মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

ফজল হাসানের ধারাবাহিক ভ্রমণগদ্য : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৫ম পর্ব

0

ভ্যালি অব দ্য কিংক্স: প্রাচীন মিশরের মৃত ফারাওদের রাজকীয় আবাসভূমি


ফারাও রানি হাটশেপসুটের ম্যরচুয়্যারি টেম্পল (সমাধি মন্দির) থেকে বেরিয়ে এসে আমরা বাসে উঠি। গাইড বলেছে, সেখান থেকে ভ্যালি অব দ্য কিংক্স মাত্র মিনিট দশেকের পথ। ফারাও রাজারা ভ্যালি অব দ্য কিংক্সকে মনে করতো ‘পরবর্তী জীবনের প্রবেশদ্বার’ (দ্য গেইটওয়ে টু দ্য আফটারলাইফ)। কেননা প্রাচীন কালে তারা বিশ্বাস করতো যে, মৃত্যুই জীবনের সমাপ্তি নয় এবং তারা পরবর্তী জীবনে একই অবয়ব নিয়ে পুনরুথ্থিত হবে, অর্থাৎ তারা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিল। তাই ফারাও রাজারা মৃত্যুর পরে এবং পুনর্জ্জীবনের আগের সময়টুকুতে পাহাড়ের গর্ভে নির্জনে শুয়ে থাকার জন্য তৈরি করেছিল রাজকীয় আবাসভূমি। উল্লেখ্য, ওল্ড কিংডমের সময়ে (২৬৪৬-২১৫২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ফারাও রাজারা নির্মাণ করেছে বিভিন্ন ধরনের পিরামিড, কিন্তু পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ নিউ কিংডম আমলে (১৫৫০-১০৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), ফারাও রাজারা তৈরি করেছে জনারণ্যের বাইরে কারনা পাহাড়ের উপত্যকায় গুহার ভেতর সমাধি।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-১ম পর্ব


ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় যে, প্রাচীন মিশরের নিউ কিংডমের সূচনা লগ্নে ফারাও রাজারা থেবস (বর্তমানে লুক্সর) শহরে নতুন রাজধানী গড়ে তোলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, পিরামিডের মতো বিশাল সমাধি নির্মাণ করবেন না, বরং তারা তাদের মমিকে আরও নির্জন এবং এমন দূর্গম জায়গায় সমাধিস্থ করবেন যেখানে কেউ যেতে পারবে না। অর্থাৎ সেখানে যাওয়ার পথ হবে সংকীর্ণ ও বন্ধুর। সুতরাং তাদের মমি নিরাপদে থাকবে। তারা থেবসের অদূরে নীল নদের পশ্চিম পাড়ে খানিকটা ভেতরের দিকে এবং লোকালয় থেকে দূরে অবস্থিত নিখুঁত জায়গা খুঁজে পায়, যা ছিল কারনা পাহাড়ের উপত্যকা। সেখানে সমাধি খননের জন্য প্রচুর জায়গা ছিল।

নিউ কিংডমের সময়ে ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের সরকারি নাম ছিল ‘The Great and Majestic Necropolis of the Millions of Years of the Pharaoh, Life, Strength, Health in The West of Thebes’, যা বাংলায় তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায়: ‘প্রাচীন মিশরের থেবস্ শহরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ফারাও, জীবন, শক্তি, স্বাস্থের লক্ষ লক্ষ বছরের মহান ও মহিমান্বিত গোরস্থান’। তবে প্রাচীন মিশরীয় ও কপ্টিক ভাষায় জায়গাটির নাম ‘তা-সেখেত-মা’আত’ (দ্য গ্রেট ফিল্ড বা মহান ভূমি)। এছাড়া জায়গাটি মিশরীয় আরবি ভাষায় ‘ওয়াদি আল মুলুক’ (ভ্যালি অব দ্য কিংক্স) বা ‘ওয়াদি আবওয়াব আল মুলুক’ (ভ্যালি অব দ্য গেইটস্ অব দ্য কিংক্স) নামে পরিচিত। তবে ফরাসী ইতিহাসবিদ এবং প্রাচীন মিশরীয় ভাষা হায়রোগ্লিফিস ভাষা বিশেষজ্ঞ Jean-François Champollion (১৭৯০-১৮৩২), ১৮২৮ সালে জায়গাটি পরিদর্শন করেন এবং নাম রাখেন ‘ভ্যালি অব দ্য কিংক্স’। বর্তমানে এ নামেই সারা বিশ্বে পরিচিত।

ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে নিউ কিংডমের আঠারো থেকে বিংশতম রাজবংশের অনেক ফারাও রাজাদের সমাহিত করা হয়েছে। সেসব ফারাওদের মধ্যে তৃতীয় থুতমোস (রাজত্বকাল ১৪৭৯-১৪২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), তুতানখামুন (রাজত্বকাল ১৩৩৩-১৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), প্রথম সেটি (রাজত্বকাল ১২৮৯-১২৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং দ্বিতীয় র‌্যামসেস বা ‘র‌্যামসেস দ্য গ্রেট’ (রাজত্বকাল ১২৭৯-১২১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সেখানে সমাহিত করা হয়েছে বিভিন্ন রানি, রাজপরিবারের গুরূত্বপূর্ণ সদস্য, উচ্চ পর্যায়ের যাজক ও ধর্মগুরু এবং প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ।


EP_5_1

ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের উত্তর পার্শ্ব


বাসের মধ্যে গাইড আমাদের ভ্যালি অব দ্য কিংক্স সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দিয়েছে। ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে মোট এগারোটি সমাধি দর্শনার্থীদের জন্য পর্যায়ক্রমে উন্মুক্ত রাখা হয়। এগুলোর মধ্যে আটটি সমাধির (কেভি১–সপ্তম র‌্যামসেস, কেভি২–চতুর্থ র‌্যামসেস), কেভি৬–নবম র‌্যামসেস), কেভি৮–মেরেপতাহ, কেভি১১–তৃতীয় র‌্যামসেস, কেভি১৪–ট্যাউসারট-সেটনাখট্, কেভি১৫–দ্বিতীয় সেটি এবং কেভি৪৭–সিপটাহ) মধ্যে মাত্র প্রবেশ টিকেটের সঙ্গে তিনটি সমাধি দর্শন করা যায়। কেননা সমাধিগুলো দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ নিয়মিত অদল-বদল করে। এছাড়া সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার এবং সংস্কারের জন্য সেসব সমাধি পর্যায়ক্রমে খোলা রাখা হয়। অন্যদিকে যে তিনটি সমাধিতে যেতে বাড়তি বা আলাদা টিকেট ক্রয় করে ঢুকতে হয়, সেগুলো হলো: কেভি৯–পঞ্চম ও ষষ্ঠ র‌্যামসেস, কেভি১৭–প্রথম সেটি এবং কেভি৬২–বালক রাজা তুতানখামুনের সমাধি। উল্লেখ্য, সবগুলো সমাধি একই সঙ্গে খোলা থাকে না।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-২য় পর্ব


বেলা তখন প্রায় এগারোটা। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ। শীতের প্রকোপ নেই বললেই চলে। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। কেননা আমরা বিগত ছত্রিশ বছর ধরে অষ্ট্রেলিয়ার যে শহরে বসবাস করছি, সেখানে শীতের সময় তাপমাত্রা লজ্জাহীন ভাবে সুড়সুড় করে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে মাইনাসে চলে যায়। তাই বাইরের তাপমাত্রা তেমন শীতল মনে হয়নি। তবে গায়ে স্যুয়েটার ছিল। যাহোক, কংক্রিটের রাস্তা। গাড়ি আপন গতিতে এগিয়ে চলে। দু-ধারে ফাঁকা। আশেপাশে এবং কাছাকাছি জনবসতি নেই। তবে অনেক দূরে বাড়িঘরের অস্তিত্ব দেখা গেছে। সত্যি, আমরা দশ মিনিটের মধ্যে ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের মূল প্রবেশদ্বারের পাশে পার্কিং এরিয়ায় পৌঁছি। গাইড আগে নেমে গিয়ে টিকেট কেটে আনে। বিদেশীদের জন্য টিকেটের মূল্য ঈজিপশিয়ান দুই শ চল্লিশ পাউন্ড। টিকেটের গায়ে লেখা আছে ‘ফর থ্রি টুমস্’, অর্থাৎ প্রবেশ টিকিটের সঙ্গে মাত্র তিনটি গুহা দর্শন করা যাবে। একসময় গাইড আমাদের হাতে টিকেট তুলে দিয়ে তাকে অনুসরণ করতে বললো। গেইটে টিকেট দেখিয়ে আমরা সবাই ভেতরে প্রবেশ করি।

মূল গেইট থেকে গুহার ভেতর সমাধিগুলো বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত। তাই যাতায়াতের জন্য রয়েছে হাশেপসুট মন্দিরের মতো ট্রাম গাড়ি। ট্রামের ভাড়া ট্যুর প্যাকেজের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল। আমরা কয়েক মিনিট অপেক্ষা করি। অবশেষে গাইড আমাদের একটি গাড়িতে তুলে দেয় এবং সে-ও ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছাই। গাড়ি থেকে নামার পরে গাইড আমাদের জড়ো করে। উল্লেখ্য, মৃত ফারাওদের সম্মানার্থে ট্যুর গাইডদের গুহার ভেতর সমাধি স্থলে যাওয়ার কোন অনুমতি নেই। তাই তারা দলের সবাইকে প্রতিটি গুহার সামনে জড়ো করে সমাধি, বিশেষ করে সমাধির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা, কোন রাজাকে সেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সমাধির ইতিহাস এবং ভিতরের সাজসজ্জা ও কারুকাজ, সম্পর্কে বয়ান দিয়ে সে বাইরে অপেক্ষা করে। এছাড়া প্রতিটি সমাধির প্রবেশদ্বারের পাশে সাইন বোর্ডে গুহার নকশা, সমাধির গুরুত্ব, কোন রাজার সমাধি, ইতিহাস এবং দেওয়াল ও সিলিং-এর চিত্রকর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে।

গাইডের তথ্য অনুযায়ী জানতে পেরেছি যে, অনেক বছর ধরে ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে ছবি তোলা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, অর্থাৎ দর্শনার্থী ভ্রমণের ব্যক্তিগত ছবি তুলতে এবং ভিডিও করতে পারে। ডিজিটাল/ডিএসএলআর উভয় ক্যামেরা, এমনকি মোবাইল ফোন, দিয়ে ছবি তোলা কিংবা ভিডিও করার জন্য ফটোগ্রাফি পারমিট ঈজিপশিয়ান নিতে হতো এবং তার জন্য আলাদা তিন শ পাউন্ড খরচ হতো। মোবাইল ফোনের নিষেধাজ্ঞা ২০২০ সালের শুরু থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই সঙ্গে থাকা মোবাইল দিয়ে ছবি তুলতে কোন ঝামেলা হয়নি।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৩য় পর্ব


আমরা যে তিনটি গুহার ভেতর প্রবেশ করেছিলাম, সেগুলো ছিল কেভি২ (চতুর্থ র‌্যামসেসের সমাধি), কেভি৬ (নবম র‌্যামসেসের সমাধি) এবং কেভি১১ (তৃতীয় র‌্যামসেসের সমাধি)। এখানে লক্ষণীয় বিষয় যে, প্রত্যেকটি আবিস্কৃত সমাধির একটি করে কেভি (কিংক্স ভ্যালির সংক্ষিপ্ত ফর্ম) নাম্বার রয়েছে এবং সেসব নাম্বার আবিষ্কারের ক্রমানুসারের দেওয়া হয়েছে। যেমন আজ পর্যন্ত আবিস্কৃত তেষট্টিটি গুহার নামকরণ করা হয়েছে কেভি১ থেকে কেভি৬৩, অর্থাৎ প্রতিটি সংখ্যার আগে সংক্ষিপ্ত কেভি ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, ১৮২৭ সালে বিখ্যাত ইংরেজ প্রত্বতত্ত্ববিদ জন গার্ডনার উইলিনসন (১৭৯৭-১৮৭৫) এই পদ্ধতিতে নামকরণ প্রবর্তন করেন।

যাহোক, ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে এ পর্যন্ত সর্বমোট তেষট্টিটি সমাধি আবিস্কৃত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে তেইশজন ফারাও রাজার সমাধি চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা ছিলেন নিউ কিংডমের শাসনামলের আঠারো, উনিশ ও বিংশতম রাজবংশের রাজা। উল্লেখ্য, সেই তেষট্টিটি সমাধির মধ্যে একমাত্র বালক-রাজা তুতানখামুনের সমাধি (কেভি৬২) অক্ষত ছিল। বাকিগুলো কবর ডাকাত এবং লুটেরাদের হাতে নষ্ট হয়েছে। বলা হয়, ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে আবিস্কৃত সমাধির মধ্যে তুতানখামুনের সমাধি উল্লেখযোগ্য এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার ১৯২২ সালের নভেম্বরে সমাধিটি আবিষ্কার করেন। তবে তুতানখামুনের সমাধি নিয়ে অভিসম্পাতের কাহিনি চালু আছে। যেমন অনেকের ভাষ্য মতে জানা যায় যে, তুতানখামুনের সমাধি আবিষ্কারের ছ’মাসের মধ্যেই লর্ড কারনারভান, যিনি হাওয়ার্ড কার্টারের অর্থকড়ি যোগানদাতা ছিলেন, মারা যায়। এছাড়া কয়েক বছরের ভেতর মারা যায় হাওয়ার্ড কার্টারসহ আরও অনেক সহকর্মী।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খিৃষ্টপূর্ব পনের শ সালের দিকে ফারাও রাজা প্রথম তুথমোসিস (রাজত্বকাল: ১৫০৬-১৪৯৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পূর্বসূরী ফারাওদের মতো বিশাল পিরামিড না বানিয়ে ডাকাতদের হাত থেকে তার সমাধি রক্ষা করার জন্য তৈরি করেছিলেন ভ্যালি অব দ্য কিংক্স। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের (সময়কাল: ১৫৫০-১২৯১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) তৃতীয় ফারাও। ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে প্রথম ফারাও হিসেবে তাকে সমাধিস্থ করা হয় এবং খিৃষ্টপূর্ব ১১০৭ সালে দশম র‌্যামেসেসকে শেষ ফারাও হিসেবে সমাধি করা হয়।


আরও পড়ুন : বাইরে দূরে মিশর ঘুরে-৪র্থ পর্ব


যাহোক, ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের বেশিরভাগ সমাধি চুনাপাথর কেটে প্রায় একই ধরনের নকশা অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়েছে। তিনটি করিডোর, একটা এন্টিচেম্বার আর সারকোফাগাস (কফিন বাক্স) রাখার চেম্বার বা প্রকোষ্ট। সেসব ভূগর্ভস্থ সমাধিতে মরদেহ অর্থাৎ বাক্সবন্দি মমি খুব সহজেই লুকিয়ে রাখা যেত, কেননা সেখানে প্রবেশ করে চুরি বা ডাকাতি করা কঠিন ছিল। তাই ফারাওদের মৃতদেহকে সমাধি চোর-ডাকাতদের কবল থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পিরামিডের পরিবর্তে উপত্যকায় কবর দেওয়ার রীতি চালু হয়েছিল।

কেভি৯ সম্পর্কে গাইড আমাদের এক আজগুবি তথ্য দিয়েছে। সে বলেছে যে, কেভি৯ সমাধির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল পঞ্চম র‌্যামসেসের (রাজত্বকাল: ১১৪৭-১১৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জন্য, কিন্তু ষষ্ঠ র‌্যামসেস (১১৪৩-১১৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সেই নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখেন। পরবর্তীতে সেই সমাধিতে উভয় ফারাওকে সমাহিত করা হয়। সে আরও বলেছে যে, প্রবেশ পথ থেকে কফিন বাক্সে মমি রাখার চেম্বারের দূরত্ব এক শ মিটারেরও বেশি এবং যাওয়ার পথটি বেশ প্রশস্ত। দেয়াল এবং সিলিং জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর উৎপত্তির পৌরাণিক কাহিনির চিত্র এবং জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিষয়ে অঙ্কনশিল্প।

বর্তমানে কোন গুহার ভেতরের সমাধিস্থলে কোন মরদেহ (মমি) নেই। তবে উৎসাহী পর্যটক এবং দর্শার্থীদের কৌতূহল নিবারণ এবং মনোরঞ্জনের জন্য গুহার কড়িডোরের কারুকাজ করা দেওয়াল ও সিলিং এবং মমি রাখার প্রকোষ্ট পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কেননা ফারাওদের আমলে প্রাচীন মিশরীয়দের পরবর্তী জীবনের বিশ্বাস এবং পরবর্তী বিশ্বের জন্য তাদের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সমাধি নির্মাণ করত। তারা বিশ্বাস করত যে, পরকালে তাদের জীবন চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এবং ফারাওদের দেবতাদের সঙ্গে মিত্রতা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। মমিফিকেশন, অর্থাৎ মমি প্রস্তুত, প্রক্রিয়া মূলত মৃত দেহ সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেন তাদের আত্মা পরবর্তী জীবনে আবার জেগে উঠতে পারে। প্রাচীন সমাধিগুলোতে মৃতের সমস্ত জিনিসপত্রও দেওয়া হত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে, সেসব জিনিস তাদের পরবর্তী জীবনে প্রয়োজন হতে পারে।


EP_5_2

ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে নবম র‌্যামসেসের সমাধির (কেভি৬) প্রবেশ পথ


সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে, প্রাচীন মিশরীয় ফারাওরা তাদের সমাধিতে আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, এমনকি আন্ডারগার্মেন্টস, দামী অলংঙ্কার, খাদ্যসামগ্রী এবং বিভিন্ন ধরনের পানীয়সহ অনেক কিছুই রাখার ব্যবস্থা করত। বালক ফারাও রাজা তুতানখামুনের সমাধিতে অনেক দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার করার মতো জিনিসপত্র ও খাদ্যসামগ্রী পাওয়া গিয়েছে, যা বর্তমানে কায়রো জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া তাদের প্রিয় সঙ্গী এবং দাসীদেরও একই সঙ্গে সমাহিত করা হয়েছে। তবে ফারাওদের সমাধিতে কোন বই-পুস্তক পাওয়া যায়নি। যাহোক, বই-পুস্তক না থাকার রহস্য গবেষকদের কাছে এখনো প্রশ্ন হয়ে রয়ে গেছে।

সমাধির অভ্যন্তরে, বিশেষ করে করিডোরের দুপাশে, সিলিং-এ এবং চেম্বারের মধ্যে, বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে উল্লেখযোগ্য এবং প্রয়োজনীয় তথ্য প্রাচীন হায়রোগ্লিফিস ভাষায় লেখা আছে। এছাড়া দেওয়াল ও সিলিং-এ অঙ্কিত বাহারি রঙের শিল্পকর্ম রয়েছে। সেসব চিত্রাঙ্কণের মাধ্যমেও ফারাও রাজাদের গুণকীর্তন এবং বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। অনেক জায়গায় বার্ধকের ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। কোথাও আবার রঙ উঠে গেছে অথবা পলেস্তারা খসে পড়েছে। তবে এখনো যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা নিজের চোখে দেখার পর অবশ্যই তারিফ করতে হয়।

ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের প্রথমেই ডানে-বামে যে কয়টা সমাধির মুখোমুখি হতে হয়, তাদের মধ্যে কেভি৬, অর্থাৎ নবম র‌্যামসেসের, সমাধি অন্যতম। নবম র‌্যামসেস ছিলেন বিংশতম রাজবংশের অষ্টম রাজা এবং খ্রিষ্টপূর্ব ১১২৫ থেকে ১১০৭ পর্যন্ত তিনি রাজ্য শাসন করেন। রাজ্য শাসনের সময়কাল বিবেচনা করলে তিনি ছিলেন তৃতীয় র‌্যামসেস এবং একাদশ র‌্যামসেসের পর একই রাজবংশের তৃতীয় দীর্ঘতম রাজা। তার আসল নাম ছিল Amon-her-khepshef Khaemwaset। তবে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করার পরে নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন Neferkare Setepenre Ramesses IX Neferkare Setepenre বাংলায় তরজমা করলে মোটামুটি দাঁড়ায় ‘দেবতা রা-এর সুন্দর আত্মা, রা-এর পছন্দনীয়’।

লম্বা করিডোর এবং সেখানে বেশ ভীড়। দর্শনার্থীদের মধ্যে কেউ আমাদের মতো সমাধি দেখার জন্য নিচের যাচ্ছে, অনেকেই আবার দেখা শেষে ফিরে আসছে এবং অন্যরা দেওয়ালের দু’পাশে ও সিলিংয়ের কারুকাজ দেখে চোখ আর মনকে তৃপ্ত করছে। আমরা কোনরকমে গা বাঁচিয়ে শেষ মাথায় পৌঁছি। যদিও গুহার ভেতর ঢোকার আগে গাইড আমাদের বলেছিল যে, এ পর্যন্ত ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে যতগুলো সমাধি আবিস্কৃত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কেভি৬-এর প্রবেশদ্বার সবচেয়ে বড় ও প্রশস্ত। কিন্তু দর্শনার্থীদের ভিড়ে তা মালুম হয়নি।

যাহোক, তিনটি সমাধি দেখার মধ্যে সেটি ছিল আমাদের প্রথম সমাধি দর্শন। তাই স্বাভাবিক কারণেই আমার মনের ভেতর ছিল এক ধরনের উত্তেজনা এবং বাকিটা রোমহর্ষক কিছু দেখার আকুলতা। সিস্টার মাই, তার মা, মামী ও বোনেরা এবং মেহেরুন ও আমি দল বেঁধে লোহার দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। লম্বা করিডোর এবং সেখানে বেশ ভীড়। দর্শনার্থীদের মধ্যে কেউ আমাদের মতো সমাধি দেখার জন্য নিচের যাচ্ছে, অনেকেই আবার দেখা শেষে ফিরে আসছে এবং অন্যরা দেওয়ালের দু’পাশে ও সিলিংয়ের কারুকাজ দেখে চোখ আর মনকে তৃপ্ত করছে। আমরা কোনরকমে গা বাঁচিয়ে শেষ মাথায় পৌঁছি। যদিও গুহার ভেতর ঢোকার আগে গাইড আমাদের বলেছিল যে, এ পর্যন্ত ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে যতগুলো সমাধি আবিস্কৃত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কেভি৬-এর প্রবেশদ্বার সবচেয়ে বড় ও প্রশস্ত। কিন্তু দর্শনার্থীদের ভিড়ে তা মালুম হয়নি।

কেভি৬-এ একের পর এক করে তিনটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। প্রকোষ্ঠগুলো এবং করিডোরের দেওয়ালে হায়রোগ্লিফিস ভাষায় বিভিন্ন রঙের চিত্রকর্ম এবং ধর্মীয় বানী খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সমাধির পেছনের দিকে রাজকীয় পোশাকে র‌্যামসেসের ছবি এবং বিভিন্ন দেবতা চতুর্দিক থেকে তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তবে সময়ের নির্মম করাঘাতে অনেক জায়গায় পলেস্তারা খুলে গিয়ে চিত্রকর্ম এবং ধর্মীয় বানী নষ্ট হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, হায়রোগ্লিফিস এক ধরনের সাঙ্কেতিক ভাষা, যা প্রাচীন মিশরে আনুষ্ঠানিক লেখার পদ্ধতি হিসেবে, বিশেষ করে প্রাচীন মিশরীয় স্মৃতিস্তম্ভে, ব্যবহার করা হতো। লোগোগ্রাফিক, সিলেবিক এবং বর্ণমালার দিয়ে গঠিত হায়রোগ্লিফিসে এক হাজার স্বতন্ত্র অক্ষর রয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভে কিংবা প্যাপিরাস (এক ধরনের গাছের বাকল দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি) কাগজে অঙ্কিত চিত্র বা প্রতীক ব্যবহার করে, অর্থাৎ হায়রোগ্লিফ সাঙ্কেতিক ভাষায় ফারাও রাজাদের নাম লেখা, তাদের জন্ম বৃত্তান্ত, রাজ্য শাসন এবং বীরত্বের কাহিনি, এমনকি ধর্মীয় বাণীও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।


EP_5_3

নবম র‌্যামসেসের সমাধির (কেভি৬) দেওয়ালে প্রাচীন মিশরীয় ভাষা হায়রোগ্লিফিসে লেখা ধর্মীয় বাণী


গুহার শেষ মাথায় মমি রাখার প্রকোষ্টে পৌঁছানোর পরে আমার সারা শরীরে কেমন এক ধরনের গা ছমছম ভাব ছড়িয়ে পড়ে। চারপাশে তাকিয়ে দেখার সময় আমার মনে হয়েছে আমি যেন টাইম মেশিনে চড়ে সাড়ে তিন হাজার বছর পেছনে ফিরে গেছি। আমার আশেপাশে কেউ নেই। কোন কোলাহল নেই, নেই কোন শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষীণ আওয়াজ। সেই নির্জনতা এবং নিস্তবদ্ধতার মাঝে আমি বোবার মতো একাকী দাঁড়িয়ে আছি। আচমকা মেহেরুনের ডাকে আমার সম্বিৎ ফিরে আসে। আমি যেন নিউটনের আপেলের মতো ধুপ করে কল্পনার জগৎ থেকে ছিঁটকে পড়ে যাই বাস্তবের রূঢ় জমিনে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামাল দিয়ে মেহেরুনকে বললাম, ‘সবাই কোথায়?’ কড়িডোরের দিকে তাকিয়ে মেহেরুন বললো, ‘সবাই বাইরে গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’ আমি বললাম, ‘চলো যাই।’

বাইরে এসে দেখি সবার সঙ্গে গাইড আরবীতে কথা বলছে। আমাদের দেখে সিস্টার মাই চোখ টিপে টিপ্পনি কাটে, ‘কী, রাজার সঙ্গে দেখা হলো?’ কিছু না বলে আমি তার প্রশ্নের বিনিময়ে চোখেমুখে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে তুলি।

আমরা গাইডকে অনুসরণ করে সামান্য দূরে কেভি১১-এর দিকে এগিয়ে যাই।

প্রাচীন মিশরের ফারাও রাজা তৃতীয় র‌্যামসেসের (জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ১২১৭ এবং মৃত্যু খ্রিষ্টপূর্ব ১১৫৫) সমাধি কেভি১১। তৃতীয় র‌্যামসেস ছিলেন বিংশতম রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা এবং তার বাবা ছিলেন রাজা সেথনাকত্ (শাসন আমল: ১১৮৭-১১৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বুঝানোর উদ্দেশ্যে তৃতীয় র‌্যামসেসের বেশ কিছু নাম ছিল, যেমন ‘দেবতা রা তাঁকে সজ্জিত করেছেন’ এবং ‘হেলিওপলিসের শাসক’। এছাড়া তৃতীয় র‌্যামসেস সিংহাসনে আরোহণ করার পরে ‘শক্তিশালী ন্যায়বিচারক, আমুনের প্রিয়’ নাম গ্রহণ করেন। তিনি একত্রিশ বছর (খ্রিষ্টপূর্ব ১১৮৪ সাল থেকে ১১৫৩ সাল) প্রাচীন মিশর শাসন করেন। তার সেই দীর্ঘ শাসনামলে তিনি একাধিক বিশাল মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করেন। এছাড়া তিনি কয়েকটি সামরিক যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং দূর দেশ থেকে অজস্য দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র এনে দেশকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ইতিহাসবিদদের মতে, তিনি ছিলেন বিংশতম রাজবংশের অন্যতম শেষ রাজা।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, তৃতীয় র‌্যামসেসের মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক। তার দ্বিতীয় স্ত্রী আপন ছেলেকে রাজসিংহাসনে বসানোর জন্য সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে স্বামীকে হত্যা করার চেষ্টা করে। যদিও তা সার্থক হয়নি এবং বিচারে দোষীদের সাজা হয়। কিন্তু তৃতীয় র‌্যামসেস হত্যা চেষ্টার সময় আহত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই ক্ষত তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বলা হয়, তার মৃ্ত্যুর পর থেকেই তৎকালীন মিশরের পতন শুরু, যা পরবর্তীতে কখনই আর পুনর্জ্জীবিত হয়নি এবং আগের সুনাম ফিরিয়ে আনতে পারেনি।


EP_5_4

ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে তৃতীয় র‌্যামসেসের সমাধির (কেভি১১) করিডোরের দেওয়ালে অঙ্কিত চিত্রকর্ম


গাইডের তথ্য পুঁজি করে আমরা কেভি১১-এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। সেখানে ভীড় আছে, তবে কেভি৬-এর মতো নয়। তৃতীয় রামেসিসের সমাধিটি স্থাপত্য এবং অঙ্গসজ্জার দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেভি১১ চারটি সারিবদ্ধ করিডোর নিয়ে গঠিত। চতুর্থ করিডোরের শেষ মাথায় রয়েছে সমাধি কক্ষ এবং সেই কক্ষের প্রতিটি কোণে একটি করে চারটি ছোট পার্শ্ব কক্ষ আছে। একসময় সমাধি কক্ষের মাঝখানে গ্রানাইট পাথরের সারকোফ্যাগাস (কফিন বাক্স) ছিল, কিন্তু এখন নেই। কেননা ১৮২৩ সালে বৃটিশ কনসাল-জেনারেল হেনরী সল্ট সারকোফ্যাগাস পুনরুদ্ধার করে প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়। অন্যদিকে ১৮১৫ সালে জিওভানি বেলজনি রাজার মূর্তি আঁকা কফিন বাক্সের ঢাকনা আবিষ্কার করেন এবং সেটি তিনি ক্যামব্রিজের এক জাদুঘরে বিক্রি করেন। সমাধি কক্ষে ঢোকার পরে চারদিকে তাকিয়ে দেখার সময় মনটা ক্ষণিকের জন্য বিষণ্ন হয়ে উঠে। কেন জানি মনে হলো, মানুষ অর্থকড়ি লাভের আশায় কত কিছুই না করে। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বিক্রি করতেও তাদের মন বাঁধা দেয় না, হাতও কাঁপে না।

একসময় আমরা কেভি১১ থেকে বেরিয়ে আসি। কিছুটা দূরে ছায়ায় দাঁড়িয়ে গাইড আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা তার কাছে যেতেই সে আরবীতে জানতে চায় উপভোগ করেছি কি না।

আমরা উল্টো দিকে, অর্থাৎ ফেরার পথের দিকে, হাঁটতে থাকি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কেভি২, যা চতুর্থ র‌্যামসেসের সমাধি। উল্লেখ্য, কেভি২-এর অবস্থান ঢোকার মুখেই। তবে গাইড কেন আমাদের সবার শেষে নিয়ে যায়, তা আমার মালুম হয়নি এবং আমি তাকে জিজ্ঞাসাও করিনি। হয়তো সেটাই নিয়ম। যাহোক, কেভি২ সম্পর্কে একই ভাবে গাইড আমাদের জ্ঞান বিতরণ করে। আমরা সুবোধ ছাত্র-ছাত্রীর মতো তার অনেকাংশ গলাধঃকরণ করি।


EP_5_5

চতুর্থ র‌্যামসেসের সমাধির (কেভি২) করিডোরের দু’পাশের দেওয়ালে হায়রোগ্লিফিসে লেখা ধর্মীয় বাণী


প্রাচীন মিশরের অর্থনৈতিক পতনের সময় ফারাও রাজা হিসেবে চতুর্থ র‌্যামসেসের আগমন হয়েছিল। তাই ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের অন্য সব সমাধির তুলনায় তার সমাধি অনাড়ম্বর এবং সাদামাটা। কেভি২-এর প্রবেশদ্বার থেকে সমাধি প্রকোষ্ঠের দৈর্ঘ্য প্রায় নব্বই মিটার। কেভি২-এর ভেতরে সমাধির দেওয়াল জুড়ে সাত শ-এর বেশি গ্রীক এবং ল্যাটিন গ্রাফিতি রয়েছে। এছাড়া এখনো সেখানে পঞ্চাশের অধিক কপ্টিক ভাষায় লেখা বহাল তবিয়তে বলবৎ আছে।

এখনো সমাধির মধ্যে বিশাল সারকোফ্যাগাস (ভাস্কর্যশিল্পে অলংকৃত পাথরের তৈরি শবাধার) রয়েছে, যা সাড়ে তিন মিটার লম্বা। লাল গ্রানাইট পাথরের তৈরি কফিন বাক্সের ওপরে রয়েছে খোদাই করা একটি ঢাকনা। বাক্সের গায়ে ‘বুক অব দ্য আর্থ’ (যেখানে রয়েছে প্রাচীন মিশরীয় অন্তোষ্টিক্রিয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য) গ্রন্থের কিছু চিত্রকর্ম অঙ্কিত আছে।

এখনো সমাধির মধ্যে বিশাল সারকোফ্যাগাস (ভাস্কর্যশিল্পে অলংকৃত পাথরের তৈরি শবাধার) রয়েছে, যা সাড়ে তিন মিটার লম্বা। লাল গ্রানাইট পাথরের তৈরি কফিন বাক্সের ওপরে রয়েছে খোদাই করা একটি ঢাকনা। বাক্সের গায়ে ‘বুক অব দ্য আর্থ’ (যেখানে রয়েছে প্রাচীন মিশরীয় অন্তোষ্টিক্রিয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য) গ্রন্থের কিছু চিত্রকর্ম অঙ্কিত আছে। উল্লেখ্য, ভ্যালি অব দ্য কিংক্সের প্রবেশদ্বারের মুখেই কেভি২-এর সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে সমাধিস্থলের কাছাকাছি বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য বিশ্রামের জায়গা হিসেবে হোটেল নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে সেই হোটেলের অস্তিত্ব নেই।


EP_5_6

চতুর্থ র‌্যামসেসের সমাধিতে সারকোফ্যাগাস বা পাথরের কফিন (কেভি২)


ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে ফারাও রাজাদের সমাধি আবিষ্কারের নেশায় বিশ্বের বিখ্যাত প্রায় সব প্রত্নতত্ত্ববিদদের আনুমানিক দুই শতাব্দী ধরে ব্যস্ত রেখেছে। হয়তো আগামিতেও তাদের উৎসাহে ভাটা পড়বে না এবং নিত্য-নতুন সমাধি আবিস্কৃত হবে। যাহোক, ভ্যালি অব দ্য কিংক্সে অবস্থিত মৃত রাজাদের আবাসভূমির সমাধিগুলো দেখার সময় নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। তবে আমার মনে হয়েছে, পাহাড় ঘেরা উপত্যকার মাঝে মৃত রাজাদের আবাসভূমি যেন নির্জনতাকে সঙ্গী করে গোপন কথা বলতে চায়।

সব শেষে বলতে হয়, আকাশ জোড়া নীল শামিয়ানার নিচে ধূসর ‘কারনা’ পাহাড়ের উপত্যকায় বহু শতাব্দীর ইতিহাস গায়ে মেখে গুহার অভ্যন্তরে এখনো ফারাও রাজাদের সমাধি টিকে আছে। নির্জনতাকে সঙ্গী করে অপেক্ষায় থাকা গুহাগুলো হয়তো মানুষের পদধূলিতে মুখরিত হতে চায়, বলতে চায় প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের গোপন কথা। যাহোক, আমার বিশ্বাস, গুহাগুলো হয়তো ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আরও কয়েক শতাব্দী টিকে থাকবে এবং কোটি কোটি দর্শনার্থীদের চোখ শীতল করবে, মনকে করবে তৃপ্ত।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।