সেদিন পুর্ণিমা ছিল। গায়ের লোম দেখা জোছনা। হাঁটছিলাম উদ্দেশ্যহীন। মনে হচ্ছিল, অনেকদিন পর খোলা আকাশের নিচে হাঁটছি। ওয়াজ মাহফিল উপলক্ষ্যে বাড়ি যাওয়া। আমার কোনোকালেই আগ্রহ নেই ওসবে৷ আগ্রহ কেবল মাহফিলের রাতে বাড়ি না-ফেরা জুড়ে। এসব রাতে মনে হয়, আমার তুমুল বাউণ্ডুলে হওয়ার আছে। ঐ যে ওদের বাড়ির পাশের খালি জায়গাটা। ইলেক্ট্রিসিটিহীন এখনো। এককালে কুয়া ছিল শুনেছি— সেখানটায় আমি অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি অনেকগুলো রাত, কেবল পাতাদের গান শুনে।
গ্রামের এমন পূর্ণিমায় মাঝেমধ্যে ভর করে ভাস্কর চক্রবর্তী—
বাইরে, উঁচু নিচু জ্যোৎস্না
আমাদের স্বপ্নের রেলগাড়ি এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে আজ আমাদের উঠোনে—
জ্যোৎস্না উঁচু নিচু হয় না। তবে আমি দেখি, চাঁদের আলো হয়ে গেছে বাবা-চাচাদের মারামারি করা জমিটার মতো। খাপছাড়াভাবে কোপানো। অযত্নে বেড়ে উঠছে দূর্বাঘাস। কিছুটা আমার মতো।
কুয়াটা জীবন্ত হয়ে গেছে।
ভাস্করকে সাক্ষী রেখে, আমরা এখন ঝাঁপ দিতে পারি কয়েক দশক আগে বুজে ফেলা কুয়ার গহীনে, সোল্লাসে।
০২.
কাফকা মিলেনাকে লিখেছিল—
তুমি সুঁচালো এক ছুরি, যা আমি নিজেই নিজের ভেতর গেঁথে নিয়েছি। এটাই প্রেম, হায় প্রেয়সী আমার, এটাই প্রেম। [অনুবাদ : ওয়ালিদ প্রত্যয়]
হায়! এরকমই তো। এই যে ছটফটানি, ফাঁকা ফাঁকা লাগা, নিজেদের সহ্য করা— এসবকিছু কাফকা বলে দিয়েছে এই দুই লাইনেই। এতো সুন্দর! এতো প্রাঞ্জল! নীরবতা রক্ষার প্রতিযোগিতায় প্রতিবার হেরে গিয়ে, অলিখিত অনেক চুক্তি ভুলে গেলে, মনে পড়ে এই লাইন। সে এই হৃদয়ে থাকা সত্ত্বেও আমাকে এইসব বলে দিতে হয় কেন, আমার বোঝা হয়ে ওঠে না।
জেনেছি, কেন সেদিন বেসামাল হয়ে ওঠা হলো ইচ্ছাকৃত ভুলে। দেয়ালের কানে কানে ছড়িয়ে যাওয়া রিউমারে এসব জেনে গেছে সবাই। ওরা শুনিয়ে শুনিয়ে বলে—
The woods are lovely dark and deep;
But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep
কে না জানে, কথা দেওয়াই হয় ভাঙার জন্য। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। যাক না সবকিছু থেমে! এই মোহময় বনেই তবে শুরু হোক আদিম বসবাস।
ওসব হয় না কিছুই৷ বন পুড়ে গেছে, ভেঙে যায় সুঁচ। মনে পড়ে রুদ্রের লাইন—
দূরত্ব জানে শুধু একদিন খুব বেশি নিকটে ছিলাম,
একদিন শরীরের ঘ্রাণ শুকে তুমি বলে দিতে : অমিতাভ
আজ সমুদ্রে যেও না, আজ খুব ঝড় হবে—
আরও মনে পড়ে দমকা হাওয়া, লোডশেডিং। আমি আবার কথা দেই।
…miles to go before I sleep.
০৩.
বন্ধুরা সব ফিরছে বাড়ি দূর থেকে . . .
কেন যে আজ হিংসে হল তাই দেখে,
দেখতে গিয়ে সন্ধে হল জানলাতেই
আগের মতো মেঘ করেছে . . . কান্না নেই
লাইনগুলো শ্রীজাত’র। সহজসরল। এর গভীরতা বুঝি৷ এদের সাথে আমার অনেক প্রেম।
স্কুল ছুটির বিকেলগুলোয় দেখতাম, সহপাঠিরা বাড়ি যেত। সহপাঠি-ই বলছি, কোনো বন্ধু নেই আমার। হয়তো আছে এখন, এক-দুইজন। ওদের বাড়ি যাওয়া পথের দিকে আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতাম। খুব ইচ্ছে হতো বাড়ি ফেরার, খুব। স্মৃতিসৌধের ঐদিকটার ঘাসে বসে থাকতাম একা একা।
বাড়ি ফেরা সহজ ছিল না। দরজার খিল আটকে বৃষ্টি দেখতাম শুধু।
এখন তো অনেকদিন হলো, কান্না আর করা হয় না। তবে কান্না পায়, মেঘ জমে। জলবায়ুর পরিবর্তনে বৃষ্টি হয় না।
শুধু জানি, মেঘ জমলে আমি নদীর পাড়ে যাই৷ কারো সাথে দেখা হলে অনিচ্ছাকৃতভাবে দলে ভিড়তে হয়৷ আমার হাঁসফাঁস লাগে। যমুনায় নিজে ডোবার ইচ্ছা সংবরণ করে ঢিল ছুড়ি৷ ওরা ডুবে যায়। আমার মনে পড়ে মন্দাক্রান্ত সেনের কবিতাটা। কেউ একজন দিয়েছিল ফেসবুকে।
সঙ্গে তেমন কেউ নেই, তাই সাগরে নামিনি। একা একা বসে আছি সৈকতে, জলের কিনারে। আমার সঙ্গে কেউ নেই। ওরা জলে নেমে গেছে। বালিতে পায়ের ছাপ মুছে নিয়ে সরে গেল ফেনা
আমার তেমন কেউ নেই, জল একথা জানে না…
আমি জল-কে জানিয়ে দিই— আমার তেমন কেউ নেই; আমি শুধু তার হতে চাই। আমার খুব ডুবে যাওয়ার শখ। সন্তানবিহীন নদী বয়ে চলে যায় আমার বাড়ির দিকে। খড়কুটোর দিকে তাকালে আমার হিংসা হয় খুব। হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠি—
‘country roads, take me home // to the place I belong…’
০৪.
পরীক্ষা ছিল৷ ফেরার পথে হিসেব করছি গুরুবেশি ব্যবসায়ী আমাকে কতো নম্বর দেবে। ভাব সম্প্রসারণে শূন্য পাওয়ার কথা৷ ওদের দাবি, আমার বোঝাপড়া লেখা আছে বইয়ের সাড়ে তেরো লাইনে। আমার কোনোকিছু ভাবার নাই। আমি তবু উগড়ে দিয়ে আসি আমার অনুধাবন। প্রিয় ঋতু যে বর্ষা, এটা ওরা মানতে চায় না৷ বৃষ্টির আবেদন জানে না ওরা৷ এইম ইন লাইফ রচনায় আমি শিল্পী হতে চাইতে পারি না।
কলম কামড়াতে কামড়াতে আমি আওড়াই জীবনানন্দ।
সকল লোকের মাঝে ব’সে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে, আমি একা হতেছি আলাদা?
এসব যখন লিখছি, আমার কেন জানি নবারুণ ভট্টাচার্যের দুইটা লাইন খুব কানে বাজছে—
বোকা ছেলে পুচুপুচু কোকাকোলা খায় / বোকাচোদা বাপ তার পয়সা জমায়।
এই সিস্টেম, বাটপারি, রাষ্ট্রকে আমার মনে হয় বোকা ছেলে। যে কোকাকোলা খেয়ে দেদারসে পয়সা নষ্ট করছে। কোকাকোলা মানে উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থা, আরও যা কিছু। নিজেকে, নিজেদের মনে হয় পিতা। বোকাচোদা বাপ।
এসবের শেষ কোথায়? বোকাচোদা বাপেদের মাথা খুলবে না কোনোদিন? নবারুণ নিজেও জানেন না৷ তাইতো লেখেন—
একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।
০৫.
খুব হাঁটাহাঁটির রাতে নিজেকে শাদা রাতের কথক বলে ভ্রম হয়৷ যদিও আমি বাড়িদের সাথে কথা বলিনি কখনো, কোনোরকম ছায়া ছাড়া ওরা কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে বিরামহীন, রং বদলালে কেমন লাগে ওদের, কিংবা, গুড়িয়ে ফেললে কি একেবারে মরে যায় ওরা? ওদেরও কি ধর্ম আছে? শাস্তি হয় মরার পরে? —আমাকে ভাবায়নি কোনোদিন।
এসময়ের নাস্তিয়েনকাদের দেখা পাই। বড়ো বিচিত্র ওরা।
ওদের চোখের দিকে তাকানো যায় না। খালি মনে হয়, চোখে চোখ পড়েলেই ধরা পরে যাব বিচ্ছিরিভাবে। সকল অন্ধকারের কথা জেনে যাবে নিমিষেই। আমাকে আটকে ফেলবে বিশেষ পোষাক পরিহিত প্রহরী। আমি ভুলে যাব, আমার নাম জানি না আমি।
দস্তয়েভস্কি, আমাকে একটা নাম দিন। সন্তানকে এমন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে রাখবেন না, প্লিজ! নাম না দিলে আর কিছুই বলব না আজ। শাদা রাতের কসম!
০৬.
তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে না পারার দিনগুলোতে ভিজে যেত মন। জানলার কাছে বহুবার পড়া প্রিয় কোনো উপন্যাস নিয়ে থাকতাম। বাড়ি ছাড়ার আগে আব্বু শিখিয়েছিল, না ভিজেও উপভোগ করা যায় বৃষ্টি। আক্ষেপে বসে থাকাতেও মজা আছে। তখন সৌরবিদ্যুত ছিল। আয়োজন করে ল্যাপটপের সঞ্চিত চার্জ আব্বু ফুরাতো সেদিন। ছোট্ট স্পিকারটায় গান বাজতো। বর্ষার গানই বেশি। মাঝেমধ্যে মনখারাপ মনখারাপ মুখ করে বসতাম কাছে। গান শুনতাম। সাগর সেন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, লতা মঙ্গেশকর, সুবীর নন্দী… আব্বুর অত্যধিক পছন্দের। একে একে বেজে যেত তাঁরা। আব্বুর তৃপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মাটির সিঁড়িতে পিছলা খেলার আক্ষেপ কেটে যেত অনেকটাই। বৃষ্টি থেমে গেলে আব্বু হেঁড়ে গলায় গেয়ে শোনাতো দু-এক লাইন৷ সাথে দুই হাতের আঙুলে আঙুলে টোকা দিয়ে বাজাতো আমার পছন্দের বাদ্যযন্ত্র।
এখানেও বৃষ্টি হয়৷ কখনো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভিজে জবুথবু হই। বৃষ্টিতে রিক্সায় ঘোরার অনুভূতি কি, সে-তো প্রেমিকমাত্রই জানে৷ রিক্সায় কোনো যুগলকে দেখলে আমার ভয়ানক ঈর্ষা হয়। ভেজা বুটের অস্বস্তিতে বসে যাই কলেজের পুকুরপাড়ে। আকাশের অসংখ্য ফুটো দিয়ে বর্ষণ হয়৷ ভাবি, এই মফস্বলি বৃষ্টির ডিরেকশন দিচ্ছেন আব্বাস কিরোয়াস্তমি।
এখানেও বৃষ্টি হয়৷ কখনো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভিজে জবুথবু হই। বৃষ্টিতে রিক্সায় ঘোরার অনুভূতি কি, সে-তো প্রেমিকমাত্রই জানে৷ রিক্সায় কোনো যুগলকে দেখলে আমার ভয়ানক ঈর্ষা হয়। ভেজা বুটের অস্বস্তিতে বসে যাই কলেজের পুকুরপাড়ে। আকাশের অসংখ্য ফুটো দিয়ে বর্ষণ হয়৷ ভাবি, এই মফস্বলি বৃষ্টির ডিরেকশন দিচ্ছেন আব্বাস কিরোয়াস্তমি।
আমার খুব পড়তে ইচ্ছে হয় শক্তিকে—
…বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে— অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
নিজেদের কথা কোন শক্তিতে যে বলে দেয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়! ওসব না ভেবে আস্তানায় ফিরি। প্লে করি আব্বুর পছন্দের গান৷ গানে গানে তাঁর নাগাল পাওয়া যায়।
০৭.
কিছু দুর্দান্ত অভিমানী আসে এইখানে। সিলিঙে ঝুলে থাকা মাকড়সার অসংখ্য জাল, ছড়িয়ে থাকা অজস্র বই, দেয়ালের রংচটা পোস্টার, চায়ের মগে জমে থাকা ছাঁই, এলোমেলো বিছানা, ছড়ানো টিস্যু…ডিঙিয়ে বসে থাকে। ওদের সমস্ত বিষাদেরা ভর করে পারফিউমে। আশেপাশে সব ঘুম হয়ে যায়। কেঁপে কেঁপে ওঠে ঠোঁট। নখ কামড়ানোর আওয়াজে আমার মাথাব্যথা করে। গোপন করি না কিছুই। পুড়ে যাওয়া স্যান্ডউইচ মেকারে নরম নরম স্যান্ডউইচ বানায় ওরা।
ভীষণ দুঃখি ওরা। ওদের প্রেমিকেরা আসে না কথা দিয়ে। কেউ কেউ নাক-ফুল হারিয়ে ভুলে গেছে বাড়ি যাওয়ার পথ। স্লিপিং পিল খেয়ে মরে যাওয়া যায় না, জেনে গেছে কেউ কেউ।
ওদের হাঁচিতে যে রংবেরঙের ফুল বেরোয়, এ কারণে ওদের আসতে বারণ করি না আমি। তবে, এই নোংরা জায়গায় বারবার কেন আসে ওরা, আমি জানি না।
ঘুম ভাঙলেই ওরা তলিয়ে যায় কোথাও।
একটা গান শুনলেই আমার ওদের মনে পড়ে৷ সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান—
তুই বৃষ্টির মতো মিষ্টি
তুই ঝর্ণার মতো চঞ্চল
আমি দেখবো না তোর স্তন-তিল
তোর রহস্যময় অঞ্চল
এক পাড়াতো দাদার কথা মনে পড়ছে। ধোঁয়া ইনহেল করতে করতে বলত, ‘শোন, জীবনে যা যা দেখবি, তার বেশিরভাগ হইলো বেনসনের মতো। অর্ধেক ফুরাইলে তীব্রতর হইতে থাকে।’
জন্ম ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া গ্রামে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে। লেখালেখি করেন; পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবেন।