটা বুদ্ধিমান। জীবনের সবচেয়ে জটিল প্রশ্নটা সে করে ফেলে, ‘আম্মা আমারে কবা বস্তির মাইনসে ক্যান আমারে জাউরা পোলা কয়?’
অনেক কষ্টে ভিখারিনী উত্তর দেয়, ‘ওই বড়োবাড়ির কাজীর ব্যাডা আমারে নষ্ট করছিল। হের পর আমারে দোতালা থেইকা ফালাই দিছিল। ওই বাড়িত আমি কাম করতাম। হেই থেইকা আমি নুলা হৈছি। আর তোর জন্ম হৈছে।’
ভিখারিনীর জবান বন্ধ হয়ে যায়। ঘোলাটে দৃষ্টিতে সে দেখে, তার চোখের মধ্য থেকে আগুনের দুটো সূক্ষ্ম ধারা ছেলেটার দুচোখের মধ্যে ঢুকে দাউ দাউ করে জ্বলছে।
গদ্যে-পদ্যে সমান বিচরণ। পেশায় উন্নয়ন কর্মী। ২০০২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গল্প সংকলন ‘হ্রেষাধ্বনি ও অন্যান্য কণ্ঠস্বর’ দিয়ে আত্মপ্রকাশ। উল্লেখযােগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘স্পর্শপুরাণ’ (উপন্যাস), ‘বিহঙ্গ হত্যার পূর্বাপর’ (উপন্যাস), ‘কুহেলিবৃত্তান্ত’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘হৃৎপিণ্ড ভরতি ভেজা পলল’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘রংছুট কোয়েলের বিষণ্নতা’ (কাব্যগ্রন্থ) উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের পথ-পরিক্রমায় তার সম্বল স্বকৃত ভাষাশৈলী। শব্দকে ব্রহ্মজ্ঞান করেন। শব্দ-সংঘাত সৃষ্টি করে তা থেকে বিচ্ছুরিত বিভার ভেতর খুঁজে ফেরেন শিল্পের অন্তর্গূঢ় রহস্য। জন্ম সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে, যশোর জেলায়।