পারস্যসভ্যতা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর একটি। জার্মান দার্শনিক হেগেলের মতে, মানুষের নথিবদ্ধ ইতিহাস শুরু হওয়ার পর পারস্যবাসীই হচ্ছেন প্রথম ‘ঐতিহাসিক’ জাতি। ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহামতি সাইরাস (Cyrus the Great)-এর হাতে প্রতিষ্ঠিত আকেমেনিদ সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের প্রথম পরাশক্তি—যা বিস্তৃত ছিল ইউরোপের বলকান উপদ্বীপ থেকে ভারতের সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত। এটিই ছিল বিশ্বের সর্বপ্রথম এবং আজ পর্যন্ত একমাত্র সাম্রাজ্য, বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ যার অধীন ছিল। এরপর প্রায় এক হাজার বছর ধরে সেলুসিড, পার্থিয়ান আর সাসানীয় সাম্রাজ্যের অধীন ছিল ইরান। ইসলামের আবির্ভাবের পর কয়েকশো বছর ধরে শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞানে ইরানিয়দের অবদান ছিল ঈর্ষণীয়। সেলজুক তুর্কি আর মোঙ্গলদের দ্বারা বিজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েকটি মুসলিম রাজবংশ ইরান শাসন করে। পঞ্চদশ শতকে উত্থান ঘটে সাফাভিদ বংশীয়দের—আর তখন থেকেই সুন্নিদের হটিয়ে শিয়া মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় দেশটিতে। উল্লেখ্য, ‘পারসিয়া’ নামটি সমগ্র ইরানকে বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও বস্তুত নামটি এসেছে দক্ষিণ ইরানের নির্দিষ্ট একটি অংশ, যা গ্রিকদের কাছে ‘পারসিস’ এবং পরে ‘ফার্স’ নামে পরিচিত ছিল। এটি থেকেই পরে সমগ্র ইরানের নামই হয়ে যায় পারসিয়া। পরবর্তীতে বিংশ শতকের শুরুতে রেজা শাহ পাহলভির উদ্যোগে দেশটি ‘ইরান’ নামে পরিচিত হতে শুরু করে। বর্তমানে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে পারস্য আর ইরান দুটো নামই প্রচলিত হলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একচ্ছত্রভাবে ব্যবহৃত হয় কেবল ইরান নামটিই।
ইরানি লিপির সর্বপ্রাচীন যে নিদর্শন পাওয়া গেছে সেটি রাজা প্রথম দারিয়ুসের সময়কার, আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের এই নৃপতি ৫২২ থেকে ৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ইরানের কারমেনশাহ প্রদেশের জাগরোস পর্বতের পাদদেশে প্রাপ্ত এই শিলালিপি তিনটি ভাষায় লেখা : ব্যাবিলনিয়, প্রাচীন ফার্সি ও এলামাইট। পারস্যের সর্বপ্রাচীন পুস্তক আভেস্তা, যাতে বিধৃত হয়েছে পার্সি ধর্মের প্রবর্তক জরথস্ত্রুর নানা বাণী। এটি লেখা হয়েছে আভেস্তি নামের প্রাচীন এক ভাষায়। পাঁচটি অংশে বিভক্ত এই পুস্তক নানা সময়ে নানা স্থানে লিখিত হয়েছে। ইরানের প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় আকেমেনিদ রাজাদের রাজধানী এস্তাখারে। ৩৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সম্রাট আলেকজান্ডারের বাহিনীর হাতে শহরটির পতন ঘটার পর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় গ্রন্থাগারটি। যাই হোক, আলেকজান্ডারের নির্দেশে ধ্বংসস্তুপ থেকে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বইগুলো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রিসে, সেখানে ওগুলোকে অনুবাদ করে মূল কপিগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়। এরপর থেকে গ্রিক প্রভাবে ইরানের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ দীর্ঘদিনের জন্য ব্যাহত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইরানের ইতিহাসে গ্রন্থাগার ধ্বংসের ঘটনাটি প্রায় নিয়মিত বিরতিতে ঘটেছে। এ পরিস্থিতিকে এড়ানোর জন্য অনেক নৃপতি যুদ্ধের আগে গ্রন্থাগারের গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী, বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যার ওপর লেখা বইগুলোকে গ্রন্থাগার ভবনের নিচে মাটিচাপা দিয়ে রাখার আদেশ দিতেন। ৩য় শতক থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত সাসানীয় শাসনামলে ইরানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপক বিকাশ ঘটে। জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ইতিহাস, চিকিৎসাবিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, সংগীতসহ নানা বিষয়ে প্রচুর পরিমাণে বই লিখিত ও অনূদিত হয়। তবে সপ্তম শতকে আরবদের পদানত হবার পর এতে বড়ো ধরনের ছেদ পড়ে। শেষ সাসানীয় সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেগার্দ তার রাজধানী তাইসাফুন ছেড়ে পালানোর পর শহরের অন্যান্য স্থাপনার পাশাপাশি ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় রাজকীয় গ্রন্থাগারেও। ফার্সি ভাষাকে হটিয়ে আরবীকে করা হয় রাজভাষা এবং পরবর্তী দুশো বছর ফার্সি ভাষায় আর কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়নি। তবে মানুষের মুখের কথায় টিকে থাকে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য। ইরানি সাহিত্যের এক ধরনের পুনর্জাগরণ ঘটে সামানীয় আমলে (৮১৯-৯৯৯)।
অনেক নৃপতি যুদ্ধের আগে গ্রন্থাগারের গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী, বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যার ওপর লেখা বইগুলোকে গ্রন্থাগার ভবনের নিচে মাটিচাপা দিয়ে রাখার আদেশ দিতেন। ৩য় শতক থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত সাসানীয় শাসনামলে ইরানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
আরবদের হাত থেকে স্বশাসনের অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে সামানীয়রা ফার্সি ভাষাকে ব্যবহার করে হাতিয়ার হিসেবে। সাহিত্যের ভাষা হিসেবেও গ্রহণীয় হয়ে ওঠে এ ভাষা। এ সময়টাতেই আবির্ভাব ঘটে আজ যাকে আমরা ফার্সি ভাষা বলে চিনি সেটির। এর বর্ণমালা আরবি এবং এটি প্রচুর আরবি শব্দের ব্যবহারও ঘটায়। কবি রুদাকির হাতে ফার্সি গীতিকবিতার পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং লোকপ্রশাসন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও ধর্মীয় নানা বিষয়ে ফার্সি ভাষায় অনেক বই লেখা হতে থাকে। আরবির পর ইসলামি সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ভাষায় রূপলাভ করে ফার্সি। সামানীয় শাসকদের রাজধানী বুখারায় এসে ভিড় জমান অসংখ্য সাহিত্যিক, গবেষক, পণ্ডিত। দ্রুতই ইসলামের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে বাগদাদকে চ্যালেঞ্জ জানানোর অবস্থায় পৌঁছে যায় বুখারা। নিজেদের ঐতিহ্য অনুসারে, সাহিত্যচর্চায় কবিতাকেই প্রধান হাতিয়ার করেন পারস্যদেশীয়রা। বস্তুত পারস্যদেশীয়দের কবিতাপ্রীতি এতই প্রবল যে প্রায় সব ধ্রুপদী ফার্সি রচনাতেই কবিতার ছড়াছড়ি— সেটি সাহিত্য, বিজ্ঞান, অধিবিদ্যা— জ্ঞানের যে শাখাতেই হোক না কেন। পারস্যদেশীয় যেকোনো পণ্ডিতেরই কবিতার ছন্দে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা থাকাটাকে প্রায় বাধ্যতামূলক মনে করা হতো। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে সিনার চিকিৎসাবিষয়ক লেখালেখির প্রায় অর্ধেক কবিতার ছন্দে লেখা। প্রথমদিকের ফার্সি কবিতা ব্যাপকভাবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়, ফলে রাজা-বাদশাহর প্রশস্তিই ছিল এসব কবিতার প্রধানতম উপজীব্য। রাজকীয় আনুকূল্য পাওয়ার এ ধারা ইরানে ইসলামের আগমনের আগে— সম্ভবত সাসানীয় শাসনামলে শুরু হয়। পরবর্তীতে আব্বাসীয় ও সামানীয় থেকে শুরু করে প্রতিটি রাজবংশই সাহিত্যিক, বিশেষ করে কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
ফার্সী কবিতার প্রাচীনতম যেসব নিদর্শন যাওয়া যায় সেটি কয়েক হাজার বছরের পুরনো, বিচ্ছিন্ন এসব কাব্যপ্রচেষ্টা থেকে সে সময়কার ফার্সী সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি পাওয়া যাবে না। সামানীয় আমলেই ফার্সী কবিতার উৎকর্ষের কাল শুরু হয়। সামানীয় শাসক নাসির বিন আহমেদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় চীন থেকে কাস্পিয়ান সাগরের তীর পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অসংখ্য কবির হাতে স্বরূপ ধারণ করতে থাকে পারস্যদেশীয় কবিতা। উন্মেষের প্রথম পর্বে ফার্সী কবিতার প্রধান ভিত্তি ছিল বাস্তববাদ, যা একাদশ শতক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন রুদাকি, শহিদ বলখি আর দাকিকি। দ্বাদশ শতকে এসে প্রকৃতিবাদী ধারার প্রাধান্য দেখা যায়, এবং এর পরপরই সূচনা ঘটে সুফিবাদী ধারার।
ফার্সি কাব্যসাহিত্যের জনক হিসেবে আবু আব্দুল্লাহ জাফর ইবনে মুহাম্মদ আল-রুদাকির নাম মোটামুটিভাবে স্বীকৃত। জন্ম ৮৫৯ সালে খোরাসানের অন্তর্গত রুদাক নামের ছোট এক গ্রামে। সামানীয় শাসক দ্বিতীয় নাসিরের পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্যরচনায় ব্যপৃত হন রুদাকি। মহাকাব্য, গীতিকবিতা, নীতিমূলক কবিতা-কাব্যসাহিত্যের প্রতিটি শাখাতেই বিচরণ ঘটেছে তাঁর। এছাড়াও দিওয়ান নামে কাব্যধারা, যেখানে একজন কবির সব গীতিকবিতা বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো থাকে, তারও প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয় রুদাকিকে। গায়ক এবং বীনাবাদক হিসেবেও খ্যাতি ছিল তাঁর। রাজ অনুগ্রহবঞ্চিত হয়ে শেষ জীবনটা দুঃখ ও দারিদ্র্যে অতিবাহিত করেন রুদাকি। আনুমানিক ৯৪০ খ্রিষ্ট্রাব্দে প্রয়াণ ঘটে তাঁর। এক লক্ষেরও বেশি দ্বিপদী কবিতা (couplet) রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়— যার মধ্যে হাজারখানেক মাত্র এখনও টিকে আছে। রুদাকির একটি কবিতার অংশবিশেষ—
সব তেমনই আছে যেমন হবার কথা ছিল
এই তো সুখ চারদিকে, সুখী হও
কিসের দুঃখ তোমার? কিসের উদ্বেগ?
নিয়তি তোমার জন্য তাই করে যা তাকে করতে হবে—
উজিরের জীবন কেমন তা নিয়ে ভেবে কী লাভ?
নিয়তিই বলে দেবে তোমার ভালো হবে কিসে।
জীবনক্রের ঘূর্ণনে সৃষ্টি হবে না আরেকজন তুমি
তোমার মায়ের গর্ভেও আসবে না আরেকজন তুমি
খোদার দরজা কখনোই বন্ধ হবে না তোমার জন্য—
তার আগে খুলে যাবে আরো সহস্র সুন্দর দরজা।
দশম শতাব্দীর পর মহাকাব্য লেখার একটা প্রচেষ্টা শুরু করেন কোনো কোনো ফার্সি কবি, যাঁদের মধ্যে দাকিকির নাম উল্লেখযোগ্য। জরথস্ত্রুবাদের প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটি মহাকাব্য লিখতে শুরু করেন তিনি, যার সামান্য একটু অংশ এখন পর্যন্ত টিকে আছে। তবে নিঃসন্দেহে এসময়ের এবং সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পারস্য প্রতিভা ফেরদৌসির হাতেই পূর্ণতা পায় ফার্সি ভাষায় মহাকাব্য রচনার প্রয়াস। ফেরদৌসির প্রকৃত নাম ছিল আবুল কাসেম মনসুর বিন হাসান, জন্ম হয়েছিল পারস্যের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে— খোরাসানের তুস শহরের নিকটবর্তী ‘পাজ’ নামের একটি গ্রামে, ৯৪০ খ্রিষ্ট্রাব্দে। ফেরদৌসি হচ্ছে তাঁর কবি নাম, যেটি প্রাচীন একটি ফার্সি শব্দ থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ হচ্ছে ‘স্বর্গীয়’। তাঁর রচিত ‘শাহনামা’ ইরানের শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইরান নামের ভূখণ্ড শাসন করেছেন যেসব নৃপতি এবং তাঁদের যশোগৌরব রক্ষায় যুদ্ধ করেছেন যেসব বীর— তাঁদেরই গল্প শাহনামা। প্রায় ৬০ হাজার দ্বিপদ (couplet)-বিশিষ্ট শাহনামা ইরানের জাতীয় মহাকাব্য, যেটির রচনা শেষ হয় ১০১০ খ্রিষ্ট্রাব্দে। শাহনামা রচনা করতে গিয়ে ধ্রুপদ ফার্সির এমন একটি রূপের গোড়াপত্তন করেছেন যাকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছেন তাঁর উত্তরসুরিরা। পুরাণ, কিংবদন্তী আর ইতিহাসের মিশ্রণে রচিত অমর এই কাব্য কেবল ফার্সি সাহিত্যেরই নয়, বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। মধ্য-ফার্সি বা পাহলভী ভাষায় লিখিত এ মহাকাব্যের পটভূমি কয়েক হাজার বছরের, যার শুরু পৌরাণিক আমলে আর শেষ আরবদের হাতে পারস্যের পদানত হবার মুহূর্তে। দশম শতাব্দীতে পারস্য সভ্যতা এক ধরনের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, ফেরদৌসির হাতে শাহনামা রচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তা এক চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছাল। পারস্য জাতির মূল্যবোধ, আদর্শ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষারই এক শিল্পিত রূপ শাহনামা। নিষ্ঠুরতা, মিথ্যা, ভোগবাসনা আর অন্য সব মানবীয় বিচ্যুতিকে পরিহার করে সত্য, ন্যায়, শৃঙ্খলা আর অন্যান্য গুণের অন্বেষণ করার শিক্ষাই দেয় শাহনামা।
এগারো শতকের মাঝামাঝি আরেক মহান প্রতিভার আলোয় আলোকিত হয় ফার্সি সাহিত্য, যিনি একাধারে গণিতবিদ, চিকিৎসক, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীও ছিলেন। তাঁর নাম গিয়াসুদ্দিন আল-দীন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম খৈয়াম, যদিও ওমর খৈয়াম নামেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত। জন্ম ১০৪৮ সালে, খোরাসানের নিশাপুর শহরে। মৃত্যু ১১৩১ সালে। চতুষ্পদী কবিতা বা ‘রুবাই’ (quatrains) নামে ফার্সি কবিতার জনপ্রিয় যে ধারা, তার বিকাশ ও বিশ্বজোড়া খ্যাতি ওমর খৈয়ামের হাতেই। জন্ম নিশাপুরে হলেও বুখারা ও সমরখন্দেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো অতিবাহিত করেন তিনি। কবি হিসেবে ওমর খৈয়ামের খ্যাতি তাঁর অতুলনীয় রুবাইয়ের জন্য-১৮৩৯ সালে এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড-এর অনুবাদে যা সারাবিশ্বের কাব্যরসিকদের মন জয় করে। কী আছে খৈয়ামের রুবাইয়ে, যেজন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে এগুলো? এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া কঠিন। তবে বাংলা ভাষায় ওমর খৈয়ামের শ্রেষ্ঠতম অনুবাদক কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম’ গ্রন্থের ভূমিকায় যে মন্তব্য করেছেন তা স্মর্তব্য। নজরুলের ভাষায়, ‘আমাদের কাছে, বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান-পুষ্ট কারণ-জিজ্ঞাসু মনের কাছে, ওমরের কবিতা যেন আমাদেরই প্রশ্ন, আমাদেরই প্রাণের কথা।’ ওমরের কবিতা পড়লে মনে হয়, যেন মহাবিশ্বের মহারহস্যের সামনে ওমরের মতো প্রতিভাধর মানুষও বিস্ময়ে বিমুঢ়, এ কারণে যুক্তি আর জিজ্ঞাসাকে একপাশে ছুড়ে ফেলে জীবনকে উপভোগের আনন্দে মেতে থাকতে চান তিনি। “পারস্যপ্রতিভা”খ্যাত মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর অনুবাদে ওমরের এ মনোভাবই জীবন্ত হয়ে উঠেছে—
এ চাঁদ কিরণে মধু লুটো আজ
কালি নিশীতের ভরসা কই
চাঁদনী হাসিবে যুগ যুগ ধরি
আমরা তো আর রব না সই!
ঢালো সুরা আজ পিয়াসা থাকিতে
জীবন অথির পারদ প্রায়;
উঠ সখি এই জাগরণ-যোগে
যৌবন ত্বরা নিভিয়া যায়!
রুবাইয়াতের নিবিড় পাঠ আমাদের কাছে এ সত্যটিকে স্পষ্ট করে দেয় যে, মানব-অস্তিত্বের দুটি মাত্রা-দার্শনিক আর কবি-দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন ওমর। তাঁর কবিতায় সে কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেয়েছে মানুষ, তার ক্লান্ত-জিজ্ঞাসাদীর্ণ মন যা শুনতে চায়। এ কারণেই দেশ-কাল নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে খৈয়াম এত প্রিয়, এত প্রাসঙ্গিক।
এগারো শতকের প্রথম দশকে গজনি ছিল ফার্সি সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র। গজনির সুলতান মাহমুদের (শাসনকাল ৯৯৮-১০৩০) সাংস্কৃতিক নীতির বদৌলতে বিপুলসংখ্যক পণ্ডিত, দার্শনিক আর কবির সম্মিলন ঘটে গজনিতে। এসময়ের নেতৃস্থানীয় কবি ছিলেন উনসুরি, যাঁকে সুলতান ‘রাজকবি’ হিসেবে নিয়োজিত করেন। সুলতানের রাজসভায় কবি হিসেবে যুক্ত হতে চান এরকম যেকোনো উঠতি কবির মেধা ও কাব্যদক্ষতা যাচাইয়ের ক্ষমতা অর্পণ করা হয় উনসুরির ওপর। ইনসুরির কাসিদা শিল্পোৎকর্ষের জন্য নন্দিত ও বহুলজনপ্রিয় ছিল। মাহমুদের রাজসভার অন্যান্য বিখ্যাত কবিদের মধ্যে ছিলেন ফারুকি এবং মানুচেহরি। সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষে একের পর এক যেসব অভিযান চালিয়েছিলেন তাঁর সভাকবিদের দায়িত্ব ছিল সেগুলোর প্রশংসা করে কাব্যরচনা। এ সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল একজন কবি মাসুদ সা’দ সালমান। উচ্চপদস্থ একজন রাজকর্মচারি ছিলেন তিনি, কিন্তু রাজানুগ্রহ বঞ্চিত হয়ে দীর্ঘ সময় তাঁকে বন্দি অবস্থায় কাটাতে হয় বিভিন্ন দুর্গে। বন্দি অবস্থায় নিজের দুরবস্থার বর্ণনা করে গজনির সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একাধিক কাব্য রচনা করেন এবং বন্দিজীবনে লেখা কবিতার নতুন একটি ধারাই প্রতিষ্ঠা করেন। গজনির শাসকেরা কবি সাহিত্যিদের পৃষ্ঠপোষকতার যে ধারা তৈরি করেন একাদশ ও দ্বাদশ শতকের তুর্কি শাসকেরা তা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন সেলজুক সুলতানেরা। প্রথমে ইরানের ইস্পাহান এবং পরবর্তীতে খোরাসানের নিকটবর্তী মার্ভ শহরে ছিল তাঁদের সালতানাতের কেন্দ্র। সুলতানের প্রশস্তি করে রচিত কাসিদার অসাধারণ রচয়িতা ছিলেন দুজন কবি-মুঈজি এবং আনভারি, দ্বাদশ শতকের প্রথমার্ধে যাঁদের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরা ও তাঁদের সমকালীন কবিরা কাব্যরচনায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন, ফলে পারস্য কবিতার প্রথম পর্যায়ের কবিদের প্রবর্তিত তুলনামূলক সহজ শৈলী (যা ‘খোরাসানি স্টাইল হিসেবে পরিচিত ছিল)-র পরিবর্তে আগমন ঘটল নতুন শৈলীর, যেটি পরিচিত হলো ‘ইরাকি স্টাইল’ হিসেবে। এসব ভৌগোলিক পদের ব্যবহার থেকে ইরানের শিল্পসংস্কৃতির কেন্দ্রের পশ্চিমমুখী যাত্রার একটা আভাস পাওয়া যায়-যার অন্যতম কারণ ছিল দ্বাদশ শতকে সেলজুক তুর্কি শাসকদের প্রতিপত্তি কমে যাওয়া। দেশের নানা অঞ্চলে ছোট ছোট রাজ্যের উদ্ভব ঘটে, এগুলোর অধিকাংশেরই মসনদে আসীন হন সেলজুক তুর্কিদেরই অধীনস্থ শাসকেরা। ক্ষমতাকেন্দ্র এভাবে নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে শাসকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফার্সি কাব্যসাহিত্যের উপকারই হয়-কবিরা নানা শাসকের উদার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি প্রতিভাবান দুজন ফার্সি কবির আবিভাব ঘটে, এঁরা হচ্ছেন খাকানি ও নিজামি। খাকানির কাসিদায় উপমা ও রূপকের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। রাজপ্রশস্তির পাশাপাশি ধর্ম ও নৈতিকতার মতো বিষয়গুলোও তাঁর কবিতায় উঠে আসে। অন্যদিকে পশ্চিম ইরানের বাসিন্দা নিজামির কবিতা শৈলীবিচারে খাকানির অনুরূপ হলেও খ্যাতিতে তিনি খাকানিকে ছাড়িয়ে যান। ‘খামেশ’ নামে তাঁর পাঁচটি ‘মসনভি’ (অন্ত্যমিলবিশিষ্ট দ্বিপদী কবিতার সংগ্রহ) তাঁকে অমর করে রেখেছে। এর মধ্যে প্রথমটি (মাখজান আল-আসরার) শিক্ষামূলক, আর বাকি চারটির মূল উপজীব্য প্রেম। নিজামির সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি কবিতা দুজন সাসানিয় নৃপতিকে ঘিরে রচিত। প্রথমটি (খসরু ওয়া শিরিন) হচ্ছে সম্রাট দ্বিতীয় খসরু এবং শিরিন নামে এক আর্মেনিয় রাজকুমারির প্রণয়গাঁথা। আর দ্বিতীয়টির (হাফ্ত পাইকার) উপজীব্য হচ্ছে সম্রাট পঞ্চম বাহরামকে তাঁর সাত স্ত্রীর বলা সাতটি রূপকথা। ষষ্ঠ শতকের আরব কবি ইমরুল কায়েসের লেখা কবিতা অবলম্বনে লাইলি-মজনুর প্রণয়কাব্যও নতুন করে লিখেছিলেন নিজামি। সম্রাট আলেকজান্ডারকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘ইসকান্দারনামা’। নিজামির ‘খামেশ’ একটা মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়, যেটি নানাভাবে অনুকরণ করেছেন তাঁর উত্তরসুরিরা। এর মধ্যে সবচেয়ে সফল অনুকারক ছিলেন চতুর্দশ শতকের কবি আমির খসরু, যিনি দিল্লির সুলতানদের রাজসভার অংশ ছিলেন-এছাড়াও নিজামির আরেক বিখ্যাত অনুসারি ছিলেন পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত কবি জামি।
ফার্সি কবিতার মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী ধারা হচ্ছে সুফি ধারা। সুফিবাদী ধারার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন আবু সাঈদ ইবনে আবু আল খায়ের, যিনি ১০৪০ সালে পরলোকগমন করেন; অবশ্য কেউ কেউ বলেন, আবু-আল খায়ের নিজে কোনো কবিতা লিখেননি, বেনামী কবিদের লেখা চতুষ্পদী কবিতা তিনি প্রচার করতেন। সুফিবাদী ধারার অন্যতম পথিকৃৎ কবি হলেন হাকিম আবুল মজিদ মজদুদ ইবনে অদম সানাই গজনভি, যিনি সানাই নামেই বহুলখ্যাত। গজনির রাজসভার একজন কবি হিসেবে পেশাজীবন শুরু করলেও অচিরেই সুফিবাদী ধারায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘হাদিকাহ আল-হাকিকাহ ওয়া শারি আত আল-তারিকাহ’ আংশিকভাবে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে ‘দ্য ওয়াল্ড গার্ডেন অব ট্রুথ’ নামে। এটি বস্তুত দীর্ঘ একটি কবিতা যাতে গজনির সুলতানের উদ্দেশে নানা উপদেশ প্রদান করা হয়েছে। সানাইয়ের কবিতা থেকে তিনটি উদ্ধৃতি—
`প্রেমের ভুবনে কোনো দ্বৈততা নেই
‘তুমি’ আর ‘আমি’-এগুলো স্রফে বাকোয়াজি
যে পাত্র পূর্ণই আছে তাকে ফের পূর্ণ করবে কীভাবে?’
`পথ যখন আত্মায় আগুন জ্বালায়
তখন আর থেমে থাকা বলে কিছু নেই
পা মাটি স্পর্শ করে ঠিকই
তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়।’
`যখন তার কথা ভাবি
হৃদয়ে উদিত হয় একটি কবিতা
ভালোবেসে কেউ একজন বলেছিল ফিসফিসিয়ে
সহস্র বছর আগে-
উপলব্ধি করতে পারি না তোমার আকৃতি
তাই যেদিকে তাকাই তোমাকেই দেখি;
তোমার প্রেমময় উপস্থিতি দৃষ্টিকে পূর্ণ করে
এবং নমিত করে হৃদয়-যেহেতু সর্বত্রই আছ তুমি।’
সানাইয়ের আরেক স্মরণীয় সৃষ্টি ‘সায়ের আল-ইবাদিলা আল-মা’দ’। মসনভির ঢঙে রচিত এই কবিতাটিতে ছোট একটি ভ্রুণ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়া পর্যন্ত মানুষের আত্মা কীভাবে জীবনের পথে অগ্রসর হয় তারই বর্ণনা রয়েছে। সানাই হচ্ছেন পারস্যের প্রথম কবি যিনি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গজল লিখেছেন। ফার্সি সাহিত্যে সানাইয়ের আরেক উল্লেখযোগ্য সংযোজন ‘কালান্দার’-আইন অমান্যকারী একজন ব্যক্তি যিনি মাতলামি ও অমিতাচারে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন। পরবর্তীকালে ‘কালান্দার’ শব্দটি অনেক সুফিই ব্যবহার করেন যাঁরা সমাজের প্রচলিত প্রথাকে অস্বীকার করে ভীষণ রকমের বেহিসাবি জীবনযাপন করেন। সুফি কবিতা, বিশেষত গজলে এই কালান্দার একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা লাভ করেন।
সানাইয়ের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের আরেক মহান প্রতিভা ফরিদ আল-দীন আত্তার, সংক্ষেপে আত্তার। জন্ম তাঁর নিশাপুরে, সম্ভবত পেশায় ছিলেন ঔষধ প্রস্তুতকারক বা হেকিম। তাঁর রচনাকর্মের কলেবর বিশাল, যদিও তাঁর নামে প্রচলিত অনেক রচনাকর্মই সম্ভবত তাঁর নিজের লেখা নয়। আত্তারের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘মান্তিক-উত্-তাইয়ুর’। এতে তিনি আত্মশ্লাঘার বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং স্রষ্টার সকল সৃষ্টি যে তাঁর কাছে সমান সেকথা স্মরণ করিয়ে দেন। আত্তার মানবজাতিকে আহ্বান করেন ‘আমরা বনাম তোমরা’ এই দ্বিমেরুকরণকে বর্জন করতে এবং জাতি, ধর্ম ও শ্রেণিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে। মানুষে-মানুষের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। আত্তারের জীবনদষ্টি অনুধাবন করার জন্য তাঁর সুবিখ্যাত একটি কবিতার অনুবাদ প্রাসঙ্গিক হবে—
দুনিয়ার মানুষ মোমবাতির শিখার সামনে উড়ন্ত
তিনটি প্রজাপতির মতো—
প্রথমটি অগ্নিশিখার খুব কাছে গিয়ে বলে: ভালোবাসা কী আমি জানি।
দ্বিতীয়টি তার ডানা দিয়ে আলতো স্পর্শ করে আগুনকে এবং বলে:
আমি জানি প্রেমানল কীভাবে পোড়ায়।
আর তৃতীয় প্রজাপতি নিজেকে নিক্ষেপ করে অগ্নিশিখার বুকে,
এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কেবল সে-ই জানে সত্যিকারের প্রেম কী।
সুফিবাদী ঘরানার প্রধানতম কবি জালালুদ্দিন রুমি, যিনি মাওলানা রুমি নামেই সুপরিচিত। তিনি কোথায় জন্ম নিয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাঁর জন্মস্থান হিসেবে বর্তমান আফগানিস্তানের বল্খ শহরের পক্ষেই প্রমাণ বেশি। কবি ও সাধক হিসেবে রুমির আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ সেলজুক শাসকদের আবাসস্থল কনিয়া (বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্গত)-য়। ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনবিশারদ হিসেবে রুমির খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এবং অচিরেই আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রুমি।
সুফিবাদী ঘরানার প্রধানতম কবি জালালুদ্দিন রুমি, যিনি মাওলানা রুমি নামেই সুপরিচিত। তিনি কোথায় জন্ম নিয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাঁর জন্মস্থান হিসেবে বর্তমান আফগানিস্তানের বল্খ শহরের পক্ষেই প্রমাণ বেশি।
তাবরিজ শহরের বিখ্যাত সুফি সাধক শামসুদ্দিনের ওরফে শামস-ই-তাব্রিজের সাথে পরিচয় রুমির জীবনের এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। শামসুদ্দিনকে তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধা করতেন। রুমির সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ছয়খণ্ডে সমাপ্ত ‘মসনবি-ঈ-মা নাভি’ তথা ‘আধ্যাত্মিক মসনবি’। ফার্সি সুফিবাদী কবিতার একটি মাস্টারপিস হিসেবে এটি সর্বজনস্বীকৃত। ঝর্ণা থেকে যেমন স্বচ্ছ, সুপেয় পানি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্গত হয়, রুমির ভেতর থেকেও তেমনি নির্গত হতো কবিতা। তাঁর ভাষা ও অন্তর্গত আবেগ গভীর, বিশুদ্ধ এবং চিরনতুন-এ কারণেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এসব কবিতা ও গজল নানা দেশের নানা জাতির মানুষকে নিখাদ আনন্দ আর ভাবনার খোরাক জুগিয়ে আসছে। তীব্র ভাবাবেগ আর গভীর অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে প্রেমের প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন রুমি তাঁর কবিতায়—
কেউ একজন জানতে চেয়েছিল: ‘প্রেমিক হওয়ার অর্থ কী?’
জবাব দিয়েছিলাম, ‘এসব অর্থের কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করো না—
যেদিন আমার মতো হবে, নিজেই জানবে—
সে যখন তোমাকে ডাকবে, তুমি তার গল্প বলবে।
তাহলে প্রেমিক হওয়ার অর্থ কী? বিশুদ্ধ তৃষ্ণা অনুভব করা;
কাজেই জীবন নামের যে পানি বরং তার কথা ব্যাখ্যা করি তোমায়।
পাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সকল কালের সকল যুগের মানুষের মধ্যে রুমির চিরন্তন আবেদনের কারণ হচ্ছে, রুমি সাধারণ একটি বিষয়ের মধ্যেও বিশাল কোনো তাৎপর্য আবিষ্কার করতে পারতেন, প্রাত্যহিকের তুচ্ছ ঘটনা থেকেও সৃষ্টি করতে পারতেন বিমলানন্দের খোরাক। নৈতিক দর্শনের একটি আকরগ্রন্থ বলা যায় রুমির মসনভিকে। হিতোপদেশ ও তাত্তি¡ক আলোচনার এক সুষম সমন্বয় ঘটেছে এই গ্রন্থে, যাতে রূপক-কাহিনি, উপমা আর রূপকালঙ্কারের সুদক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে গভীর আধ্যাত্মিক জীবনদৃষ্টিকে ফুটিয়ে তুলেছেন রুমি। মসনভি থেকে উদ্ধৃতি—
তোমার উপস্থিতি যখন মিষ্টি করে ডাকে, আমার আত্মা উড়ে যেতে চায়।
‘তুমি যখন ফিসফিসিয়ে বলো: ‘জাগো’, আমার আত্মা তখন পালাতে চায়।
যখন ঢাকের শব্দ বলে-‘ফিরে এসো’-শুকনো মাটি থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়তে চায় মাছ;
আলোর আভায় দীপ্যমান সুফি সূর্যরশ্মির মতো নেচে উঠতে চান, যখন অন্ধকার তাঁর জন্য শমন পাঠায়।
১২২০ সালে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী ইরান আক্রমণ করে এবং দেশটির পূর্বাঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এর ত্রিশ বছর পর চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু ইরানে একটি মোঙ্গল রাজ্য স্থাপন করেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে ইরানের মোঙ্গল শাসকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং পারস্য সভ্যতায় তাদের আত্মীকরণ ঘটে। মোঙ্গলদের রাজধানী তাব্রিজ একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এসময় চীনের সাথে ব্যাপক সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে। চীনা শিল্পীরা দলে দলে তাব্রিজে আসতে থাকেন এবং চীনা ও পারস্যরীতির সমন্বয়ে নতুন এক শিল্পধারার উদ্ভব ঘটে, বিশেষ করে অণুচিত্রকলা (মিনিয়েচার পেইন্টিং)-এর ব্যাপক বিকাশ ঘটে। ইরানে মোঙ্গলদের শাসনের অবসান ঘটে ১৩৩৫ সালে এবং তৈমুর লং-এর বংশধররা উজবেকিস্তানের সমরখন্দ এবং আফগানিস্তানের হিরাত শহর থেকে ইরানের পূর্বাঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেন। এসময় ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় ফারস প্রদেশের রাজধানী সিরাজ পারস্যের প্রধানতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভুত হয়। এই শহরের এক ভুবনবিখ্যাত সন্তান আবু মোহাম্মদ মোশাররফউদ্দিন মুসলেহ বিন আব্দুল্লাহ মোশাররফ সিরাজী ওরফে শেখ সাদী সিরাজি। ইরানিদের কাছে শেখ সাদী সবচেয়ে আদরণীয় তাঁর গজলের জন্য, অনেকেই তাঁকে ফার্সি ধ্রুপদী গজলের জনক-এর স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। সাদীর শ্রেষ্ঠ দুই রচনাকর্ম বোস্তাঁ আর গুলিস্তাঁ। বোস্তাঁ শব্দের অর্থ ফলের বাগান আর গুলিস্তাঁ মানে গোলাপ বাগান। প্রথমটির প্রকাশকাল ১২৫৭ আর দ্বিতীয়টি ১২৫৮। বোস্তাঁ বিশ্বসাহিত্যের এক অমর কীর্তি। বাস্তববাদিতা আর প্রয়োগবাদিতার সঙ্গে মরমীবাদ আর আদর্শবাদিতার অদ্ভুত এক সংমিশ্রণ ঘটেছে এ কাব্য সংগ্রহে। অন্যদিকে গুলিস্তাঁ হচ্ছে গদ্যরচনা যাতে সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তব ঘটনা, হিতোপদেশ আর ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে উপদেশ দিয়েছেন তিনি। গল্প-কাহিনিগুলো গদ্যে উপস্থাপিত হলেও এর মধ্যেই ঢুকে পড়েছে পদ্য, যার কাজ হচ্ছে গদ্যের হিতোপদেশ বা সার কথাটি বলে দেয়া। সাদী কেবল পণ্ডিতদের জন্য লেখেননি, লিখেছেন সব মানুষের জন্য। তাঁর ভাষা সহজবোধ্য, কিন্তু চাইলেই কেউ অনুকরণ করতে পারবে না তা-আর এখানেই সাদী অনন্যসাধারণ। সাদীর একটি বিখ্যাত একটি কবিতার শিরোনাম ‘বনি আদম’ তথা ‘আদমের সন্তান’। বহুলপঠিত ও ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত এ কবিতাটি যেন শেখ সাদী সিরাজীর জীবনদর্শনেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। এ কবিতার একটি অংশ উৎকীর্ণ আছে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদরদপ্তরের একটি সভাকক্ষের দেয়ালে। সেটি এরকম—
গোটা মানবজাতি একটি শরীরেরই অংশ;
একই আত্মা ও বীজ থেকে জন্ম তাদের
একটি অঙ্গ যখন কষ্ট পায়
অন্য অঙ্গগুলোও অনুভব করে তা;
মানুষের দুঃখে যার হৃদয়ে সহানুভূতি জাগে না—
মানুষ নামে অভিহিত হবার যোগ্য নয় সে।
ফার্সি কবিতার ভুবনে চতুর্দশ শতকের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা সিরাজ নগরীর আরেক কৃতীসন্তান খাজা শামসুদ্দীন মুহাম্মদ হাফিজ-ই-সিরাজি ওরফে হাফিজ। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, কবির জন্ম ১৩১৫ খ্রিষ্ট্রাব্দে, মৃত্যু ১৩৯০ খ্রিষ্ট্রাব্দে। গজল-এর বাইরে বলতে গেলে আর কিছুই লিখেননি তিনি এবং তাঁর হাত ধরেই ফার্সি গজল খ্যাতি ও উৎকর্ষের শিখর স্পর্শ করে। পূর্বসুরিদের কাছ থেকে পাওয়া সাহিত্যিক উপাদানগুলোকে নিজের প্রতিভায় জারিত করে সম্পূর্ণ নতুন পথের সন্ধান দিলেন হাফিজ। তাঁর গজলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চিত্রকল্প ও ‘মোটিফ’-এর দক্ষ ব্যবহার। এছাড়া গজলের প্রতিটি স্তবককে স্বাতন্ত্র্য দান এবং সব স্তবক মিলিয়ে একটি একক ও সংহত ধারণার সৃষ্টি হাফিজের অতুলনীয় প্রতিভার স্বাক্ষরবাহী। তিনি কি আধ্যাত্মিক নাকি জাগতিক ভালোবাসার জয়গান গেয়েছেন এ নিয়ে হাফিজের ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে বিতর্ক আছে, যদিও আধুনিক পশ্চিমা গবেষকরা তাঁর সেক্যুলার সত্তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। ভাবের তুঙ্গে না উঠলে হাতে কলম তুলে নিতেন না হাফিজ, এজন্য বছরে দশ-বারোটির বেশি গজল তিনি লিখতেন না। এ কারণে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই কালোত্তীর্ণ। হাফিজ নিজে তাঁর কবিতাগুলো সংকলন করেননি। এ কাজটি তাঁর মৃত্যুর ২০/২২ বছর পর করেছিলেন মোহাম্মদ গোলান্দাম। সাইয়িদ কাসিম-ই-আনোয়ার নামে হাফিজের আরেক তরুণ ভক্তও তাঁর কবিতা সংগ্রহ ও সংকলন করেছিলেন। হাফিজের গজলের প্রধানতম উপজীব্য হচ্ছে প্রেম। তাঁর গজলে নানা রূপে, নানা মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে প্রেমের মাধুর্য আর মহত্ত্ব—
যখন আমার মৃত্যু হবে, আমার কবর খুলে দেখো
আমার পায়ের কাছে ধুম্রকুণ্ডলীর মতো মেঘ
আমার মৃত হৃদয়ে তোমার জন্য জ্বলছে আগুন
আমার শরীরে প্যাঁচানো কাফন থেকে উঠছে ধোঁয়া!
এসো, হে প্রিয়, তোমারই প্রতীক্ষায় আছে তৃণভূমি
এবং কাঁটা থেকে কাঁটা নয়, বরং ফুটছে ফুল,
সাইপ্রেস গাছের ফল আর বিরান-নগ্ন শীতকাল
তোমার পায়ের শব্দে পালিয়েছে দিগন্তে—
অন্যত্র—
যদিও আমি বৃদ্ধ, একটি রাত আমাকে আঁকড়ে রাখো তোমার বুকে,
যখন ভোর আসবে আমাকে জাগাতে
চিবুকে তারুণ্যের দীপ্তি নিয়ে জেগে উঠব তোমার বুক থেকে।
ওঠো! তোমার মহিমাময় সৌন্দর্য ধন্য করুক আমার দৃষ্টিকে!
তোমার দিকেই ধাবিত পুরুষের সকল প্রয়াস
হাফিজের সব প্রার্থনার উদ্দিষ্টও কেবল তুমি;
এ ধরিত্রী আর এ জীবন থেকে তোমার মুখ
আমায় আহ্বান করে-‘জাগো, উঠে দাঁড়াও!
হাফিজের মৃত্যুর পরও ফার্সি গীতিকবিতার প্রধানতম ধারা হিসেবে গজলের জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন থাকে। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে জ্ঞানের নানা শাখায় উল্লেখযোগ্য কিছু রচনাকর্মের দেখা মেলে। ইতিহাস ও ভূগোলে গুরুত্বপূর্ণ নানা গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি ‘জাফরনামা’ বা ‘বিজয়গাথা’ নামে ৭৫,০০০ দ্বিপদী কবিতাসম্বলিত একটি গ্রন্থ রচনা করেন হামিদুল্লাহ মুস্তফি। দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার ওপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন নাসিরুদ্দিন তুসী। এ সময়ের ফার্সি ভাষার তিন উল্লেখযোগ্য কবির জন্ম ইরাকে। লামা’ত বা ঝলক নামের মরমী কবিতার অনামী কবি, পাঁচটি অসাধারণ দিওয়ানের রচয়িতা ও ‘ভারতবর্ষের তোতাপাখী’ নামে খ্যাত আমির খসরু এবং রম্যরচয়িতা জাকানি। সাদীর গীতিকবিতার ঢঙে নিজের কাব্যসম্ভারকে সাজিয়েছিলেন আমির খসরু, যিনি ভারতীয় উপমহাদেশে ফার্সি কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফার্সি ভাষায় এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ জুভাইনি-র মোঙ্গল আক্রমণের বিবরণভিত্তিক তারিখ-ই-জাহান গুশা এবং রশিদ-উদ্-দীনের জামিউত তাওয়ারিখ (‘বিশ্বজনীন ইতিহাস’)। আব্দুল্লাহ ইবনে ফজলুল্লাহ শরফ-আলদ্বীন সিরাজী, ওয়াসাফ নামেই যিনি সুপরিচিত-রচনা করেন পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত যুগান্তকারী ইতিহাসগ্রন্থ ‘তারিখ-ই-ওয়াসাফ’।
ইতিহাসরচনার সমৃদ্ধ ধারাটি পঞ্চদশ শতকেও অব্যাহত থাকে। নিজাম-উদ্দিন-শামি মোঙ্গল বীর তৈমুর লং-এর বিজয়গাথা নিয়ে রচনা করেন ‘জাফরনামা’, যেটিকে অবলম্বন করে পরবর্তীতে আরেকটি ‘জাফরনামা’ রচনা করেন শারাফ-উদ্দিন-আলী-ইয়াজদি। এ সময়ের গদ্যরচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হাফিজ-ই-আব্রু, খাফি, দৌলতশাহ ও মীর খান্দ-যিনি রচনা করেছিলেন ‘রোজাত-আস-সাফা’ (‘বিশুদ্ধতার বাগান’) নামে সুখ্যাত একটি গ্রন্থ। পঞ্চদশ শতকের শ্রেষ্ঠ ফার্সি কবি সুফিবাদি ধারার কিংবদন্তী পুরুষ জামি, যাঁর পূর্ণ নাম নুর আদ্-দীন আব্দুর রহমান। খোরাসানের ‘জাম’ শহরে ১৪১৪ সালে জন্ম জামি-র। মসনবি বা দ্বিপদী কবিতার রচয়িতা হিসেবে তিনি বিখ্যাত। জামি পঁয়তাল্লিশটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাহারিস্তান, দিওয়ান এবং হাফ্ত আওরাং বা সপ্ত সিংহাসন। ইউসুফ-জুলেখা এবং সালমান ও আবসালের কাহিনি নিয়ে জামি-র রচিত কবিতাগুলো অমর হয়ে আছে।
যদি হতে হয় অশান্ত এক বুলবুল, হও সেই বুলবুল!
তুমি তো অংশমাত্র, বাস্তবতা যার পূর্ণরূপ—
কিছুদিন ধ্যান করো পূর্ণতার, হয়ে যাও নিজেই পূর্ণ!
যদি হৃদমাঝারে ফোটে একটি গোলাপ, হয়ে যাও সেই গোলাপ!
হৃদয়-বাঁশিতে বাঁশিতে বাজে একটিই গান, প্রেমের,
সেই সুরের ছোঁয়ায়, মাথা থেকে পা অব্দি প্রেমে মাতোয়ারা আমি।
যুগের পর যুগ কেটে যায়, শুধতে পারি না
সেই এক মুহূর্তের ভালোবাসার ঋণ।
১৫০১ সালে ইরানের ইতিহাসে বিশাল এক মোড় পরিবর্তন ঘটে। ক্ষমতায় আসেন সাফাভিদ শাসকেরা, এবং শিয়া ইসলামকে করেন ইরানের রাষ্ট্রধর্ম। প্রথম দিকে পূর্ববর্তী শাসকদের মতোই শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখেন তাঁরা। স্থাপত্য ও অণুচিত্রকলায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে। তবে সাদী বা হাফিজের মতো ভুবনবিখ্যাত আর কোনো প্রতিভার জন্ম এসময় বা পরবর্তী শতকগুলোতে হয়নি। ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ে সাফাভিদ নৃপতিরা ফার্সি কবিতার পৃষ্ঠপোষকতা ধীরে ধীরে কমিয়ে দেন। বরং সাহিত্যের মাধ্যমে শিয়া মতবাদের প্রচার-প্রসারই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ মনোভাব থেকেই ভারত ও অটোমান শাসনাধীন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ফার্সি সাহিত্যের একধরনের বিস্তার ঘটে। ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের মূল ভাষা ফার্সি হওয়ায় তাব্রিজ, সিরাজ আর ইস্পাহান থেকে বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিকের সমাগম ঘটে সেখানে। মুঘল সম্রাটদের বদৌলতে ফার্সি সাহিত্যের ভারতীয় একটি ধারা বিকশিত হতে থাকে, যে ধারার স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তববাদ এবং জনপ্রিয় শব্দভাণ্ডার ব্যবহারের প্রবণতা। এ সময়ের কবিদের মধ্যে ফেগানি, ফাইয়াজ এবং সাঈব সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সপ্তদশ শতকে পারস্যের শ্রেষ্টতম সাহিত্যপ্রতিভা হিসেবে ধরা হয় সাঈব’কে। জীবনের প্রথমাংশে কিছুদিন ভারতে কাটান তিনি, যেখানে সম্রাট শাহজাহানের অনুগ্রহধন্য হন। পরে ইরানে ফিরে এসে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের সভাকবির পদ অলঙ্কৃত করেন। সাঈব ছিলেন এক বিশুদ্ধ কবি যিনি ফার্সি কবিতার পুরনো আঙ্গিকের মধ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার করে নতুন একটি ঘরানার জন্ম দেন, যেটিকে ‘ভারতীয় শৈলী’ (Indian style) হিসেবেও অভিহিত করা হতে থাকে। এ ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চিত্রকল্পের ব্যাপক ব্যবহার যা ফার্সি কবিতাকে একধরনের বন্ধনমুক্তির স্বাদ দেয়। বস্তুত এ শৈলীটি পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে বাবা ফাইগানি প্রমুখের গজলেই প্রথম দেখা দেয়, ভারতবর্ষে রচিত ফার্সি কবিতায় যার ব্যাপক প্রয়োগ ঘটে। যে অনায়াস পারঙ্গমতায় অসাধারণ সব পংক্তি রচনা করতেন সাঈব, পারস্যের সুধীমহলে তা তাঁকে দিয়েছিল কিংবদন্তীর মর্যাদা। সাঈবের কবিতার অনেক পংক্তি প্রবাদে রূপ নিয়েছে। এমনই কয়েকটি পংক্তি—
`ঢেউ জানে না সমুদ্রের প্রকৃতি কী। ক্ষণস্থায়ী কেউ কীভাবে বুঝবে চিরন্তনের মাহাত্ম্য?’
`আমি যদি মস্তিষ্কবিকৃত হই তাহলে সুস্থ কে? আর তুমি যদি সুস্থ হও তাহলে দুনিয়ায় উন্মাদ বলে কেউ নেই।’
`আগে মৃতদের নিয়ে শোক করত মানুষ। এখন শোক করে যারা বেঁচে থাকে তাদের নিয়ে।’
`হাতে তসবিহ, ঠোঁটে অনুতাপ, আর হৃদয়ভরা পাপার্ত বাসনা-পাপ নিজেই হাসে আমাদের অনুতাপ দেখে!’
`যন্ত্রণাক্লিষ্ট এ দুনিয়ায় প্রবেশের চেয়ে প্রস্থানই শ্রেয়। গোলাপকুঁড়ি এ বাগানে প্রবেশ করে বিপর্যস্ত হৃদয়ে, আর ঝরে যায় হাসতে হাসতে।’
`পুড়ে মরা পতঙ্গের জন্য কাঁদে না মোমবাতি। ক্রমশ এগিয়ে আসছে ভোর, মোমবাতি কাঁদে তার নিজের অন্ধকার রাতের কথা ভেবে।’
ষোড়শ শতক থেকেই সাফাভিদ শাসকদের কাছ থেকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষণা না পাওয়ায় অনেক কবি ইরান ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমান। ফার্সি কবিতার ভারতীয় শৈলীর এই ধারাটিকে উৎকর্ষের চূড়ায় নিয় যান মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯) ও মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮)-এর মতো কবিরা। আগ্রায় জন্মগ্রহণকারী মির্জা গালিব উর্দু ও ফার্সি দুই ভাষাতেই কবিতা লিখতেন। প্রয়ানের এত বছর পরও গালিবের বিপুল জনপ্রিয়তা তাঁর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবেরই স্মারক। মুহাম্মদ ইকবাল, যিনি পাকিস্তানীদের কাছে আল্লামা ইকবাল আর পারস্যবাসীর কাছে ইকবাল-ই-লাহোরি নামে পরিচিত, বস্তুত ফার্সি কবিতার ভারতীয় শৈলীরই উত্তরাধিকারী। ফরিদউদ্দিন আত্তার ও ইবনে আরাবি-র মতো ধ্রুপদ সুফী কবির চিন্তার সঙ্গে গ্যেটে ও দান্তে আলিগিয়েরির মতো পশ্চিমা কবির চিন্তাকে মিলিয়ে কবিতা রচনা করেছেন তিনি। ইকবালের ফার্সি কবিতার উল্লেখযোগ্য সংকলন ‘জাবুর-ই-আযম’ (ফার্সি প্রার্থনাসঙ্গীত)। অষ্টাদশ শতকের সুপরিচিত গদ্যরচয়িতা আজার, যিনি ‘আতিশ কাদেহ’ নামে প্রায় ৮০০ কবির জীবনীমূলক একটি অভিধান রচনার পাশাপাশি দিওয়ান ও রোম্যান্টিক মহাকাব্যেরও স্রষ্টা। এ সময়ের আরেক বহুলপ্রজ লেখক হাজিন, যিনি ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও একটি আত্মজীবনী ও চারটি দিওয়ান রচনা করেছেন। উনিশ শতকের প্রখ্যাত কবি সাবা ছিলেন ফতেহ আলী শাহ-এর রাজকবি। তিনি ‘শাহানশাহনামা’ নামে একটি মহাকাব্য ছাড়াও একটি দিওয়ানও রচনা করেন। জামি-র পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম খ্যাতিমান মির্জা হাবিবুল্লাহ সিরাজী (১৮০৮-১৮৫৪), যিনি কানি নামে খ্যাত। আরবি ও ফার্সি সাহিত্যে ব্যাপক পড়াশোনা ছিল কানি-র। পরিচয় ছিল ফরাসী ও ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গেও। কবিতারচনা ছাড়াও গণিত ও যুক্তিবিদ্যায় কানির সুগভীর জ্ঞান ছিল। সারাজীবনে প্রায় বারো হাজার কবিতা রচনা করেন তিনি। শেখ সাদী-র গুলিস্তাঁর আদলে রচনা করেন ‘পারিশান’ নামে একটি গ্রন্থ। ১৮৫৪ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। উনিশ শতকে ফার্সি সাহিত্যের আরো দুজন প্রতিভাবান কবি সর্দার গুলাম মুহাম্মদ খান তারজি (১৮৩০-১৯০০) ও ইরাজ মির্জা (১৮৭৪-১৯২৬)। আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরে জন্মগ্রহণকারী গুলাম মুহাম্মদ খান তার্জি ছিলেন আফগান প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন মুখপাত্র। খোরাসানি ফার্সি কাব্যধারার সমঝদার ছিলেন তার্জি। কবি ও রম্যরচয়িতা ইরাজ মির্জা নতুন ভাবনা ও শৈলীর মাধ্যমে ফার্সি কবিতার ভুবনে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। দৈনন্দিন, আটপৌরে ভাষার সঙ্গে রূপকাশ্রিত বাগধারার সম্মিলন ঘটিয়ে নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করেন তিনি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে তাসভিল-ই-জান (নারীর প্রতিমূর্তি) ও দাস্তান-ই-দুহরিহ ভা মানুচেহের (জুহরি ও মানুচেহের-এর কাহিনি) উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত রচনাটি শেক্সপিয়ারের ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’ কবিতার আদলে রচিত।
উনিশ শতকের শেষার্ধে ইরানের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ বাড়তে থাকে, রাশিয়ার সঙ্গে পরপর দুটো যুদ্ধে ইরানের সামরিক দুর্বলতাও পরিস্ফূট হয়। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে ইরানি সমাজের আধুনিকায়ন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। ফার্সি সাহিত্যেও তখন নানারকম পালাবদল চলছিল। নাট্যকার মির্জা জাফর কারাচা দাঘি, মির্জা আকা তাব্রিজি ও ঔপন্যাসিক আব্দাল রহিম তালিবাফ ও জয়নাল আবেদিন তাঁদের লেখার মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রথার সমালোচনা করেন যা রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ভিত্তি স্থাপনকরে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ শতকের শুরুতেই ঘটে সাংবিধানিক বিপ্লব। কবিরা শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা লাভের শতাব্দীপ্রাচীন প্রয়াসকে পরিত্যাগ করে স্বাধীন সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে আবির্ভুত হন। রাজকীয় অনুগ্রহ প্রত্যাখ্যান করে সরাসরি জনতার কাতরে সামিল হওয়ার এ প্রয়াসের সূচনা ঘটে আরেফ কাজভিনি ও মুহাম্মদ তাকি বাহারের মাধ্যমে। রেজা শাহ পাহলভির শাসনকালে (১৯২৫-৪১) বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হলেও সরকার কর্তৃক ইরানি সমাজের আধুনিকায়নের নানা উদ্যোগ নতুন ধারার এক ফার্সি সাহিত্যের উন্মেষে সহায়ক ভুমিকা রাখে। তবে সাধারণভাবে আধুনিক ফার্সি কবিতার জনকের অভিধা যাঁকে দেয়া হয় তিনি নিমা ইয়ুসজি, জন্ম যাঁর ইরানের মাজান্দারান প্রদেশে, ১৮৯৭ সালে। কেবল বিষয়বস্তুই নয়, ছন্দ, চিত্রকল্প সব দিক দিয়েই ফার্সি কবিতায় নতুন এক যুগের সঞ্চার করেন ইয়ুসজি। তাঁর প্রথমদিকের কবিতাগুলোয় ফরাসি রোমান্টিকতা ও প্রতীকবাদের প্রভাব স্পষ্ট, তবে তাঁর প্রতীকের ব্যবহারে ছিল স্বকীয়তা ও উদ্ভাবনী সক্ষমতার ছাপ। চল্লিশের দশকের ইরানি কবিরা নিমা ইয়ুশজির প্রভাবে যে নতুন ধারার কবিতা লিখতে শুরু করেন সেটিই পরবর্তীকালে আহমেদ শামলু, ফারোখ ফারোখজাদ, মেহেদি আখবান-ই-সালেস ও নাদের নাদেরপুরের মতো যশস্বী কবির জন্ম দেয়। আধুনিকতার নানা ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁরা, ফার্সি সাহিত্যের ধ্রুপদী ঐতিহ্য থেকে নিজেদের মত করে সৃষ্টি করে নেন দূরত্ব। ১৯৬০ নাগাদ আধুনিক কবিতার ধারাটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, যদিও ক্ষমতার পালাবদলের কারণে আশির দশক থেকে নিষেধাজ্ঞা, নির্বাসনসহ নানা পরিণতি বরণ করতে হয় অনেক কবি সাহিত্যিককে।
ফার্সি আধুনিক গদ্যসাহিত্যের ধারাটি শুরু করেন মোহাম্মদ আলি জামালজাদেহ ১৯২১ সালে প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্প সংকলন ইয়াকি বুদ ইয়াকি নাবুদ-এর মাধ্যমে।
ফার্সি আধুনিক গদ্যসাহিত্যের ধারাটি শুরু করেন মোহাম্মদ আলি জামালজাদেহ ১৯২১ সালে প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্প সংকলন ইয়াকি বুদ ইয়াকি নাবুদ-এর মাধ্যমে। বাস্তববাদী গদ্য সাহিত্যের একটি মডেল হিসেবে কাজ করে এসব গল্প, যার প্রভাব ফার্সি গদ্যসাহিত্যে এখনও বিরাজমান। জামালজাদেহর পর উল্লেখযোগ্য গদ্যশিল্পী হলেন সাদেক হেদায়েত, যিনি তাঁর ছোটগল্পে ইরানের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকেই কেবল নয় বুদ্ধিজীবীদের দ্বন্দ্ব ও সংশয়কেও মূর্ত করে তোলেন। সাদেক হেদায়েতই প্রথম ফার্সি ভাষায় ফ্রাঞ্জ কাফকা ও আন্তন চেখভের লেখা অনুবাদ করেন। হেদায়েতের কাফকা-প্রভাবিত উপন্যাস ‘অন্ধ প্যাঁচা’ (১৯৩৭) ফার্সি ভাষায় প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। ব্যক্তিজীবনে বিষন্ন ও অন্তর্মুখী হেদায়েত এক পর্যায়ে প্রবলভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি প্যারিসে চলে যান ও সেখানেই আত্মহত্যা করেন মাত্র ৪৭ বছর বয়সে। পরবর্তীকালের গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বোজোর্গ আলাভি, সাদেক চুবাক, জালাল আলী আহমাদ, হুসাং গোলশিরি, ইরাজ পেজেশ্খজাদ, রেজা বারাহেমি, শাহরিয়ার মান্দানিপুর, মাহমুদ দৌলতাবাদী উল্লেখযোগ্য।
ফার্সি সাহিত্যের ঊষালগ্ন থেকেই সাহিত্যসাধনায় নারীদের দৃপ্ত পদচারণা লক্ষ করা যায়। এঁদের মধ্যে প্রথম যিনি ব্যাপকভাবে কবিখ্যাতি লাভ করেন তিনি রাবিয়া বলখি, যিনি রাবিয়া কাজদারি নামেও পরিচিত ছিলেন। দশম শতকে আফগানিস্তানের বল্খ প্রদেশে জন্ম তাঁর। সামানীয় শাসনামলে (৯১৪-৯৪৩) এমনকি লাভ করেন রাজকবির মর্যাদা। বাখতাশ নামে এক তুর্কী ভৃত্যের সঙ্গে তাঁর প্রেমকাহিনি নিয়ে পরবর্তীকালে বাখতাশনামা নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন কবি রিজা কুলি খান হিদায়েত। রাবিয়া বলখির পথরেখা অনুসরণ করে পরবর্তীকালে যাঁরা পারস্যের নারী কবিদের মধ্যে প্রতিনিধিস্থানীয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে দ্বাদশ শতকে মাহাস্তি গাঞ্জাভিম, ত্রয়োদশ শতকে পাদিশাহ খাতুন ও চতুর্দশ শতকে জাহান মালিক খাতুনের নাম উল্লেখ করা যায়। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা জেব-উন-নিসা (১৬৩৮-১৭০২) ‘মাখফি’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। তাঁর সাহিত্যপ্রীতির নিদর্শন হচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি যা সমকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধতম গ্রন্থাগার হিসেবে পরিচিত ছিল। মধ্যযুগে অভিজাত পরিবারের সদস্য ছাড়াও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত নারীরা কবিতা রচনা করেছেন। ষোল শতকে সাফাভিদ ইরান ও মুঘল ভারতে অনেক নারীই কবিতারচনায় প্রবৃত্ত হন। উনিশ শতকে ফার্সি শিল্প-সাহিত্যের পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের পদচারণাও বৃদ্ধি পায়। বিশ শতকে ইরান, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানে নারী কবি ও লেখকদের পদচারণা লক্ষণীয়। বর্তমানে ফার্সি সাহিত্যে নারী কবি, লেখক, নাট্যকার প্রমুখের সংখ্যা পুরুষদের প্রায় সমান, বই বিক্রির হিসাবে অনেক সময় তাঁরা ছাড়িয়ে যান পুরুষ সাহিত্যিকদের।
উনিশ শতকের অন্যতম কবি ফাতিমা বারাঘানি (১৮১৫-১৮৫২) বেশি পরিচিত ‘তাহিরা’ ও ‘কুররাত-উল-আইন’ ছদ্মনামে। কেবল কবি হিসেবেই নয়, নারীমুক্তি ও নারী অধিকারের সংগ্রামেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। বাহাই ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অপরাধে প্রাণদণ্ড দেয়া হয় তাঁকে। নারীদের মধ্যে বিশ শতকে যাঁরা কবিখ্যাতি লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে পারভিন এতেশামি (১৯০৭-১৯৪১) একজন। সানাই, নিজামী আর রুমির মতো কবির কাব্যশৈলী দ্বারা প্রভাবিত স্বল্পায়ু এই কবির ‘সফর ই আশ্ক’ (একটি অশ্রুবিন্দুর ভ্রমণ) ফার্সি ভাষায় লেখা শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার একটি। বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফার্সি সাহিত্যিক সিমিন দানিশভার (১৯২১-২০১২) ঔপন্যাসিক, গল্পকার, অনুবাদক ও পণ্ডিত হিসেবে বহুল সমাদৃত। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘সাভুশান’ বেস্টসেলারের মর্যাদা পেয়েছে এবং বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আন্তন চেখভ ও নাথানিয়েল হথর্নের রচনা অনুবাদের জন্যও তিনি সুখ্যাত। বিশ শতকে ফার্সি কবিতার জগতে সবচেয়ে আলোচিতদের একজন সিমিন বেহবাহানি (১৯২৭-২০১৪)। দু’বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত বেহবাহানি অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ সময়ের আরেকজন উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক শাহারনুশ পারসিপুর। ১৯৭৮ সালে লেখা তাঁর উপন্যাসিকা ‘জানান বিদুন ই-মারদান’ পুরুষশাসিত সমাজে আত্মর্যাদারক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত পাঁচজন নারীর গল্প। পারসিপুরসহ সমকালীন ইরানের অনেক নারী ঔপন্যাসিকই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখনী দ্বারা প্রভাবিত, ফলে তাঁদের লেখায় জাদুবাস্তবতার ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। বিশ শতকের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নারী কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে আছেন ফারুখ ফারুখজাদ, শাহারনুশ পারসি, গুলরুখশার সাফি, জয়া পীরজাদ, মারজান সাত্রাপি প্রমুখ। এঁদের কেউ কেউ প্রবাসে অবস্থান করেই ফার্সি ভাষায় সাহিত্যসাধনা অব্যাহত রেখেছেন।
একুশ শতকের ইরানি সাহিত্যিকরা বিষয়বস্তু ও শৈলীর বিচারে নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যপৃত আছেন। নতুন প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মধ্যে জয়া পীরজাদ ও হোসেন সানাপুর সাধারণ পাঠকের ভালোবাসা ও সমালোচকদের মনোযোগ দুটোই লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কবি লেখক আর শিল্পীদের কণ্ঠস্বর কখনও উচ্চকিত ও কখনও স্তিমিত হলেও সহস্রাব্দ-প্রাচীন ফার্সি সাহিত্যের ধারাটি নতুন জল ও হাওয়ায় পরিপুষ্ট হয়ে নতুন নতুন অর্জনকে অন্বিষ্ট করে এগিয়ে চলেছে।
তথ্যসূত্র
• পারস্যপ্রতিভা। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। ঢাকা, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৬।
• পারস্যের পাঁচ গোলাপ। মোস্তাক শরীফ। ঢাকা, সরলরেখা, ২০২০।
• রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম। কাজী নজরুল ইসলাম। ঢাকা, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৬।
• A brief overview of medieval Persian literature. Bahman Solati. Studies in English Language Teaching. Vol. 5, No. 3, 2017
• A Literary History of persia, Edward G. Browne. Vols. I-IV. Ibex Publishers, 1997.
• Classical Persian Literature, Bahman Solati.
• https://www.iranchamber.com/literature…
• Encyclopaedia Iranica, Ferdowsī, Abu’l-Qāsem. www.iranicaonline.org
• Iran Chamber Society, Persian language and literature: a brief history of Persian literature. https://www.iranchamber.com/literature/articles/history_literature.php
• Iran: Politics, History and Literature (Iranian Studies Book 15). Homa Katouzian. Routledge, 2013.
• Modern Iranian Literature: Between Politics and Traditions, Published on May 16, 2018, Chronicle of the Middle East and North Africa, https://fanack.com/
• Persian Literature: Ancient and Modern. Elizbeth A. Reed. S. C. Griggs and Company, 1893.
• The Book of Iran. A History of Petrsian Literature: Schools, Periods, Styles and Literary Genres. Ahmad Tamimdari, Al Hoda Publishers & Distributors, 2002.
জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।