শনিবার, ডিসেম্বর ২১

পুকুরের ঘাটলায় বসে কন্যাপক্ষকে মোকাবেলার প্রস্তুতি : মঈনুস সুলতান

0

পুকুরের নোনাধরা ঘাটলায় বসে আবু নসর এক শলা ফাইভ ফাইভ ধরায়। তখন খেয়াল হয় যে— প্যাকেটে আর মাত্র দু’শলা সিগ্রেট আছে। এবার পাথরের চালানে খায়খর্চা হলো বিঘত। ধারদেনা করে আবু নসর সামাল দিয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় নীলা, গোমেদ, প্রবাল ও আকিক সাপ্লাইয়ের অর্ডার পেয়েছে বটে। কিন্তু ওসব সূত্র থেকে পয়সাকড়ির আমদানি আসতে সময় লাগবে প্রচুর। এদিকে হাতখরচে টান পড়ল। সিগ্রেট ফুঁকতে ফুঁকতে আবু নসর ভাসমান কচুরিপানার দিকে ধুন ধরে তাকিয়ে থাকে। পানার শিকড়ের কাছে শতখানেক ছানাপোনা নিয়ে ভাসছে একটি তাজাতনা শোল।

আবু নসর রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে। বাইরের চারচালা টঙ্গিঘরের কামরার দরোজা-জানালা বন্ধ করে বিছানার ওপর পাথরের পুরা চালান মেলে বসেছিল। বাজাইলের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সুরুজের তেড়ছা আলো পড়ে রক্তমুখি নীলা থেকে ছড়াচ্ছিল বারিক-মুরিক বিজলি। গানের রেশের মতো গোমেদ পাথরগুলো থেকেও ঠিকরাচ্ছিল বেগুনি আভা।

আবু নসর রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে। বাইরের চারচালা টঙ্গিঘরের কামরার দরোজা-জানালা বন্ধ করে বিছানার ওপর পাথরের পুরা চালান মেলে বসেছিল। বাজাইলের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সুরুজের তেড়ছা আলো পড়ে রক্তমুখি নীলা থেকে ছড়াচ্ছিল বারিক-মুরিক বিজলি। গানের রেশের মতো গোমেদ পাথরগুলো থেকেও ঠিকরাচ্ছিল বেগুনি আভা। বর্মা থেকে টেকনাফ হয়ে চোরাই পথে ঢুকে পড়া এ মণিরত্ন আবু নসর খরিদ করে নিয়ে এসেছে কক্সবাজারের এক সওদাগরের কাছ থেকে। বাছা বাছা কিছু পাথর বাজারের পোদ্ধারকে দিয়ে চান্দির আংটিতে বসিয়ে বেঁচাবিক্রির পরিকল্পনা সে করছে।

এ থেকে যে রিটার্ণ আসবে, তারও হিসাবনিকাশ ক্যালকুলেটর দিয়ে সেরে রেখেছে। টঙ্গিঘরের আন্ধাইরে বসে আবু নসরের তেজারতির খোয়াব দূর্বাঘাসে লেগে থাকা শিশিরবিন্দুর মতো কেবলমাত্র জমে উঠেছিল। এমন সময় তার জননী হাজিবিবি রহিমা দুয়ারে এসে করাঘাত করেন। হুড়কা খুলতেই তিনি খড়গহস্ত হয়ে আবু নসরকে পাথরের সওদা গুটাতে হুকুম দেন। হাজিবিবির বক্তব্য পরিষ্কার— তাকে পাত্র দেখতে আসছে কনেপক্ষ আজ সন্ধ্যায়। তিনি চান না—আবু নসর যে বারোবাজারি বেফজুল কায়কারবারে মশগুল হয়ে আছে, তা তারা জানুক।

মা রহিমা বিবির হুকুমকে অবজ্ঞা করার হিম্মত আবু নসরের নেই। লেখাপড়া জানা বেওয়া রহিমা বিবি স্বভাব-চরিত্রে জাঁদরেল কিসিমের। স্বামীর ইন্তেকালের পর থেকে শক্তহাতে জমিজিরত সমালাচ্ছেন। একা মক্কাশরীফ থেকে হজ সেরে, শিশিবোতল ভর্তি আবে-জমজম নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। দুমদাম করে বিবাহ দিয়েছেন তার একমাত্র কন্যার। দুটি পুত্রসন্তানকে ভার্সিটি অব্দি পড়িয়ে মানুষ করেছেন।

তাঁর বড়ো ছেলেটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করে অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মেঝ ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে হালফিল ওয়াপদার প্রকৌশলি, সে ল্যান্ড ক্রুজার হাঁকড়ে বেড়ায়। বালক বয়সে এরা কখনো উল্টাসিধা কিছু করলে— তিনি এদের বাঁশের লিকলিকে কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে শাসন করেছেন। কেবলমাত্র তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান আবু নসর পড়ালেখায় তাঁর স্বপ্নসাধ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে।

সে বারোবাজারি কায়-কারবার নিয়ে খোদার খামোকা হরেক রকমের ধান্দা করে বেড়াচ্ছে। বানিজ্য বিভাগে অনার্স পড়ানোর জন্য তিনি তাকে টাকাপয়সা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। বেআক্কেলটা পড়ালেখা শিকায় তুলে, এখন ব্যবসার নামে নানা রকমের নারিংবিরিং করে বেড়াচ্ছে।

সে বারোবাজারি কায়-কারবার নিয়ে খোদার খামোকা হরেক রকমের ধান্দা করে বেড়াচ্ছে। বানিজ্য বিভাগে অনার্স পড়ানোর জন্য তিনি তাকে টাকাপয়সা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। বেআক্কেলটা পড়ালেখা শিকায় তুলে, এখন ব্যবসার নামে নানা রকমের নারিংবিরিং করে বেড়াচ্ছে। এ আত্রাফে হাজিবিবি বলে পরিচিত তার মা রাহিমা এবার বিষয়টার হেস্তনেস্ত করতে চান। তিনি সন্তান আবু নসরকে পাথরাদি গুটিয়ে, কনেপক্ষকে মোকাবেলা করার হুকুম দিয়ে বেরিয়ে যান টঙ্গিঘর থেকে।

পাথরগুলোর প্যাকেটে রত্নের নাম, রাশিচক্রের সাথে সম্পর্ক, ও ভাগ্যপরিবর্তনে এদের কার্যকরিতা নিয়ে দু-চার ছত্র লিখে স্টেপলার দিয়ে মাত্র সাঁটার উদযোগ করছিল আবু নসর। মায়ের আলটিমেটামে তার দিলে তাৎক্ষণিকভাবে পয়দা হয় তীব্র ডর। সে আতংকে হিচকিচিয়ে গিয়ে তাকিয়ে থাকে, ছনের চৌচালা ছাদের দিকে। ওখানে টিকটিক আওয়াজে লেংগুড়ের অর্ধেকটা ফেলে দিয়ে বেফায়দা ছুটাছুটি করছে বেবাট কিসিমের এক টিকটিকি। বিরক্ত হয়ে আবু নসর বেরিয়ে আসে টঙ্গিঘর থেকে।

সে ঘাটলায় বসে সিগ্রেটে শেষটান দিয়ে নিজমনে পরিস্থিতির খতিয়ান নেয়। বিয়ের পয়গাম নিয়ে পাত্রীপক্ষের আগমণের বিষয়ে সে ওয়াকিবহাল হয়েছে মাত্র ঘন্টাখানেক আগে। পড়শি এক নারী, গ্রাম সম্পর্কে তার ভাবী, কনের ফটোগ্রাফসহ বিস্তারিত তাকে অবগত করেছেন। মেয়েটির বাবা যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে প্রবাসী। কনেও বছর সাতেক হলো ওই দেশে বাস করছে। ইতোমধ্যে সে মেম-বালিকাদের মতো সরফরিয়ে ইংরেজিতে বুলি আওড়ানো শিখেছে।

নারীদেহ সম্পর্কে আবু নসরের উদ্দীপনা সচরাচর জাগ্রত হয় রাতবিরাতে। কোনো নারীর অন্তরের অন্তস্থলে খানিকটা স্থান পাওয়ার ব্যাপারে তার ষোলআনা আগ্রহ আছে। কিন্তু, এখনই বিলাতপ্রবাসী কনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তার কায়-কারবারের সম্ভাবনা যে লাটে ওঠে। আবু নসর যতটা বুঝতে পেরেছে, তাতে মনে হচ্ছে, সে প্রস্তাব কবুল করলে, নাইনটি ডেজের ভেতর তাকে ঘেঁটি ধরে পাঠিয়ে দেয়া হবে বিলাতে। এতে মণিরত্নের কারবার করে রোজগারের তাবৎ সম্ভাবনা নির্ঘাত তছনছ হয়ে যাবে। আর নিজমনে ব্যাবসাভিত্তিক যে খোয়াব ডগমগে লাল মোরগঝুঁটি ফুলের মতো বাড়ছে, তারও স্রেফ দফারফা হবে।

কায়-কারবারের রিটার্ন আসা মাত্র আবু নসর শহরে একটি তিন কাটার প্লট খরিদ করতে চায়। তারপর ব্যবসা বিস্তারিত হলে, লাল সিরামিক ইটে বানাবে জানালায় ওভাল শেপের আয়না বসানো একটি দোতালা বাড়ি, যার গাড়ি-বারান্দায় থাকবে স্পোর্টি টাইপের একখান ডাটসান ওয়ান হানড্রেড-এ কার। আবু নসরের দৃঢ় বিশ্বাস, এখনই বিবাহের ফাঁদ থেকে পিচকাতে পারলে এ ধরনের স্বপ্নিল অর্জন হাসিল করা কেবলমাত্র বছর কয়েকের ব্যাপার।

কিশোর বয়স থেকেই নানাবিধ ব্যবসার ঘুনপোকা তার করোটির কড়িকাঠে ছিদ্র খুঁড়ছে। কলেজ জীবনে সে ‘ব্যবসার মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হাওয়া’ বিষয়ে একটি নিবন্ধ দেওয়াল পত্রিকায় প্রকাশ করে সতীর্থদের নজরে পড়ে। তখন তার ক্লাসমেটরা কো-এডুকেশনের মওকার সহপাঠিনীদের প্রেম-ভালোবাসায় নিমজ্জিত হচ্ছিল অহরহ। আবু নসর কিন্তু ওসবে উদ্যোগ নেয়ার উদ্যোম খুঁজে পায়নি নিজমনে। সে বরং ব্যস্ত থেকেছে, লাইব্রেরি থেকে ব্যবসার ওপর বইপুস্তক জোগাড় করে নিবিড় অধ্যয়নে। একই বছর, তার ক্লাসমেটরা নববর্ষের দিন বের করে, প্রত্যেকের নামে একটি করে কৌতূককর ছড়া সম্বলিত হাতে লেখা বুলেটিন। তাতে আবু নসরকে উদ্দেশ্য করে লেখা ছড়াটির পয়লা দুটি ছত্র ছিল এ রকম: ‘সফল ব্যবসায়ী হতে চায় মোহাম্মদ আবু নসর/লেখাপড়ায় মন নেই তার, বাঁধতে চায় না সে ঘর।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও হোস্টেলে খায়খর্চা নির্বাহের জন্য জননী হাজিবিবি রহিমা তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আবু নসর তা সম্বল করে চলে যায় সুন্দরবনে। গোলপাতার ব্যবসায়ে লগ্নি করার মাস তিনেক পর সে বাড়ি ফেরে ম্যালেরিয়াক্রান্ত হয়ে। শরীর সেরে ওঠার পর মংলার দিকে ফিরে গিয়ে সে চিংড়িমাছের ঘেরে পুঁজি খাটাতে চায়। এ বাবদ কিছু জমিজমা বন্ধক রেখে টাকা সংগ্রহের জন্য মা-কে প্রস্তাব দিলে, হাজিবিবি আধপোড়া চেলাকাঠ নিয়ে তাকে তাড়া করেন।

মায়ের আচরণে আবু নসরের দিলে জবর চোট লাগে। মনের তীব্র তিক নিয়ে, একখানা চিরকুটে তার অভিমান সংক্ষিপ্তভাবে বয়ান করে, সে গৃহত্যাগ করে ধলপ্রহরের সময়। এর সাতমাস তেরোদিন পর সে বাড়ি ফিরে আসে রাত্রিবেলা। তার পরনে ক্রিমকালারের নিপাট সাফারি, পায়ে অক্সফোর্ড শু ও ঝকঝকে ব্রিফকেসে তাকে সফল ব্যবসায়ীর মতো দেখায়। সে মায়ের জন্য মাসকতি হালওয়া, পেয়ারার জেলি ও চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি ইত্যাদি নিয়ে এসেছে। সকাল বেলা বাড়ির বাইরে টঙ্গিঘরের সামনে পায়চারি করতে করতে সে কিসের জন্য যেন ইন্তেজারি করে। অতঃপর তার তেজারতির সওদা নিয়ে, ধানখেতের আল মাড়িয়ে, ঠ্যারঠেরিয়ে টঙ্গিঘরের সামনে এসে থামে একটি ট্র্যাকটার। জংধরা চেসিস ধামসানো ট্র্যাকটারখানা তার ট্রেইলারে করে বয়ে এনেছে ভাঙ্গারোঙ্গা দুখানা মাজদা মটরকার।

দুপুরবেলা খেতে বসে আবু নসর মৃগেল মাছের মুড়ো দিয়ে রান্না করা মুগডালে কাগজি লেবু চিপতে চিপতে মা-কে তার ব্যবসার পরিকল্পনা খুলে বলে। স্পেয়ার স্পার্টস্ অলরেডি কেনা হয়ে গেছে। এসবের চালান বাড়িতে এসে পৌঁছলেই সে কার-মেকানিক দিয়ে গাড়িগুলো সারাই করাবে। তারপর এসব রিকন্ডিশনড কার বিক্রি করে লাখ-লাখ টাকা মুনাফা করা কঠিন কিছু না। সব শুনে মা হাজিবিবি তবদিল হয়ে যান, তিনি চুঁলচেরা কিছু না করে নীরবে কিছুক্ষণ ভোজনরত ছেলেকে তালপাখায় বাতাস করেন। অতঃপর খাওয়া শেষ হলে পবিত্র ‘আয়তল কুরসি’ পড়ে তার মাথায় ফুঁ দেন।

মেকানিকরা গাড়ি বারবার স্টার্ট দিয়ে টেস্ট করে। আওয়াজে বাঁশবন থেকে আসমানে ওড়ে পাখপাখালি। দুপুরের কাঁচা-ঘুম ভেঙে পাড়শীদের কাচ্চাবাচ্চারা জেগে ওঠে তাদের মা-কে জড়িয়ে ধরে কাউমাউ করে কাঁদে। মাজদা কার দুখানি যান্ত্রিক গলায় তারস্বরে গজরায়। কিন্তু, কিছুতেই আগ বাড়তে পারে না। মেকানিকরা ঢাকার বাংলামটর থেকে নতুন ধরনের পার্টস আনার পরামর্শ দেয়। তাদের বক্তব্য, ধোলাইখাল থেকে ওস্তাদগোছের এক মেকনিককে ধরে আনতে না পরলে গাড়ি দুখানা সড়কে দৌড়াতে সমর্থ হবে না কখনো।

এরপর মাস দেড়েক টঙ্গিঘরের সামনে তোড়েজোড়ে মেকনিক দিয়ে গাড়ি সারাইয়ের কাজ চলে। স্প্রেপেইন্টের বদৌলতে রংচটা বজরা মটরকার দুটির চেসিস থেকে রঙের জৌলুস বেরোয়। মেকানিকরা গাড়ি বারবার স্টার্ট দিয়ে টেস্ট করে। আওয়াজে বাঁশবন থেকে আসমানে ওড়ে পাখপাখালি। দুপুরের কাঁচা-ঘুম ভেঙে পাড়শীদের কাচ্চাবাচ্চারা জেগে ওঠে তাদের মা-কে জড়িয়ে ধরে কাউমাউ করে কাঁদে। মাজদা কার দুখানি যান্ত্রিক গলায় তারস্বরে গজরায়। কিন্তু, কিছুতেই আগ বাড়তে পারে না। মেকানিকরা ঢাকার বাংলামটর থেকে নতুন ধরনের পার্টস আনার পরামর্শ দেয়। তাদের বক্তব্য, ধোলাইখাল থেকে ওস্তাদগোছের এক মেকনিককে ধরে আনতে না পরলে গাড়ি দুখানা সড়কে দৌড়াতে সমর্থ হবে না কখনো।

এদিকে আরেকটি ফ্যঁকড়ার সৃষ্টি হয়। মোহাম্মদ দালাইলাম আজাদি নামে এক জুনাগড়ি ব্যবসায়ি আবু নসরের তালাশে মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে তার বাড়িতে এসে হাজির হয়। সে আজাদির কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে টাকা করজ নিয়ে গাড়ি দুটি কিনেছিল। তো, দালাইলাম আজাদির মোটরবাইকের চেনা আওয়াজ শোনামাত্র, সে বাড়ির পেছনের নয়ানজুলি অতিক্রম করে, দ্রুতবেগে কেঁয়াবনের ভেতর দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়।

হাজিবিবির সঙ্গে আজাদির পর্দার আড়াল থেকে বিস্তর কথাবার্তা হয়। দ্বন্দ্বের আলামত পেয়ে গেরামের দু’একজন মোড়ল-মাতব্বরও এসে হাজির হন। ক্রোন্দল বিস্তৃত হয়। সন্ধ্যা অব্দি প্রচুর বাত-বাদখাস্তের পর সাব্যস্ত হয়ে যে, আজাদির মারফত গাড়ি দুখানা মন দরে লোহালাক্করের ব্যবসায়ির কাছে বিক্রি করে দেয়া হবে। এতে পাওনার টাকা পুরাপুরি নিকেস না হলে, হাজিবিবি তার সোনার জেওরাত একখানা বিক্রি করে জুনাগড়ির হাত থেকে নিস্তার পান।

ঘাটলায় বসে আবু নসর ঝিম মেরে পরিস্থিতির কুলকিনারা করছিল। এমন সময় টঙ্গিঘরের সামনে বেবিটেক্সি থেকে নামেন তার দারোগা কাকা। স্থূলকায় ভুড়োপেট এ পুলিশ কর্মকর্তা বেগুনি রঙের সিভিলিয়ান কোট পরে গেরামের বাড়িতে এসেছেন। উৎকোচের অভিযোগে উত্যক্ত হয়ে ইদানিং দারোগা সাহেব অত্যধিক মাত্রায় নামাজ-কালাম শুরু করেছেন। পুকুরঘাটে বসে থাকা ভাতিজার দিকে নজর পড়তেই, তিনি মাথা থেকে গোলটুপি খুলে তা নাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকেন।

কাকাকে দেখা মাত্র আবু নসরের আত্মরক্ষার তাবৎ সামর্থ স্পর্শে কুঁকড়ে যাওয়া ছইতে-মরা লতার মতো মিইয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে— খানিকপর সে ভেতরবাড়িতে কাকাকে কদমবুসি করতে আসে। দারোগা সাহেব বাড়িতে ঢুকেই বদনাতে ওজুর পানি নিয়ে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মেছওয়াক শুরু করছিলেন। ভাতিজাকে দেখা মাত্র— তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে তস্করকে বমাল গ্রেফতার করার চাপা প্রসন্নতা।

তিনি মেছওয়াকের ডালা কামড়ে থুক থুক করে থুতু ফেলে, আবু নসরকে ওজু-গোছল করে, পায়জামা পাঞ্জাবীর সাথে চোখে সুর্মা দিয়ে তৈয়ার হতে হুকুম দেন। তারপর হাজিবিবির দিকে ফিরে বলেন, ‘কন্যাপক্ষের পছন্দ হলে আর দেরি করার কোনো দরকার নেই ভাবী, আজ সন্ধ্যায়ই বাতকথা পাক্কা করে ফেলা যায়।’ হাজিবিবি ইতস্তত করে বলেন, ‘তোমার ভাতিজার মতামত নেবে না?’ দরোগা সাহেব চটে উঠে জবাব দেন, ‘এ বারোবাজারি ভাদাইম্যা বেআক্কেলের আবার মতামত কী? বলদের সাথে পরামর্শ করে কঞ্চি কাটার মানুষ আমি না, ভাবী। তোমার পছন্দ হলে আমাকে ইশারা দেবে। ডিসিশন আমি নেব।’

দারোগা কাকার ডিসাইসিভ বিবৃতিতে ঘাবড়ে গিয়ে অত্যন্ত খাজুল হালতে আবু নসর আবার ঘাটলায় এসে বসে। দারোগা কাকাকে নিয়ে বছর দেড়েক আগের একটি বেমক্কা স্মৃতি বেকায়দা জায়গায় চাগিয়ে ওঠা বিষফোঁড়ার মতো তার স্নায়ুতে ছড়ায় ক্লেদাক্ত পুঁজ। মটরগাড়ির ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়ার পর সে শেল্টার নিয়েছিল দূরবর্তী এক গঞ্জের মাজারে। ওখানে ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছিল তার চুলদাড়ি। জিকির আজকারে কোনো না কোনোভাবে কেটে যাচ্ছিল দিন। পুত্রের আউলা-বাউলা আচরণের সংবাদ হাজিবিবির গোচরে আসলে, তিনি খবরিয়ার মরফতে ছেলের কাছে বাড়ি ফেরার জন্য কাকুতিমিনতি করে চিঠি লেখেন।

তো, আবার বাড়িতে ফিরে আসে আবু নসর। সে চুলদাড়ি কাটে। উকুন নিরাময়ের জন্য লাইজল মেখে গোছল করে, অতঃপর আদ্দির পাঞ্জাবী পরে ফুরফুরে মেজাজে ফের গেরামের বাজারে ঘোরাফেরা শুরু করে। কাকতালীয়ভাবে তখন ভিন্ন এক ধরনের ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। হাজিবিবি তার ধান বিক্রির টাকা ছেলেকে দিয়ে গঞ্জের ব্যাংকে ডিপোজিট করতে পাঠালে, আবু নসর অবলীলায় তা তছরূপ করে। এ অর্থে সে চা-বাগানের দোহাতি শ্রমিকদের কাছ থেকে খরিদ করে কয়েকখানা চিতাবাঘের চামড়া। এবং এসব গরুরগাড়িতে চাপিয়ে রাত্রিবেলা যৎসামান্য ধেনোমদ খেয়ে ফিরে আসে বাড়িতে।

সপ্তাহ খানেক সে চামড়াগুলো রোদে শুকায়। এগুলো থেকে উত্থিত উৎকট দুর্গন্ধে পাড়াপড়শিদের টেকা দায় হয়। শুধু চামড়াই না, বয়ামে করে সে লেবুর আচারের মতো দেখতে এক বস্তু রোদে শুকাতে দেয়। হাজিবিবি কীভাবে যেন জানতে পারেন এ পদার্থ মৃত চিতাবাঘের অন্ডকোষ বিশেষ। এতে তেড়িয়া হয়ে তিনি পুত্রকে ছেড়া চটিজুতা দিয়ে প্রহারের হুমকি দেন। আবু নসর মায়ের ফৈজত গায়ে না মেখে, উল্টা তাকে বুঝায়— কীভাবে এসব পণ্য চীনা ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে সে লাখ-বিলাখ রোজগার করবে। হাজিবিবি এতে অত্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে দারোগা দেবরের কাছে চিঠে লিখে সাহায্য প্রার্থনা করেন।

হাজিবিবির এত্তেলা পাওয়া মাত্র, ডিউটির ধড়চূড়া পরে, কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরেন তার দারোগা কাকা। প্রথমে কামলা ডেকে, গর্ত খুঁড়িয়ে, চিতাবাঘের আধ-পঁচা চমড়া ও অন্ডকোষাদি পুঁতে ফেলার হুকুম দেন। তারপর, আবু নসরকে কাছে ডাকেন। তার কান খামচে ধরে, পড়শির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সামনে ভাতিজাকে ‘বেআক্কেল বান্দর’ সম্মোধন করে, তার পেটে রুলারের খোঁচা দিয়ে চিৎকার করে বলেন, বারোবাজারি ব্যবসার নামে আর কখনো বাইসলামি করলে তিনি কনস্টেবল দিয়ে পিটিয়ে তার পাঁজরের হাড় ভাঙার বন্দোবস্ত করবেন। দারোগা-কাকার ডিউটিতে ফেরার ঘণ্টা খানেকের ভেতর মনের তীব্র তিকে ফের নিরুদ্দেশ হয় আবু নসর।

বছর খানেক চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফে ঘোরাফেরা করে, নানা ঘাটের পানি খেয়ে, হরেক রকমের মণিরত্নের চালান নিয়ে কেবলমাত্র বাড়ি ফিরেছে আবু নসর দিন কয়েক আগে। তার মহার্ঘ পাথর সাপ্লাইয়ের কারবার মাঁচায় লাতিয়ে ওঠা ঝিঙ্গার ঝাড়ের মতো বাড়ছে। তাতে হলদে রঙের ফুল ফোটার আগেই আবার তার জীবনে সৃষ্টি হলো ঘোরতর মুসিবতের।

বছর খানেক চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফে ঘোরাফেরা করে, নানা ঘাটের পানি খেয়ে, হরেক রকমের মণিরত্নের চালান নিয়ে কেবলমাত্র বাড়ি ফিরেছে আবু নসর দিন কয়েক আগে। তার মহার্ঘ পাথর সাপ্লাইয়ের কারবার মাঁচায় লাতিয়ে ওঠা ঝিঙ্গার ঝাড়ের মতো বাড়ছে। তাতে হলদে রঙের ফুল ফোটার আগেই আবার তার জীবনে সৃষ্টি হলো ঘোরতর মুসিবতের। এখন উপায়ই বা কী? বিবাহ যদি সত্যিসত্যি ঘটে যায়, তাহলে ইংরেজি ভাষায় পারঙ্গম বেগানা একটি মেয়ের সঙ্গে কীভাবে সে কথাবার্তা বলবে, এ উদ্বেগ তার ভেতর চুলায় রাখা তাওয়ার মতো উত্তপ্ত হতে থকে।

ঘটনা যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে পুরো বিষয়টা আবু নসরের বেজায় তালগোলে মনে হয়। পড়শি সম্পর্কে ভাবীটি এসে তাকে মজাক করে ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারি কেনার পরামর্শ দেন। এমন সময়, আবে-জমজমের জল ভরা শিশি হাতে হাজিবিবিও ঘাটলায় আসেন। তিনি পুত্রকে প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ করে, তার মাথায় মাখিয়ে দেন কয়েক ফোঁটা পবিত্র সলিল। মা ও ভাবী ভেতর-বাড়িতে ফিরে গেলে— আরও কিছুক্ষণ ঘাটলায় বসে থাকে আবু নসর। পুকুরপাড়ের ডেফল গাছের আগায় বসে একটি কোকিলা পঙ্খি আকুল গলায় কু ধ্বনিতে মাতেলা করে দিচ্ছে দখিনা বাতাস। আবু নসরের মেজাজ বিগড়ে যায়, তার ইচ্ছা হয়, গুলাইল দিয়ে পঙ্খিটির দিকে গুলতি ছুড়ে তাকে তৎক্ষণাত জখম করতে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম শ্রীহট্ট জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে। নব্বই দশকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটসে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে লেখাপড়া করেন কয়েক বছর। পেশাগত অছিলা হিসাবে লিপ্ত থাকেন কখনো ভিজিটিং প্রফেসার, কখনো প্রশিক্ষক কিংবা কনসালট্যান্ট হিসাবে। এ ছাড়া জর্জিয়া, সাউথ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, নেপাল, জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, ফিলিপাইনস্, কসবো, মেসিডোনিয়া কিংবা কিরগিস্তানে গবেষণা অথবা শিক্ষা-বিষয়ক কনসালটেন্সির কাজে ভ্রমণ করেন। তাঁর ‘জিম্বাবুয়ে : বোবাপাথর সালানিনি’ গ্রন্থটি বর্ষের সেরা বই হিসাবে প্রথম আলো পুরষ্কার পায়।  তিনি ভ্রমণ সাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরষ্কারও লাভ করেন। লেখক সম্প্রতি সিয়েরা লিওনে প্রথমে ডেমোক্রেসী এন্ড হিউম্যান রাইটস্ এবং পরে ইবোলা রিকাভারি ফান্ড নামক বলে দুটি কর্মসূচীর সমন্বকারী হিসাবে কাজ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচীশিল্প, পান্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।