শনিবার, নভেম্বর ২৩

ফজল হাসানের ধারাবাহিক ভ্রমণগদ্য : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৩য় পর্ব

0

লুক্সর জাদুঘর: প্রাচীন মিশরের রাজকীয় শিল্পকর্মের বিস্ময়কর ভান্ডার


লুক্সর মন্দির থেকে বেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল লুক্সর জাদুঘর দেখা। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে তিনজন, অর্থাৎ সিস্টার মাই, মেহেরুন এবং আমি, ধীর পায়ে টিকেট কাউন্টারের দিকে হাঁটতে থাকি। কর্ণিশ এল নাইল রাস্তার এক পাশে বহমান নীলনদ এবং আরেক পাশে প্রাচীন মিশরের রাজকীয় শিল্পকর্মের বিস্ময়কর ভান্ডার খ্যাত লুক্সর জাদুঘর। বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ঈজিপশিয়ান এক শ চল্লিশ পাউন্ড এবং স্থানীয়দের জন্য দশ পাউন্ড। টিকেট কাউন্টারের পাশেই সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে আমরা জাদুঘর চত্বরে প্রবেশ করি। ভেতরে ঢোকার পরে সরু কংক্রিটের হাঁটা পথ ধরে খানিকটা যেতে হয়। কেননা দালানের অভ্যন্তরে ঢোকার দরজা উল্টোদিকে। জাদুঘর ভবনের সামনে দাঁড়ানো এবং বসা বিশাল আকৃতির কয়েকটি মূর্তি রয়েছে।

মিশরের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু নিদর্শন সংরক্ষণ এবং কায়রোর জাদুঘরে দর্শনার্থীদের চাপ কমানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে লুক্সর জাদুঘর, যা ১৯৭৫ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মক্ত করা হয়।

মিশরের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু নিদর্শন সংরক্ষণ এবং কায়রোর জাদুঘরে দর্শনার্থীদের চাপ কমানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে লুক্সর জাদুঘর, যা ১৯৭৫ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মক্ত করা হয়। সেই থেকে লুক্সর জাদুঘর প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থীকে আকৃষ্ট করছে। লুক্সর জাদুঘরে যে সমস্ত নিদর্শন দেখা যায়, তার বেশিরভাগই প্রাগৈতিহাসিক থেবসের আশেপাশে পাওয়া গেছে। সেই সব নিদর্শনের মধ্যে কয়েকটি প্রধান আকর্ষণ হলো অসামান্য শিল্পের টুকরো, যা ফারাওদের, এমনকি লুক্সরের দরিদ্র লোকেরা, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করত। এছাড়া লুক্সর জাদুঘরে প্রচুর ইসলামিক শিল্পকর্ম পাওয়া যায় এবং সেসব শিল্পকর্ম খ্রিষ্টাব্দ চতুর্দশ শতকের। সেসব শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে মামলুক যুগে ব্যবহৃত জিনিসপত্র। সেসব জিনিসের মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত সুন্দর ছোটো বাটির সংগ্রহ, যা সত্যিই দেখার মতো। মিশরের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী জাদুঘর থেকে লুক্সর জাদুঘরের পরিবেশ গতিশীল এবং আলাদা।


EP_3_1

লুক্সর জাদুঘর ভবনের সম্মুখ দিক


প্রধান দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পরেই আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে দুপাশের দুই বিশাল আকৃতির মাথার মূর্তি। ডানদিকে রয়েছে গ্রানাইট পাথরের তৈরি তৃতীয় আমেনহোতেপের মূর্তি এবং বাম দিকে রয়েছে গ্রানাইট পাথরের তৈরি ফারাও রাজা তৃতীয় সেনুরেতের মূর্তি। উল্লেখ্য, তৃতীয় আমেনহোতেপ ছিলেন অষ্টাদশ রাজবংশের নবম ফারাও রাজা এবং তিনি ১৩৮৭ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। অন্যদিকে তৃতীয় সেনুরেত ছিলেন দ্বাদশ রাজবংশের ফারাও রাজা। তিনি ১৮৮১ থেকে ১৮৪২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ প্রাচীন মিশরের শাসনকর্তা ছিলেন। মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ঝটপট ছবি তুলি। সেই সময় আরও কয়েকজন দর্শনার্থী প্রবেশ করে। আমরা জায়গা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যাই।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-১ম পর্ব


সীমিত পরিসরের লুক্সর জাদুঘরটি দোতলা এবং প্রতিটি তলায় রয়েছে ছয়টি করে হলঘর। সেসব হলঘরের ভেতর এবং একাধিক করিডোরের পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাইশ শর অধিক সংখ্যক দর্শনীয় বস্তু, যার অধিকাংশই ফারাওদের আমলের। তবে জাদুঘরের তথ্য অনুযায়ী কপটিক এবং মামলুক আমলের কিছু দুষ্পাচ্য নিদর্শনও রয়েছে। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে প্রতিটি নিদর্শনের পাশে আরবী এবং ইংরেজিতে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বা বিবরণী রয়েছে।

লুক্সর জাদুঘরের বেশ কয়েকটি গ্যালারিতে প্রদর্শনের জন্য ছাব্বিশটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সংরক্ষিত মূর্তির সংগ্রহ রয়েছে, যা ১৯৮৯ সালে বিখ্যাত লুক্সর মন্দিরের কাছে সমাধিস্থ অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছিল। জাদুঘরের ভেতর প্রাচীন মিশরীয় দেবতাদের বিভিন্ন আকৃতির এবং বিভিন্ন ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি মূর্তি রয়েছে

লুক্সর জাদুঘরের বেশ কয়েকটি গ্যালারিতে প্রদর্শনের জন্য ছাব্বিশটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সংরক্ষিত মূর্তির সংগ্রহ রয়েছে, যা ১৯৮৯ সালে বিখ্যাত লুক্সর মন্দিরের কাছে সমাধিস্থ অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছিল। জাদুঘরের ভেতর প্রাচীন মিশরীয় দেবতাদের বিভিন্ন আকৃতির এবং বিভিন্ন ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি মূর্তি রয়েছে, যেমন দেবতা আমুনের (উনিশতম রাজবংশ, প্রথম রামেজিসের রাজত্বাল, ১৩৪৭-১৩৩৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, মূর্তির উচ্চতা ১.৫৫ মিটার, চুনাপাথর) মূর্তি, কুমির দেবতা সেবেক ও রাজা তৃতীয় আমেনহোটেপের ক্যালসাইটের (অ্যালাবেস্টার) মূর্তি, প্রেম, আনন্দ ও সৌন্দর্যের দেবী হাথোরের কালো গ্রানাইট মূর্তি, প্রথম রাজা সেতির সিংহাসনে বসে থাকা দেবতা আমুন ও তার স্ত্রী দেবী মুতের মূর্তি এবং দেবী ইনেটের মূর্তি। এছাড়া অষ্টাদশ রাজবংশের শেষ রাজা হোরেমহেবের সঙ্গে দেবতা আতুনের একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে এবং দেখা যায় যে, রাজা হোরেমহেব আতুনের সামনে হাঁটু গেড়ে আছেন।। তবে ফারাও রাজা এবং দেবতা ছাড়াও অন্যান্যদের মূর্তি রয়েছে, যেমন ধূসর গ্রানাইট পাথরের তৈরি পাসার এবং তার স্ত্রী হেনাটের মূর্তি। পাসার ছিলেন দ্বিতীয় রামজিসের শাসনামলের (১২৭৯-১২১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) তীরন্দাজ প্রধান। এছাড়া বালক তুতানখামুন সমাধি থেকে আবিস্কৃত কিছু প্রদর্শনী ছাড়াও নব্বই থেকে এক শ ত্রিশ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের তৃতীয় থুতমোজে এবং তৃতীয় আমেনহোটেপের অসংখ্য মূর্তি রয়েছে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, পুরো জাদুঘরের মধ্যে প্রদর্শিত জিনিসপত্রের শৈল্পিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে এবং দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জনের জন্য অত্যাধুনিক প্রদর্শন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি দেওয়াল এবং সিলিং গাঢ় ধূসর রঙের এবং দর্শনীয় জিনিসের উপর এমনভাবে আলোকরশ্মি ফেলা হয়েছে যে, আলো-আঁধারীর লুকোচুরী খেলায় সবকিছু সহজেই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। অনেক দর্শনীয় বস্তু কাচের ফ্রেমের মধ্যে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

আমরা নিচের তলা থেকে উপরের তলায় হেঁটে যাই। তবে বৈদ্যুতিক সিঁড়ি দিয়েও যাওয়া যায়। উপরের তলার মাঝখানে কাচের বাক্সের ভেতর ছোটো জিনিস, যেমন স্বর্ণ, হাঁড় ও পাথরের তৈরি বিভিন্ন ধরনের গহনা, অন্তোষ্টিক্রিয়ায় ব্যবহৃত পাথরের ফলক এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার মতো বস্তু ও শিল্পকর্ম, রাখা হয়েছে। অন্যান্য বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে ফুলদানি, শিলালিপি সহ মৃৎশিল্পের বৈয়াম (বৈয়ামের গায়ে রাজকীয় শিশুদের নাম এবং শিরোনাম উল্লেখ করা আছে), সুগন্ধি বা প্রসাধনী তেলের জন্য কাঁচের বোতল, কাপড়ের মোজা (অষ্টাদশ রাজবংশের সময়ের এবং প্রাচীন মিশরীয় মোজার প্রাচীনতম উদাহরণগুলির মধ্যে অন্যতম) ইত্যাদি। এছাড়া আরও আছে কাঠের এবং পাথরের তৈরি বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম, বিশেষ করে ফারাও সভ্যতার দালান-বাড়ি পরিমাপ করার সরঞ্জামাদি। উপরের তলায় উল্লেখযোগ্য আকর্ষণের মধ্যে আরেকটি হলো চতুর্থ আমেনহোটেপ (আখেনাতেন)-এর পুনর্নির্মিত প্রাচীর, যা কারনাক মন্দির থেকে পাওয়া গিয়েছিল।


EP_3_2

লুক্সর জাদুঘরের বিশাল হলঘরে সাজানো বিভিন্ন ধরনের দর্শনীয় বস্তু


চতুর্থ আমেনহোটেপের বেলেপাথরে (স্যান্ডস্টোন) নির্মিত মূর্তির মাথা দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি বেশ কয়েক মিনিট। তাকে নিয়ে ভাবতে থাকি। তার সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১৩৫৩ থেকে ১৩৩৬ পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেছিলেন। তার রাজত্বের পঞ্চম বছর পর্যন্ত তিনি চতুর্থ আমেনহোটেপ নামে পরিচিত ছিলেন, যা প্রাচীন মিশরীয় থেকে ভাষায় ‘আমন সন্তুষ্ট’। তিনি প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে একটি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেন, যা একজন ঈশ্বরকে– সূর্য দেবতা ‘আতেন– শুধু বিশ্বাস করে। তাই তিনি তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ‘আখেনাতেন’, যার অর্থ ‘আতেনের জন্য উপযোগী’ বা ‘আতেনের অনুসারী’।

পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়ে তিনি আতেনকে একমাত্র সত্যিকারের দেবতা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং আমুনের সমস্ত চিহ্ন ধ্বংস করার চেষ্টা করার বিষয়ে সেট করেছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত, থেবসের প্রধান দেবতা এবং কারনাকের মহান মন্দিরকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।

পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়ে তিনি আতেনকে একমাত্র সত্যিকারের দেবতা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং আমুনের সমস্ত চিহ্ন ধ্বংস করার চেষ্টা করার বিষয়ে সেট করেছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত, থেবসের প্রধান দেবতা এবং কারনাকের মহান মন্দিরকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। যাজক সম্প্রদায়ের জন্য এটি ভালো খবর ছিল না যা শত শত বড়ো এবং ছোটো মিশরীয় দেবতাদের সেবা করার জন্য খুব ভালো জীবিকা নির্বাহ করেছিল যারা এখন হঠাৎ করে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ছিল। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তার মৃত্যুর পর তুতানখামুন তার উত্তরাধিকারী হয়ে পুরানো ধর্মীয় বিশ্বাসে ফিরে যায় এবং মিশরীয়রা পুনরায় বহু দেবতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠে।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-২য় পর্ব


বিভিন্ন দর্শনীয় জিনিসপত্র দেখতে দেখতে আমার পা কিছুটা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল, নাকি আমি ধীর গতিতে হাঁটার সময় চারদিকে তাকিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই সময় ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। যাহোক, একসময় সামান্য দূরে কাঠের তৈরি বাক্স-আকৃতির কারুকাজ করা দুটি কফিন দেখে আমি যেন সম্বিত ফিরে পাই এবং আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক ধরনের অন্যরকম অনুভূতির তরঙ্গ দ্রুত নেমে যায়। আমরা কফিনের কাছে যাই।


EP_3_3

ফারাও রাজা চতুর্থ আমেনহোতেপ (আখেনাতেন)-এর মূর্তির ভঙ্গিতে লেখক


বাক্স-আকৃতির (বাইরের) কাঠের কফিনটি ইমেনির জন্য খোদাই করা হয়েছিল। ইমেনি ছিল প্রাচীন মিশরের মিডল কিংডমের এগারোতম রাজবংশের সময় (২০৬৫-১৯৯৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) উচ্চ আদালতের বিচারক। ইমেনির কফিনের অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো সমস্ত অভ্যন্তরীণ দেয়ালের গায়ে সুরক্ষিত কারুকাজ, যা আদর্শ সমাধি সরঞ্জামের ‘কফিন লিপিকা’ এবং পলিক্রোমের ব্যবহার প্রমাণ করে।

ইমেনির কফিনের ভেতর দ্বিতীয় কাঠের কফিনটি ছিল। দ্বিতীয় কফিনের বাইরের দিকে শুধু সাজানো হয়েছে। সেখানে সঙ্গত কারণে ইমেনির নাম এবং শিরোনাম পাওয়া যায়নি, বরং ‘তার প্রিয়তমা স্ত্রী ভদ্রমহিলা গেহেসেট’—এর নাম পাওয়া গিয়েছে। তার কফিনের শিলালিপি এবং সাজসজ্জার উপর ভিত্তি করে ধারণা করা হয় যে, তিনি তার স্বামীর চেয়ে এক থেকে দুই প্রজন্মের ছোটো ছিলেন।

ছোটো কফিনটি বড়ো কফিনের মধ্যে স্থাপন করার কারণ ছিল কবরে জায়গার স্বল্পতা। কেননা দুটি কফিন রাখার জন্য কবরটি যথেষ্ট বড়ো ছিল না। কবর ডাকাতরা উভয় কফিনের পায়ের দিকের অংশ ভেঙে দিয়েছিল এবং আংশিক ভাবে মমি করা কঙ্কালের অবশিষ্টাংশ কফিনের কাছাকাছি পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, সুরক্ষিত কফিন দুটি ২০০৪ সালে লুক্সরের কাছে ‘দ্রা আবু এল-নাগা’ কবরস্থানে ইমেনি এবং গেহেসেটে মূল সমাধিস্থলে আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং প্রদর্শণের জন্য ২০০৭ সাল থেকে লুক্সর জাদুঘরে রাখা হয়েছে।


EP_3_4

ইমেনির জন্য নির্মিত বাক্স-আকৃতির কারুকাজ করা কাঠের কফিন


লুক্সর জাদুঘরের উপরের তলায় ২০০৪ সালে একটি নতুন অংশ নির্মাণ করা হয়। সেই অংশটি নতুন রাজ্যের (নিউ কিংডম, সময়কাল: ১৫৫০–১০৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সময় প্রাচীন থেবসের গৌরবের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। ‘মিশরীয় সামরিক বাহিনীর স্বর্ণযুগ’ খ্যাত সেই সামরিক হলের এক পাশে অন্ধকার কক্ষে কাঁচের বাক্সের মধ্যে সুন্দরভাবে প্রদর্শনের জন্য রাখা রয়েছে দুটি রাজকীয় মমি – প্রথম আহমোজ এবং প্রথম রামেজিস। উল্লেখ্য, প্রথম রামেজিসের মমি সম্পর্কে কিছুটা মতানৈক্য রয়েছে। যাহোক, সেই অন্ধকার ঘরে ঢোকার আগে দেওয়ালে মমি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছি।

প্রথম আহমোজ ছিলেন নতুন রাজ্যের (নিউ কিংডম) অষ্টাদশ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, যা প্রাচীন মিশরকে দুই শ বছরেরও অধিক সময় শাসন করে। কথিত আছে, সেই রাজবংশের সময়েই মিশরীয় সভ্যতা সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেছিল প্রথম আহমোজ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১৫৫০ থেকে ১৫২৫ পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। আহমোজ নামের অর্থ হলো ‘ইয়াহ (চাঁদ) জন্মগ্রহণ করেন’। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে ইয়াহ একজন চন্দ্র দেবতা।

তার বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয় এবং দশ বছর বয়সে তার ভাই যখন অজ্ঞাত কারণে মারা যায়, তখন তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তার নেতৃত্বে মিশরীয়রা দেশ থেকে শত্রুদের বিতারিত করে।

প্রথম আহমোজ ছিলেন দ্বিতীয় সেকেনেনরা তাওয়ের পুত্র এবং সপ্তদশ রাজবংশের শেষ ফেরাউন কামোজের ভাই ছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয় এবং দশ বছর বয়সে তার ভাই যখন অজ্ঞাত কারণে মারা যায়, তখন তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তার নেতৃত্বে মিশরীয়রা দেশ থেকে শত্রুদের বিতারিত করে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, তার রাজত্বকালে থেবস শহর ছিল সমস্ত মিশরের রাজধানী, যা মধ্য রাজ্যের (মিডল কিংডম) প্রথম দিকের এগারোতম রাজবংশের সময় ছিল।


EP_3_5

লুক্সর জাদুঘরে সংরক্ষিত ফারাও রাজা প্রথম আহমোজের মমির পাশে মেহেরুন নিসা


ফারাও রাজা হিসেবে অভিষেকের পর প্রথম আহমোজ নিজেকে ‘শক্তির প্রভু রা’ নামে পরিচিত করেন। জানা যায়, রা ছিল প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবতা, যা সাধারণত মধ্য-দুপুরের সূর্যের সঙ্গে চিহ্নিত করা হত। সে ছিল সূর্য, আদেশ, রাজা ও আকাশের দেবতা। দেবতা রা-কে একটি বাজপাখি হিসেবে চিত্রিত করা হয় এবং সে আকাশ দেবতা ‘হোরাস’-এর সঙ্গে বৈশিষ্ট্যসমূহ ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। অনেক সময় দুই দেবতাকে ‘রা-হোরখটি’ (যার অর্থ ‘রা, যিনি দুই দিগন্তের হোরাস’) হিসেবে একত্রিত করা হত। নতুন রাজ্যে, যখন দেবতা আমুন খ্যাতি অর্জন করেন, তখন তিনি আমুন-রা হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেন। ধারণা করা হয় যে, মৃত্যুর পরে তার মরদেহ মমি করে গোপনে অ্যাবিডোস এলাকায় সমাহিত করা হয়েছিল। জানা যায়, সেখানেই তিনি পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন—যা ছিল সেই অঞ্চলের একমাত্র পিরামিড। কিন্তু তার মমি ১৮৮১ সালে দইর আল-বাহারির গোপন জায়গায় আবিষ্কৃত হয়, যা হাতশেপসুটের মর্গ মন্দিরের সরাসরি উপরের পাহাড়ে অবস্থিত। মমিটি একটি কফিনের মধ্যে পাওয়া যায় যেখানে তার নাম হায়ারোগ্লিফসে লেখা ছিল এবং তার ব্যান্ডেজে তার নাম আবার হিরাটিক লিপিতে লেখা ছিল। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যে, তাকে তার মূল সমাধিস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং একুশতম রাজবংশের যাজক-রাজা দ্বিতীয় পিনেদজেমের শাসনামলে দইর আল-বাহারির গোপন জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় পিনেদজেমের নাম মমির মোড়কে লেখা ছিল। যাহোক, আবিস্কারের কয়েক বছর পরে (১৮৮৬ সালে) মমিটি উন্মোচন করা হয়। তার মমি গবেষণা করে দেখা দিয়েছে যে, তিনি বাতরোগে ভুগেছেন। তার দেহের উচ্চতা ছিল মাত্র ১.৬৩ মিটার (বা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির একটু বেশি)।

তখন তিনি আমুন-রা হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেন। ধারণা করা হয় যে, মৃত্যুর পরে তার মরদেহ মমি করে গোপনে অ্যাবিডোস এলাকায় সমাহিত করা হয়েছিল। জানা যায়, সেখানেই তিনি পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন—যা ছিল সেই অঞ্চলের একমাত্র পিরামিড।

প্রথম আহমোজের মমি দেখে আমরা পাশের ঘরে যাই। সেখানে প্রথম রামেজিসের মমি রাখা হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, প্রথম রামেজিস ছিলেন উনিশতম রাজবংশের প্রথম রাজা এবং প্রথম সেতির পিতা। তিনি মাত্র দু’ বছর (১২৯২-১২৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন উনিশতম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। সেই রাজবংশের পথ ধরেই পরবর্তীতে প্রাচীন মিশরের ক্ষমতায় এসেছিলেন আরও নয়জন ফারাও রাজা, যারা দ্বিতীয় রামেজিস থেকে দশম রামেজিস নামে পরিচিত। প্রথম রামেজিস তার মমি নিয়ে অনেক ঘটনা রয়েছে। কানাডিয়ান নায়াগ্রা জলপ্রপাত প্রাচীন এক জাদুঘরের স্টোর রুমে ১৪০ বছর তার মমি অজ্ঞাত ছিল। টরন্টোর একজন ব্যক্তিগত সংগ্রাহক ১৯৯৯ সালে সেই জাদুঘরের সবকিছু ক্রয় করেন এবং সে বছরই তিনি আরও অন্যসব সংগৃহীত জিনিসের সঙ্গে অজ্ঞাত মমি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া রাজ্যের আটলান্টার এক জাদুঘরের কাছে বিক্রি করেন। তারপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে জানা যায় যে, অজ্ঞাত মমিটি প্রথম রামেজিসের। যাহোক, ২০০৩ সালে আটলান্টার জাদুঘর সদিচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সহযোগিতার উপহার হিসেবে প্রথম রামেজিসের মমিটি মিশরকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

অবশেষে আমাদের ফেরার পালা। মনের মধ্যে এক অদ্ভূত অনুভূতি নিয়ে উল্টো দিকে হাটতে থাকি। সত্যি কথা বলতে কি, লুক্সর জাদুঘরের সব প্রদর্শনীর মধ্যে আমার মনে হয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান প্রদর্শনী প্রথম আহমোজ এবং প্রথম রামেজিসের মমি।

যদিও কায়রো জাদুঘরের মতো বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা হয়নি কিংবা অধিক সংখ্যক শিল্পকর্ম নেই, তবুও আয়তনে ছোটো এবং স্বল্প সংখ্যক শিল্পকর্মের ভান্ডার লুক্সর জাদুঘরকে সহজেই প্রত্যাখান করা যাবে না। কেননা লুক্সর জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে শিল্পকর্মের সংখ্যার দিক দিয়ে বিবেচনা করে নয়, বরং প্রদর্শিত শিল্পকর্মের গুণগত মান বিচার করে। এছাড়া সেখানে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত দর্শনীয় জিনিসপত্র সুপরিকল্পিত ভাবে সাজানো হয়েছে, যা দর্শনার্থীদের নজর কাড়ার জন্য যথেষ্ট। আসলেই লুক্সর জাদুঘর প্রাচীন মিশরের রাজকীয় শিল্পকর্মের বিস্ময়কর ভান্ডার। কেননা জাদুঘরে এক ধরণের ‘পরিমাণের আগে গুণমান’ (কোয়ালিটি বিফোর কোয়ান্টিটি) নীতি রয়েছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।