বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

পুরুষের পৃথিবীতে নারীর সংগ্রামের আখ্যান : লাবণী মণ্ডল

0

শিল্প-সাহিত্যে নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার ইতিহাস বহু পুরনো। ইতিহাসে ‘মহান’ বলে উল্লিখিত পুরুষগণ, যারা কবি হয়ে দেখা দিয়েছেন, তাঁরা নারীর শরীরের এমন বর্ণনা দিয়েছেন! ওই বর্ণনা আমাদের স্পষ্টভাবেই জানান দেয়, নারী শুধুই ‘ভোগপণ্য’।

যা-ই হোক, খুব বিমর্ষ অবস্থায় এ লেখাটি লিখতে শুরু করলাম। এতটাই বিমর্ষ যে, লেখার কোনো ছিরি দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও দায়বোধ রয়েছে। এমন একটি উপন্যাস পড়ার পর, যদি দু’চার লাইন না লিখি, আগ্রহী পাঠকের কাছে বিষয়টি পৌঁছে না দেই; তাহলে ঘোরতর অন্যায় হবে।

‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’ বইটি পড়ে শেষ করলাম। আসলে, এখানে ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক লাবণী-শ্রাবণী-জুলেখা-সুলেখা’ বললেও বেশি বলা হবে না। হলফ করে বলা যায়, কোনো নারী যদি উপন্যাসটি পড়ে, তাহলে এটি যে তার জীবনের কথা; এ কথা সে অবশ্যই বোধ করবে!

‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’ বইটি পড়ে শেষ করলাম। আসলে, এখানে ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক লাবণী-শ্রাবণী-জুলেখা-সুলেখা’ বললেও বেশি বলা হবে না। হলফ করে বলা যায়, কোনো নারী যদি উপন্যাসটি পড়ে, তাহলে এটি যে তার জীবনের কথা; এ কথা সে অবশ্যই বোধ করবে!

পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে

বই : পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে ।। প্রকরণ : উপন্যাস ।। প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭ ।।  প্রকাশনী : অঙ্কুর প্রকাশনী।। প্রচ্ছদ : দেবাশীষ মান্না

লিখতে গিয়ে বারবার নিজের মুখাবয়ব ভেসে উঠছে। নিজের অভিজ্ঞতাই হয়তো লিখছি। কথাসাহিত্যিক আকিমুন রহমান কি আমায় ভেবেই লিখেছেন— এ রকম প্রশ্নই আসছে! আসলে, প্রতিটি নারীর জীবনের ঘটনা এত সুন্দর-সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য, নারীর জীবন নিবিড়ভাবে জানতে হয়। পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলেই কেবল এ রকম একটি শক্তিশালী উপন্যাস দাঁড় করানো যায়।

নিজের উপলব্ধি ও অনুভব ভাষার মাধ্যমে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য কাজ। তার জন্য শক্তিশালী চিন্তাশক্তি লাগে। সেইসঙ্গে শৈল্পিক কলাকৌশল যুক্ত হয়েই কেবল এমন একটি বই জন্ম নিতে পারে। অথচ এমন শক্তিশালী একজন কথাসাহিত্যিক অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে!

পিরিয়ডকালীন সমস্যা নিয়ে কম লেখালেখি, খিস্তি হয়নি। কত শতশত নারীবাদী এই একটি বিষয় নিয়ে পড়ে রয়েছেন; বলা যায় ‘পিএইচডি’ করে ফেলেছেন এ বিষয়ে; কিন্তু এভাবে শামীমাদের গল্প ক’জন ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন?

একজন মা যখন গর্ভবতী হন, তখন তার স্বপ্নজুড়ে থাকে একটি পুত্র সন্তানের। এটি তার চাওয়া না চাওয়ার উপর নির্ভর করে না— সমাজ ও পরিবারের চাওয়াই একজন মায়ের আকুতি। কারণ, এই পুরুষনিয়ন্ত্রিত সুন্দর-সুশীল পৃথিবীতে নারীদের চাওয়া থাকতে নেই, এটি জন্মের পরই নারীরা শিখে যান।

শামীমা বা একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিক, এটা ওই পরিবারের কেউই চায়নি। আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ে। কী থেকে কী হলো— এ যেন মহাভুল; কেনই-বা কন্যা সন্তানের জন্ম হলো?

খুশির আমেজ এক নিমিষেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। সব আনন্দ-উচ্ছ্বাস ধপ করে থেমে যায়। কী-ই বা করার আছে শামীমার মায়ের? চোখের জলে এক নদী বানিয়ে ফেলা যায়; কিন্তু তাতে কী শামীমার পৃথিবীতে আসার অপরাধ ঘুচবে! এভাবেই উপন্যাসের যাত্রা শুরু করেছেন আকিমুন রহমান।

উপন্যাসটি আবেগপ্রবণ যে কারও চোখে জল আনতে সক্ষম। শরীর কিয়ৎক্ষণের জন্যও হিম করে দিতে সক্ষম। আবার দ্বিগুণ বেগে, দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠার আহ্বানও রয়েছে এতে

উপন্যাসটি আবেগপ্রবণ যে কারও চোখে জল আনতে সক্ষম। শরীর কিয়ৎক্ষণের জন্যও হিম করে দিতে সক্ষম। আবার দ্বিগুণ বেগে, দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠার আহ্বানও রয়েছে এতে— কেন শুধুই কান্নায় সীমাবদ্ধ রাখব!

শামীমা শিশুকাল পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করে। হাফপ্যান্টকে বিদায় দিয়ে, পোশাক হিসেবে আসে পায়জামা। শরীরের গঠন পাল্টে যেতে থাকে। আর কিছুদিন পরেই হয়তো যৌবনবতীর তকমা পাবে। যেটুকু আনন্দ-আহ্লাদ ছিল, সেটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না।

নারী পাঠকরা, নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন কি? নিজের শৈশব-কৈশোর পেরুনোর স্মৃতি মনে আছে কি?

ওদিকে, শামীমার জন্ম নেওয়া এবং পরবর্তী পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা তার মাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। তার বাবা প্রতিরাতেই চেষ্টা চালাচ্ছে, কিভাবে তার সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বউকে গর্ভবতী করা যায়— এটাকে কোন নামে আখ্যায়িত করবেন?

পরিবার-আত্মীয়-স্বজন বহুজনের মুখে শুনেছি, ‘এবার কন্যাসন্তান হলে মা-মেয়ে দুজনকেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলব!’ এরকম বাক্যের কচকচানির মধ্য দিয়ে যখন এ সমাজের নারীদের বেড়ে ওঠা, তখন উপন্যাসটি আকাশ-কুসুম ভাববার অবকাশ নেই।

পুরো পৃথিবীতে আনন্দ বয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল, যেদিন শামীমার মা দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। তার স্বামীর মুখে চকচকে ভাব চলে আসল। শামীমার পৃথিবী আরও কষ্ট-দুঃখে ভরে উঠল। বাবার আদর, মায়ের বন্ধন তার জীবন থেকে মুছেই গেল বলা চলে।

পাঁচ হাত ওড়নায় বুক পেঁচিয়ে রাখার যে কী যন্ত্রণা, তা সমাজের প্রত্যেক শামীমাই হাড়েহাড়ে টের পায়। তবু সে হাল ছাড়েনি। পড়াশুনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক হাজারটা বাধা তাকে বারবার আটকে দেয়; কিন্তু অদম্য স্পৃহা কাউকে দমাতে পারে না। শামীমা বিভিন্ন কায়দায় বই জোগাড় করে এবং পড়াশুনাটা অব্যাহত রাখে।

যা-ই হোক, একটি বিষয় তাড়াচ্ছে, সেটি হলো উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে, আরেকটি উপন্যাসের কঠিন রূপ তৈরি করে ফেলার যে অনুভূতি তা এই প্রথম আঁচ করলাম।

ইংরেজ ঔপন্যাসিক হেনরি ফিল্ডিং উপন্যাস ও ঔপন্যাসিক সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমাদের আয়ত্তাধীন ও জ্ঞানের পরিধির মধ্যে যা কিছু আছে, তাদের সবাইকার মর্মস্থলে প্রবেশ করার এবং তাদের অন্তর্নিহিত পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষমতা রাখতে হবে ঔপন্যাসিককে।’ হ্যাঁ, সে কাজটি পরিশীলিতভাবেই ঔপন্যাসিক করতে পেরেছেন। এত শক্তিশালী নাড়া আর কোনো ‘নারী বিষয়ক’ বই দিতে পেরেছে কি-না সন্দেহ করা অমূলক নয়।

শামীমার ঋতুস্রাব চলাকালীন হাজারটা বাধা পেরুতে হয়। সবসময় চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে, ‘এ মাসে এখনও রক্তের থকথকে গন্ধ পাচ্ছি না, তবে কী কোনো অপরাধ…’ পরিবারের চাপ তো রয়েছেই।

খুব স্পষ্ট করে মনে আছে, আমার প্রথম ঋতুস্রাবের পর ছয়মাস বন্ধ ছিল; এ নিয়ে হাজারটা টেনশন ছিল; কিন্তু মায়ের অগাধ বিশ্বাস এবং দাদীর আস্থা আমাকে খুব বেশি কষ্ট পেতে দেয়নি। আমার ধারণা, এ ভূখণ্ডের অধিকাংশ নারীর অভিজ্ঞতা এর বাইরে নয়। এখন মেডিক্যাল সায়েন্সের অগ্রসরতা ও সামাজিক প্রচারণা বৃদ্ধির ফলে মেয়েদের এমন দুঃচিন্তা কমেছে কিছুটা হলেও।

শামীমা তার ঋতুস্রাব নিয়ে বলে, ‘…বেঁচে থাকাকে আমার কাছে কখনোই খুব বেশি সুখকর কিংবা আবেগে ফেনিয়ে ওঠার বিষয় বলে মনে হয় না, আবার বেঁচে থাকতে না পারাকেও মহা কোনো কষ্টের ব্যাপার বলে মনে করতে পারি না আমি। তবে পিরিয়ডের সময়টুকুকে আমার বেঁচে থাকার বড়ো দণ্ডভোগ বলে বরাবর মনে হয়ে আসছে। কী বিচিত্র পীড়নই না আমাকে ভোগ করতে হয় পাঁচদিনের প্রতি দিন। অবশ্যি যন্ত্রণাভোগ শুরু হয় ওই পাঁচ দিনের বহু আগ থেকে। পিরিয়ড শেষ হবার সপ্তাহ দুয়েক পরে একটা ব্যথার হিংস্র হাত থেকে মুচড়ে দিতে থাকে আমার নাভির নিম্নাংশের অভ্যন্তর প্রদেশ…।’

‘সর্ব অঙ্গেই ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা?’ বাক্যটি বেগম রোকেয়ার। চরম সত্য কথা। নারীর এত ব্যথা-যন্ত্রণা; যা উপন্যাসের চরিত্র থেকেও কয়েকগুণ বেশি; কিন্তু নিরাময়ের বুদ্ধি কী?

পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ছড়া, বচন, গাথা, রূপকথা, ব্রতকথা, মন্ত্র প্রভৃতি আদিযুগের লোকসাহিত্য বা গ্রাম-প্রাকৃত সাহিত্যের অধিকাংশই নারীর রচনা। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশই নয়, অন্যান্য দেশেও আদিযুগে সাহিত্যের সূত্রপাত এবং ভিত্তি স্থাপন হয়েছে নারীর হাতে।

তবে যখনই ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টি সামনে আসে, তখনই পুরুষ উৎপাদন যন্ত্র নিজের দখলে নিয়ে নেয়। নারী তার স্বাধীন সত্তা হারায়। হয়ে পড়ে পুরুষের অধীনস্ত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয় নারী। সাহিত্যক্ষেত্রে নারীর অবদান মোটেও উপেক্ষণীয় নয়; কিন্তু শিল্প-সাহিত্য সমাজের উপরিকাঠামোর অংশ। অর্থনীতি হলো ভিত্তি। সেই অর্থনীতি বা উৎপাদনের হাতিয়ার যখন পুরুষের দখলে, তখন সাহিত্যেও নারীর অংশগ্রহণ কমে আসবে স্বাভাবিকভাবেই।

তবে যখনই ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টি সামনে আসে, তখনই পুরুষ উৎপাদন যন্ত্র নিজের দখলে নিয়ে নেয়। নারী তার স্বাধীন সত্তা হারায়। হয়ে পড়ে পুরুষের অধীনস্ত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয় নারী। সাহিত্যক্ষেত্রে নারীর অবদান মোটেও উপেক্ষণীয় নয়; কিন্তু শিল্প-সাহিত্য সমাজের উপরিকাঠামোর অংশ। অর্থনীতি হলো ভিত্তি। সেই অর্থনীতি বা উৎপাদনের হাতিয়ার যখন পুরুষের দখলে, তখন সাহিত্যেও নারীর অংশগ্রহণ কমে আসবে স্বাভাবিকভাবেই। সেটিই হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যে নারীর অংশগ্রহণ যত কমেছে, ততই বেড়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পুরুষতান্ত্রিক, নারী-বিদ্বেষী উপাদান। যা থেকে ‘মহান’ কবি-সাহিত্যিকরাও বাইরে ছিলেন না।

যে শিল্প-সাহিত্য সমাজের মানুষের কথা বলে না; মানুষের মনকে জাগিয়ে তোলে না; লড়াইয়ে সামিল করে না; সে সাহিত্য কার্যত গণবিচ্ছিন্নতাই টেনে আনে। সেই অবস্থান থেকে বিচার করলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ সাহিত্যই আত্মকেন্দ্রিক, গণবিচ্ছিন্ন সাহিত্য। যে কারণে আকিমুন রহমানদের মতো কথাসাহ্যিত্যিক অনেকটা আড়ালেই থেকে যান।

‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস নয়; কিন্তু এর বাইরেও নয়। নারীর যন্ত্রণা, সমাজের কলুষতা, পুরুষের আধিপত্যের কথা স্পষ্টভাবে চিত্রিত রয়েছে; সামাজিক-পারিবারিক জীবনকে উপজীব্য করা হয়েছে। আর তা রাজনৈতিকতার বাইরে নয় মোটেও।

উপন্যাস বলতে যে বিষয়টি আমরা আজকাল বুঝে থাকি, ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেই তার গোড়াপত্তন। এ নিয়ে তেমন মতভেদ নেই। কাহিনি গঠন, বিন্যাস, চরিত্রায়ন, বিষয়ভাবনা, এর উপযোগী ভাষা ও পরিবেশ— সব মিলিয়ে বাস্তবতার সঙ্গে একটি গভীর সখ্য বজায় রাখা। আলোচিত উপন্যাসটিতে এ বিষয়গুলোর কোনো ঘাটতি নেই। বাস্তবতা বহির্ভূত কোনো অতিরঞ্জিত কথন নেই।

এ ভূখণ্ডে, বিশেষত এ সময়ে রচিত বেশিরভাগ উপন্যাসেই নারী চরিত্রকে ‘আগুন সুন্দরী’ উপাধি দেওয়া হয়। এই গদগদ ভাবকে টক্কর দিয়েছেন আকিমুন রহমান। তিনি মূল চরিত্র শামীমাকে তুলে ধরেছেন, দাঁত উঁচু, সমাজের চোখে ‘অসুন্দর’ এক নারী হিসেবে। এটিই বাস্তব চিত্র! উপন্যাসের নারীদের ‘অপ্সরা’ বানানোর ট্রেন্ড ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছেন এ বইয়ের রচয়িতা।

জমজ দুই ছেলেকে শামীমার বাবা নিজে পড়ান, পড়াশুনা যাতে আরও ভালো হয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়; কিন্তু শামীমার কোনো ঠাঁই নেই। শিক্ষকের নোংরা হাত, পরিবারের অবজ্ঞা, সমাজের নিন্দা শামীমাকে ধ্বংস করে দিতে চায়; কিন্তু শামীমা জ্বলে ওঠে। সে চাকরি শুরু করে। নতুন চাকরি। নতুন জীবন। কত স্বপ্ন। কত ব্যথা লুকোনোর বৃথা চেষ্টা; কিন্তু যেখানে পুরো সমাজব্যবস্থা ব্যথায় কাঁতরায়, সেখানে একা শামীমা কতটা মুক্ত হতে পারে! এখানেই চলে আসে সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্ন, সেখানে শামীমাদের দায়িত্ব যেন উপন্যাসটি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

চাকরি জীবনের যুদ্ধটা যেন আরও কঠিন। দুর্গম পাহাড় তাও পেরুনো যায়; কিন্তু এ পথ যেন পেরুনো যায় না! শামীমা প্রেমে মগ্ন। চরমমাত্রার পুরুষতান্ত্রিক একটি সমাজে নারীর প্রেম, আবেগ, ভালোবাসার মূল্যায়ন হয় শরীরের ভিত্তিতে। শরীরটাই মুখ্য, শরীরের গঠন বৈশিষ্ট্য অনেকসময় গৌণ হয়ে ওঠে।

প্রেমিক ডেন্টিস্ট। নাম তার মনিরুজ্জামান। প্রেম মানে শরীরের গন্ধ খোঁজা। কোনো সুবাসিত গন্ধ, একে আড়াল করতে পারে না। একে-অপরের সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা খুবই স্বাভাবিক। তবে এটি স্বাভাবিকতা হারায়, যখন তা শরীরসর্বস্ব হয়ে উঠে। তখন ‘মনুষ্যত্ববোধ’ হেরে যায়। মনিরুজ্জামানও ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারেনি। শামীমার শরীর ভোগ করাই তার কাছে এ সম্পর্কের মূলকথা।

শামীমা জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। একজন নারীর জন্য এর চেয়ে সুখের কোনো খবর থাকতে পারে না; কিন্তু শামীমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। বহু প্রতীক্ষিত পথ, বহু আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর থাকে একজন নারী অনাগত সন্তানের অপেক্ষায়; কিন্তু পুরুষটি যদি সে সন্তানটির দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে, সে কষ্ট-দুঃখ-রাগের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না!

শামীমার প্রেগন্যান্সির খবরটি তার প্রেমিকের কাছে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। শামীমা বারবার যায় তাকে বোঝাতে। মনিরুজ্জামান তার ভেতরের কদাকার চেহারা সামনে তুলে ধরে। শামীমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, আঘাত করার জন্য তাকে ধর্ষণ করে। উপন্যাস থেকে তুলে ধরছি, “…‘গোলমাল তো তুই বান্দাইছস’ বলতে বলতে সে আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। হেঁচকা টানে সে আমাকে চেয়ার থেকে টেনে নেয়। দড়াম করে ফেলে দেয় কার্পেটে। তার মুখ আমাকে কামড়াতে শুরু করে। একটি তীক্ষ্ণমুখ মাংসদণ্ড আমাকে বিদ্ধ করে ঝলসাতে থাকে। দুটি হাত মুচড়ে মুচড়ে থেতলে দিতে থাকে আমার শরীর। ‘আবার আসছস ক্যান তুই?’ আমারে ঝামেলায় ফালাইয়া জিততে চাস? ঝামেলা বাড়াইতে আমি না নিষেধ করতেছি তোরে, বোঝছ না? শুনতাছস না ক্যান?’ ধাপ ধাপ করে আমাকে পাড় দিতে থাকে এক ভোঁতা ভারী দুরমুশ। ‘তরে সাইজ কইরা দিতেছি। মনে রাখবি আবার আসলে তরে জানে বাঁইচ্যা ফিরতে দিব না।’ আমার স্তন আঁচড়ে আঁচড়ে দগদগে হয়ে ওঠে। আমার চোখ আমার বারণ না মেনে দরদরাতে থাকে। আমার ভেতরে শক্ত কঠিন হয়ে ঘাড় উঁচোয় আর এক আমি। আমি আমাকে দুই উরুর পেষণ থেকে মুক্ত করার জন্যে পথ খুঁজতে থাকি। পথ কোথায়, নখ বসে ছঁড়ে যাওয়া আমার গাল জ্বলতে থাকে, আমার শরীর অন্ধকারে ডুবে যায়, আমাকে জানান না দিয়ে। প্রবল ধাক্কায় আমি সম্বিৎ ফিরে পাই।…’

আমি কাঁদছি। আমার লেখাটা কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। আমি আর পারছি না। সরি, সরি; আই অ্যাম রিয়েলি সরি— নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণেই হয়তো ‘সরি’!

নারীর বাস্তবতা গভীরভাবে ধারণ করলেই কেবল এভাবে শামীমাদের তুলে ধরা যায়। শামীমাদের জীবনে সুখের ছোঁয়া থাকতে নেই। এ সমাজে তাদের জন্মই যেন আজন্ম পাপ! আর এই আজন্ম পাপকে ঝেটিয়ে বিদায় করার জন্য, সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়, সুন্দর, ঝকঝকে পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য দৃঢ়ভাবে লড়াইয়ে সামিল হতে হয়। শামীমারা কী পারবে সেই লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে?

নারীর বাস্তবতা গভীরভাবে ধারণ করলেই কেবল এভাবে শামীমাদের তুলে ধরা যায়। শামীমাদের জীবনে সুখের ছোঁয়া থাকতে নেই। এ সমাজে তাদের জন্মই যেন আজন্ম পাপ! আর এই আজন্ম পাপকে ঝেটিয়ে বিদায় করার জন্য, সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়, সুন্দর, ঝকঝকে পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য দৃঢ়ভাবে লড়াইয়ে সামিল হতে হয়। শামীমারা কী পারবে সেই লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে?

প্রেমিকের অনাগত সন্তান গর্ভে ধারণ করা এবং পরিচয়হীনতার কারণে অ্যাবরশন করে আর কত দায়মুক্তি? আর কত কাঁদবে শামীমা? নাহ! এবার শামীমাদের দায় নিয়ে, ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকার শপথ নিতে হবে।

আর এরকম একটি উপন্যাস নিয়ে এতদিনেও কেন বৃহৎ পরিসরে আলোচনা হয়নি— এ থেকেও বোঝা যায়, আমাদের সাহিত্যের বাস্তবতা কোন পর্যায়ে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

তাঁর জন্ম টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। সবুজের মাঝে বেড়ে ওঠা এই লেখক ভালোবাসেন প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের গল্প বলতে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রকাশনাশিল্পে। তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে সাহিত্য ও বই আলোচনা এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে থাকেন। ইতিমধ্যে যৌথ সম্পাদনায় তাঁর পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।