ক্যাতাভিৎসে : পোল্যান্ডের শিল্পশহর
শাকুর মজিদ
দক্ষিণ পোল্যান্ডের বাণিজ্যিক শহর এই ক্যাতাভিৎসে। সব মিলিয়ে প্রায় বিশ লাখের মতো মানুষের বাস এই শহরে। কয়লা খনির জন্য এই এলাকা বিখ্যাত। শহরের উপকন্ঠে পাহাড়ি এলাকায় মূলত কয়লা খনিগুলো।
ত্রয়োদশ শতকে পোল্যান্ডের একটি সমৃদ্ধশালী গ্রাম ছিল এই ক্যাতাভিৎসে। কৃষি খামার এবং কয়েকটি কলকারখানার জন্য এই গ্রামটির সুনাম ছিল। অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে এক জার্মান ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এই এলাকায় এসে বেশ কয়েকটি শিল্পকলকারখানা গড়ে তোলেন। এরপর উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ক্যাতাভিৎসে হয়ে ওঠে পোল্যান্ডের অন্যতম শিল্প শহর। ১৮৮৫ সালে এটি শহরের মর্যাদা পায়। এই এলাকায় জার্মানদের বসবাসই বেশি। সে কারণে এই শহরটাতেও জার্মানের শহরের একটা ছায়া আছে।
রাস্তার সড়ক দ্বীপের ওপরে একটি স্মৃতিসৌধ। সেলসিয়ান ইনসার্জেন্ট স্মৃতিসৌধ। পোল্যান্ডের সব থেকে বড়ো স্মৃতিসৌধ এটি। স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় আছে এই স্মৃতিসৌধটিতে। ভূমি থেকে একটি উঁচু বেদীর ওপরে স্থাপিত। স্মৃতিসৌধটি তিনটি পাখির পাখার সমষ্টি। এই তিনটি পাখা সেলসিয়ানের তিনটি পুনর্জাগরণকে নির্দেশ করছে।
রাস্তার সড়ক দ্বীপের ওপরে একটি স্মৃতিসৌধ। সেলসিয়ান ইনসার্জেন্ট স্মৃতিসৌধ। পোল্যান্ডের সব থেকে বড়ো স্মৃতিসৌধ এটি। স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় আছে এই স্মৃতিসৌধটিতে। ভূমি থেকে একটি উঁচু বেদীর ওপরে স্থাপিত। স্মৃতিসৌধটি তিনটি পাখির পাখার সমষ্টি। এই তিনটি পাখা সেলসিয়ানের তিনটি পুনর্জাগরণকে নির্দেশ করছে। আর এই পাখা তিনটিতে যে পালকগুলো আছে সেগুলো তিনটি পুনর্জাগরণের সময় সে সমস্ত এলাকার যুদ্ধগুলো সংগঠিত হয়েছিল সে জায়গাগুলোর নাম।
শহরটি খুব একটা বড়ো নয়। অল্পসময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই তার অফিসে।
দরজায় সাইনবোর্ড, বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেলের অফিস। তিনি ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক। সাজানো গোছানো অফিস কক্ষ। পোল্যান্ড আর বাংলাদেশর পতাকা পাশাপাশি দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়।
কুমিল্লায় জন্ম গ্রহণ করা এই মানুষটি কেমন করে পোল্যান্ডের কনসাল জেনারেল হলেন তার গল্প শুনি।
—বাংলাদেশ থেকে একজন সরকারী কর্মকর্তা আসেন। আমার সাথে কথা হয়। তিনি আমাকে বলেন আমরা শুনেছি কোনো পোর্টফোলিও ছাড়াই আপনি পোল্যন্ডে বসে বাংলাদেশের জন্য অনেক কাজ করছেন। আমরা আপনার কাজের একটা স্বীকৃতি দিতে চাই। আপনি একটা দরখাস্ত করেন। আমাদের একজন অনারারী কনসাল জেনারেল দরকার। আমি যে শহরে আছি, সে শহর পোল্যান্ডের রাজধানী শহর থেকে ২৮০ কিলোমিটার দুরে হলেও ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এ শহর। সে কারণে পোলিশ নেতানেত্রী এবং আমলাদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তারা আমাদের যেকোনো সমস্যায়, বিপদে আপদে ইতিবাচক সাড়া দেয়। পোল্যান্ডে শ্রমবাজার বিকশিত হচ্ছে। এ শ্রম বাজারকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। পোল্যান্ডের শ্রমিকরা চলে যাচ্ছে ইউরোপের অন্যান্য দেশে। এখানে ভ্যাকেন্সি তৈরি হচ্ছে, এ ভ্যাকান্ট জায়গাটা ধরার চেষ্ট করছি।
বাংলাদেশ থেকে যেকোনো লোক যদি আমাকে ই-মেইল করে অথবা ফোন করে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব। অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পোল্যান্ড সফর করে না। ১৯৯২ সালে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল পোল্যান্ড সফর করেছিল। গত বছর ২০০৯ সালে উপদেষ্টা পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল পোল্যান্ড সফর কেরেছিল। পোল্যান্ড জনসংখ্যার হিসেবে বেশ বড়ো একটা দেশ। শেষ মুহূর্তে যে চৌদ্দটা দেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ঢুকেছে তার মধ্যে পোল্যান্ডের জনসংখ্যা সবথেকে বেশি। এখানে অনেক সুযোগ আছে বাংলাদেশের জন্য।
পোল্যান্ড জনসংখ্যার হিসেবে বেশ বড়ো একটা দেশ। শেষ মুহূর্তে যে চৌদ্দটা দেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ঢুকেছে তার মধ্যে পোল্যান্ডের জনসংখ্যা সবথেকে বেশি। এখানে অনেক সুযোগ আছে বাংলাদেশের জন্য।
ইউরোপের অর্থনীতিতে পোল্যান্ড এখন তেমন দাপট না খাটাতেও পারলেও খুব তাড়াতাড়ি পোল্যান্ড উঠে আসছে ওপরের দিকে। এ রকম একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি উৎযাপন করেছেন ওয়ারশোতে বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই। এছাড়াও পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসসহ প্রতিটি জাতীয় দিবসই পোল্যান্ডে পালিত হয় যথাযথ মর্যাদার সাথে। আর এসবের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি এই মানুষটি।
ক্রমবর্ধমান পোল্যান্ডের শ্রমবাজারে যাতে বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রবেশ করতে পারে তার জন্য এই মানুষটি বেশ তৎপর। কেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা এখনও পোল্যান্ডের শ্রম বাজার ধরতে পারছে না তার ব্যাখ্যা তার মুখ থেকেই শুনি।
—বাংলাদেশি শ্রমিকরা সব পোল্যান্ডে আসছে কিন্তু কিছুদিন থেকেই তারা অবৈধভাবে পাড়ি জমাচ্ছে ইতালী অথবা অন্যকোন দেশে। ফলে এদেশীয়রা বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপরে বিশ্বাস রাখতে পারছে না।
—অন্য আরেকটা কারণ পোল্যান্ডের রিক্রুটিং এজেন্টরা সরাসরি যোগাযোগ করছে বাংলাদেশি এজেন্টদের সাথে। বাংলাদেশি এজেন্টরা সেখানে কিছু অনিয়ম করছে। তারা যে ধরনের লোক দরকার সে ধরনের লোক আনছে না। সে ক্ষেত্রে পোল্যন্ডের এজেন্টরা হতাশ হচ্ছেন। যদি পোল্যন্ডের এজেন্টরা সরাসরি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন তাহলে আমরা ভালোমতো সোর্সিং করে যোগ্য শ্রমিকদের এখানে আনতে পারি।
তাঁকে প্রশ্ন করি, আচ্ছা বলুন তো এই দুই দেশের মধ্যে কী সম্পর্ক আপনি তৈরি করতে চান?
ওমর ভাই কিছুক্ষণ ভাবেন। তারপর খুব সংক্ষেপে বলেন, আমি চাই বাংলাদেশিরা যেন পোল্যান্ড বলতে হল্যান্ড না শোনে, আর পোলিশরা বাংলাদেশ বলতে ইন্ডিয়া না বোঝে।
আমাদের আলোচনা প্রায় শেষ হয়ে আসে। আমরা তাঁর অফিস থেকে নেমে আসি। তিনি আমাকে নিয়ে আরেকটা জঙ্গলের মতো জায়গার সামনে চলে আসেন। জায়গাটা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। কয়েকটি উচুঁ গাছ আছে এখানে, আছে একটা খোলা মাঠও। তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন, এ জায়গাটিকে বাংলাদেশ চত্বর বানানো।
প্সেমশা নদীর তীরে বেশ বড়োসড় খোলামেলা জায়গাই হবে বাংলাদেশ চত্বর। এখানে থাকবে বাংলাদেশের সৌধ, স্থাপনা আর ভাস্কর্য, বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য পার্ক। বড়োদের বসারও ব্যবস্থা থাকবে। পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য থাকবে খাওয়ার ব্যবস্থা।
তার এই স্বপ্ন সফল হলে পূর্ব ইউরোপের এই ছোট্ট শিল্প নগরীতে গড়ে উঠবে আরেকটা ছোট্ট বাংলাদেশ।
এই মানুষটি পোল্যান্ডে কেমন আছেন দেখতে ইচ্ছে করে। ক্যাতাভিৎসে শহরের খুব কাছেই তিনি বসবাস করেন। পোল্যান্ডের শেষ বিকেলটা আমরা তার বাড়িতেই কাটাব।
পঞ্চপর্যটককে ফেয়ারওয়েল দেবার জন্য পোলান্ডের অনারারি কনসাল জেনারেল তাঁর বাসার বাগানে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছেন। মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সারি নামক একটা গ্রাম। ঢুকেই বোঝা গেল, বেশ অভিজাত এই আবাসিক এলাকাটি।
ক্যাতাভিৎসের শেষ বিকেল আজ শেষ হচ্ছে পোল্যান্ডের ১২ দিনের সফর। আজ রাতে আমরা ভিয়েনার উদ্দেশ্যে পোল্যান্ড ছাড়ব। কাল সকালে যাব পৃথিবীর মঞ্চ বলে কথিত প্রকৃতির অপরূপ শোভার শহর মোজার্টের সালসবুর্গ। পঞ্চপর্যটককে ফেয়ারওয়েল দেবার জন্য পোলান্ডের অনারারি কনসাল জেনারেল তাঁর বাসার বাগানে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছেন। মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সারি নামক একটা গ্রাম। ঢুকেই বোঝা গেল, বেশ অভিজাত এই আবাসিক এলাকাটি।
দুপাশে সারি সারি ডুপ্লেক্স রো হাউজিং। এখানেই বেশ বড়োসড় একটা জায়গা, প্রায় ২ বিঘার মতো জমি নিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়িটিতেই থাকেন পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল ওমর ফারুক। একজন বাংলাদেশি বিদেশের একটা অভিজাত আবাসিক এলাকায় সবচেয়ে বড়ো প্লটটিতে বাসা বানিয়ে থাকেন, এটা কিন্তু কম অহংকারের বিষয় নয়।
বাড়িটির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ খালি জায়গা। অনায়াসে একটা ভলিবল ও একটা বাস্কেটবল কোর্ট হয় তার বাড়ির পেছন দিকের উঠানে। কিন্তু ওখানে লাগানো আছে নানা জাতের ফুলের গাছ, তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ের ভূমিরুপ, কৃত্রিম ঝরনা।
তারই এক কোণে পোড়ানো হচ্ছে স্যালমনসহ কয়েক পদের মাছ, মাংশ। সাথে নানা রকমের সালাদ। রুটি। বুঝে যাই, আজ ভাত নাই আমাদের কপালে। ক্ষতি নাই, ওমর ভাইর এই শহরে আসার পর ভাত-মাছ-মাংসের অভাব আমাদের ঘুচে গিয়েছিল আগেই। সে সব জেনেই হয়তো আজ এই বাঙালিদেরকে দিয়ে ইউরোপিয় গ্রিলের আস্বাদন দেওয়ার চেষ্টা তাঁর।
আড্ডা জমে যায় মুহূর্তের মধ্যেই। এর মাঝেই এসে যোগ দেন তাঁর পোলিশ স্ত্রী ও দুই কন্যাও। তাঁর স্ত্রীর সাথে আমাদের খুব বেশি কথা হয় না। তিনি ইংরেজি কম জানেন। বাংলা কয়েকটি শব্দ জানেন, ‘সালামালাইকুম, কেমন আছেন, আবার আসবেন, ধন্যবাদ’ এই কয়টি শব্দ শোনা হয়েছে তাঁর কাছ থেকে। ওমর ভাইর কন্যা যুগল খুবই মিশুক প্রকৃতির। মিনিট পাঁচেকের মাথায় তারা একেবারেই আপন ভাতিজিদের মতো আচরণ করতে শুরু করে। আমাদের আড্ডার এক ফাঁকে ওমর ভাইয়ের নস্টালজিক স্মৃতিচারণও আমাদের আনন্দ দেয়।
স্বপ্নবাজ এই মানুষটি ১৯৮৩ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে বুয়েটে ভর্তি হতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েন। পরে তিনি বাংলাদেশ সেভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী বৃত্তিতে আবেদন করেন। সে আবেদনে আশানুরুপ সাড়া পেয়ে তিনি পাড়ি জমান মস্কো।
অনেকটা খালি হাতেই ছিল তার সোভিয়েত গমন। একব্যাগ ব্যবহারিক কাপড়-চোপড় আর ৫০ ডলার মুদ্রা পকেটে নিয়ে পাড়ি জমান মস্কো।
তারপর পাড়ি দিয়েছেনে দীর্ঘ পথ। সিভিল ইঞ্জিয়ারিং পড়ার সময়ে দুই মাস গ্রীষ্মের ছুটি পেতেন। সে সময় কাজ করা শুরু করেন। কাজের জন্য কয়েকবার লন্ডন গিয়েছিলেন। লন্ডনের সিলেটি রেস্টুরেন্ট মালিকরা তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। কেউ কেউ তাঁকে স্থায়ীভাবে লন্ডনে থেকে যাওয়ারও পরামর্শ দিতেন নানা প্রলোভনও দেখাতেন। কিন্তু থাকা হয়নি। ছুটি শেষে কিছু পাউন্ড কামিয়ে আবার চলে এসেছেন মস্কোতে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিলোপ হয়, তখন তিনি কম্পিউটার ব্যবসা শুরু করেন। এটার জন্য তার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। অনেকটা এডভেঞ্চার প্রিয় হয়েই প্রথমে সিঙ্গাপুর থেকে কিছু কম্পিউটার নিয়ে আসেন মস্কোতে। পরে দেখা গেল, এতে মোটামুটি লাভও হয়। আরও কয়েকবার মস্কো-সিঙ্গাপুর করে করে বেশ কিছু কম্পিউটারের আমদানি ঘটান তিনি রাশিয়াতে। এর মাঝেই তিনি লেখাপড়া শেষ করেন। ফল ভালো করার কারণে তিনি পিএইচডি করারও সুযোগ পান। পড়াশুনা এবং ব্যবসা একই সাথে চালাতে থাকেন।
এর মাঝেই ১৯৯১ সালে এক পোলিশ মেয়েকে বিয়ে করেন। প্রথম সন্তান নাদিয়ার জন্মলগ্নের সময় বসতি গড়তে হয় পোল্যান্ডে। পোল্যান্ড তার জন্য নতুন জায়গা। অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় জমানো পয়সা। তখন নতুন করে চিন্তা পেয়ে বসে, এখানে কিছু করতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই বাংলাদেশের সাথে ব্যবসার চিন্তা মাথায় আসে এবং কিছু নিকট আত্মীয়ের সহায়তায় বাংলাদেশের সাথে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন।
মস্কোর প্রতিষ্ঠিত আরামের জীবন ছেড়ে এসে প্রায় খালি হাতেই পোল্যান্ডে নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে প্রথমে বেগ পেতে হয়েছিল। মস্কোতে যেখানে নিজের গাড়ি, রাশান ড্রাইভার, সেখানে পোল্যান্ডে বাসে ট্রামে চলা ফেরা। প্রথম জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন তিনি। নিজের একনিষ্ঠ শ্রম আর মেধার কারণে অল্পসময়ে তিনি পোল্যান্ডে গার্মেন্টস ব্যবসা জমিয়ে ফেলেন। পোল্যান্ড সে সময়ে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে ধনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে। আর এই ট্রানজিশনাল পিরিয়ডটি তার পক্ষে যায়।
গার্মেন্টস ব্যবসায় থিতু হবার পর তিনি তার চিন্তাকে বিভিন্ন দিকে বিস্তার করতে থাকেন। সে কারণেই তিনি সসনোভিচ শহরে প্রথম বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। এটিই পোল্যান্ডে প্রথম কোনো বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রেস্টুরেন্টটির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
গার্মেন্টস ব্যবসায় থিতু হবার পর তিনি তার চিন্তাকে বিভিন্ন দিকে বিস্তার করতে থাকেন। সে কারণেই তিনি সসনোভিচ শহরে প্রথম বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। এটিই পোল্যান্ডে প্রথম কোনো বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রেস্টুরেন্টটির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আশেপাশের কয়েকটি শহরেও রেস্টুরেন্ট খুলে বসেন। এক সময় তিনটি রেস্টুরেন্ট নিয়ে চেইন রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন।
গার্মেন্টস ব্যবসা এবং পাশাপাশি তিনটি চেইন রেস্টুরেন্ট চালানো তার পক্ষে আর সম্ভবপর হচ্ছিল না, সে কারণে তিনি একটি রেস্টুরেস্ট রেখে বাকি রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেন।
একটা সময় ছিল, খারাপ সময়, সে সময় তার নিজের দিকে তাকানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। নিজেকে নিয়েই থেকেছেন, ভেবেছেন। এখন তার চিন্তা এবং চেতনায় আরও অনেক অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। নিজের বাইরে বাংলাদেশ নিয়ে তার সফল চিন্তা। এটা যেহেতু তাঁর জন্য সত্য যে, এই পোল্যান্ড ছেড়ে একেবারেই তার পক্ষে বাংলাদেশে ফেরত গিয়ে স্থায়ী হওয়া সম্ভব হবে না, সুতরাং ঐ পোল্যান্ডেই তিনি বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশিদের জন্য অবস্থান তৈরি করতে চান। যাতে যেখানে তিনি থাকেন, তার পারিপার্শ্বিকদের কাছে তিনি এবং অন্য বাংলাদেশি বংশোৎভূত হিসেবে অহংকারের সাথে মাথা উচিঁয়ে থাকতে পারেন।
বাংলাদেশিদের নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা। পুরো পোল্যান্ডে মাত্র ৫০০ বাংলাদেশির অবস্থান। তার শহর ক্যাতাভিৎসে আর সসনাভিতসেতে খুব বেশি বাঙালি নাই। যে ক’জন আছেন অধিকাংশই রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন কিংবা রেস্টুরেন্টর ব্যবসার সাথে জড়িত।
বিগত ২ বছর যাবৎ তার শহরে পহেলা বৈশাখ পালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে তার কন্যারা তাঁকে সহযোগিতা করছেন বেশি। তারা যেহেতু স্কুলে যায়, তাদের অসংখ্য বন্ধু বান্ধবীদেরকে দিয়ে, শাড়ি পরিয়ে, খোপায় ফুল দিয়ে, রবীন্দনাথের গানের তালে তালে নেচে গেয়ে তাঁরা বৈশাখ বরণ করেন। ২৬শে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনাগুলো স্মরণ করান, এটা কম কথা নয়।
আমাদের বিদায়ের সময় হয়ে যায়। তার বাড়ি ছেড়ে আমরা যাব আমাদের এপার্টমেন্টে, সেখান থেকে রেল স্টেশন।
নাদিয়া আমাদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে। চাচু, আবার কবে আসবে তোমরা? বলি তুমি বাংলাদেশ যাও?
—কয়েবার গিয়েছি।
—বাংলাদেশ কেমন
—খুব সুন্দর দেশ।
—পোল্যান্ডের চেয়েও?
—না, দু’দেশের সৌন্দর্য, দুই রকম।
—বাংলাদেশে কী তোমার ভালো লাগে?
—বাংলাদেশের মানুষেরা খুব আন্তরিক
—বাংলাদেশের কী কী জিনিস তুমি দেখেছ?
—ঢাকা দেখেছি, পার্লামেন্ট হাউজ, কুমিল্লা, আমার বাবার শহর, ওটা খুব ইতিহাস সমৃদ্ধ একটা জায়গা। কুমিল্লার ময়নামতিতে যা ছিল, পোল্যান্ডের কোথাও ওরকম কিছু নাই।
—আর কী দেখেছ?
—বাবার ক্যাডেট কলেজ। ওরকম কিছুও পোল্যান্ডে নাই।
—বাংলাদেশ আর পোল্যান্ড নিয়ে তোমার কী কোনো পরিকল্পনা আছে?
—আছে। আমি আর আমার বাবা মিলে পোলিশ এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে এমন সম্পর্ক তৈরি করে দিতে চাই যে, এই দুই দেশ যেন খুব ভালো বন্ধুর মতো থাকে। যেমন আমার বাবা আর মা।
নাদিয়ার সাথে কথায় পারা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে নাদিয়া। বড়ো হয়ে বাবার ব্যবসা দেখা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া, এ দুটোই তাঁর ইচ্ছা।
পোল্যান্ড সফর শেষ হয়ে যায়। রাত দুটোর ট্রেনে আমরা ভিয়েনার পথে রওয়ানা দিতে উঠে পড়েছি। ৫ দিন আগে যে প্লাটফর্মে ভোর বেলা এসে হাজির হয়েছিলেন ওমর ভাই, সেই প্লাটফর্মে এখন তিনি একা। এক সময় বন্ধ হয় দরোজা। ট্রেন চলতে শুরু করে। কালো ওভারকোর্ট পরা এক যুবকের হাত নাড়ানোর দৃশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
ধারাবাহিকটির অন্য পর্বগুলো পড়ুন :
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০১
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০২
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৩
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৪
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৫
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৬
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৭
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৮
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৯
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-১০
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-১১
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-১২
জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৬৫। তিনি একজন বাংলাদেশি স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক। ভ্রমণকাহিনি ও জীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।