প্রথম পর্ব
এক সেই গ্রাম, পানিডাঙা
এই যে গল্পটা, এটা একটা গ্রামের গল্প! আবার, এটা একটা ছেলেরও গল্প! গ্রামটার নাম ছিলো পানিডাঙা, ছেলেটার নাম জুলহাস আলী। অনেক অনেকদিন আগে, সেই কোন ১৩৫০ বাংলা সালে, পানিডাঙা গ্রামে থাকতো ওই ছেলে! পানিডাঙা ভারী ছোট্ট, একটুখানি একটা গ্রাম। ওই সময়ে, সেই গ্রামে, কেবলই বিশ পঁচিশ ঘর মানুষের বসত!
সেসব বাড়িতে বাড়িতেও তখন, মানুষজন ছিলো অল্প অল্প! একেক বাড়িতে হয়তো তখন বড়োয় আর বাচ্চাকাচ্চায় মিলিয়ে আছে চার বা পাঁচ জন করে করে লোক! তাও তখনকার কালে, কেউই ভরসা করে বলতে পারতো না, পরের বছরেও তাদের বাড়ির অই কয়জনের সকলেই, বেঁচে থাকবে কি না!
কীভাবে তারা সেটা আশা করবে! প্রতি বছরের চৈত্র-বৈশাখ মাসে, পানিডাঙা আর তার আশেপাশের গ্রামে গ্রামে হয় কলেরা রোগটা এসে হাজির হয়, নয়তো গুটি বসন্তে বসন্তে লোকের শরীর ছেদামেদা হয়ে যেতে থাকে! তারপর, ওই দুই আধিব্যাধির কামড়ে কামড়ে সকল বাড়িরই দুজন তিনজন করে করে শেষ হয়ে যায়ই!
এটা তো গেলো শুধু গরমের কালের কথা! তার ওপর বর্ষার দিনের বিমারবালাইও তো আছে! পুরো বর্ষাকালটা ভরে সেখানকার সকলকে কেমন এক রকমের জ্বরের ধাক্কাও সইতে হয়! ওই জ্বরের কালে হয় কী, সারাদিন রোগীর শরীরে অসুখের কোনো নামনিশানা নেই! রোগী হাঁটেচলে, কাজকর্ম করে। দরকার হলে এমনকী তারা গাছেও চড়ে!
কিন্তু দিনটা যেই বিকেলের দিকে ঢলে পড়া শুরু করে, তখনই শরীরে কাঁপুনি জাগতে থাকে। প্রথমে অল্প অল্প! ক্রমে সেটা হয়ে যায় মস্ত জোর কম্প! তার সাথে সাথে জ্বরটাও এসে হাজির হয়ে যায়! ধুমধুমা উথালপাথাল কঠিন জ্বর!
জ্বর আর কাঁপুনি যখন হালকা-পাতলা অবস্থায় থাকে; তখন সকল ঘরের রোগীই, চটজলদি নিজের মুখের সামনে তেঁতুলগোলা লবণপানির খোরাটা তুলে নিয়ে, ঢাকুর-পাকুর করে করে পানিটা গিলে ফেলে! মাটির খোরায় রাখা অই নুনমেশানো তেঁতুলজলটুকুই সেই কালাজ্বরের একমাত্র অষুধ কিনা! ঘরের সকলেই হয়তো তখন সেই জ্বরের থাবড়ায় থাবড়ায় একেবারে ধুকধুকন্ত, পেরেশান!
জ্বর আর কাঁপুনি যখন হালকা-পাতলা অবস্থায় থাকে; তখন সকল ঘরের রোগীই, চটজলদি নিজের মুখের সামনে তেঁতুলগোলা লবণপানির খোরাটা তুলে নিয়ে, ঢাকুর-পাকুর করে করে পানিটা গিলে ফেলে! মাটির খোরায় রাখা অই নুনমেশানো তেঁতুলজলটুকুই সেই কালাজ্বরের একমাত্র অষুধ কিনা! ঘরের সকলেই হয়তো তখন সেই জ্বরের থাবড়ায় থাবড়ায় একেবারে ধুকধুকন্ত, পেরেশান! জ্বর বাড়লে, তখন কে কার মুখের সামনে সেই পানিভরা খোরাটা তুলে ধরবে! একজন কেউও কী তখন সুস্থ থাকে!
কালাজ্বরকেও সেখানকার লোকে খুবই ভয় পায়! কিন্তু তাও তখন তাদের আশা থাকে, নুনমেশানো তেঁতুলগোলা জলটুকুর গুণে আর হায়াতের জোরে, রোগী হয়তো জানে বেঁচে গেলেও যেতে পারে! আর, নাও যদি বাঁচে; তাও মনের একটা সান্ত¡না থাকে! রোগীকে অনেকদিন ধরে, চোখের সামনে দেখতে পাবার ভাগ্যটা হয়েছে তাদের! সেটাও কম কিসমতের ব্যাপার না!
কিন্তু ওলা বিবির দয়ায় যেই বিমারটা হয়, সেইখানে সংসারের কে কার দিকে তাকায়! তখন নজরটা ফেরাতে না-ফেরাতেই তো একেকজনের ভেদ-দাস্ত শুরু হয়ে যায়! তারবাদে ফুরাত-মুরাত করে করে একেকজনের জান কবজ হয়ে শেষ! ওদিকে, মউতের ফেরেশতায় গুটি বসন্তের বিমারীর জান তুলে নিতেও বিশেষ দেরি করে না!
সেই ১৩৫০ বাংলা সালে দেশদুনিয়ার যখন এমন অবস্থা; তখন আমাদের জুলহাস আলী সাত বছর পুরা করে, মাত্রই আট বছরে পা দিয়েছে! সে গ্রাম ভরে ইতিপিতি হাঁটে-চড়ে। ছোটো আর মাঝারি গাছগুলোতে চড়ার কায়দা তার তখন খুব রপ্ত হয়ে গেছে! তবে ঝাপড়া-মোটকা গাছগুলোতে চড়ার আও-ভাওটা তখনও তার পক্ষে ধরে ওঠা সম্ভব হয়নি! খুব জোর চেষ্টা করলে হয়তো সেটাও শিখে উঠতো সে! কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে, জোর কোনো চেষ্টাটা করারই কোনো উপায় নেই তার! মায়ের কড়া নিষেধ দেয়া আছে যে! মায়ের কথা তো কখনো অমান্য করে না জুলহাস আলী!
সকলে বলে, অমন লক্ষ্মী, সুশীল ছেলে তাদের দেশগ্রামে এই একটাই আছে! এই ছেলে, মায়ের কথার অবাধ্য হতে জানে না! মায়ের মনে রাগতাপ ওঠার মতন কোনো দুষ্টকর্ম সে কখনো করে না! কেমন এক সোনার টুকরা এই পোলা! মায়ের অন্তর তাহলে ক্ষণে ক্ষণে তার ছেলেকে দোয়া না করে, পারে নাকি! দোয়ার গুণেই তো, একটা কোনো বিপদ-বালাই, আজ পর্যন্ত জুলহাস আলীর কাছেপিঠে সুদ্ধ পৌঁছাতে পারেনি! এটা ভারী আশ্চর্যের কথা!
এই যে দেশ-গ্রাম-সংসারে অমন অমন কঠিন কঠিন অসুখ-ব্যারাম হয়ে চলছে, তার কোনোটাও আজ পর্যন্ত জুলহাসকে ধরতে পারেনি! ভেদ-দাস্তের অসুখ, বা জল-বসন্ত গুটি-বসন্তের অসুখ তো না-ই; এমনকী ঘরে ঘরে চিরকালের জন্য বসত নিয়ে আছে যেই কালাজ্বর, সেটা সুদ্ধ না! কোনো অসুখই যেনো জুলহাসের দিকে চেয়ে দেখার ফুরসতও পায় না, কিছুতেই!
তবে লোকে মনে মনে আবার অন্য আরেকটা কথাও বলে! তারা বলে, শুধু মায়ের দোয়ার গুণেই অই ছেলে এমন নীরোগ হয়ে নেই! পেছনে অন্য আরেকটা ঘটনাও আছে! ঘটনাটা হলো, জুলহাস আলী জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই বাড়ির লোকেরা তাদের ছাওটাকে ঠিকঠাক মতো খুঁতো করে নিতে পেরেছে! সেই কারণেই কোনো আলাই-বালাইয়ের পক্ষেই আর জুলহাস আলীর কাছে ঘেঁষার সাধ্য নেই!
সেই বাড়ির প্রতিটা জনেই হলো বিষম মাথাঠান্ডা লোক! তারা অন্য সব বাড়ির লোকদের মতন বেখেয়ালী আর মাথা-আউলা তো না! দরকারের কাজটা তারা, ঠিক দরকারের সময়েই, করে ফেলতে জানে! একটু কোনো ভুল করে না!
অন্য অন্য বাড়িতে যখন কোনো একটা নতুন ছাও জন্ম নেয়; তখন ঘরের লোকেরা নয়া ছাও নিয়ে আজান—আহ্লাদে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে যায়! নানা প্রকারের হই-মই করতে করতে তারা শেষে, আসল কাজটা আর যথাসময়ে করার অবকাশই পায় না! সময়ের কাজ তারা—দেখো কেমন—অসময়ে সারতে যায়! সেই জন্যই তো নিজেদের বেখেয়ালীপনার উচিত শাস্তিও তারা একেবারে হাতে হাতেই পায়!
সেই আসল কাজ কোনটা?
আসল কাজ হলো, জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বাচ্চাটার অঙ্গে একটা কোনো খুঁত করে দেওয়া! সেটা আবার করতে হয়, বাচ্চাটা দুনিয়ায় আসার সঙ্গে সঙ্গে! এই কাজে এক দণ্ডও দেরি করা চলে না! যদি সঠিক ক্ষণে, খুঁতো করার কর্মটা সেরে নিতে পারো; তবেই আর বাচ্চাটার আয়ু নিয়ে একটুও কিছু চিন্তা করার থাকে না! সে বাঁচবেই বাঁচবে! ওলা বিবি বা তার বোন কালাজ্বর বিবি বা তাদের অন্য বোন শীতলা বিবির নজর লাগা থেকে ছাওটাকে রক্ষা করার এটাই একমাত্র পথ! কারণ খুঁতো অঙ্গের কিছুর দিকে ওই বোনেরা ফিরেও তাকায় না!
তবে খুঁতো করার কাজটা সারতে যদি এক লহমা দেরিও হয়ে যায়, তাহলেই আর কোনো উপকার পাওয়ার আশা থাকে না! দেরি হলো তো, জানবে ওই বোনদের নজর এড়ানোর আর কোনো উপায় নেই! কোনো না কোনো ছুঁতায়, বাচ্চাটাকে তারা নিয়ে যাবেই যাবে!
জুলহাস আলীর বাড়ির সকলে কী করেছিলো? তারা নিজেদের ছাওটাকে গোসল করানো বা মুখে একটু মধু দেওয়ার জন্য একটুও অস্থির হয়নি! বরং হুড়মুড় হাতে তারা, ছাওয়ের বাম কানের লতিটাকে ছিদ্র করে দিয়েছে! তারপর অন্য কাজ!
জুলহাস আলীর বাড়ির সকলে কী করেছিলো? তারা নিজেদের ছাওটাকে গোসল করানো বা মুখে একটু মধু দেওয়ার জন্য একটুও অস্থির হয়নি! বরং হুড়মুড় হাতে তারা, ছাওয়ের বাম কানের লতিটাকে ছিদ্র করে দিয়েছে! তারপর অন্য কাজ! ব্যস! এই যে দেখো! দেখো গো ওলা বিবির বোনেরা! খুঁতো বস্তুর দিকে এখন তোমরা তাকায়ে দেখবে? নাকি ফিরেও তাকাবে না!
পানিডাঙার সকলে বোঝে, জুলহাস আলীকে খুঁতো বানাবার কর্মটা সঠিক রকমে হয়েছে বলেই; এই যে কতো সুন্দর সে এখন হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে! কিন্তু, জুলহাসের আশেপাশের সময়ে জন্মানো অন্য বাচ্চাগুলো কই? আহা! তাদের কোনো একজনও আর মাটির ওপরে নেই! তাদের কবরের মাটিতে মাটিতে কতো কতো দণ্ডকলস আর রক্তদ্রোণের ঝাড় মাথা তুলছে; আর মাথা কাত করে যাচ্ছে!
জুলহাসের বাম কানের সেই ছিদ্রে, সুতা বাঁধা একটা ফিনফিনে তাবিজ পরিয়ে রাখা আছে! বছর মাস দিন বা রাত, সকল সময়, ওই সুতা-বাঁধা ফুরফুরা তাবিজটা, তার কানে ঝোলে! বছরের একদিন, পৌষ মাসের শেষ সন্ধ্যায়, পুরানো সুতা ছিঁড়ে, কানের ছেদায় তাবিজ-বাঁধা নতুন সুতা পরানো হয়!
সেই কাজ তো আর ঘরের লোকে করে না! প্রতি বছর সেটা করে দেয় এক দরবেশ হুজুর! দূরের গ্রাম ভোলাইলে যেই পীরের দরগাটা আছে, দরবেশ হুজুর সেখানেই আসন নিয়ে থাকে! পৌষ মাসের শেষ সন্ধ্যায়, হুজুরকে এই বাড়িতে আনা হয়! হুজুর এসে কানের সুতা-বাঁধা পুরোনো তাবিজ বদলে দিয়ে যায়! তারপর পুরো বছর ভরে বাড়ির সকলের কাজ হলো, সেই সুতাটার দিকে খেয়াল রাখা! কোনো প্রকারেই যেনো সেটা ছিঁড়ে না যায়!
এই যে নিজের ছেলেটা এখনও বেঁচে আছে, এটা নিয়ে জুলহাসের মায়ের মনে শান্তি আছে ঠিক; কিন্তু মায়ের ভয়ের কোনো শেষ নেই! জুলহাসের আগের-পিছের কোনো একটা বাচ্চা, পানিডাঙা গ্রামের কোনো বাড়িতেই আর, বেঁচে থাকার কিসমত পায়নি! থাকার মধ্যে আছে শুধু এই জুলহাসে! কোনদিন না জানি তার দিকে অসুখের নজর পড়ে যায়! কোনদিন না-জানি এই ছেলের কোন বিপদ ঘটে যায়! এই ভয়ে মায়ে সারাক্ষণ শিউরে উঠতে থাকে!
শিউরে উঠতে উঠতে, বহু বহু রকমের মানত পালন করে যেতে থাকে মা! কে জানে, কোন মানতের গুণে তার ছেলেটা রক্ষা পাবে! নিস্তার পাবে ওলা বিবি আর তার নিদয়া বোনদের হাত থেকে! তাই, দরবেশ হুজুর জুলহাসের জন্য যেই মানত কর্ম করার আদশেই দেয়, সেটাই করে মা! একটুও দোনোমোনো করে না!
এই যে গত পৌষমাসের শেষ সন্ধ্যায়; জুলহাসের কানে-বাঁধা সুতা ও তাবিজ বদলানো হলো! তখন দরবেশ হুজুর নতুন একটা ব্রত-মানত পালনের ফরমাশ দিয়ে গেছে! সেই সন্ধ্যাতেই জুলহাস আলী সাত বছর পূর্ণ করে আটে ঢুকেছে! এখন যদি ছেলের মা, এই নতুন রকমের ব্রত-মানতটা পালন না-করে; তাহলে বিপদ!
তবে এবার আর এই ব্রত, একা একা পালন করলে চলবে না! মায়ের সাথে সাথে, তার নয়নের মণি অক্ষির তারা জুলহাস আলীকেও, এই ব্রত পালন করতে হবে! এই ব্রতে এমনটা করাই নিয়ম!
ব্রতটা বড়ো অদ্ভুত রকমের! অমন ব্রতও যে দুনিয়ায় আছে, আর সেই ব্রতকে যে অমন নিয়ম-নিষ্ঠা নিয়ে পালনও করতে হয়; তেমন কথাই তো পানিডাঙা গ্রামের কেউ কোনোদিন শোনেনি! কাজেই অমন ব্রত পালনের কথাটা শুনে গ্রামের সকল লোকের মনই কেমন একটু বিবশ হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু শক্ত থাকে শুধু মায়ের অন্তর! আর, মা তো জানে; মা বললে জুলহাস আলী মায়ের কথা মান্যি করবেই করবে! কাজেই হুজুরের দেওয়া নতুন এই ব্রত পালন করা তো অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়!
দরবেশ হুজুর বলেছিলো; আসছে শ্রাবণমাসের পয়লা দিনের জোহরের ওয়াক্তে, এগারোটা পাতিহাঁসের বাচ্চাকে দরগায় দান করা চাই! এই ব্রতে, পাতিহাঁসের বাচ্চাদের সাথে তাদের মা পাতিহাঁসকেও দান করাই নিয়ম! তবে বাজার থেকে নগদা-নগদি কিনে যে, এই মা সহ পাতিহাঁসের বাচ্চাদের দরগায় দান করে আসা যাবে; ব্যাপারটা তেমন সহজ নয়!
করতে হবে কী; নিজের বাড়িতেই পাতিহাঁসের বাচ্চা ফোটাতে হবে! জ্যৈষ্ঠ মাসের গোড়ার দিকে, নিজের বাড়িতে পোষা পাতিহাঁসকে যদি ডিমে তা দেওয়ার জন্য বসিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ওই ডিম থেকে ছানা ফুটতে লাগবে হয়তো ঊনত্রিশ-ত্রিশ দিন! ঠিক সময়ে ঠিক কাজটা যাতে হয়, ঘরের লোককেই সেই মতো ব্যবস্থা নিতে হবে! ছানা বেশী ফুটলে সমস্যা নেই! গুণে গুণে তখন এগারোটা ছানা দান করে দিলেই হবে! কিন্তু এগারোটার কম হওয়া চলবেই না! তেমনটা যাতে না হয়, সেদিকে খুব হুঁশিয়ার থাকতে হবে!
পাতিহাঁসের ছানা ফোটানো পর্যন্ত সময়ে, দেখভালের যতোকাজ আছে; সব করবে মা! তবে তারপর আষাঢ় মাস ভরে, ছানাদের তদারকি করার কাজে কিন্তু, মা কিছুতেই হাত লাগাতে যেতে পারবে না! দরগায় পাতিহাঁসদের দান করতে যাবার আগ পর্যন্ত তবে ওই তদারকিটা কে করবে? সেটা করতে হবে মায়ের পুত, জুলহাস আলীকে!
‘হায় হায়! এত্তটুক একটা পোলাপাইন, এই জুলহাসে! সেয় কেমনে অত্তাগিলি হাঁসের ছাওয়ের যতন নিবে! হায় হায়! হুজুরে এটি কী কয়!’ উদ্বেগে বাড়ির সকলের অন্তরে আগুন জ্বলতে থাকে!
‘বাজান! তুমি পারবা না?’ চোখের পানি মুছতে মুছতে মা তার এক রত্তি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে!
‘তুমি কইয়া দিয়ো মা? তাইলে আমি পারমু!’ জুলহাসে বুঝি তার মায়েরে ডর পেতে দেবে! কোনোদিন না!
স্থির হয়; পাতিহাঁসের বাচ্চা ফোটার পর, বাচ্চাসহ মা-পাতিহাঁসটাকে নিজেদের পুরানো বাড়িতে নিয়ে যাওয়াটাই হবে সঠিক কাজ! সেই বাড়িতে এখন আর কেউই বসত করে না! ভিটিতে ভিটিতে ঘরের মতো ঘর পড়ে আছে! উঠান-আঙ্গিনায় খাড়া হয়ে আছে গাছের পরে গাছ! বাড়ির লোকে শুধু সন্ধ্যাকালে গিয়ে, সেই ভিটির ঘরগুলাতে সন্ধ্যাবাতি জ্বালায়ে আসে!
হাঁসগুলারে সেই বাড়িতে রেখে পালা-পালান্তি করাই হবে অতি আরামের কাজ! ছাড়া-বাড়িতে রাত্রিকালে বাগডাশা এসে হানা দিতে পারে, সে-কথা সত্য! কিন্তু সেখানে অই ছানাপোনারা তো আর উঠানের খোঁয়ারে থাকবে না! এরা হলো মানতের জিনিস! এদের অতি যতন করে বাঁচিয়ে না-রাখলে তো বিপদ! কাজেই, এদের রাখতে হবে কোনো-না কোনো ঘরের ভেতরে!
সেই ছাড়া-বাড়ির যে পুবের ঘর, সেটা একেবারে ফাঁকা-শূন্য হয়েই পড়ে আছে! সেই ঘরের মেঝেতে চাটাই পেতে, পাতিহাঁসদের রাখলেই তো হয়!
চাটাইয়ে থাকা ছানাগুলার ওপরে, পোক্ত একটা বাঁশের ঝাঁপি বসিয়ে দাও! ব্যস! আর কী চিন্তা! ঝাঁপির নিচে সব কয়টাকে রেখে দিলেই আর চিন্তা নেই। বাগডাশা কিছুতেই কিছু করতে পারবে না! দরোজায় তো বাইরে থেকে শেকল তোলা থাকবেই!
চাটাইয়ে থাকা ছানাগুলার ওপরে, পোক্ত একটা বাঁশের ঝাঁপি বসিয়ে দাও! ব্যস! আর কী চিন্তা! ঝাঁপির নিচে সব কয়টাকে রেখে দিলেই আর চিন্তা নেই। বাগডাশা কিছুতেই কিছু করতে পারবে না! দরোজায় তো বাইরে থেকে শেকল তোলা থাকবেই!
পুরোনা বাড়ির পুবেই আছে বাড়ির পুকুরটা! আষাঢ় মাসের দিনে সেই পুকুরের জল আর বন্যার জল মিলেমিশে থইথই এক সায়র হয়ে যায়! দূরের কাছের সকল ক্ষেতিখোলাও তখন বেনোজলের নিচে! অই থুমথুমা অথই পানিতে চরে বেড়িয়ে, ছানাগুলার ডাঙর হয়ে উঠতে দেরি হবে না! সমস্তটা দিন, নিজেদের খাদ্যখাবার তারা নিজেরাই জোগাড় করে নিতে পারবে!
জুলহাসে তবে তখন কী করবে? সে শুধু ভোর-সকালে গিয়ে ছানাগুলোকে বের করে দেবে, সনধ্যায় আবার ঠিকঠাক রকমে ঘরে তুলে রাখবে!
রোজকার সকালের আর সন্ধ্যার ফেন-মাখানো খুঁদকুঁড়ার খোরা তো মা জুলহাসের হাতে ধরিয়ে দেবেই! সেটাকে হাঁস কয়টার সামনে রাখতে কী আর পারবে না সে?
পারবে না?
‘মায়ে তো জুলহাসের লগে লগে থাকলোই! এট্টু আউলে থাইক্কা, পোলারে তো মায়ে, চক্ষে চক্ষে রাখবোই! তাইলে কী এইটুক করতে পারবো না জুলহাসে?’
‘একদম পারবো সেয়!’ ভালো মতো কিচ্ছু না-বুঝেও, এই জবাব দিতে ভুল করে না জুলহাস আলী!
[লেখকের নিজস্ব বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।]
বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।
আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!